লুক্কায়িত পাঠক্রম : শতানীক রায় ও শানু চৌধুরী
[It is not good for man to keep reminding himself, that he is man. — E.M. Cioran
খুব বড়ো একটা পৃথিবীতে বসবাস করি। প্রতিদিন অনেক কিছু বদলায়। ভাঙে গড়ে। আমরা নিজেই ভেঙে আবার গড়ে উঠি। আমরা ভাবি। আমাদের এই নিগূঢ় অস্তিত্ব যাপনের পদ্ধতির মধ্যে এসে পড়ে অন্বেষণ। জানি না কক্ষনো। জানতে পারি না। গানটা কেন এভাবে হচ্ছে কেন এভাবে হেঁটে চলেছি আর শেষপর্যন্ত ভাবতে বাধ্য হই কেন বেঁচে আছি। এই অন্বেষণের একটা বড়ো অংশ হল বই। আর পৃথিবীর নানা ভাষার বই থেকে আমরা কিছু বই বেছে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, একটি বই কিন্তু আবার জীবনও। মানুষ অদ্ভুতভাবে সেখানে লুক্কায়িত আছে। তারই পাঠ করতে করতে আমরা গড়ে উঠি। শব্দ। বাক্য। বাক্যের মধ্যে মধ্যে লুপ্ত শব্দ। শূন্যতা আর কীভাবে যে নিজেদের সংশয়কে এসে যেতে দেখি। নিজেদের অস্তিত্বচিন্তা চেপে বসে। এঁটে যায়। এই ধারাবাহিক সেরকমই কিছু বই। সেরকম জীবনের সন্ধান যার কোনো-না-কোনো অণুর ভেতর আমিও আছি। আর চাইছি সেই বিচ্ছুরণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাক। এই ধারাবাহিকে শতানীক রায় সে-সব বই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবেন। আর শানু চৌধুরী সে-বইয়ের কিছু অংশ অনুবাদ করবেন। আসলে কোনো পাঠই সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ-না আপনি সে-পাঠের অংশ হয়ে উঠছেন।]
পর্ব ৫
দি আনওম্যানলি ফেস অব ওয়ার
স্বেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ্
আসলে যুদ্ধের মধ্যে একজন মানুষ নিজেকে যেভাবে খুঁজে পায় তা অন্য কোনো পরিস্থিতিতে পায় না। এই আখ্যান ক্রমাগত কেন মানুষের আখ্যান হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত যত আমি সংঘর্ষ আর হিংসার ইতিহাসে প্রবেশ করছি ততটাই দেখছি যুদ্ধ এখানে একটা পাঠ। একজন মানুষ যুদ্ধের ভেতর সৃষ্টি হচ্ছে। তৈরি হয়ে আবার পুনরায় শূন্য হয়ে উঠছে। যুদ্ধ থেমে যাওয়া আর যুদ্ধকালীন সমস্ত পরিস্থিতির ভেতর উদ্ভাবনী শক্তি সেইসব যুদ্ধের মানুষকে বয়ে নিয়ে চলে। সেই জন্যই বোধহয় লেখক এ-বইয়ের আখ্যানে মানুষের অনুভূতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রতিটা মেয়ের পৃথক পৃথক যুদ্ধ। সে-যুদ্ধের কোনো অন্তর-বাহির নেই। আসলে আমাদের কোনো অন্তর-বাহির থাকতে পারে না! এরও যুক্তি আছে। আমরা যদি ক্রমাগত নিজেকে প্রতিফলিত করি নিজেরই বোধ নামক জলে তাহলে দেখব সবটাই প্রতিবিম্ব। আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘দি নস্টালজিয়া’য় চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্ট দৃঢ় অভিপ্রায় নিয়ে হাঁটছেন একটা বাড়ির ভেতরে যেখানে শুধু জল আর জল। আর এ-জল দিয়েই সে অন্তর-বাহিরের বিভেদরেখা মুছে ফেলছে। এভাবেই প্রতিফলিত প্রতিটি বিম্ব প্রতিটি মুহূর্তকে যেভাবে ধারণ করে সেও একটি ইতিহাস। আর জল হিসেবে এখানে শরীরকে ধার্য করা হয়।
আপনি যদি মনে করেন ‘দি আনওম্যানলি ফেস অব ওয়ার’ বইটা শুধুমাত্র পড়ে যাবেন তাহলে সেটা ভুল হবে। আপনি পড়ছেন অথচ এমনও মনে হতে পারে যে, কিছুই যেন পড়ছেন না। ইতিহাসের খোলসটাকে আপনি ওপর ওপর লক্ষ করবেন অথচ এখানে ইতিহাস কেবল একটা অবলম্বন। এই অবলম্বনই পথ করে দেয় অনুভূতির।
পুনরায় ফিরে পড়তে গিয়ে লক্ষ করি এই বইতে লেখক একদম শুরুটা করেছেন হতিহাস দিয়ে। কবে কোন যুদ্ধে মেয়েদের অবদান কীরকম ছিল। ইতিহাস ছাড়া ছাড়া হয়ে— ছিন্নভিন্ন। জোড়া লাগিয়েছেন লেখক।
“During World War II the world was witness to a women’s phenomenon. Women served in all branches of the military in many countries of the world: 225,000 in the British army, 450,000 to 500,000 in the American, 500,000 in the German…” এ হল যুদ্ধে মেয়েদের ভূমিকার একটি উদাহরণ।
যুদ্ধের মেয়েলি স্বরূপ তৈরিই হয়েছে এই মেয়েদের জন্যই। তাঁদের ভূমিকা নির্ধারিত করেছে গতিপথ।
“The feminine forms were born there, in the war …”
স্বেতলানার বক্তব্য একটু পড়া যাক। নোবেল বক্তৃতায় বলেছেন— “ফ্লব্যের নিজেকে বলেছিলেন মানুষরূপী কলম; আমি নিজেকে বলি মানুষরূপী শ্রবণযন্ত্র (কান)। আমি যখন পথ হাঁটি আর শব্দ সংগ্রহ করি, পঙক্তি, আর বিস্ময়বাক্য, আমি সবসময়ই ভাবি— কত উপন্যাস যে অন্ধকারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আমরা এখনও মানুষের জীবনের কথোপকথনের দিকটাকে সাহিত্যে তুলে ধরতে পারিনি। আমরা এটা নিয়ে উৎসাহিত বোধ করি না, আমরা আশ্চর্য হই না বা বিস্ময়বোধও করি না। কিন্তু এটা আমাকে আকর্ষণ করেছে আর এটা আমাকে ওর বন্দিত্ব স্বীকার করিয়েছে। মানুষের কথা বলার ভঙ্গি আমি ভালোবাসি… আমি সেই একা মানুষের স্বরটাকে ভালোবাসি। এটা আমার মহত্তর ভালোবাসা আর আবেগ।” এভাবেই তাঁর সাহিত্য বিশেষ করে এই বইটি দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের এই অধ্যায়ের অনুবাদও করার একটা কারণ হল যে, সবসময়ই মানুষ মহৎ এবং যুদ্ধ বা যে-কোনো বিশৃঙ্খলতা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। যন্ত্রণাও তার কাছে ফুল হয়ে ফোটে।
যুদ্ধের থেকে মানুষ মহৎ
[A HUMAN BEING IS GREATER THAN WAR]
ভাষান্তর: শানু চৌধুরী
যুদ্ধের থেকে মানুষ মহৎ…
সেই মুহূর্তের মহত্ত্বকে সংরক্ষণ করে রাখে স্মৃতি। একজন মানুষ ইতিহাসের থেকে আরও শক্তিশালী কিছুর দ্বারা পরিচালিত হয়। আমাকে প্রসারিত হতে হবে— সাধারণভাবে জীবন ও মৃত্যুর সত্যকে লেখায় ধরে রাখার জন্য, কেবলমাত্র যুদ্ধের সত্যকে লেখার জন্য নয়। দস্তয়েভ্স্কির সেই প্রশ্নকে উত্থাপিত করছি: কতটা মানুষ আছে মানুষের মধ্যে, এবং একজন মানুষ কীভাবে এই মানুষকে নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে? প্রশ্নাতীতভাবে, অশুভ যা কিছু তা স্বভাবতই রিপু উদ্রেককারী। অশুভ সবকিছুই শুভ কিছুর তুলনায় একটু বেশিই শৈল্পিক। এমনকী বেশি আকর্ষণীয়। আমি যত এই অনন্ত যুদ্ধের গভীরে ডুবেছি, ততই সবকিছু বিবর্ণ হয়েছে, সাধারণের থেকেও সাধারণ মনে হয়েছে। একটা সুবিশাল আগ্রাসী আর ভক্ষক জগৎ। এখন আমি বুঝতে পারি সেইসব যুদ্ধ-ফেরত মানুষের নিঃসঙ্গতা। ঠিক যেন অন্য কোনো গ্রহ বা পৃথিবী থেকে সে আগত। এই মানুষের এমন উপলব্ধির জগৎ আছে যা অন্য কারো নেই এবং তা পাওয়া যায় কেবল সেখান থেকেই, মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে। যখন সে কোনো কিছুকে শব্দের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করে, তখন তার ধারণার বিপর্যয় ঘটে। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে বলতে চায়, অন্য সবাই শোনার জন্য আগ্রহী, কিন্তু সে অসহায় শক্তিহীন।
তারা শ্রোতাদের থেকে সবসময়ই আলাদা একটা জগতে থাকে। একটা অদৃশ্য জগৎ তাদেরকে ঘিরে রাখে। কমপক্ষে তিনজন ব্যক্তি এই কথোপকথনের অংশ হয়ে ওঠে: যে এই মুহূর্তে বলছে, আর একজন যে সেই ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল এবং আমি। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেই সময়ের সত্যকে উজাগর করা। কোনোরকম দ্বিধা না রেখে। যুদ্ধের পরপরই সেই মহিলা হয়তো শুধু একটি মাত্র যুদ্ধের ঘটনাই বলতে পারতেন; যুগ-যুগান্ত পরে, নিশ্চিতভাবে, অনেক কিছু পরিবর্তিত হওয়ার দরুন, সে তার সমগ্র জীবনকেই জুড়ে দেয় নিজের স্মৃতির সঙ্গে। জুড়ে দেয় নিজের সমগ্র সত্তাকে। কীভাবে সে ওই বছরগুলো কাটিয়েছে, সেই সময় কী বই পড়েছিল সে, কী দেখেছিল, কার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সর্বোপরি, সে সুখে ছিল না দুঃখে। আমরা কি নিজেদের সঙ্গে কথা বলি, নাকি অন্য কারো উপস্থিতি সেখানে থাকে? পরিবার? যদি কোনো বন্ধু থেকে থাকে, তবে কীরকম বন্ধু? ফ্রন্টের বন্ধুরা একরকম, আর বাকি বন্ধুরা আর একরকম। আমার নথি হল জীবন্ত মানুষেরা; তারা আমাদের সঙ্গে ক্রমাগত বদলায় এবং তরঙ্গায়িত হয়; তাদের স্মৃতি কখনো ফুরোয় না অনেক তথ্য ধারণ করে তারা। এখুনি নতুন কিছু তারা সাজিয়ে গুছিয়ে তোমার সামনে উপস্থাপিত করতে পারে। এই মুহূর্তেই। বেশিরভাগ সময়ই আমরা কোনো মহত্ত্ব বা বীরত্বকে খুঁজি না, অনুসন্ধান করি ছোটো কিছুকে, মানুষের কীর্তিকে, যা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক আর কাছের হবে আমাদের। ধরে নেওয়া যাক দৃষ্টান্তস্বরূপ, প্রাচীন গ্রিসের জীবনধারা থেকে আমি কী জানতে চাই? স্পার্টার ইতিহাস [১] থেকে কী জানতে চাই? আমি জানতে চাই মানুষ সেই সময় নিজেদের বাড়িতে কীভাবে কথা বলত, এবং কী কী বিষয়ে? কীভাবে তারা যুদ্ধ করত। তাদের প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার আগের দিনে-রাতে তারা কী বলে বিদায় নিত। তাদের যুদ্ধে যাওয়ার আগের মুহূর্তটা কেমন হত। তাদের প্রিয়জনদের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার আগের অপেক্ষার সময়টা কীভাবে কাটাত তারা… বীর বা উচ্চপদস্থদের কথা বলছি না, তবে সাধারণ মানুষ যারা…
একজন অচেনা অজানা মানুষের দ্বারা কথিত গল্পের মধ্যে যে-ইতিহাস। হ্যাঁ, এ-ই আমাকে আগ্রহ দান করে, এইসব কাহিনিকেই আমি সাহিত্যরূপ দিতে চাই। তবে এই কথকেরা কেবল মাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নয়, কমবেশি প্রত্যক্ষদর্শী হলেও, তারা আদতে অভিনেতা এবং নির্মাতা। সোজা পথ দিয়ে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের আর সত্যের মাঝে আছে আমাদের অনুভূতি। আমি বুঝতে পারি যে, আমি প্রত্যেকের এক-একটা আলাদা কাহিনির প্রেক্ষিতের সম্মুখীন হচ্ছি, এদের প্রত্যেকের একটা নিজস্ব আখ্যান আছে, আর সেটা শুধুমাত্র তাদেরই, তাদের আখ্যানবিশ্বের বহুত্ব এবং সংমিশ্রণ থেকে জন্ম নেয় সময়ের চালচিত্র আর সেখানকার মানুষের গড়ে ওঠার রূপরেখা। তবে এটা আমার এই বইয়ের ক্ষেত্রে আমি নির্ধারিত করে দেব না: এর বীর যোদ্ধারা আসল, এবং এর চেয়ে বেশি কিছু না। এটা শুধু ইতিহাস। নিছক ইতিহাস।
আমি যুদ্ধের কথা লিখি না, যুদ্ধের মানুষদের কথা লিখি। আমি যুদ্ধের ইতিহাস লিখি না, তবে অনুভূতির ইতিহাস লিখি। আমি আত্মার ইতিহাসবিদ। অপর দিকে আমি বিশেষ কিছু মানুষদেরই নিরীক্ষণ করি, যারা নির্দিষ্ট একটা সময়ে বসবাস করে এবং নির্দিষ্ট কিছু কর্মের সঙ্গে লিপ্ত, পাশাপাশি আবার আমাকে তাদের ভেতরের অনন্ত মানুষকে খুঁজে বের করে আনতে হয়। অনন্তের গমক থাকে। যা সব মানুষের মধ্যেই সবসময়ই বিরাজ করে।
তারা আমাকে বলে: শোনো, স্মৃতিরা কিন্তু ইতিহাস বা সাহিত্য কোনোটাই নয়। তা শুধুই জীবন, যা শিল্পীর স্পর্শ না পেয়ে আবর্জনায় ছেয়ে থাকে। কথার একেবারে তরল রূপ, যা এক-একটা দিন নিজের ভেতরে ধারণ করে রাখে। এই ইটগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে। ইট কিন্তু মন্দির সৃজনের কারণ হয়ে উঠতে পারে না! আমার মতে এই সবই অন্যরকম… সৃজনের শক্তি নিহিত থাকে ওইখানে, মানুষের উষ্ণ কণ্ঠস্বরে, অতীতের জীবন্ত প্রতিফলনে, একেবারে মূল আনন্দ এখানেই নিহিত আর জীবনের অবিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা এখানেই উন্মুক্ত অনাচ্ছাদিত। এর বিশৃঙ্খলতা আর আবেগ। এর অভিনবত্ব আর অবর্ণনীয়তা। যা এখনও কোনো নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়নি। একেবারে মৌলিক।
আমাদের অনুভূতি থেকেই আমি মন্দির তৈরি করি… আকাঙ্ক্ষা থেকে, ব্যর্থতা থেকে। স্বপ্ন। এসবই আবার ফসকে যায়, হারিয়েও যায়।
[টীকা:
১. স্পার্টার ইতিহাস— স্পার্টা ও এথেন্স মিলিত হয়ে পারস্য সাম্রাজ্যকে হারানোর পর, এথেন্স ‘দ্য ডেলিয়ান লিগ’ এবং স্পার্টা ‘ দ্য পেলোপোনেশিয়ান লিগ’ নামে কিছু একত্রিত সাম্রাজ্যকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে, এথেন্স তুমুল শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে ও উন্নতি করতে থাকলে, স্পার্টার মনে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সন্দেহ জন্মায়। আর এই উসকানির পেছনে ছিল, কোরিন্থ নামের একটি সিটি স্টেট। আমরা সবাই জানি যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রই শক্তিশালী হলে, হিংস্র হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। আর সেই কারণেই খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-এ স্পার্টা ও এথেন্সের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা শুরু হয়। এ হল স্পার্টার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।]
[ক্রমশ…]
Posted in: December 2021 - Serial, TRANSLATION
খুব ভালো