প্রিন্সেস ডায়না : স্বকৃত নোমান

নগরজীবনে তো আমরা এডিট করে কথা বলি। সব কথা সব জায়গায় বলতে পারি না। কিন্তু ভ্রমণে গেলে এডিটের ধার ধারি না, মুখে যা আসে ছেড়ে দেই। এই ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে জিসান ভাই। এমন সব মজার কথা বলেন, হাসতে হাসতে আমাদের পেট ফাঁকা হয়ে যায়। প্রত্যয় চাপা স্বভাবের। কথা বলে কম। কিন্তু যখন বলে তখন হাসির এমন জোয়ার শুরু হয়, সহজে আর ভাটা পড়তে চায় না। মুহিম তো সারাক্ষণ হা-হা-হি-হির মধ্যেই থাকে। সে না থাকলে আসলে আমাদের ভ্রমণ জমেই না। আর আমি? প্রত্যয়ের মতে আমার পেটটা নাকি রসের হাড়ি। একবার ঢাকনা খুললে রস বেরুতেই থাকে।
অধিকাংশ ভ্রমণে আমাদের চারজনের বাইরে অন্য কেউ থাকে না। অনেকে যেতে চায়, আমরা নিই না। নিলে যদি কথা এডিট করতে হয়! এবার আমাদের সঙ্গী হয়েছেন মনজু ভাই ও হেলাল ভাই। দুজনই আমাদের সিনিয়র। জিসান ভাইর অন্তত পাঁচ বছরের বড় মনজু ভাই। টরেন্টোতে থাকেন। বছরে একবার আসেন আমাদের নিয়ে ভ্রমণ করবেন বলে। তার অন্তত তিন বছরের বড় হেলাল ভাই। পঞ্চান্ন চলছে, যদিও দেখলে মনে হয় না পঞ্চাশের বেশি। বহুদিন পর তার সঙ্গে আমাদের ভ্রমণ। তিনি রয়েল ব্যাংকের ডিএমডি, ব্যস্ত মানুষ, আমাদের মতো এত ভ্রমণের সময় কই। নিপাট ভদ্রলোক। কথা বলেন মেপে মেপে। কখনো একটি বাহুল্য শব্দ বলে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে স্যরি বলে এডিট করে নেন।
মনজু ভাই তুমুল গাল্পিক। আড্ডা জমিয়ে রাখতে পারেন। টানা ছয়-সাত ঘণ্টা কথা বললেও ক্লান্তি আসে না। তবে তার একটাই সমস্যা, কথা বলার সময় ক্ষণে ক্ষণে ইউরোপ-আমেরিকা ঢুকে পড়ে। এই সমস্যা সমাধানে জিসান ভাই এবার নিয়ম করেছেন মনজু ভাই ইউরোপ-আমেরিকার প্রসঙ্গ তুললেই আমরা তার কথা শুনব না, অন্য আলাপ শুরু করব। মনজু ভাই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন ফাগুনের মনোরম বিকেলে, আমরা যখন সৈকতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, মনজু ভাই শুরু করলেন কানাডার তুষারপাতের গল্প। জিসান ভাই কি আর চুপ করে থাকেন! তিনি বলতে লাগলেন পানিপথের যুদ্ধের ইতিহাস। হেসে উঠলেন মনজু ভাই। কানাডা থেকে এক লাফে চলে এলেন সেন্টমার্টিনে। দিতে লাগলেন এই নারিকেল জিঞ্জিরার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা। আমরা হেসে উঠলাম সমস্বরে।
আমরা হঠাৎ খেয়াল করি, কাছেই এক দম্পতি এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছে। তারা একটি ছাতার নিচে বসা। স্বামীটি মোবাইলে ব্যস্ত। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় প্রিন্সেস ডায়নার মুখ। ডায়নার মতোই মাথায় একটি গোল ক্যাপ। আমার মনে হলো গতকালের চেয়ে সেন্টমার্টিন আজ দ্বিগুণ সুন্দর। আমাদের সব কটি চোখ ডায়নার দিকে স্থির হয়ে থাকে। চোখে ভাঙতে থাকে মুগ্ধতার ঢেউ। সব কটি চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। হেলাল ভাইর মতো নিপাট ভদ্রলোকও চোখ ফেরাতে পারছেন না। যেন এমন সুন্দরী জীবনে দেখেননি।
ডায়নার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় এক গভীর হাহাকার। আহা, কুড়ি-একুশের এমন সুন্দরী তরুণীর কিনা এমন বুড়ো স্বামী! বুড়ো ঠিক বলা যায় না। পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না বয়স, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে চল্লিশোর্ধ। ফুটবলের মতো ভুঁড়িটা যেন যে কোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে সৈকতে। মাথায় এমন টাক, যেন ফুটবল খেলার মাঠ। ভ্রু দুটো এতই চওড়া, যেন পিচঢালা সড়ক। গায়ের গেঞ্জিটা দেশে তৈরি মনে হচ্ছে না। মনজু ভাই বললেন এমন গেঞ্জি নাকি আমেরিকার ফিলিং স্টেশনের কর্মীরা গায়ে দেয়। লোকটি হয়ত সত্যি সত্যি ফিলিং স্টেশনের কর্মী। বেশভূষায় প্রবাসীই মনে হচ্ছে। হয়ত ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা কানাডায় থাকে।
জিসান ভাই গেয়ে উঠলেন, তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল ক্লান্ত দুপুর বেলায়…। সঙ্গে সঙ্গেই মনজু ভাই গাইলেন, কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ, মায়াদ্বীপবিহারিনী…। আমরা সমস্বরে হেসে উঠলাম।
আমাদের মুখের ভাষা, চোখের ভাষা, গান আর হাসির ধরন দেখে বুঝি ডায়নার স্বামীর সন্দেহ হয়। তার চেহারায় বিরক্তি। মনে মনে হয়ত আমাদের গালি দিচ্ছে। আশপাশে পুলিশ থাকলে নিশ্চিত আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করত। আমি তার নাম দিলাম মি. মদন। মুহিম বলল, কারো নাম নিয়ে বিদ্রুপ করা ঠিক না। তার নাম হতে পারে মি. আলু কিংবা মি. টমেটো।
আমরা আবার হেসে ওঠি। আশপাশের মানুষজন আমাদের দিকে তাকায়। জিসান ভাই বললেন, আমাদের গ্রামে এরকম এক লোক ছিল। নাম ছিল বদিউল আলম। সবাই তাকে বদিউল, বদি বা বইদ্যা বলে ডাকত।
হেলাল ভাই বললেন, ডায়নার স্বামীকে আমরা বদিউল বা বদি বলে ডাকতে পারি।
আমরা তখন খেয়াল করি, বদিউল বা বদি এখান থেকে চলে যেতে চাইছে, কিন্তু ডায়না রাজি হচ্ছে না। সে এখানে কেন থাকতে চাইছে আমরা বুঝতে পারি। মুহিমের সঙ্গে এরই মধ্যে তার ভাষা বিনিময় হয়ে গেছে। মুখের নয়, চোখের ভাষা। মুহিমের এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা, চোখের ভাষায় যে কোনো মেয়েকে কাবু করে ফেলতে পারে। আর জিসান ভাইর ক্ষমতা হচ্ছে কথা। এমন সুন্দর করে কথা বলেন, রূপের দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না এমন মেয়েও গলে-মজে পানি হয়ে যায়।
বদিউল ধমকে ওঠে, আমরা শুনতে পাই, বেহায়ার লাহান খাড়ায়া থাকবা? লজ্জা-শরম কিছু নাই?
ডায়না আর দাঁড়ায় না, ক্যাপটা খুলে পা চালায়। তার হাঁটুতক ছড়ানো চুল দেখে আমাদের মধ্যে মুগ্ধতার জোয়ার ওঠে। আমরা চোখ ফেরাতে পারি না। স্বামীর পায়ে পায়ে সে হাঁটতে থাকে পশ্চিম সৈকতের দিকে। তারা বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলে মুহূর্তে আমরা ফিউজ বাল্বের মতো হয়ে গেলাম। যেন মধুর পূর্ণিমায় আচমকা অমাবস্যা হানা দিল। যেন হুট করে সূর্যটা সমুদ্রের অতলে ডুব মেরে পৃথিবীতে বিষণœ সন্ধ্যা নামিয়ে দিল।
সৈকতে বিস্তর মানুষ। সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখছে, ক্যামেরায় ধারণ করছে, হৈ-হুল্লোড় করছে। আমরা আবার হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠি। কিন্তু আগের সেই উদ্দীপনা পাই না। যেন ডায়না আমাদের সব আনন্দ-ফূর্তি লুট করে নিয়ে গেছে। আমাদের আর বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। লুট হওয়া ফূর্তি উদ্ধারে রওনা হই পশ্চিম সৈকতের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ডায়নাকে খুঁজি। আমাদের চিত্তে থৈথৈ অস্থিরতা। সবচেয়ে বেশি অস্থির হেলাল ভাই। তার খোঁজারু চোখ বিরাম পাচ্ছে না। খুঁজছে, কেবলই খুঁজে বেড়াচ্ছে ডায়নাকে।
সূর্যের শেষ আলোটুকুও মুছে যায়, সৈকতজুড়ে নামতে থাকে অন্ধকার। পর্যটকরা ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। মনে সমুদ্রসমান বিষণœতা নিয়ে আমরাও রিসোর্টের দিকে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে আলাপ করি ডায়না ও তার স্বামীকে নিয়ে। বদিউল হয়ত বহু কষ্ট করে বিদেশ গেছে। বহু পরিশ্রম করে টাকাপয়সা কামিয়েছে। শীঘ্রই ডায়নাকেও বিদেশ নিয়ে যাবে। কিন্তু ডায়না যেতে রাজি নয়। স্বামীর প্রতি হয়ত তার টান নেই। কারণ যেমন স্বামী সে প্রত্যাশা করেছিল বদিউল তেমন নয়। বদিউল হয়ত স্বর্বস্ব দিয়ে হলেও স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে চায়। কিন্তু স্বর্বস্ব দেওয়ার কায়দা-কানুন জানে না বলে পায় না। অবশ্য এসব আমাদের আন্দাজ। সত্যি হতে পারে, না-ও হতে পারে। তবে স্ত্রীর সঙ্গে বদিউলের সম্পর্কের যে ধরণ, তাতে সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রিসোর্টে ঢুকতেই চঞ্চল হয়ে উঠলেন হেলাল ভাই। বললেন, ডায়না না? ডায়নাই তো!
ডায়নাই বটে। চুল দেখে আমরা চিনতে পারি। স্বামীর পিছে পিছে রিসেপশনের দিকে যাচ্ছে। জিসান ভাই বললেন, একই রিসোর্টে! মুহিম সশব্দে হেসে ওঠে। হাসির শব্দে পেছনে ফিরে তাকায় ডায়না। মুচকি হেসে ওড়নায় মুখ ঢাকে। আমাদের মনে হলো হাসি নয়, একটা ধারালো ছুরি ঝিলিক দিল। ছুরির এক পোছে আমাদের হৃদয়টা কেটে নিয়ে গেল। চট করে আমি হেলাল ভাইর হাতটা ধরলাম। কেননা তিনি ডায়নার সামনে গিয়ে বলে বসতে পারেন, হাই। আমি হেলাল মুহাম্মদ। এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর অব রয়েল ব্যাংক।
রিসেপশনে আমাদের দেখে বদিউলের মাথায় বুঝি অকস্মাৎ বজ্রপাত হলো। রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, আচমকা ডায়নার বাঁ-হাতটা চেপে ধরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। যেন আমরা ডায়নাকে অপহরণ করতে এসেছি। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের চোখের সামনে থেকে তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের হাসি পায়। হাসি চেপে উঠতে থাকি দোতলায়। তারা দক্ষিণের শেষ রুমটায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমাদের রুম উত্তরে। পাশাপাশি তিন রুম। বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। আমরা রুমে ঢুকলাম। হেলাল ভাই দাঁড়িয়ে রইলেন বারান্দায়। কেন দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি। ডায়নাকে আরেকবার দেখার জন্য, একটিবার কথা বলার জন্য তিনি বড় ব্যাকুল। ব্যাকুল অবশ্য আমরাও। কিন্তু ডায়না কি এখন আর বেরুবে? মনে হয় না। বেরুতে চাইলেও তার স্বামী দেবে না।
জিসান ভাইর রুমের মেঝেতে আমরা বসে গেলাম গোল হয়ে। মনজু ভাই কানাডা থেকে টাকিলা এনেছেন দুই বোতল। ম্যাক্সিকান টাকিলা। এবং তিন বোতল জ্যাক ড্যানিয়েল। গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দিতে লাগল প্রত্যয়। সিগারেটের ধোঁয়া ঘুরছে গোটা রুমে। আমি উঠে দরজাটা খুলে দিলাম। আর তখনই গ্লাসটা হাতে নিয়ে হেলাল ভাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। মুহিম হেসে ওঠে। আমরাও। জিসান ভাই বললেন, সে বারান্দায় এলে আমাদের ডাক দিয়েন।
হেলাল ভাই বললেন, আরে ধুর! আমি চাঁদ দেখতে এসেছি।
প্রত্যয় বলে, অমাবস্যায় চাঁদ! হা হা হা।
মুহিম বলে, কথা কিন্তু হেলাল ভাই ভুল বলেননি। চাঁদ দেখতেই গেছেন বটে। তবে সেই চাঁদ আকাশে নয়, দক্ষিণের রুমে। যদি হুট করে বারান্দায় দেখা দেয়!
আমরা খেয়াল করি জিসান ভাইও অস্থির হয়ে উঠেছেন, বারবার বাইরে তাকাচ্ছেন; যে কোনো সময় গ্লাসটা নিয়ে তিনিও বেরিয়ে পড়বেন। একই অস্থিরতা টের পাই প্রত্যয়ের মধ্যেও। আমার মধ্যেও কি নেই? মিথ্যে বলি কেমন করে! গ্লাসটা হাতে নিয়ে আমিও বেরুলাম। দাঁড়ালাম হেলাল ভাইর পাশে। খানিক পর জিসান ভাইও এলেন। ভেতরে মুহিমের সঙ্গে মনজু ভাই কানাডার বেগমপড়ার গল্প করছেন। আমরা একবার আকাশের দিকে তাকাই, একবার দক্ষিণের বারান্দার দিকে। আকাশে অযুত-নিযুত নক্ষত্র, দক্ষিণের বারান্দায় খাঁ-খাঁ শূন্যতা। আমাদের কেবলই মনে হচ্ছে এই বুঝি ডায়না এসে দাঁড়াল। এই বুঝি তার চুলের ঘ্রাণ এসে লাগল। কিন্তু না, আমাদের গ্লাসের সবটুকু মদ ফুরিয়ে যায়, ডায়না আসে না। আকাশের বহু নক্ষত্র জ¦লতে জ¦লতে ক্লান্ত হয়ে নিভে যায়, ডায়না আসে না। আমরা ঢুকে পড়ি রুমে। আবারও আমাদের আলাপের বিষয় হয়ে ওঠে ডায়না ও বদিউল। হেলাল ভাই তো দু-পেগেই টাল। ডায়নার বাবা-মার মু-ুপাত করছেন। কোন বিবেচনায় তারা প্রতিমার মতো মেয়েটিকে এমন একটা টমেটোর সাথে বিয়ে দিল? টাকা-পয়সা দেখে, নিশ্চয়ই টাকা-পয়সা দেখে। বেটার মনে হয় অনেক টাকা। বিদেশে থাকে তো, বোধ হয় ভালোই কামিয়েছে।
মনজু ভাই খুব সিরিয়াস কণ্ঠে বললেন, মানুষের নাম নিয়ে বিদ্রুপ করা ঠিক না হেলাল ভাই।
হেলাল ভাই হাসেন। বলেন, খেয়েছি তো। খেলে এক-আধটু বেলাইনে বলতে হয়। না বললে খেলাম কেন?
জিসান ভাইর মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের একটি ঘটনা। সেদিন হেলাল ভাইর জন্মদিন ছিল। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন রেড বাটন বারে। খেয়েদেয়ে রাত দশটার দিকে আমরা বেরুলাম। একেকজন আট পেগ করে খেয়েছি। হেলাল ভাই টলছেন। হোটেল ভোজন বিলাসের সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে আমাকে বললেন, বলেন তো এখানে কী লেখা? আমি সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়লে তিনি আক্ষেপের সুরে বললেন, আমার টাকাটাই জলে গেল।
কেন কেন?
সাইনবোর্ডের লেখা ঠিকঠাক পড়তে পারছেন, কী মদ খেলেন?
আমি হাসি। মুহিম তখন ফুটপাতের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে প্যান্টের জিপার খুলে কল ছেড়ে দিয়েছে। পথচারীরা তাকাচ্ছে তার দিকে। একজন বলে ওঠে, এটা কি মোতার জায়গা? আর তখন হেলাল ভাই বললেন, যাক, একজনকে হলেও মাতাল বানানো গেল। সব টাকা জলে যায়নি।
জিসান ভাইর মুখে সেদিনের সেই ঘটনা শুনে আমরা হাসতে থাকি। সমবেত হাসি কোরাসের মতো শোনায়। হাসির শব্দ যাতে বাইরে না যায় তাই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন মনজু ভাই। হেলাল ভাই আবারও অস্থির হয়ে উঠলেন। হুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন। জিসান ভাই বললেন, লাভ নাই। সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকলেও দেখা মিলবে না।
মনজু ভাই বললেন, তাকে মাথা থেকে ফেলে দেন হেলাল ভাই। নইলে রাতে ঘুম হবে না।
জিসান ভাই বললেন, মাথা থেকে ফেলে দেওয়ার গল্পটা জানেন তো?
মুহিম বলল, চায়নিজটা জানি।
আবার হাসির রোল ওঠে। জিসান ভাই শুরু করলেন সেই জেন গল্প। দুই জেন গুরু বারো বছর সাধনা করে হিমালয় থেকে ফিরছে। একজন প্রৌঢ়, অন্যজন যুবক। পথে একটা নদী পড়ল। খেয়া নেই। সাঁতরে পার হতে হবে। ঘাটে দেখা পেল এক তরুণীর। তাকেও পার হতে হবে, কিন্তু সে সাঁতার জানে না। দুই গুরুর সাহায্য চাইল সে। যুবক অপারগতা প্রকাশ করল। করবে না? পার করতে হলে তো তরুণীকে কাঁধে নিতে হবে। নারীর ছোঁয়া! অসম্ভব। বারো বছরের সাধনা নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু রাজি হলো প্রৌঢ়। তরুণীকে কাঁধে চড়িয়ে নদী পার করে দিল। তরুণী চলে গেল তার পথে। দুই গুরু হাঁটছে। যুবক বলে, আপনি নারী ছুঁলেন! এটা কোনো কাজ হলো গুরু?
প্রৌঢ় বলে, কোন নারী?
ওই যে মেয়েটা, যাকে কাঁধে চড়িয়ে নদী পার করলেন।
প্রৌঢ় নিশ্চুপ।
কতক্ষণ পর যুবক আবারও বলল একই কথা। প্রৌঢ় আবারও বলল, কোন নারী?
যুবক বলে, ওই যে মেয়েটা, যাকে কাঁধে চড়িয়ে নদী পার করলেন।
প্রৌঢ় বলে, তুমি এখনো তাকে মাথায় নিয়ে ঘুরছ? আমি তো ঘাটেই তাকে মাথা থেকে ফেলে দিয়ে এসেছি।
হেলাল ভাই ফিরে এসে বললেন, ভাইরে, আমি তো গুরু না, সাধারণ মানুষ। আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? বয়স যদি তিরিশ হতো, তবে যে কোনো মূল্যে ডায়নাকে আমার করে নিতাম। হায় যৌবন, কত দ্রুতই না ফুরিয়ে গেল! কখনোই ফিরবে না আর। ওহ ডায়না, যৌবনে কেন তোমার দেখা পেলাম না!
অবস্থা খুবই খারাপ দেখছি! মনজু ভাই বললেন।
মুহিম বলে, একেই বলে ভীমরতি। বুড়ো বয়সের ভীমরতি। হা হা হা।
দশটার দিকে আমরা ডিনারে গেলাম ক্যাফেটেরিয়ায়। লোকজন বেশি নেই। দশ-বারোজন। আমাদের চোখ খুঁজে বেড়ায় ডায়নাকে। হয়ত খেয়ে চলে গেছে, কিংবা এখুনি খেতে আসবে। আমরা খাই আর বারবার দরজার দিকে তাকাই। আমাদের খাওয়া শেষ হয়, ডায়না আসে না। আমরা অপেক্ষায় বসে থাকি। অপেক্ষা করতে করতে এগারোটা বেজে যায়, ডায়না আসে না। দীর্ঘশ^াস বুকে চেপে আমরা রুমে ফিরে চলি। দোতলায় উঠে দক্ষিণের বারান্দায় তাকাই। শূন্যতা ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। আমরা ডায়নার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। না, স্বপ্নেও দেখা দিল না ডায়না।
ছেঁড়াদ্বীপ যাব বলে আগেই ঠিক করা ছিল। পরদিন সকাল ন-টায় চলে গেলাম ঘাটে। ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার ট্রলার খুঁজছি, তখন এক মাঝি ছেঁড়াদ্বীপ ছেঁড়াদ্বীপ বলে হাঁক দিল। আপ-ডাউন ভাড়া জনপ্রতি তিন শ টাকা। আমাদের দৃষ্টি সেদিকে ফেরে। সহসা আমাদের বুকটা ধক্ করে ওঠে। না, ট্রলার পেয়েছি বলে নয়, ট্রলারে ডায়নাকে দেখে। কপালে বাঁ-হাতের তেলো ঠেকিয়ে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে। মুহূর্ত দেরি না করে আমরা ট্রলারে চড়ে বসলাম। আমাদের দেখে বদিউল তো মহা খাপ্পা। তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারি। কী করবে, কী করা উচিত, ভেবে পাচ্ছে না। ট্রলার স্টার্ট করার জন্য আমি মাঝিকে তাড়া দিই। দেরি করলে বদিউল যদি ডায়নাকে নিয়ে নেমে পড়ে! মাঝি দেরি করে না, ট্রলার চালিয়ে দেয় ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দেশে। আমরা প্রত্যেকেই উতলা। সবচেয়ে বেশি উতলা হেলাল ভাই। যেন অকস্মাৎ ফিরে এসেছে তার যৌবন। একটা গাঙচিল দেখে আমরা হর্ষধ্বনি দেই। বিশাল আকাশের দিকে মুখ করে গাঙচিলের মতো দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দেই। প্রত্যয় গান ধরে, আমি শুনেছি সেদিন তুমি/সাগরের ঢেউয়ে চেপে/নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ…। ওড়নায় মুখ চাপা দিয়ে ডায়না হাসে। বদিউলের বুঝি অস্বস্তি লাগে। সে গলুইর দিকে মুখ করে ঘুরে বসে। ডায়নাকেও বসতে বাধ্য করে। তবু ডায়না বারবার পেছন ফিরে তাকায়। ওড়ানায় মুখ ঢেকে হাসে। যতবার তাকায় ততবার আমাদের বুকে মুগ্ধতার ঢেউ আছড়ে পড়ে।
ছেঁড়াদ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ট্রলার। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে তীরে ভিড়বে। হঠাৎ একটা পাথরের সঙ্গে থাক্কা খেল ট্রলার। আমরা চিৎকার করে উঠি। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলি। নীরবতা ভেঙে বদিউল মাঝির উদ্দেশে বলে, দেইখা চালাইতে পারস না বাস্টার্ড! কথাটা বুঝি মাঝির কানে ঢোকে না। সে ট্রলার রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
সহসা দেখি ট্রলার ভরে উঠছে নোনাজলে। নিশ্চয়ই পাটাতন ফেটে গেছে। মাঝির সহযোগী ছেলেটা একটা কাটা ড্রাম দিয়ে পানি সেঁচে বাইরে ফেলতে লাগল। জিসান ভাই বললেন, যেভাবে পানি উঠছে তাতে তো নৌকা ডুবতে বেশি সময় লাগবে না। আমি নিচে নেমে ফুটোটা হাতে-পায়ে চেপে ধরলাম। মুহিম ও প্রত্যয় হাতের কাছে ঘটিবাটি যা পেল তা দিয়ে পানি সেঁচে বাইরে ফেলতে লাগল। মনজু ভাই নার্ভাস। চোখেমুখে ভয়। জিসান ভাই ট্রলারের গতি বাড়ানোর জন্য মাঝিকে তাড়ার পর তাড়া দিচ্ছেন। ডায়নার স্বামী গলুইর কাছে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। কাঁপছে আরো দোয়া-দরুদ পড়ছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে, যেন এক্ষুণি ঝাঁপ দেবে। ভয়ে যবুথবু ডায়না।
একটা ঢেউ লেগে ট্রলরটা দুলে উঠতেই ডায়না চিৎকার করে ওঠে, বাবা! কয়েক মুহূর্ত। তারপর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর আমাদের হুল্লোড় চাপিয়ে হেলাল ভাই চিৎকার করে উঠলেন, মা! বিস্ময়ে আমরা তার দিকে তাকাই। তিনি বদির দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইলেন। বললেন না। চট করে ডায়নার কাছে গিয়ে তার একটা হাত ধরে বললেন, ভয় পেও না মা। আমি সাঁতার জানি। ট্রলার ডুবে গেলে আমার কাঁধে চড়ে বসবে। আমি তোমাকে ঘাটে পৌঁছে দেব।
ডায়না কেঁদে ওঠে। তার কান্না বদিউলের কানে ঢোকে না। সে বিড়বিড় করে মুশকিল আসানের দোয়া পড়েই যাচ্ছে। হেলাল ভাই ধরে আছেন ডায়নার হাত। মাঝি বলে, আই গিইয়্যি, আর ডর নাই।
আর ভয় নেই বটে। ডুবে যাওয়ার আগেই ঘাটে ভিড়ল ট্রলার। হুট করে গলুই থেকে লাফ দিল বদিউল। পড়ে গেল মাটিতে। উঠে দাঁড়িয়ে ডায়নাকে দ্রুত নেমে আসতে বলল। হেলাল ভাই ডায়নার হাতটি শক্ত করে ধরে ধীরেসুস্থে নামালেন। তাদের পিছু পিছু আমরাও নামি। হেলাল ভাই বললেন, দেখলে মা, কিচ্ছু হয়নি। ডায়নার ঠোঁট দুটি কাঁপছে, গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কিছু বলতে চাইছে, অথচ পারছে না। আর তখন বদি এসে এক ঝাটকায় হেলাল ভাইর হাত থেকে ডায়নার হাতটি ছাড়িয়ে ধমকে বলে, আসো!
মনজু ভাই মৃদু কণ্ঠে কী যেন বললেন। ঠিক বোঝা গেল না। আমরা রাস্তায় উঠে দাঁড়াই। এক ডাবওয়ালার কাছ থেকে ডাব খাই। খেতে খেতে দেখি পশ্চিমের পথ ধরে হনহন করে হেঁটে চলছে বদিউল। ডায়না পেছনে পড়ে গেছে। জোর কদমে হেঁটে স্বামীকে ধরার চেষ্টা করছে। ডাবটা হাতে নিয়ে হেলাল ভাই অপলক তাকিয়ে সেদিকে। চেহারায় বিষাদ।
ফেরার সময় আমরা তাদের পেলাম না। হয়ত আমাদের আগে চলে গেছে, কিংবা পরে যাবে। সেন্টমার্টিন ঘাটে ফিরতে ফিরতে চারটা বেজে গেল। ঘাটের এক হোটেলে লাঞ্চ করে রিসোর্টে ফিরলাম। রিসেপশনে গিয়ে আমরা তাদের কথা জিজ্ঞেস করি। রিসেপশনিস্ট জানায় যে আরো দুদিন থাকার কথা ছিল তাদের। হুট করে বুকিং ক্যান্সেল করে তিনটার জাহাজে চলে গেছে।
গত রাতের মতো দীর্ঘশ^াস বুকে চেপে আমরা দোতলায় ওঠি। দক্ষিণের বারান্দায় দেখি আগের সেই শূন্যতা। আরো গভীর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সিগারেট ধরালাম। রেলিং ধরে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন হেলাল ভাই। হঠাৎ শুনতে পাই তার কান্নার শব্দ। হুহু করে কাঁদছেন। এই কান্না যে বহু বছর আগে পদ্মায় ডুবে যাওয়া তার মেয়ের জন্য, আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

Facebook Comments

Leave a Reply