কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ
[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]
১৭
ক্রিস্টোফার দুগার্তোর মৃত্যু আমার জীবনের উঠোনে নীরব ও উত্তাপহীন রোদে একপ্রকার কুয়াসা পতনের সন্ধান দিয়েছিল। মানুষের মৃত্যু অনেকটা কুয়াসা পতনের মতোই সাদা। উত্তরপ্রদেশের ধুলো ঝড় ও কুয়াসার মধ্যে গভীর ধুন্দ (রহস্য) আছে। সেই রহস্যের মধ্যে অথবা কল্পনার জগতে কতগুলি ভারতীয় গাড়োয়ান বসে থাকত স্থির হয়ে। বিহার প্রদেশে যখন যুবক বয়সে বিচরণ করি, যারা বয়েল গাড়ি বা মোষের যান চালিয়ে মাটির রাস্তা অতিক্রম করত, তাদের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের টাঙ্গাওয়ালা, ঘোড়সওয়ার বা মপলোর গাড়োয়ানদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই মিল অমিল বিস্তর খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই কথা মনে রেখেই গুজরাত দাঙ্গার সময় লিখেছিলাম শ্বেতপাথরের ঘোড়া। একজন সজ্জন টাঙ্গা চালকের কাহিনি। হ্যাঁ, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে এ আমার গভীর দুর্বলতা, কেন যে আমার রচিত আখ্যানে খারাপ মানুষগুলি ভীষণভাবে অনুপস্থিত। যত বয়স বেড়েছে, আমার স্মৃতি থেকে, চারপাশে দেখা খারাপ মানুষগুলি কেন জানি কোথায় হারিয়ে গেল। এখন তো আমি চূড়ান্ত বিভ্রমের শিকার। আদতেই খারাপ মানুষ বলে কিছুই হয়না এই রকম একটি ধারণা বা বিশ্বাস ফুটো টিনের বাটিতে চাঁদ পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। ফুটো গলে পুনরায় চাঁদ চলে গেল নিজের অবস্থানে। যেহেতু ছবি আঁকা এবং ছবির মধ্যে জলরঙয়ের ব্যবহার আমাকে স্বর্গীয় সুখ প্রদান করত, ক্রিস্টোফার দুগার্তো একবার আমাকে বলেছিলেন, চারদিকে তাকিয়ে দেখ মানুষগুলি সব ছবির মতো। এক একজন, সব ছবির মতো। পর্তুগালে আমার গ্রামে যখন বড় হয়ে উঠছিলাম, আমি যখন বাবার নৌকো নিয়ে নদীতে মাছ শিকার করতে যেতাম, তখন পাইপ মুখে দিয়ে জেলেদের তামাক সেবনের দৃশ্য আমাকে খুবই আকর্ষণ করত। আমার বাবা পাইপ দিয়ে তামাক সেবন করতেন না, তিনি পর্তুগালের এক বিশেষ রকমের সস্তার সিগার সেবন করতেন। কিন্তু এই দেশে এসে দেখলাম ভারতীয় গ্রামীণ বা দেহাতি মানুষদের জীবনের সরলতা বা যাপনের ছন্দ অন্যরকম ভাবে প্রবাহিত। জীবনের সব বসন্তই সবসময় শেক্সপীয়ার বা টমাস মান হয়না। অনেক বসন্তই দস্তয়েভস্কির মতনও হয়। আসলে নিজের জীবনের কথাগুলি লেখার সময় অনেক অনুভবের স্পর্শ পাচ্ছি, যেখানে পর্বতের মতন উচ্চ লেখক দার্শনিকদের রচনা বা নামগুলি আমার বোধের গভীরে আলো ফেলে চলেছে। ক্রিস্টোফার দুগার্তো আমার জীবনের এমন একজন প্রথম বন্ধু যার কাছে আমি আমার খামখেয়ালিপনার গভীর আশ্রয় পেয়েছিলাম। ক্রিস্টোফার দুগার্তো আমার কাছে এমন এক মানুষ ছিলেন, যিনি প্রবাহিত ঝর্ণার জলের মতো উচ্ছল অথচ যে পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রের গঠন ও আকারের নিয়তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতেন। জন্মের পরে, বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবে সবাইকে দেখেছি অথবা যাদের স্নেহের স্পর্শ পেয়েছি, ভাবতে পারিনি তাদের কোনোদিন মৃত্যু হতে পারে। যে যার মতো আছে, আছেন, সবাই প্রত্যেকে নিজের মধ্যে অনন্তকাল ধরে বিচরণ করে যাবেন। মানুষের ক্ষয় নেই, শরীরে বৃদ্ধি আছে। এই ধারণা নিয়েই কেটে গেল কিশোরকাল, মৃত্যু চেতনা আমার জীবনে এলো ক্রিস্টোফার দুগার্তোর মৃত্যুর পরে। প্রথম দেখলাম মানুষের মৃত্যু। যাকে একটি কাঠের বাক্সের মধ্যে বন্দী করে, পরে জেনেছিলাম মাটির নিচে কবর দেওয়া হল। আমিও বোকার মতো বাবাকে বলেছিলাম, তোমার মৃত্যুর পরে একটা কাঠের সুন্দর বাক্স বানিয়ে দেব, যেখানে তুমি বসে এই করেছ ভালো নিঠুর হে গাইবে, আর খেয়ালখুশি মতো ডাক দিয়ে উঠবে গলগণ্ডার মাঝিইইইইইই………
কি সব বোকা বোকা কথা, বাবা দাঁত চেপে হাসলেন, বললেন, – আমাদের দাহ করা হয়। চিতায় পোড়ান হয়। আমাদের কফিনে ভরে মাটিতে কবর দেওয়া হয়না।
ক্রিস্টোফার দুগার্তোর মতো কেন হয়না?
পৃথিবীর সবার ক্ষেত্রে একরকম নিয়ম হয়না। আমাদের মৃত্যুর পরে শ্মশানে পোড়ানো হয়।
আমার কিন্তু কাঠের বাক্সটি ভালো লাগল। দুগার্তো কি সুন্দর কাঠের বাক্সের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকলেন। জামার কলারে বো টাইয়ের নিচে পকেটের মুখে একটি লাল রঙয়ের গোলাপের পাপড়িতে জলের ফোঁটা পড়েছিল।
বাবা বললেন,- কফিনের মধ্যে সাহেবরা সুন্দর পরিচ্ছন্ন কোট প্যান্ট পরে থাকেন। বড় হও, বুঝতে পারবে সবার মৃত্যুর পরে একই রকম নিয়ম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়না।
মৃত্যুর পরে আমার দেহের ইচ্ছের কোনোই দাম নেই। বড় হয়ে জানতে পেরেছিলাম, যত বড় হয়ে উঠছি, আমার জানা অজানার পাত্র ততই রিক্ত হয়ে আসছে। আসলে আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই মনের দিক থেকে ততই শূন্য হয়ে আসি। ছেলেবেলায় আমাদের সবার মধ্যেই বেঁচে থাকার এক গভীর সাংগীতিক রাগ থাকে, বেহালা এসরাজ সরোদ ও সেতারের ঝংকার মুগ্ধ করে রাখে, কিন্তু যতই সময়ের সঙ্গে আমরা থুবড়ো হতে থাকি, সুর ছন্দের মধ্যে পাণ্ডিত্য ও তত্বের শাসন দখল নেয়। বিস্ময়কর এক পূর্ণ থেকে অপূর্ণের দিকে যাত্রা শুরু হয়। মানব জীবনের এই পরিণতি তার নিয়তির অংশীদার। বহন ও বাহক এই দুইয়ের মধ্যে আমরা সীমায়িত হয়ে যাই।
এই স্মৃতিকথা লেখার সময় যাকে আমি গ্যাব্রিয়েল ওকের প্রেমিকা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম, আমার রোমান্টিক বাথসেবা (ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড) ক্রিস্টোফার দুগার্তোর স্ত্রী, যিনি একটি সাদা রঙয়ের গাউনের আলো ছড়িয়ে আমাদের মহল্লাতে ঘুরে বেড়াতেন, তার কথা মনে পড়তেই আমি ছুটে গেলাম, ক্রিস্টোফার দুগার্তোর বাড়ির দিকে। মাকে বলে গেলাম, আমি দুগার্তো অ্যান্টিকে একবার দেখে আসি। মা বললেন, যাচ্ছ যাও কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।
ক্রিস্টোফার দুগার্তোর মৃত্যুর পরে দুগার্তো অ্যান্টিকে আর দেখতে পাইনি। দিনের আলোতে যিনি তার স্প্যানিয়েল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, যিনি পিঁপড়েদের গর্তে কেকের গুঁড়ো দিতেন, সেই দুগার্তো অ্যান্টি যেন আমাদের পরিচিত গলি রাস্তা থেকে হারিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটি সেই ক্ষয়ে যাওয়া পাঁচিলের সামনে গিয়ে আচমকাই ডানদিকে বাঁক নিয়েছে, আমি সেই নির্জন রাস্তাটির বাঁক নিতেই আমার মনের মধ্যে একটি গানের কলি ভেসে উঠল…… আজকাল সব কিছুই বড় বেশি ঘুমিয়ে থাকে, দিন হয়েছে রাতের মতো…… তুমি ঘুমাও আমিও ঘুমাই……আমি পা টিপে টিপে দুগার্তোর বাড়ির বন্ধ দরজায় টোকা দিলাম। প্রথমে কয়েকবার। তারপর দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে আবার টোকা দিলাম। আবার দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ডাকব ডাকব করে সাহস পাচ্ছিলাম না। ফিরে যাব কি না ভাবছিলাম। পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চটির রাবার কামড়াচ্ছিলাম।
দরজা খুললেন দুগার্তো অ্যান্টি। আমাকে দেখে তিনি বললেন, এক সপ্তাহ হয়ে গেল, আমি ক্যান্ডল জ্বালিয়ে এলাম। এসো… এসো… মাই সন…
হ্যাঁ। এক সপ্তাহ হয়ে গেল, দুগার্তো কাঠের বাক্সে বন্দী হয়ে, মাটির নিচে তাঁর বাসা পেতেছেন। আমার এই ভাবনাটি চমৎকার কি না জানিনা, তবে আমার নিজস্ব এই কল্পনাটির মধ্যে নতুন কাঠের গন্ধ পাচ্ছিলাম। দুগার্তো অ্যান্টির কপালের ওপরে সাদা চুলগুলি বসন্তের বাতাসে উড়ছিল। গোলাপি ঠোঁটের ওপরে নাকের দুইপাশের গালে, হালকা কালশিটে আভা প্রমাণ করছিল দুগার্তোকে ছাড়া তাঁর কি ভয়ানক একা একা পরিণতি। স্পেনিইয়েলটি তাঁর পায়ের কাছে কুই কুই করছিল আর তাঁর গোলাপি রঙয়ের পশমের জুতোটি চাটছিল। আমি ঝুঁকে পড়ে স্পেনিইয়েলটির লোমশ শরীরে হাত বুলোলাম। দুগার্তো অ্যান্টি স্পেনিইয়েলটিকে আদর করে ডাকলেন দুই তিনবার। যার অর্থ নক্ষত্র। আর নিজেই বলতে থাকলেন মিল্ক… মিল্ক… মিল্ক… স্পেনিইয়েলটি আনন্দে লাফিয়ে উঠতে চাইছিল দুগার্তো অ্যান্টির কোলের মধ্যে।
দুগার্তো অ্যান্টি আমাকে সস্নেহে বললেন ভিতরে আসতে। আমি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে চিতা বাঘের শাবকটিকে খুঁজে যেতে থাকলাম।
বললাম নিউরো কোথায়?
দুগার্তো অ্যান্টি খুবই মোলায়েম কণ্ঠে আমাকে বললেন, আমি জানি তুমি দুজনকেই দেখতে এসেছ। নিউরো আর আমাকে? তাই তো।
আমি বললাম আপনার আদরের স্পেনিইয়েলটিও আছে যে? কিন্তু নিউরোকে দেখছিনা যে?
তিনি আমাকে বললেন, সে তো তোমার আঙ্কেলের কফিন চলে যাওয়ার পরের দিন ভোর অন্ধকারে ভেজানো দরজা অতিক্রম করে চলে গেল। কিন্তু কোথায় যে গেল, আর তো ফিরে এলনা। আচ্ছা তুমি কি জানো, এখানে আশেপাশে কোথাও জঙ্গল আছে, যেখানে বন্যপ্রাণী থাকে?
আমি এই শহরের আশেপাশে কি আছে বিশেষ কিছুই জানিনা। তবে এই শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে যমুনা নদী প্রবেশ করেছে সেখানে বনভূমির মতো কিছু আছে। আমাকে আঙ্কেল তা দেখিয়েছেন। আমাকে আঙ্কেল সেখানে নিয়ে গেছিলেন।
নিশ্চয়ই এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে বন্যপ্রাণীরা থাকে, যে জায়গাটি তাদের পক্ষে উপযুক্ত। মনে হচ্ছে নিউরো সেখানেই চলে গেছে।
কিন্তু ও আপনার সঙ্গেও থাকতে পারত?
ও যতই আমাকে মানিয়ে নিয়ে থাকুক না কেন, বাঘের বাচ্চাটি যখন বড় হয়ে উঠবে, আশেপাশের লোকালয় মহল্লা মেনে নেবে কেন? এই নিয়ে তোমার আঙ্কেল কিন্তু অনেক চিন্তা ভাবনা করতেন। যাই হোক ও যে চলে গেল, আমার কষ্ট হচ্ছে, সারাদিন ঘরের ভিতরে পাইচারি করত আর ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকত। আঙ্কেলের বিছানার ওই কোণে শুয়ে বসে থাকত। কিন্তু ও বোধহয় তোমার আঙ্কেলকে ছাড়া অন্য পথ বেছে নিল। শুনেছি পশু পাখি মানুষের থেকেও অধিক মৃত্যু বোঝে। যেখানেই থাকুক প্রভু যিশু ওকে রক্ষা করুন।
[চলবে…]
Posted in: December 2021 - Serial, PROSE
এই পর্বটা সবচেয়ে ভালো লাগল। ভীষণ রিক্ততা। আর তার থেকে উদ্ভূত আবহ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। জগৎকে একটা বেড়ে ওঠা বালকের চোখে দেখা। বিস্ময় আছে আবার রিক্ততাও আছে। যে-শূন্যতা মানুষ থেকে প্রবাহিত হয়ে পশুপাখি আর পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে একটা চিরন্তনতার সৃজন করে। এই পর্বে সেটুকুই মনে হল।