মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী

শংকর লাহিড়ী[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। অপরজনের ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]

১৬

আমি কান পেতে রই

নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে বসে এই পৃথিবীর কবির একদিন মনে হয়েছিল- ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’! সত্যিই তো। ‘মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, কত না অজানা জীব’! আর যা কিছু পৃথিবীর বাইরে, সেই আকাশভরা সূর্য তারা দেখে কবির মনে বিস্ময় জেগেছিল। কিন্তু ‘তারা রয়ে গেল অগোচরে’। তবে কোথাও তো মানা ছিল না, মনে মনে হারিয়ে যাওয়ার। নিখিলের সব অশ্রুত সঙ্গীতের পূর্ণ স্বাদ কবি পেয়েছিলেন তাঁর মনে মনে, কল্পনায়, অনুমানে। কান পেতে রেখেছিলেন, আপন হৃদয়গহন দ্বারে বারে বারে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। তাঁরা কল্পনায়, অনুমানে বিশ্বজগতের স্বাদ পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকেন না। তাঁদের দৃষ্টি যায় মহাবিশ্বের গভীর অতীতে। তাঁরা কান পেতে রাখেন বিপুল ব্রহ্মান্ডের একেবারে গভীরে, যতদূর সম্ভব। কোথা থেকে আসছে কোন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গসংকেত। কত আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্রহ-নক্ষত্র থেকে, কে পাঠাচ্ছে, কার উদ্দেশে ? কী সেই বার্তা ? -বিজ্ঞানীদের এই প্রকল্পের নাম SETI (Search For Extra-Terrestrial Intelligence), অর্থাৎ বহির্বিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীর অনুসন্ধান। পৃথিবী জুড়ে এই কাজে মগ্ন রয়েছে সারি সারি খানদানি রেডিও-টেলিস্কোপ। বিশাল তাদের ডিশ অ্যান্টেনা। আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, জাপানে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। পৃথিবী থেকেই তারা কান পেতে আছে গভীর মহাকাশে, ডীপ স্পেসে। যেমন দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে রয়েছে নাসা-র ২৩০-ফুট ব্যাসের ‘ডীপ স্পেস স্টেশন’ (DSS 43), যে যোগাযোগ রাখছে গভীর মহাকাশে ভয়েজার-২ উপগ্রহের সাথে। উপগ্রহটি এখন সৌরমন্ডলের সীমানা পার করে ছুটে চলেছে ; সঙ্গে রয়েছে বিখ্যাত সেই ‘গোল্ডেন ডিস্ক’। -পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব এখন প্রায় ১৯৩০ কোটি কিলোমিটার।

[সৌর মন্ডল পার করে এখন ছুটে চলেছে ভয়েজার-১ এবং ২]

ব্রহ্মান্ডকে জানার জন্য বিজ্ঞানীদের যে অদম্য উৎসাহ, তার একটা প্রধান অন্তরায় হল দূরত্ব। এত বিপুল সেই দূরত্ব, যে আলোর গতিতে ছুটে গেলেও (প্রতি ঘন্টায় ১০৭ কোটি কিলোমিটার) লেগে যাবে কোটি কোটি বছর। অথচ মানুষের আয়ু তো খুবই সীমিত, মাত্র সত্তর-আশি বছর। তাই সশরীরে হয়তো দূরে কোথাও উপস্থিত হওয়া যাবে না। বড়জোর পৌঁছনো যেতে পারে আমাদেরই সৌর মন্ডলের অন্য কোনও গ্রহে, বা উপগ্রহে। তাও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ।
সৌরমন্ডলের বাইরে অন্য নক্ষত্রলোকে যেসব গ্রহ রয়েছে, যাদের আমরা এক্সোপ্ল্যানেট বলি, তাদের মধ্যেও প্রাণের সন্ধান করছেন বিজ্ঞানীরা। সুর্যের পরেই, আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটির নাম প্রক্সিমা সেন্টাউরি। মাত্র ৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে এই অনুজ্জ্বল লাল বামন নক্ষত্র (Red Dwarf Star)। তাকে নিয়েও ঘুরছে কয়েকটি গ্রহ, যার একটির নাম ‘প্রক্সিমা-বি’, সে নাকি অনেকটাই আমাদের পৃথিবীর মত। হয়ত প্রাণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে সেখানে।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা শোরগোল ফেলে দিয়েছেন, আমাদের পৃথিবী থেকে নাকি চল্লিশ আলোকবর্ষ দুরে রয়েছে লাল হয়ে যাওয়া আর একটি ঢিমে আঁচের বামন নক্ষত্র (Red Dwarf Star), যার নাম Trappist-1, আয়তনে বৃহস্পতির মতো। বয়স বেশি নয়, মাত্র ৭৬০ কোটি বছর। তাকে ঘিরে ঘুরছে সাতটি গ্রহ, যাদের আকার অনেকটা আমাদের পৃথিবীর মতো। সম্ভবতঃ তাদের তিনটেতে আছে আমাদের মতোই জল, মাটি, সমুদ্র, এবং তাহলে অবশ্যই আছে নিজস্ব জীবজগতও। আগামী দশ বছরে তাদের সম্বন্ধে জানা যাবে আরো অনেক কিছু। কেমন তাদের অধিবাসীরা? কেমন তাদের শরীর আর ইন্দ্রিয় সকল? কেমন তাদের প্রেমপত্র, বিবাহগীত, মৃত্যুদন্ড?

এলিয়েনদের খবর কি সত্যিই পাওয়া গেছে? নাসার একটি ঘোষণার পরে চারিদিকে এই নিয়ে অনেক গুজব। সম্প্রতি আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে একটি সংগঠনে নাসা আমন্ত্রণ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরূপে ২৪-জন ধর্মগুরু অথবা ধর্মীয় পুরোহিতকে, যাঁরা পুরাণ ও শাস্ত্রের বিধান অনুসারে পরামর্শ দেবেন কীভাবে মানবজাতি অদূর ভবিষ্যতে মোকাবিলা করবে এলিয়েনদের। হঠাৎই একদিন দূর নক্ষত্রলোকের কোনও এলিয়েন সভ্যতার সাথে পৃথিবীর মানুষের যোগাযোগ হলে, কীরকম তার অভিঘাত হবে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ধর্মবিশ্বাস ও রাজনীতিতে?
*
মহাকাশ বিজয়ের লক্ষ্যে রাশিয়া আর আমেরিকার ছিল প্রথমস্থান পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিনের রেষারেষি। তবে প্রথমবার রকেটে চেপে মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল ১২ এপ্রিল, ১৯৬১ সাল। সেদিন সোভিয়েট রাশিয়ার ভস্তক মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবীকে পরিক্রমা করেছিলেন ইউরি গ্যাগারিন।
প্রথম মহিলা মহাকাশচারিও ছিলেন রাশিয়ান। তাঁর নাম ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা। ভস্তক-৬ রকেটে করে ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন থেকে ১৯ জুন, তিনদিন ধরে পৃথিবীর চারপাশে ৪৮ বার ঘোরার পরে, পারাশ্যুটে করে তিনি পৃথিবীর মাটিতে অবতরণ করেন। ভ্যালেন্টিনা ছিলেন রাশিয়ার একজন নামী পার‍্যাট্রুপার।
মহাকাশ অভিযানে রাশিয়ার ক্রমান্বয়ে সাফল্যের পরে, ১৯৬১ সালের ২৫ মে, প্রেসিডেন্ট কেনেডি জাতির জন্য একটি লক্ষ্য ঘোষণা করেন। লক্ষ্য ছিল, ষাটের দশকের মধ্যেই অন্য কোনও দেশের আগে একজন আমেরিকানকে চাঁদের মাটিতে নামিয়ে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষাগুলো শেষ করে, অবতরণের রঙীন ছবিসহ আবার তাকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে হবে।
এর মাত্র দুবছর পরে নভেম্বর ১৯৬৩ সালে আততায়ীর গুলিতে প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃত্যু হয়। তাঁর প্রস্তাবিত সেই চন্দ্রাভিযানের বিশাল কর্মকান্ডের প্রস্তুতির জন্য আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছিল আট বছর।
শুরুটাই হয়েছিল একটা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ সাল পরিকল্পনা ছিল চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করবে অ্যাপোলো-১ মহাকাশযান। তার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনজন অ্যাস্ট্রোনট : পাইলট জি গ্রীসম (G Grissom), এড হোয়াইট (Ed White), এবং আর বি চ্যাফি (R B Chaffee)। উৎক্ষেপণের ২৬-দিন আগে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য একটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হয়। সেদিনটা ছিল ২৭ জানুয়ারি, ১৯৬৭ সাল। পরীক্ষার সময় লঞ্চপ্যাডেই কিভাবে যেন আগুন লেগে যায়, পুড়ে মারা যান তিনজন অ্যাস্ট্রোনটই।

[ অ্যাপোলো-১ অভিযানে মৃত তিনজন ]

এর পরে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময়ে, ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই তিনজন মহাকাশচারীকে নিয়ে ফ্লোরিডার ‘কেপ কেনেডি’ উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে রওনা হয়েছিল অ্যাপোলো-১১ প্রকল্পের ‘স্যাটার্ন ফাইভ (Saturn V)’ রকেট। সেই রকেটের মাথায় ছিল ‘কলম্বিয়া’-নামের কমান্ড অ্যান্ড সার্ভিস মডিউল (CSM), যেটা চাঁদের কাছে পৌঁছে তাকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে, এবং নীচে নামিয়ে দেবে ‘ঈগল’-নামের লুনার মডিউল বা, অবতরণযানকে। ২০ জুলাই ছিল সেই শুভদিন, যেদিন মহাকাশযান থেকে ‘ঈগল’ নামের ‘লুনার মডিউল’-টি নেমে আসে চাঁদের ওপরে ‘সি অফ ট্রাঙ্কুইলিটি’ অঞ্চলে, নির্ধারিত অবতরণ স্থানের মাত্র চার মাইলের মধ্যে, এবং নির্ধারিত সময়ের দেড় মিনিট আগেই। অবতরণের ৬-ঘন্টা ৩৯-মিনিট পরে, (২১ জুলাই ১৯৬৯) ঈগল-যান থেকে নেমে চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখেন নীল আর্মস্ট্রং, এবং তার ২০-মিনিট পরে নামেন এডুইন অলড্রিন।

[ অ্যাপোলো-১১ : চাঁদের মাটিতে নামছেন অলড্রিন। আগে নেমে, তার ছবি তুলেছেন নীল আর্মস্ট্রং ]

বলা হয়েছিল- ‘মানুষের এই ছোট্ট পদক্ষেপ আসলে মানবজাতির অগ্রগতির একটা বিশাল লাফ’। প্রেসিডেন্ট নিক্সন সেদিন টেলিফোনে কথা বলেছিলেন চন্দ্রবিজয়ীদের সঙ্গে। সারা পৃথিবীর ৬৫ কোটি দর্শক টিভিতে সেই অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। আর চাঁদের ওপরের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে কলম্বিয়া নামের সেই সার্ভিস মডিউল থেকে এসবই তখন একলা দেখে যাচ্ছিলেন তৃতীয় অ্যাস্ট্রোনট মাইকেল কলিন্স, তাঁর ভাগ্যে চাঁদে পা রাখার কোনও সুযোগই ছিল না।
চাঁদের মাটিতে প্রায় বাইশ ঘন্টা কাটানোর পরে, আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন তাঁদের ঈগলে চ’ড়ে ঊর্ধাকাশে সেই কলম্বিয়া নামের সার্ভিস মডিউলে পুনরায় মিলিত হয়েছিলেন বন্ধু কলিন্সের সাথে। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কেনেডির স্বপ্নকে সফল করে, এর পরে তিন নভোচারীকে নিয়ে কলম্বিয়া নিরাপদে ফিরে আসে পৃথিবীতে। প্যারাশুটের সাহায্যে যানটি প্রশান্ত মহাসাগরে নেমে এলে (২৪ জুলাই ১৯৬৯) দূরে অপেক্ষারত নৌবাহিনীর ‘হর্নেট’ নামের জাহাজ এসে তিনজনকে জল থেকে উদ্ধার করে। সেই ছিল মানুষের প্রথম চন্দ্রাভিযান, যার কৃতিত্ব পেয়েছিল আমেরিকা।
এর পরেও অনেকবার চন্দ্রাভিযান হয়েছে। রাশিয়া (ROSCOSMOS) আর আমেরিকা (NASA) ছাড়াও মহাকাশ অভিযানে এখন সরকারিভাবে অংশ নিচ্ছে চীন (CNSA), জাপান (JAXA), ভারত (ISRO), কানাডা (CSA) এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো (ESA)। এছাড়া, মহাকাশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (ISS) প্রকল্পের সাথে এখন নানাভাবে যুক্ত রয়েছে মোট ১৬টি রাষ্ট্র। ভারতবর্ষ মঙ্গলগ্রহ অভিমুখে অভিযান চালালেও, মহাকাশের কক্ষপথে অসংখ্য উপগ্রহ স্থাপন করলেও, এখনও অব্দি মহাকাশে কোনও মানুষকে পাঠাতে পারেনি। আগামী ২০২৩ সালের জন্য নাকি তেমনই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
*
মহাকাশ অভিযানে যেমন সাফল্য এসেছে, তেমনই এসেছে দুর্ঘটনা এবং ভয়াবহ মৃত্যুও। এর মধ্যে স্মরণীয় দুর্ঘটনাগুলো :
১। চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল, ২৮ জানুয়ারি ১৯৮৬ ; টেক-অফের ৭৩ সেকেন্ড পরে ৭ জন ক্রুর মৃত্যু।
২। কলম্বিয়া স্পেস শাটল, ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩, রাত ৭.৩০ ; ফিরে আসার সময় ল্যান্ডিং-এর ১৬ মিনিট আগে, তাপে ও বিস্ফোরণে ৭-জন ক্রুর মৃত্যু। এতে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৈমানিক কল্পনা চাওলা। আমি সেদিন জামসেদপুরে, সন্ধ্যায় টিভিতে লাইভ দেখেছিলাম কলম্বিয়া শাটলের ধ্বংস হওয়ার সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
৩। তবে মহাকাশ অভিযানে প্রথম মৃত্যুটি ছিল বিশ্বকে স্তম্ভিত করার মতো মর্মান্তিক। রাশিয়ার এয়ারফোর্সের বিখ্যাত বৈমানিক ভ্লাদিমির কোমারভ ছিলেন ভসখদ-১ এর সফল টেস্ট পাইলট। ১৯৬৪ সালের সেই উড়ান ছিল খুবই সম্মানের। সেই সফলতার তিন বছর পরে টেস্ট পাইলট হিসেবে কোমারভ এবার একা রওনা দিয়েছিলেন সোয়ুজ-১ মহাকাশযানে চড়ে। সেদিনটা ছিল ২৪ এপ্রিল ১৯৬৭। মানব নভশ্চর নিয়ে সোয়ুজ যানের সেই ছিল প্রথম পরীক্ষামূলক উড়ান।

[দুর্ঘটনার আগে, সোয়ুজ-১ মহাকাশযানে ভ্লাদিমির কোমারভ]

সফল উড়ানের পর, কক্ষপথ ছেড়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় ঘটে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকে কোনও কারণে প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সোয়ুজের ক্যাপসুল। পরে ভয়েস রেকর্ডারে কোমারভের আর্তনাদও শোনা গিয়েছিল, বলেছিলেন প্রচন্ড তাপের কথা। বলেছিলেন হত্যাকান্ড !! এই বিপর্যয়ে তখন প্যারাশুটও খুলতে পারা যায়নি, ফলে বিপুল গতিতে আগুনের গোলার মতো মাটিতে আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছিল সোয়ুজ। কোমারভের পুরো শরীর পুড়ে আংরা হয়ে গেছিল। মহাকাশ অভিযানে এটাই ছিল প্রথম মৃত্যু। কোমারভের বয়স তখন মাত্র চল্লিশ।

[পুড়ে আংরা হয়ে যাওয়া কোমারভের দেহ : মহাকাশ অভিযানে প্রথম মৃত্যু]

৪। এর পরে রাশিয়ান অভিযানে আবারও দুর্ঘটনা ঘটে। আবারও সোয়ুজ। ১৯৭১ সালে রাশিয়ার ‘স্যালুট-১’ নামক স্পেস স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময়ে সোয়ুজ-১১ মহাকাশযানে কেবিন প্রেসার খুব কমে যাওয়ায় তিনজন অ্যাস্ট্রোনটের সকলেরই মৃত্যু হয়েছিল।
*
এত মৃত্যুর পরেও, মহাকাশ অভিযান এবং মহাকাশ গবেষণা থেমে যায়নি। অর্থাভাব, অতিমারী, যুদ্ধ, রাজনৈতিক পরিবর্তন, সমস্ত অতিক্রম করে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা নিরলস কাজ করে চলেছেন, পেয়েছেন সাফল্য। বিশেষতঃ একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেকানেক বিষয়ে ত্বরান্বিত হয়েছে প্রগতি। পাওয়া গেছে এলন মাস্ক-এর মতো প্রযুক্তিবিদ, ‘ফ্যালকন হেভি’-র মতো উন্নত রকেট, ‘ক্রু ড্রাগন’-এর মত স্পেসশিপ। পৃথিবী থেকে আশি হাজার কিলোমিটার ওপরে, মহাকাশে কক্ষপথে স্থাপিত হয়েছে ‘চন্দ্রা এক্সরে অবজার্ভেটরি’। প্ল্যাঙ্ক স্পেসক্র্যাফটের সাহায্যে তৈরি করা গেছে ব্রহ্মান্ডব্যাপী (Cosmic Microwave Background Radiation) আদি মজাগতিক বিকিরণের ছবি।
এছাড়াও খোঁজ পাওয়া গেছে অনেক এক্সোপ্ল্যানেট, সুপারনোভা, আর মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের (গ্রাভিটি ওয়েভ), এবং পাওয়া গেছে সুপারম্যাসিভ ‘M-87’ ব্লাক হোলের প্রথম ছবিও। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে পাঠিয়েছেন অবিশ্বাস্য কিছু ‘প্রোব’, যা সম্প্রতি সূর্যকে স্পর্শ করে এসেছে, যেমন ‘পার্কার সোলার প্রোব’। অথবা মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে অবস্থিত ‘প্রধান গ্রহাণু বলয়’-এর (Main Asteroid Belt) একটি গ্রহাণুর ওপর নামানো হয়েছে প্রোব, যা গ্রহাণুর পাথর ভেঙ্গে নমুনা নিয়ে ফিরে এসেছে পৃথিবীর গবেষণাগারে।

এবার নবতম সংযোজনটি হতে চলেছে ‘জেমস ওয়েব’-নামে একটি যুগান্তকারী ইনফ্রা-রেড টেলিস্কোপ, যাকে স্থাপন করা হবে উর্ধাকাশে, পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার ওপরে, সূর্য-পৃথিবীর ‘লাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট-দুই’ (L2) অঞ্চলে। মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে আপাততঃ এটাই বোধহয় সবচেয়ে জরুরী, উচ্চাকাঙ্খী, বেপরোয়া, রুদ্ধশ্বাস, উন্মাদ, ও আন্তর্জাতিক একটি প্রকল্প, যার পেছনে দুরুদুরু বুকে ১০০০ কোটি ডলার (পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা) ব্যয় করেছেন বিজ্ঞানীরা।

প্রায় এক হাজার প্রযুক্তিবিদ, কয়েকশত বিজ্ঞানী, পৃথিবীর চোদ্দটা দেশ, আমেরিকার ২৯-টা রাজ্য, এবং প্রায় তিনশো বিশ্ববিদ্যালয় দিনরাত এক করে কুড়ি বছর ধরে কাজ করেছেন এই প্রকল্পকে সফল করতে।
বিজ্ঞানীদের দুরুদুরু বুকের কারণ, সর্ববৃহৎ এই মহাকাশ টেলিস্কোপ প্রকল্পে আছে হাজার হাজার সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশের মধ্যে এমন ৩৪৪-টি চিহ্নিত অংশ, যাদের বলা হয় ‘সিঙ্গল পয়েন্ট ফেলিয়র’। অর্থাৎ, এই ৩৪৪-টার মধ্যে কোনও একটিও যদি বিগড়ে যায়, তবে সম্পূর্ণ প্রজেক্টটাই ফেল করবে, হাত ধুয়ে ফেলতে হবে সবাইকে। আর কিচ্ছুটি করার থাকবে না।

উদ্বেগের আরও কারণ আছে। পৃথিবী থেকে ৫০০ কিমি ওপরে ঘূর্ণায়মান হাবল টেলিস্কোপ কখনো খারাপ হয়ে গেলে, পৃথিবী থেকে একাধিক অ্যাস্ট্রোনমারদের টিম গিয়ে তাকে সারিয়ে এসেছে। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ থাকবে আকাশের চাঁদের থেকেও (যা আছে ৩,৮৪,০০০ কিমি দূরে) আরও অনেক দূরে, পৃথিবী থেকে ১৫,০০,০০০ কিমি ওপরে। সেখানে লোক পাঠিয়ে কিছু রিপেয়ার করা অসম্ভব। যাকিছু করতে হবে, তা পৃথিবীতে বসে, মিশন কন্ট্রোল সেন্টার থেকে দূর নিয়ন্ত্রণে, কলকাঠি (Joystick) নেড়ে।

কিন্তু ‘হাবল টেলিস্কোপ’ থেকেও অনেক ওপরে, প্রায় ৮০,০০০ কিমি উচ্চতায়, উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে আরেকটি টেলিস্কোপ। নোবেলজয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভূত জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুব্রামনিয়ান চন্দ্রশেখরের নামানুসারে এর নাম ‘চন্দ্র এক্সরে অবজার্ভেটরি’ (CXO)। এর কাজ গভীর মহাকাশে কোনও নক্ষত্র বিস্ফোরিত হলে, অথবা কৃষ্ণগহ্বর অঞ্চল থেকে যে বিপুল পরিমাণ এক্স-রে রশ্মি বিকিরণ হয়, তাদের চরিত্র নির্ধারণ করা। এসব কাজ পৃথিবীতে বসে-থাকা কোনও টেলিস্কোপের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ দূরাগত অনেক রশ্মিই পৃথিবীর আবহাওয়া মন্ডলে ঢোকার সময়ে মেঘে, বাস্পে ও ধূলিকণায় শোষিত হয়ে হারিয়ে যায়।

হাবল টেলিস্কোপ ছবি তোলে দৃশ্য আলোর উপযোগী অপ্টিকাল ক্যামেরায়। পরে অবশ্য হাবল-এ যোগ করা হয়েছে ‘ইনফ্রা রেড’ ক্যামেরাও। গভীর মহাকাশে আজ অব্দি সবচেয়ে দূরের ছবি, যা হাবল তুলে দেখিয়েছে, যাকে বলে ‘হাবল ডীপ ফিল্ড’, তা হোল ১৩৪০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ‘GN-z11’ নামের একটি গ্যালাক্সি। সেই ছবি হাবল তুলতে পেরেছে ইনফ্রারেড ক্যামেরাতেই। কারণ ১৩৪০ কোটি বছর ধরে আলোকরশ্মি সেখান থেকে পৃথিবীতে আসার দীর্ঘ পথে তার তরঙ্গ ক্রমশঃ দীর্ঘায়িত হয়ে ইনফ্রারেড-এ পরিণত হয়, যা আর দৃশ্য আলো নয়, শুধুমাত্র একটু অতিক্ষীণ তাপের সংকেত, যা ধরা পড়ে ইনফ্রারেড ক্যামেরায়। তবে হাবলের এই ক্যামেরার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অতদূরে দেখার জন্যে নির্মিত হয়নি সে। অনেক ভুলচুক হতে পারে তার।

২৫-ডিসেম্বর ২০২১: বিজ্ঞানীদের সব দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের অবসান করে, আরিয়ান-ফাইভ রকেট আজ একটু আগে নিখুঁত ভাবে উৎক্ষেপণ করলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে। এবং ২৭-মিনিট ফ্লাইটের পরে রকেটের ফাইনাল স্টেজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৪০০ কিমি ওপরে কক্ষপথে পৌঁছে গেছে জেমস ওয়েব, খুলেছে তার নিজস্ব সোলার প্যানেল। সেই মুহূর্তের আসল ছবিও এবার পাওয়া গেল। আমি নাসার লাইভ টেলিকাস্ট দেখছিলাম।

পৃথিবীর নীলিমা ছেড়ে মহাকাশের ঘন অন্ধকারে এবার সে পাড়ি দেবে তার জন্য নির্ধারিত ‘L-2’ পয়েন্টে। পৃথিবী থেকে তখন তার দূরত্ব হবে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার। সেখান থেকেই আগামী দশ বছর ধরে চলবে তার যাবতীয় নজিরবিহীন ক্রিয়াকর্ম।

এই ‘জেমস ওয়েব’ টেলিস্কোপ বিশেষভাবে নির্মিত, একটি পূর্ণতঃ ইনফ্রারেড ক্যামেরা, যে কল্পনাতীতভাবে সংবেদনশীল। ১৩৫০-কোটি বছর অব্দি পিছিয়ে অতীতকে দেখতে পাবে সে, বিগ ব্যাং-এর পরবর্তীকালে যেসময়ে ব্রহ্মান্ডে নক্ষত্রমন্ডল গঠিত হয়ে উঠছে। সেই সময়ের আলোকতরঙ্গ এখন এতকাল পরে অতিক্ষীণ তাপের চিহ্নমাত্র বয়ে আনবে, যার মান হয়তো মাইনাস -২৭০ ডিগ্রি।

এই তাপ-তরঙ্গকে সনাক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে। এর জন্য তাকে রাখতে হবে প্রায় মাইনাস -২৩৩ ডিগ্রি শৈত্যে। কিছুতেই তাকে এর বেশি উষ্ণতায় থাকতে দেওয়া যাবে না, কারণ তাহলে এর যন্ত্রগুলো সনাক্ত করতে পারবে না ১৩৫০-কোটি বছর আগে নির্গত সেইসব জ্যোতিস্কের বিকিরণের আজকের তাপমান, যা দিয়ে তৈরি করা হবে তাদের জন্মলগ্নের ছবি। এইজন্য জেমস ওয়েবকে সম্পূর্ণভাবে আড়াল করতে হবে সূর্যালোক থেকে, যাতে তার মাইনাস -২৩৩ ডিগ্রি হিমশীতলতা বিঘ্নিত না হয়। তার সম্পূর্ণ যাত্রাপথে টেলিস্কোপটিকে তাই এখন ক্রমান্বয়ে ডানদিকে ও বাঁদিকে অল্প অল্প ঘোরাতে থাকা হচ্ছে, যাতে তার শরীরে উষ্ণতার সমতা থাকে।

আগামী ২৯-দিন ধরে চলবে গন্তব্য ‘এল-টু’ পয়েন্টের দিকে তার এই পথচলা। এই পথে চলতে চলতে তার নিজের কাঠামো সংলগ্ন ছোট ছোট বুস্টার রকেটগুলো প্রয়োজনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চালু করবেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা, যাতে তাকে নির্ধারিত গমনপথে ধরে রাখা যায়, যাতে সে পথভ্রষ্ট না হয় কোনমতে।

এই পথে যেতে যেতেই ক্রমশঃ মেলে ধরা হবে তার তাপরোধক প্রকান্ড ‘সানশীল্ড’, যার আয়তন একটা টেনিস কোর্টের সমান। এই সানশীল্ডের মধ্যে রয়েছে বিশেষ পদার্থে তৈরী পাঁচটা সমান্তরাল পর্দা, যার ওপরে আছে অ্যালুমিনিয়ামের মিহি আস্তরণ, যা সূর্যালোককে প্রতিফলিত ক’রে ফিরিয়ে দেয়। টেনিস কোর্ট সাইজের এই পর্দাগুলো (thin membranes) আমাদের মাথার চুলের চেয়েও পাতলা। এদের পাঁচটা স্তরের প্রত্যেকের মধ্যে সামান্য ফাঁক এবং তাপনিরোধক ব্যবস্থা আছে।

মহাকাশে এই সম্পূর্ণ সানশীল্ডটিকে তার প্যাকড্‌ অবস্থা থেকে উন্মুক্ত ক’রে যথাযথ ভাবে মেলে ধরাও একটা বিরাট ব্যবস্থাপনা, এতে কোনওরকম ত্রুটি হলে সম্পূর্ণ টেলিস্কোপই মূল্যহীন হয়ে যাবে। এই সানশীল্ডটা সবসময় থাকবে সূর্যের দিকে মুখ করে, এবং তার বিপরীত দিকে আড়ালে থাকবে হিমশীতল টেলিস্কোপটি।
জেমস ওয়েবকে পৃথিবীর বিষুব রেখা থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার ওপরে ল্যাগ্রাঞ্জ-টু (L-2) পয়েন্টে ঠিক মতো পৌঁছে দেওয়াও এক বিরাট ঝকমারি। এর জন্য ফ্রেঞ্চ গিয়ানা থেকে আরিয়ান রকেটে করে উৎক্ষেপণের সময়েই তাকে খুব সন্তর্পণে এমনভাবে লক্ষ্যের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বরং পিছিয়েই থাকে। তারপরে খুব হিসেব করে তাকে বুস্টার রকেটের সাহায্যে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, সে যদি এল-টু পয়েন্ট ছেড়ে এগিয়ে যায়, তবে তাকে আবার সেখানে ফিরিয়ে আনা যাবে না, এবং ক্রমে সে কক্ষচ্যুত হয়ে সম্পূর্ণ বিপথে চলে যাবে। বুস্টার রকেটের সাহায্যে তার মুখ ঘুরিয়ে এল-টুতে ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়, কারণ মুখ ঘোরালেই সূর্যালোকের তাপ লেগে তার যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাবে!! এই অকল্পনীয় দুরুহ কাজটা বিজ্ঞানীদের করে যেতে হবে আগামী ২৯ দিন ধরে। তারপরেও টেলিস্কোপটা চালু হতে সময় লাগবে কিছুটা। মোট ১৬০ দিন পরে, অর্থাৎ ৩-জুন ২০২২ হয়তো সে শুরু করতে পারবে তার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজ।

যাঁরা আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের অভিযানের একাগ্র সাক্ষী থাকছেন, তাঁরা গায়ক, কবি, চিত্রকর, প্রযুক্তিবিদ, যেই হন, তাঁরা প্রত্যেকে এই সময়ের পৃথিবীর কতিপয় ভাগ্যবান নাগরিকদের একজন।

দৃ‌ষ্টিসম্ভব (observable) ব্রহ্মান্ডের এখনকার পরিমাপ ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ, অর্থাৎ ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষ ব্যাসের একটি গোলক। ব্রহ্মান্ডের আনুমানিক ডার্ক ম্যাটার, আলোর গতি, প্রসারণ বেগ, ইত্যাদির মিলিত কারণে এটা ক্রমে বেড়ে ১২২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাসের গোলক অব্দি বিস্তৃত হবে। এর বাইরে তবুও থেকে যাবে আরও ২৫০ গুণ বড় আকারের ব্রহ্মান্ড, যা কখনোই দৃষ্টিসম্ভব হয়ে উঠবে না। (তার বাইরেও কিছু থাকবে কিনা, এখনই জানা যায় না।) জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের বর্তমান অবজার্ভেবল ইউনিভার্সের পরিধির মধ্যেই ১৩৫০ কোটি বছর (দূরত্ব নয়) অতীতের দৃশ্যকে প্রকাশ করবে নিপুণতর বিশ্লেষণে। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখবো, আদিম ব্রহ্মান্ডে কীভাবে গঠিত হয়ে উঠেছিল কোটি কোটি নক্ষত্রমন্ডলী, কৃষ্ণগহ্বর।

এযাবৎ খোঁজ পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন ‘GN-z11’ গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রমন্ডলীর যে ছবি (নীচে) তুলে হাবল টেলিস্কোপ আমাদের দেখিয়েছে, তার বয়স ১৩৪০ কোটি বছর, কিন্তু এখন সে রয়েছে পৃথিবী থেকে ৩২২০ কোটি (32.2 billion) আলোকবর্ষ দূরে। ব্রহ্মান্ডের অবিরাম প্রসারণ বা ইনফ্লেশনের জন্যই এমনটা সম্ভব হয়েছে।

তবে ৩২২০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সেই গ্যালাক্সিটি এখন কেমন আছে জানতে গেলে, অর্থাৎ এখনকার অবস্থার ছবি পেতে গেলে, সেখান থেকে আলো আসার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও ৩২২০ কোটি বছর। হয়তো সেই আলো তখন অতিক্ষীণ, অতিশীতল, ইনফ্রারেড হয়ে পৌঁছবে পৃথিবীতে, যাকে আমরা আর সনাক্ত করতেও পারবো না। অথবা আমাদের উভয়ের মধ্যের দূরত্ব তখন ক্রমে এত তীব্রভাবে বেড়ে চলবে যে, সেই আলোও আর আমাদের নাগাল পাবে না। অর্থাৎ আমরা সেইথেকে পরস্পরের কাছে অনন্তকাল অদৃশ্য থেকে যাবো। -বাস্তবিক তার অনেক আগেই অবশ্য ধ্বংস হয়ে যাবে এই পৃথিবী।

অর্থাৎ এই ব্রহ্মান্ডের সমস্তটুকুকে জানা আমাদের কখনোই হয়ে উঠবে না, যত উন্নতই হোক আমাদের প্রযুক্তি। আমাদের আটকে দেবে আলোর গতি এবং ব্রহ্মান্ডের প্রসারণ। যে গ্রহ নক্ষত্র আমাদের থেকে যতদূরে আছে, সে তত দ্রুততর দূরে সরে যাচ্ছে। যারা কাছে আছে, তাদের দূরে চলে যাওয়ার গতিবেগ অপেক্ষাকৃত কম। প্রতিদিন ব্রহ্মান্ডে এইভাবে লার্জস্কেলে দূরে সরে সরে যাওয়ার নিয়মকে আমাদের মেনে নিতে হবে।

মানুষ এটা বুঝুক। এখনও যাকিছু আমাদের কাছাকাছি আছে, তার সাথে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কগুলো গড়ে উঠুক, লালিত হোক। কোনও মহাজাগতিক কারণ ছাড়াই, আমরা যেন নিজেদের ধ্বংস নিজেদের হাতেই করে না ফেলি।

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

Leave a Reply