বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
দশম পর্ব
আগের পর্বে লিখেছিলাম বৈষ্ণব ও শৈব তন্ত্রের পার্থক্য এবং বৈদিক-অবৈদিক তন্ত্র ভাবনা সম্পর্কে আরেকটু লিখব। সে লেখার শুরুতেই জানানো প্রয়োজন বহুচর্চিত দু-একটি কথা। শুরুতে পশুশিকারী, পরে পশুপালক হয়েছে মানুষ। দুই স্তরেই সম্ভবত নারীরা গর্ভাবস্থায় কিছুটা বেশী সময় পেয়েছে পুরুষের তুলনায় প্রকৃতির প্রজনন প্রক্রিয়াকে অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করার। অবশ্যই সে নিজে প্রজননের ক্ষেত্রে গর্ভধারিণী, এ কথাও তাকে এ দেখায় সহায়তা করেছে নিশ্চয়ই।
সেই দেখা থেকে মাটিতে ফুল-ফলাদির মাধ্যমে বীজের পতন, সেই বীজ থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্ম তার দেখা। এও তার দেখা যে সব বীজ থেকেই ফসল হয় না। এই সব দেখা ও জ্ঞান থেকে নারী কৃষিসভ্যতার শুরুয়াদ করে। তারা ভূ-কর্ষণের জন্য যে যন্ত্রটি প্রস্তুত করে তা সম্ভবত গাঁটের হাড়ের ছিল, বাঁকানো।
পরবর্তীতে সেই চেহারাতেই লাঙল ইত্যাদির উদ্ভব হবে। ফ্রজিলুস্কি তাঁর “Non-Aryan Loans in Indo Aryans” প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন লিঙ্গ, লাঙ্গল, লাঙ্গুল তিনটিই এক ধাতু নিষ্পণ্ণ। সেই সূত্রে পুংলিঙ্গ সম দণ্ডের ব্যবহারের কথা বহুবার আলোচিত হয়। কিন্তু ফালের যে বক্রভাব তা কম আলোচিত হয়, অথবা হয়ই না। ঐ বক্রভাব যে যোনির তির্যকতা নয় তা কেমন করে স্থিরিকৃত হল? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার অবকাশ এখানে নেই। চলে আসি, কর্ষক এবং কর্ষণের কথায়। এই প্রজননতন্ত্র লিঙ্গ সংক্রান্ত এ ধারণার এই কারণেই উদ্ভব। সে তন্ত্রে ভূমি ও নারী (মানুষ ব্যতীত অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রেও), পুরুষ এবং মানুষের কাছে সার্বিকভাবে গুরুত্ব পেল বেশী। এই প্রজননতন্ত্রের অন্যতম দেবতা এই উপমহাদেশে শিব।
এখানে শিব-রুদ্র চেহারাটি কালে কালে গড়ে উঠেছে। অনেকেই অনুমান করেন শিবের দক্ষযজ্ঞের কাহিনীটি তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণে পাওয়া যায়। দেবতারা বলির পশু ভাগ করছিলেন রুদ্রকে বাদ দিয়ে। ‘দেবা বৈ পশুন ব্যভজন্ত’ ইত্যাদি কথায়। যাই হোক, শিব এবং রুদ্র এককালে মিলেছে। ভাগবৎ পুরাণে এই পার্থক্য স্পষ্ট হয় দক্ষের উক্তিতে। যজ্ঞে দক্ষ বলছে, সে জটাজূটধারী শূলহস্তে একাদশ রুদ্রকে চেনে, কিন্তু মহেশ্বরকে চেনে না। অর্থাৎ বৈদিক রুদ্র এবং পৌরাণিক রুদ্র-শিবের পার্থক্য স্পষ্টই ছিল। শুধু তাই-ই নয়, সিন্ধুঘাটীর মানুষদের সভ্যতা, যা আজ হরপ্পা সভ্যতা বলে চিহ্নিত, সেখানে শিশ্নপূজা চলতো। লিঙ্গচিহ্নায়িত সেই পূজাকে ঋগ্বেদ শিশ্নদেবের পূজা বলে ধিক্কারও জানিয়েছে। সেই ধারাতেই ভাগবতও আক্রমণ করেছে শিবপূজাকে।
ভাগবতেই দক্ষ শিবকে গালাগাল করে চলেছেন। এ বিষয় লক্ষ্য করার মত এই জন্য যে শিব-বিষ্ণু বিরোধের বীজ এখানেও আদপে রয়েছে। একদা একান্তিক, সাত্ত্বত এবং কখনো ভাগবৎ বলে পরিচিত সম্প্রদায় অনেক পরে বৈষ্ণব নাম ধারণ করেছে। ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য দেয়। এ সাক্ষ্যকে লক্ষ্য করার প্রয়োজন ভবভূতির নাট্যে রাম-পরশুরাম দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতেও। বৈষ্ণব উত্থান হতে হলে শৈব দমন প্রয়োজন। শিব, কুবের, গণেশ ইত্যাদি লৌকিক দেবতাগণ কালে কালে বৈদিক দেবতাদের বেশীরভাগকেই ছাপিয়ে উঠবে যদিও, তবুও বৈদিকদের মধ্যে একমাত্র বৈষ্ণবরাই যে দেব বিষ্ণুর মহিমা রক্ষা করতে পেরেছে এও দেখার। সে প্রক্রিয়াটি কেমন করে ঘটছে তার চেহারাও এখানে আমরা পাচ্ছি।
আবার এ কথাও এখানে বলা প্রয়োজন, ভাগবৎ বলতেই বিষ্ণুভক্তদের বোঝাবে এমন কথা অধুনাতন কালের ভাবনা। একদা শিবভাগবত বলেও গোষ্ঠী ছিল যার প্রমাণ পাণিনি-পাতঞ্জলী থেকে আমরা পেতে পারি। তিনি পাণিনির ঠক্ ও ঠঞ্ প্রত্যয়দুটি আলোচনা প্রসঙ্গে এ কথা জানাচ্ছেন। সঙ্গে এও জানাচ্ছেন এরা উগ্রবেগশীল। যে সিদ্ধি শান্ত পদ্ধতিতে পাওয়া যায় তা পেতে এরা উগ্রতা প্রয়োগ করে।
অর্থাৎ অনুমান করা চলে শিবভাগবতদের মধ্যে তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ তখনই যথেষ্ট স্পষ্ট। ‘যো মৃদুনোপায়েনান্বেষ্টব্যানার্থান রভসেনান্বিচ্ছতি’। রভস বলতে এখানে ঔতসুক্য, প্রবল, ভাবাবেগ, আবেশ, গভীর শোক, উল্লাস, মিলন, বিলাস, সুখ, আমোদ, কেলিবিলাস, রতি, সম্ভোগ, রঙ্গ ইত্যাদি বুঝতে হবে। এখান থেকে আমরা শিবভাগবতদের সঙ্গে পাশুপতদের মতের দিকে প্রস্থান করব, যাঁরাও একদা শৈব বলে পরিচিত হবেন। পাশুপতদের এই উগ্র পদ্ধতি সম্পর্কে মাধবাচার্য যা জানাচ্ছেন তা নীচে আমরা সংক্ষেপিত করছি।
পাশুপত মতের চতুর্থ তত্ত্ব, বিধি। এ হল পশুর পুণ্য ও উৎকর্ষ সম্পাদনকারী ধর্মাচরণ প্রণালী। অর্থাৎ মানবাদিকে সরাসরি পশু বলেই গণ্য করা হচ্ছে এখানে। এর মুখ্য বিধিগুলির নাম চর্যা। তা ‘ব্রত’ ও ‘দ্বার’ নামক দুই ভাগে বিভক্ত। ভস্মস্নান অর্থাৎ সমস্ত শরীরে ত্রিসন্ধ্যা ভস্মানুলেপন, ভস্মে শয়ন, ( অহেতুকী) হাস্য, গীত, নৃত্য, হুডুক্কার শব্দকরণ (জিহ্বা ও তালুর সাহায্যে বৃষভাদি পশুর মত অস্ফুট ধ্বনি ), সাষ্টাঙ্গ নমস্কার, মন্ত্রোচ্চারণ প্রভৃতি ক্রিয়াই পাশুপত ব্রতের অন্যতম অঙ্গ। ‘দ্বার’, অর্থাৎ অন্য যে সব ক্রিয়ানুষ্ঠানের সাহায্যে ধর্মের প্রবেশপথ উন্মুক্ত হয়, ছয় প্রকার। যথা ক্রাথন (জাগরূক অবস্থায় নিদ্রিত থাকার ভাণ) , স্পন্দন (পক্ষাঘাত- গ্রস্থ রােগীর মত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কম্পন), মণ্ডন ( ভ্ৰমণকালে পদদ্বয় ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিক্ষেপ), শৃঙ্গারণ (সুন্দরী যুবতী দর্শনে আদিরসাত্মক ভাব প্রকাশ), অবিতত্করণ (অসামাজিক, নিন্দার্হ উন্মত্তবৎ আচরণ ) এবং অবিতদ্ভাষণ (অর্থহীন প্রলাপ উচ্চারণ)।
চর্যার গৌণ উপায়গুলিও প্রায় সমপর্যায়ের। যেমন শিবলিঙ্গ পূজাশেষে দেহে ভম্মলেপন ও দেবতার প্রতি উৎসর্গীকৃত পুষ্প, পত্র ও মাল্যাদি অঙ্গে ধারণ, অপরের উচ্ছিষ্ট ভােজন ইত্যাদি। পাশুপত সূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের দুইটি (ষষ্ঠ ও অষ্টম) শ্লোক এ সম্বন্ধে উল্লেখযােগ্য। যষ্ঠ শ্লোকটি এইরূপ- ‘উন্মত্তবদেকো বিচরেত লােকে’, অর্থাৎ ‘লােকসমাজে পাশুপত ব্ৰতধারী উন্মত্তের ন্যায় বিচরণ করবেন’। অষ্টম শ্লোকে বলা হইতেছে ‘উন্মত্তো মূঢ় ইত্যেবং মন্যন্তে ইতরে জনাঃ’, অর্থাৎ সাধারণ (সামাজিক) লােক তাহাকে উন্মত্ত ও মুর্খ বলিয়া মনে করিবে। ভাষ্যকার কৌণ্ডিন্য এ প্রসঙ্গে এই ক্রিয়াগুলিকে ‘ব্রাহ্মণকর্মবিরুদ্ধ’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন (অব্যক্তপ্রেতােন্মত্তাদ্যং ব্রাহ্মণকর্মবিরুদ্ধং ক্রমং )।
পাশুপতরা, যাঁরা লকুলীশ বলেও পরিচিত, তাঁরা ছাড়াও অন্যান্য শৈব সম্প্রদায়ও ছিল। কালামুখ, কাপালিক, অঘোরী ইত্যাদি। কাপালিক-কালামুখদের ক্ষেত্রে বর্ণভেদও জোর ধাক্কা খাচ্ছিল। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁদের মত ছিল তাঁদের ‘মহাব্রত’ রাখলেই যে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে। বেদ-এর মাধ্যমে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব থাকছে না। বরং বেদ বাদ দিয়েই ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের পথ হচ্ছে। যদিও সকল শৈব সম্প্রদায় মোটেও বর্ণাশ্রমকে সামগ্রিকভাবে ত্যাগ করেনি আচার-ব্যবহারে, তাহলেও একটা বড় অংশ, একদা বৈষ্ণব চৈতন্যের মতই ভেঙে ফেলছিল অচলায়তন। সিন্ধু থেকে বারানসী একদিকে, অন্যদিকে দক্ষিণেও এঁদের বিস্তার। উপমহাদেশের বাইরেও এঁদের অস্তিত্বের কথা আছে। যাই হোক, স্বাভাবিক ভাবেই বৈষ্ণবদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।
অযোধ্যার কাহিনী লিখছেন ভবভূতি। এমন সময় লিখছেন যখন একদিকে বৌদ্ধাদি মতবাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদের লড়াই চলছে। অন্যদিকে শৈব-শাক্তদের সঙ্গেও চলছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই যুদ্ধের দুটি রাস্তা। অথবা যে কোন ধর্মসম্প্রদায়েরই দুটি রাস্তা। হয় প্রতিপক্ষকে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও, নতুবা তাকে নিজের অংশ করে নাও। প্রথম রাস্তাটি অবিমিশ্রভাবে সম্ভবই হয়নি কখনো। এক ধর্মকে বা সম্প্রদায়কে ভাঙতে গিয়ে সচরাচর অন্য সম্প্রদায়ও নিজেকে বদলে ফেলে থাকে। আমরা ভবভূতির নাট্যের মাধ্যমে দেখছি দু ধরণের লড়াই-ই জারী আছে।
পরশুরাম না রাম, কে বড় এ প্রশ্নের মীমাংসার সঙ্গে শৈব না বৈষ্ণব কে বড়, এর উত্তর জড়িয়ে। অন্তত প্রাথমিকভাবে শৈব প্রভাব চূর্ণ করে বৈষ্ণব প্রভাব প্রতিষ্ঠা হবে। অতঃপর, অন্যতম শৈব রাবণের সঙ্গে সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। সেই ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পরশুরাম, যাকে বিষ্ণুর অবতাররূপে চিহ্নিত করা হবে তাঁকেও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের দিয়ে অপমান করাচ্ছেন ভবভূতি।
বিশ্বামিত্র বোঝাতে চেষ্টা করছেন, আর বশিষ্ঠ স্বগতোক্তিতে অসুর বলছেন। পরশুরাম, গর্বিত। একুশবার ক্ষত্রিয় হত্যাই নয়, সঙ্গে ক্ষত্রিয়জায়াদের গর্ভ থেকে সন্তান হত্যার জন্য কিম্বা বৃদ্ধ ও বালকদের হত্যা করার জন্যও গর্বিত। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যা করেছেন তাতে তাঁর সন্তাপ নেই।
এই সন্তাপ না থাকাটাই ঘৃণার বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম এ সব প্রসঙ্গে যে ঘৃণা মানুষ লালন করে তার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল অপরকে নিজের সমান মানুষ বলে মনে না করার অবস্থানটি। আর এক ঐতিহাসিক যুক্তিবোধের দুর্বলতাও সঙ্গে কাজ করে। মূল কর্মটি যিনি করেছিলেন বা যাঁরা করেছিলেন তাঁদের ছাড়িয়েও বংশ বা অন্য ধারাতে কর্মের ফলাফল চলতে থাকে। সেখান থেকে যে কর্ম উৎপাদিত হয় তাও আবার বিষ ছড়ায়। রামের অপরাধের শাস্তি মধুর দ্বারা শ্যামকে পেতে হয়। শ্যামের পক্ষীয়রা যদুকে ধরে তার দায়ে। অর্থাৎ ব্যক্তি নয়, ক্রমে কে কার পক্ষ (জ্ঞানত বা অজ্ঞানত) সেইটিই প্রধান থাকে।
অবশ্য শুধু ঘৃণাই নয়, তার থেকে বড় চালিকাশক্তি সম্পদও বটে। পরশুরামের ক্ষেত্রেই যেমন। ভার্গবদের সম্পদ দখলের জন্যই উদগ্র হয়েছিল কার্তবীর্যার্জুনপক্ষীয়রা। এখানেও বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র দ্বন্দ্বের মত এক কামধেনু হরণের কাহিনী আছে। কার্তবীর্যার্জুন, জমদগ্নির অধীনস্থ কামধেনু হরণ করেন। এ কামধেনু রূপকার্থে দেখলে আসলে ভার্গবদের সম্পদ।
জমদগ্নি যুদ্ধ করে এ সম্পদ রক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু পরশুরাম যোদ্ধাও। তিনি হত্যা করলেন কার্তবীর্যার্জুনকে। কার্তবীর্যার্জুনের ছেলেরা আবার প্রতিশোধে হত্যা করল পরশুরামের পিতা জমদগ্নিকে। শুরু হয়ে গেল পরশুরামের ধ্বংসযজ্ঞ। একুশবার ক্ষত্রিয়ের নামচিহ্ন সমেত তিনি মুছে দিলেন। অবশেষে তাঁর পূর্বজ ভার্গবেরা এবং অন্যান্য ঋষিরা তাঁকে শান্ত করলে তিনি ক্ষত্রিয়দের যে সকল রাজ্য ও সম্পদ জয় করেছেন (রূপকে বললে সসাগরা ধরিত্রী) তা তাঁর গুরু মহর্ষি কাশ্যপকে দান করে দিলেন। নিজে চলে গেলেন কাশ্যপকে দত্ত ভূমির বাইরে। মহেন্দ্রদ্বীপে সমুদ্রের থেকে ভূমি উদ্ধার করে সেখানে বসবাস করলেন। সেখানে প্রজাপুঞ্জকেও ঠাঁই দিলেন।
মনযোগ দিয়ে দেখলে এ কাহিনী জানাচ্ছে প্রতিশোধও সম্পদের জন্যই একপ্রকারে। কোনো না কোনো পক্ষ থেকে সম্পদের দখল অন্য পক্ষের হাতে যাচ্ছে। তাই যুদ্ধের আবর্তন চলছিলই। কাশ্যপের হাতে দান এবং কাশ্যপ আবার সে সব ক্ষত্রিয়দের হাতে বন্টন করে দিলে নতুন সমস্যা শুরু হল রামকে নিয়ে। ইক্ষ্বাকু বা কাকুৎস্থ রাম শৈবদের প্রাধান্য ভেঙে আদপে পরশুরামকেই প্রথমে দ্বন্দ্বে আহ্বান করেছেন যেন।
এই নাটকেই আছে সেই সংলাপ, যেখানে রাম ব্যঙ্গ করছেন পরশুরামকে, ক্ষত্রিয়দের তাঁর অধীন সামন্ত বলে গণ্য করার জন্য। অর্থাৎ দ্বন্দ্ব সম্ভাব্যই ছিল। বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-শতানন্দ সকলেই জানতেন। কিন্তু পরশুরাম দমনের জন্য তাঁরা সক্ষম ছিলেন না। এই অঙ্কে শতানন্দ, জনক, দশরথ, বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ সকলের সংলাপ এবং পরশুরামের গর্বিত প্রত্যুত্তর জানাচ্ছেও সে কথা।
দান করে দেওয়া হলেও পরশুরামও জানেন এ তাঁর রাজত্ব। সেখানে রঘুবংশীয় রামের উত্থান অর্থ তাঁর পতন। তাই তিনি বিশ্বামিত্রকে বলছেন রাম দমন করে বা হত্যা করেই তিনি আবার চলে যাবেন। দশরথাদিরা থাকুক, এবারে তাদের অন্তত হত্যা করবেন না। রাম উৎসাদিত হলে এঁদের কারোর আর ক্ষত্রিয় হয়ে অত্যাচার করার শক্তি থাকবে না।
শতানন্দ তর্কে প্রবৃত্ত হলেন। সে তর্কে শতানন্দ পরশুরামকে পাষণ্ড বলে গালি দেন। তাঁর মাতৃহত্যার নিন্দা করেন। গর্ভস্থপিণ্ড হত্যা, যজ্ঞকারী রাজাদের হত্যার নিন্দা করেন। পরশুরাম আদৌ ব্রাহ্মণ কী না সে প্রশ্ন তোলেন! তাঁকে পাল্টা পরশুরাম অহল্যার ছেলে বলে গালি দেন। অহল্যার অসতীত্বকে এবং শতানন্দের জন্মকেও ব্যঙ্গ করার জন্য। জানান তাঁদের জন্যই তিনি অস্ত্রজীবি। শতানন্দকে সরাসরি সামন্ত রাজার দানভিক্ষু পুরোহিত বলে ব্যঙ্গ করেন।
শতানন্দ শাপ দিতে উদ্যত হলেন। পরশুরাম তাচ্ছিল্যই করছিলেন। বশিষ্ঠ শতানন্দকে নিবৃত্ত করলেন। জনক আষ্ফালন করে প্রবিষ্ট হলেন। ভার্গবের বাড় বেড়েছে – এই আষ্ফালন। তাঁর সঙ্গেও চলে তর্কযুদ্ধ, হুমকী ইত্যাদি। দশরথের ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটে। এক সময় একত্রে দশরথ, জনক ও বিশ্বামিত্র অনার্য, মর্যাদাশূন্য বলে পরশুরামকে অসম্মান করেন। জনক এবং দশরথের পরে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ লেগে যায় যায় দশা। এই অবস্থায় রাম আসেন। পরশুরাম-রাম দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
নাটকের দিক থেকে দেখতে গেলে সকলেই মুখে তর্জন করছেন। একপ্রকার দ্বন্দ্ব তৈরী হয় তাতে। কিন্তু যেভাবে নিজেরাই একে-অপরকে পরশুরামের বিরুদ্ধে নিরস্ত করছেন তাতে খুব একটা ভরসা জাগে না তাঁদের প্রতি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ভবভূতি এমন একটি নাট্যাংশ কল্পনা করলেন, যেখানে এই প্রকার কুৎসিত দ্বন্দ্ব ঘটবে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় পরিসরে?
অনুমান করা চলে ভবভূতির তার্কিক ও ব্রাহ্মণ হিসেবে গর্বিত পরিবারে জন্ম তাঁকে ব্রাহ্মণত্বের নিয়মানুসারীতা প্রমাণের দিকে খানিক নিয়ে গিয়েছে। পরশুরাম শস্ত্রধারী এবং ব্রাহ্মণের পক্ষে অনুপযুক্ত কাজ করে থাকেন এমন একটি ভাবনা তাঁর সময় নিশ্চয়ই বেগবান হয়ে উঠেছিল। তাঁর পরিবারের বেদ্বিদ হওয়া, বিপুল যাজ্ঞিক কর্মে সমর্থ হওয়া এ সকল তাঁর নিজের পক্ষে নিশ্চয়ই গৌরবের বিষয় ছিল। সে জন্যই নাট্যারম্ভে তাঁর বংশের এই গৌরবকথা নানা নাটকেই ঘুরে ফিরেই এসেছে। অতএব বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রাদি পরশুরামকে যে ব্রাহ্মণত্বের পাঠ দিচ্ছিলেন বারংবার সে পাঠে তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যও নিশ্চয়ই মিশে ছিল।
অন্যদিকে, লকুলীশ পাশুপত ধারায় দণ্ড বা ত্রিশূল ধারণ ঐতিহ্য। অর্থাৎ এই পাশুপতেরা, বেদজ্ঞদের মত নিরস্ত্র নয়। তার ফলে তারা বিপজ্জনকও। ব্রাহ্মণ হলে তো বিপজ্জনক বটেই, ভিন্ন বর্ণ হলে আরোই বিপজ্জনক। ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রোহ করতে পারে, রাজা বা শাসন তার অস্ত্র কাড়তে পারবে না, ধর্মের জন্য। সুতরাং নিরস্ত্রীকরণ ও অহিংসা প্রচার ভবভূতির কাজে পরিণত হয়েছে, নিজেদের স্বার্থ এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য। তাঁদের পক্ষেই যেহেতু শাসন অতএব অস্ত্রের প্রয়োজন তাঁদের নেই।
যে সময় তিনি নাট্যরচনা করছেন, তখন এমনিতেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম বৌদ্ধাদি চিন্তার দ্বারা আক্রান্ত। ভবভূতির বৌদ্ধ বিদ্বেষ প্রসিদ্ধ। সুতরাং ব্রাহ্মণ্যধর্ম রক্ষার্থে তাঁর কলম চলেছে এ কথা ধরে নেওয়াও অসঙ্গত হবে না। মৈত্রী, করুণা এ সকল বিষয় জড়িয়েছিল প্রাথমিকভাবে বুদ্ধের সঙ্গেই। সে প্রসঙ্গ বশিষ্ঠের মন্তব্যে ব্রাহ্মণের সাধনা বলে নাটকে এনে ভবভূতি কিছুটা হলেও জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি কেমন ভাবে লড়ছেন।
এ ছাড়াও, রাম-পরশুরাম দ্বন্দ্ব রামায়ণ কাহিনীর প্রয়োজনেই গ্রথিত। পরশুরাম বিজিত না হলে ক্ষত্রিয় মহিমার প্রশ্নটির সমাধান হয় না। রামমহিমাও প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য পরশুরাম দমনের প্রয়োজন। কিন্তু নাটকে এভাবে এই দ্বন্দ্ব, অযোধ্যার পথ থেকে মিথিলায় আনার কারণ বোধহয় আগের কথাগুলোর মধ্যেই নিহিত। এভাবেই তিনি একাধারে দর্পী ব্রাহ্মণকে এবং দর্শককে ব্রাহ্মণত্বের অর্থ বোঝাতে চেয়েছিলেন। তা করতে গিয়ে ব্রাহ্মণের চরিত্রের মধ্যকার গর্ব, লোভ, অহঙ্কার, ক্ষাত্র নির্ভরতা এ সব কিছুই গোপন করেননি। কিন্তু সেখানে তর্কের মীমাংসা যে যুদ্ধে তাও প্রমাণ করে বসেছেন রাম-পরশুরাম যুদ্ধে। আর অতিরিক্ত সংলাপ ঘটনাক্রমের দুর্বলতা তৈরী করেছে।
[ক্রমশঃ]
Posted in: ARTICLE, December 2021 - Serial