পরাধীন লেখকের মনে শেকলের শব্দ বাজে : সঞ্জীব নিয়োগী
পরাধীনতার গভীরতম শেকড়:
অন্য পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো, ক্রমবিবর্তিত সামাজিক জীবের মতোই, লেখক হিসেবে চিহ্নিত মানুষটিও শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিবিধ শৃঙ্খলে বন্দি। তার যেকোনও কাজের জন্য বাইরের বহুবিধ শক্তির কাছে সে যেমন সদা উত্তরদায়ী, তার চেয়ে বেশি পরাধীন সে হয়তো নিজের অন্তরের কাছে। অন্য পাঁচজন মানুষের মতোই, লেখকের মনও আবহমান মানবজীবন যাপন, উদ্ভাবন, আবিষ্কার, লোকাচার, আইন ও সামাজিক বাস্তববুদ্ধি থেকে উদ্ভূত প্রচলিত মান্যতা ও মানদণ্ডের সার-জলে পুষ্ট, বিকশিত, ক্ষুণ্ণ ও ক্লেশ যুক্ত।
আসলে ‘পরাধীনতা’ শব্দটির ব্যপ্তি তো সুগভীর ও বহুমাত্রিক, আমরা জানি। একটি নির্দিষ্ট সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় পরিচয়ের দায় অনেক। সামাজিক সহাবস্থানের দায় লেখকের হাত চেপে ধরে, লেখককে খুব সাবধানে পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়ে যেতে হয়। মন ও মুখ দুরকম কথা বলে, সেহেতু, সত্য থেকে যায় কিছুটা দূরে। সত্যের জন্য এত বড় বড় বুলি মুখস্থ করে লিখতে আসা, আর সেই সত্য কিনা লেখকের চালাকি দেখে দূর থেকে মুচকি হাসে। বহু ‘মিথ্যা’, যা আসলে প্রচলিত মিথ, অনেক লেখকই অনেক সময় সত্য বলে চালাতে বাধ্য হন। একেক সময় নিজেও বুঝতে পারেন না, নিজের লেখায় ব্যবহৃত তাঁর মূল্যবোধের কথা আসলে বস্তাপচা কুসংস্কারই শুধু নয়, বিজ্ঞানের সমর্থনহীন এক ফাঁকা আওয়াজ, যা শুনতে ভালো লাগে বলে বলা হয়। … ললিত-অভ্যাস এমনই মারাত্মক। যখন এই ফাঁকি ধরা পড়ে, তখন, পরাধীনতার শেকলের শব্দ মনের মধ্যে বাজে। কিন্তু সাথী-বিরল এই নির্মম সত্যের মরুভূমিতে একা চলার সাহস না থাকলে সত্য উচ্চারণ করা যায় না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে, সমাজের কোনও প্রচলিত মূল্যবোধের মুখোমুখি দাঁড়ানো হচ্ছে একজন লেখকের উপলব্ধ সত্যের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যেমন ধরুন, আমার এক বন্ধু, নাম তার রামজনম, বলে, প্রায়ই বলে, “যে খায় গোরুর গোশত, সে হয় না হিন্দুর দোস্ত”। বা, আবার, ধরা যাক সাইফুদ্দিনের মা নূরুন্নেশা বিবি মনে করেন যে “হিন্দুরা মরার পরে উপরে গিয়ে লাথি খাবে আর ঘুরে বেড়াবে কেন না কোনও একজন দেবতার নাম বলতে পারবে না। মুসলমান যেমন বলবে আল্লাহ, আর অমনি তার জান্নাত হাসিল হবে।” …এই সব কথা আমি কোনও গল্পের চরিত্রের মুখে বসালে, নিষ্পাপ ভাবেই, বসালে, এক্কেবারে রে রে পড়ে যাবে। (এখানে প্রবন্ধের আড়ালে চালিয়ে দিলাম। সম্পাদক ডিলিট করে দিলে আমার এই লেখার মূল সুরটাই কেটে যাবে এবং সম্পূর্ণ বিষয়টা প্যারাডক্স এ পরিণত হবে)। আমি গ্রামে গ্রামে ঘোরার ফলে নিজেই এসব শুনি। কারও মুখ থেকে কাহিনি শুনতে হয় না। তাই মানুষের সরল বিশ্বাস ও জীবন সম্পর্কে মূল্যায়ন আমার ভালো লাগে। আবার নূরুন্নেশা বা রামজনম কে দেখেছি অন্য ধর্মের মানুষের সাথে মানুষের মতোই মিশে যায়, ব্যবহার করে ও একে-অপরের আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে। অন্য সব মানুষের মতোই নূরুন্নেশা বা রামজনমের চরিত্রে অনেক অনেক শেড। সেইসব শেড দেখতে হবে লেখককে, নীতি-শাসিত আতঙ্কে চোখ বুজে থাকলে আজীবন মিথ্যার বাণিজ্য করে ছদ্ম সত্যের জয়গান গাইতে হবে।
যে লেখক সামাজিক, রাজনৈতিক ভণ্ডামি-জর্জরিত মুখস্থ বুলির বাইরে যাবার চেষ্টা করেন তাঁকে প্রণাম করি। কারণ সেই কাজ সত্যিই সাহসের, ঝুঁকির।
আপনি বলবেন, ধর্মীয় ব্যাপার বললেন শুধু, সেখানেই কি বাজে কেবল শেকলের গান? …না, তা কেন। বাকিটা আপনিও সাজিয়ে নিতে পারেন লারনেড পাঠক। …
যেমন,
ও শিডিউল্ড কাস্ট!
ও কালো!
ও ধনী!
সে দরিদ্র!
ও খুব সেক্সী মেয়ে।
সে বড্ড খিলারি ছেলে।
তিনি দুইবেলা পুজো করেন বলে ভালো ‘চরিত্রের’ মানুষ।
গরিব মানুষ সর্বদা সৎ হয়।
ধনী হওয়া খুব পাপের বিষয়।
ইত্যাদি।
গতের বাইরে হাঁটা একটি সামাজিক দুঃসাহস:
সাহিত্যের জগতে পূর্ব-প্রচলিত বা সমসময়ে সুপ্রচলিত ধারা বা genre, ট্রেন্ড অনুসরণ করা খুব নিরাপদ ও আরামদায়ক। ভিন্নতর কণ্ঠস্বর যে সাহস, ক্ষমতা ও প্রতিভা দাবি করে তা দিতে পারলে সেই কাজের গোত্র আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। সেই অন্য পথ স্বভাবতই বন্ধুর। রিস্কি। রবিবাসরের পাতায় সহজে ও সচরাচর ঠাঁই মেলে না। এবং বাংলার পাঠকের একটা কুসংস্কার আছে, “যে লেখক ‘পেপারে’ লেখেন, তিনিই আসল লেখক”।
আসলে, লেখক ‘কোথায়’ লিখছেন সেটা একটা ব্যাপার বইকি! লেখকের জানা প্রয়োজন, যে, তাঁকে কেন ও কোথায় লিখতে হবে। একটা কথা অনেক বন্ধুকে বলতে শুনেছি, “কোথায় লিখছি সেটা বড় কথা নয়, নিজের লেখাটা লিখতে পারছি কিনা, সেটাই বড় কথা”। …এমন বাক্যরচনা আমি সমর্থন করি না। কেন না আমরা সবাই জানি, কোন কাগজে কেমন লিখতে হয়, কোন হাউস কার টাকায় বা কোন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে। যদি একথা কোনও লেখক না জানার ভান করেন, তাহলে তিনি সামাজিক রাজনৈতিক ভাবে নিজের জ্ঞান বিসর্জন দিয়েছেন বা বন্ধক রেখেছেন। তিনি, একর্থে, চরিত্রহীন। শুধু নিজের নাম ছাপানোর জন্য সমস্ত কাগজে লেখার প্রচেষ্টা একটি নিন্দনীয় গর্হিত কাজ।
হাঁটা কোন রাস্তায়, নীতি ও টেকনিক উভয় দিক দিয়েই, সেটাই লেখকের জাত নির্ণয় করে। পাঠকের আলাদা সম্ভ্রম ও মনযোগ গতের বাইরের পদচারণা থেকে পেতে পারেন লেখক। শুধু নির্মিত সাহিত্য-বস্তু লেখকের ইন্টেনসনের একমাত্র স্টেটমেন্ট হয় যদি, তবে তা সচরাচর উদ্ধার হতে সময় লাগে বা অনেক সময় চিরকালই অন্ধকারে থেকে যায়। এক্ষেত্রে লেখকের জীবন যাপনের অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম যদি তাঁর সাপোর্টিং স্টেটমেন্ট হিসেবে সোচ্চার ভাবে নজরে পড়ে, তাহলে পাঠকের পক্ষে তাঁকে বোঝা সহজ হয়ে যায়। ব্যতিক্রমী লেখকদের লিখন-বহির্ভূত আচরণ বিশ্লেষণ করলে একথা বুঝতে পারা যায় সহজেই।
সাহিত্যের দুর্ভাগ্য এই যে, তথাকথিত ‘বড়’ কাগজে লিখলেই লেখক সাহিত্যের সাধারণ পাঠকের কাছে ‘বড়’ হয়ে যান। লিখিত বস্তুর মানের চেয়ে কাগজের ‘মান’ বড় এই সমাজে। আর সেই মান নির্ধারিত হয় পুঁজির দাপটে। কম প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশিত নিবিড়, নিবিষ্ট অসম্ভব উচ্চমানের রচনা অবহেলিত থেকে যায় আর সস্তা বিনোদনের লেখা বাজারে ‘খায়’। খাওয়ানো হয়। এটা কোনও একমাত্রিক সমস্যা নয়। একটি ভাষাগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক পরিকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য।
ভাষার শেকল:
আমরা ঔপনিবেশিক কালচারাল চোদনে নিজেদের কামকলা বিস্মৃত। এ এক আলাদা চ্যাপ্টার। ভিক্টরিয়ান নীতিবোধ (যার প্রধান নিহিত লক্ষণ হিপ্পোক্রেসি) থেকে মানুষের অকৃত্রিম ভাষা, যা মানুষের জীবনের প্রগাঢ় সংবেদন প্রকাশে অমূল্য ভূমিকা রাখে, তার কিছু শব্দ স্ল্যাং নামে একঘরে করে দিলাম। বাঁড়া কে লিঙ্গ বলে নিজেকে সুরক্ষিত ও সিভিলাইজড ভাবলাম। এমনকি, এক প্রান্তিক চরিত্র যখন গুদ কে যোনি বলে, আমরা সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিলাম। এইভাবে ক্রমশ একটা লাথখোর সাহিত্যসৃজক ও সাহিত্যপাঠক সমাজ তৈরি করে ফেললাম, যে সমাজের একটা নির্ণায়ক অংশ আসলে ভণ্ড ও সারবত্তাহীন।
বিভিন্ন পুরস্কার লেখকদের মনে রাজসভার কবিদের জিন বহন করে ও ‘রাজার মনের উপযুক্ত’ হবার বাসনা তাকে গণবিচ্ছিন্ন চাটুকারে পরিণত করে। একথা একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও, এবং বহু ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে সামনে নিয়ে এলেও, মনে রাখতে হবে, রাজা যা ভালোবাসে তার প্রজাও তা অনুকরণ করে আর তাই মনোরঞ্জক লেখক আসলে একাধারে জি-হুজুর প্রজা ও হুজুরি-প্রেমী রাজার দাসানুদাস। সেই লেখক প্রজার মন ও মননে রুচির সঞ্চার করার প্রয়াস করেননি, বরং জনরুচির জোয়ারে ভেসেছেন ও নিজের স্বার্থে সেই রুচিকে আরও বিকৃত করেছেন।
কিছু বলবেন? …কী বলবেন, বলুন!
প্ৰবুদ্ধ পাঠক, “শিল্পের জন্য শিল্প” ভাবনাটা নিয়ে নিজমনে হাসাহাসি করেন। কেননা, গূঢ় রাজনৈতিক অভিপ্রায় ব্যতিরেকে মানবজাতির কোনও মানসিক সংবেদন বাইরে বেরোতে পারে না। যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার বাজারি প্রবণতা চালু করার চাপ থাকুক। হ্যাঁ, গূঢ় রাজনৈতিক অভিপ্রায় অবশ্যই সু-শিল্পিত হতে পারে।
শিল্প বিষয়ক ধারণা যদিও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা দিয়ে বিচার করতে গিয়ে একবার শিল্পের জন্য শিল্প কথাটা ঝালিয়ে/আউড়ে নিতেই হয়, তবু, যখন ‘প্রতিপাদন’ একটি টার্গের ও দায় হয়ে লেখকের কাছে অনিবার্য হয়, তখন আসলে ব্যপকার্থে শিল্পকর্মটির রাজনৈতিক ডিস্প্যাচ নিয়েই কথা বলতে চাওয়ার বাসনা জাগে। একজন লেখক যা প্রতিপাদন করতে চান, মানব সমাজের এই অতিক্রান্ত যাত্রাপথে সেই প্রতিপাদন, রাজনৈতিক বিচারের মুখাপেক্ষী, অবশ্যই।
মানুষের জীবন যত জটিল হয়েছে, ততোই ‘গল্প’ জমে উঠেছে। শিকারী মানবজাতি চাষ আবাদ শিখতে শিখতে এগিয়ে গেছে আর ‘সমাজ’ তার রাজনীতি শিখতে শিখতে বড় হয়েছে। …একটু একটু করে প্রকৃতির রহস্য থেকে পর্দা সরে গেছে; কিন্তু, যত দিন গেছে, মানব মনের রহস্য ততই গভীর হয়েছে। সে এতকিছু ব্যাপারে জড়িয়েছে নিজেকে ক্রমাগত, এতভাবে জটিল করেছে বেঁচে থাকা। গড়েছে সম্পদ-নির্ভর সামাজিক কাঠামো।
এই সামাজিক কাঠামো অনিবার্য ভাবে জন্ম দিয়েছে কূটনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমগ্রিক ভাবে সমাজনীতি নানান প্রকোষ্ঠ। প্রাকৃতিক সত্যের সাথে সমান্তরাল ভাবে বিকশিত হয়েছে রাজনৈতিক সত্য। প্রাকৃতিক সত্যের রহস্য অনুধাবন করতে করতে রাজনৈতিক সত্যের ‘পক্ষে’ থাকাটা অনেক সময়ই অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। প্রাকৃতিক সত্য আর রাজনৈতিক সত্য কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভ ও ডায়ামেনশন নিয়ে হাজির হতে পারে। আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে ইদানীং ক্ষতবিক্ষত করে প্রাকৃতিক বা মানবিক সত্য আর এর রাজনৈতিক সত্যের টানাপোড়েন। প্রাকৃতিক সত্যকে যত কাছে পেতে চাই রাজনৈতিক সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ সমাজ ততই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এখানে সামাজিক জীব হিসেবে নিজের পরাধীনতা রীতিমতো টের পাওয়া যায়। ‘স্বাধীনতা’ – এই ধারণাটিকে কোনও গন্ডীর মধ্যে ফেলে, নিজস্ব ব্যাখ্যায় খাপ খাইয়ে নিলে হয়তো ‘রাজনৈতিক সত্যের’ প্রতি আনুগত্য বজায় থাকে, কিন্তু প্রাকৃতিক সত্য তাতে ম্রিয়মাণ হয়। রাজনৈতিক ‘সত্য’ হচ্ছে বিশেষ প্রয়োজনে ‘নির্মিত’ একটি কৃত্রিম সিস্টেম-সাপোর্ট, কিন্তু প্রাকৃতিক সত্য মানব জাতির বানানো ভালো-খারাপ বিষয়ক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির তোয়াক্কা করে না।
এক্ষেত্রে লেখক কী বলবেন, কেন বলবেন, কার পক্ষ নেবেন সেটা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। কোনও মতবাদই, মনে রাখতে হবে, নির্ভেজাল সত্যের কথা বলে না, বলে ‘বিশেষ সত্যের’ কথা। নির্ভেজাল সত্য বড় তেতো। সফিস্টিকেশনে প্রশিক্ষিত মন সেই তেতো গিলতে পারলে একটা সমাজ প্রাপ্তবয়স্ক হয়।
এক্ষেত্রে, তাহলে, কেউ প্রশ্ন করেন, তাহলে “যথাযথ”ই কি শ্রেষ্ঠ? …তাহাই কি শিল্প-আকর? …সমাজের দায় মাথায় নিয়ে সাহিত্য-শিল্প সৃজন, সাহিত্যকে নীতি-নিষ্ঠ করে তুলতে পারে কিন্তু সত্যনিষ্ঠ করতে পারে না। সাহিত্য হবে নিরপেক্ষ, নির্মম। আপনি কী চান, সেটা সাহিত্য না-ই হতে পারে। যা নির্মম সত্য, তার কাছে যাবার চেষ্টাকে বলা যায় সৎ সাহিত্য। আমাদের দেশে ধর্ম, সম্প্রদায় ইত্যাদির কথা মাথায় রেখে লেখককে নিজের কলম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এটা একজাতীয় পরাধীনতা। ফাঁকির ফাঁপানো আদর্শে বানানো আমাদের শিল্প সাহিত্যের অঢেল পৃথিবী। আমাদের মূল্যবোধ নিজেকে বিজ্ঞানের ও সামাজিক সত্যের নিরপেক্ষ আলোয় যাচাই করতে ভয় পায়, কেননা তা ‘ইজমের’ খোপে নিরাপদ নয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। …গল্পের জীবন আর জীবনের গল্প অনেক ভাবেই, অনেক সময়েই, আলাদা। জীবন যে একমুখী নয়, এই কথা ধারাবাহিক ও গতানুগতিক খেলো লেখায় অভ্যস্ত পাঠক জানতে চান না। ‘বাস্তব’ জীবন নীতি, আইন বা অযৌক্তিক যুক্তির ধার ধারে না।
…সেই জীবনকে স্বীকার করতে পারলে লেখক ও পাঠক উভয়েই প্রকৃত অর্থে প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারেন না। সাহিত্যের চরিত্ররা যেন নিজের ভাষায় কথা বলতে পারে। সমাজের ফাঁকা মূল্যবোধের, রাষ্ট্রের তথাকথিত আইনের কথা তাদের যেমন মনে থাকে না নিজেদের জৈবিক, মানবিক আর পাশবিক গতিবিধির সময়, তারা যেন সেই ভাবেই ধরা দিতে পারে লেখায়।
বাস্তব তো সমস্ত আইন কানুন ও সমাজ-স্বার্থের বাইরের ব্যাপার। …জনরব সমাজকে চালনা করে। জনরব, প্রায় সব ক্ষেত্রেই, যুক্তিহীন। সেখানে ব্যক্তির একান্ত কাহিনীর মানবিক আবেদন প্রায়শই অচল। সেই অচল কাহিনিকে তুলে আনতে চাওয়ার বাসনায় একজন লেখকের অন্যরকম গল্প লেখার ইচ্ছাশক্তি লুকিয়ে থাকে।
কিন্তু কল্পনা কে দূরে রাখা যায় না। কল্পনাহীন শিল্পসাহিত্য অনেকটা সোনার পাথরবাটি। কল্পনা বাস্তব কে শিল্পিত করে। কল্পনা বাস্তবের চেয়েও সত্য। এত সামান্য ও একাধারে অসামান্য তার ভূমিকা। ‘বাস্তবানুগ’ হওয়া শিল্পের মূল লক্ষ নয়, বাস্তবকে অতিক্রম করাই শিল্পের কাজ।
…কেউ জানে না, আগেভাগে, কোথায় কোন চিহ্ন রাখা থাকবে তার অপেক্ষায়। নির্দিষ্ট চিহ্ন, গল্পের, অপেক্ষা করে নির্দিষ্ট লেখকের জন্য। সেইসব দাগ একজন লেখকের নিজের। সেসবের হদিশ অন্য কেউ পায় না। প্রকাশিত হলে পাঠক ভাবেন, হ্যাঁ, এ তো আমারই কথা। কিন্তু আমি এভাবে বলতে বা ভাবতে পারিনি। … পাঠকের এই উপলব্ধিও লেখকের স্বার্থকতা।
…এইসমস্ত চিন্তা ভাবনা লেখার সময় কাজ করে হয়তো ভেতরে ভেতরে। যদিও লেখক এত কথা সচেতন ভাবে মাথায় রেখে লিখতে বসেন না। একজন মানুষের নানা ভাবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া তার সৃষ্টির ভেতর লুকিয়ে থাকে। তার জীবনই তার ইন্টেনশন গঠন করে দেয়। মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণি অথবা প্রকৃতির আর কোনও একক, তারা নিজের জৈবিক বা প্রাকৃতিক তাগিদে নিজের মতো চলে। দর্শকের করুণা আদায়ের জন্য, বাহবা পাবার জন্য কেউ নিজের জীবন যাপন করে না। মানুষের পক্ষে স্বাধীন জীবন কাটানো প্রচন্ড অসুবিধেজনক। কেননা তার জীবন বিনিময়-মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতি থেকে উৎসারিত নানান বুজরুকি আইন কানুন নিয়ম গন্ডি মেনে চলতে বাধ্য হয়। জগৎ জুড়ে গড়ে ওঠা হৃদয়হীন রাষ্ট্রব্যবস্থার বেসাতি তাকে নিছক কীট বানিয়ে ছেড়েছে। সমাজের বিভিন্ন সংস্থায় মাথা গুঁজে থাকার নিরাপত্তা সাধারণ মানুষকে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং সে সারাজীবন সেই কথা টেরও পায় না। ব্যক্তির পরাধীনতার উপলব্ধি ও তা অস্বীকার করার বাসনা পরিপাটি জীবনে তুলকালাম অস্বস্তি তৈরি করে। সেই দর্শন থেকে জন্ম নিতে চাওয়া শিল্প অভ্যস্ত যাপন কে বিঘ্নিত করে। … এখন, এই জটিল অবস্থানে দাঁড়িয়ে লেখক তাঁর কলম কীভাবে ধরবেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিপ্রায়।
ভাসা-ভাসা জীবনপ্রেমী লেখক যখন কোনও এক মুখস্থ বুলিকে সামনে রেখে/কেন্দ্র করে পাঠকের অভ্যস্ত মনে অভ্যাসের সুরসুরি দিতে উদ্যত হন, তিনি আসলে তখন নিজের পরাধীনতাকে উপভোগ করছেন। পরাধীনতার ‘অর্জন’কে নিজের সাফল্য বলে বুঝতে পারছেন। আমি যদি কালিয়াচকের পোস্ত চাষির মন বুঝতে না পারি, যদি বীরভূমের বেকার ছেলেটার স্নাতকোত্তর জীবনে লালতে শাক চাষের গুরুত্ব না অনুধাবন করি তাহলে কাফকা ফুকো প্রুস্ত আউড়ে কী যৌনরোম উৎপাটন করব!
সাহিত্য গড়ার পথে লেখক যখন প্রতিষ্ঠিত মতামত ও আদর্শের প্রতি, রীতি ও ছাঁদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করার অবস্থানে উন্নীত করেন নিজেকে, তখন পরাধীনতার শেকলের শব্দ বেশি করে শুনতে পান নিজের আত্মার গভীরে। …সেই শেকল গান আসলে শিল্পের নবতর প্রকাশ ঘটায়, যা পরবর্তীতে লেখকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়।।
Posted in: December 2021 - Cover Story, PROSE