এতিমখানা : সাদিক হোসেন

খপ কইরে হাত ধইরে কোথায় নিয়ে যাসতোছো গো নুরুদ্দিনভাই। পায়ের নিচে যে মাঠ, মাঠের নিচে যে কাদা, সেই কাদা সরালি কি পানি পাব? সেই পানির নিচে কীসব মাছ খলবল করতেছে গো। ঐ খলবলগুলো মোর বুকের ভেতরে দুরুম দুরুম কইরে আবাজ তুলতেছে। আর চাদ্দিকে তাইকে দেখো কীসব গাছ, কীসব পাতা আর লিকলিকে মানুষ এই আন্ধারে আন্ধারে মোর দিকে কেমন তেইকে আছে। যেন মুই ভিনদেশি এক মানুষ! হ্যাগো এইটা কোন দেশ? কোথায়? সন-তারিখ-আশ্বিন-কার্তিক কিছুই খেয়াল করতি পারতিছিনি গো। পায়ের নিচে মাঠ, না সাঁকো – সাঁকোর উপরে ঐটা ডবকা মতোন চাঁদ, না ফল – ফলের ভেতর কী বীজ আছে, বীজের ভেতর কী উদ্ভিদ আছে, উদ্ভিদের ভেতর কী মোর সতীন আছে? ওগো সতীন সেই লাল টুকটুকে পায়ের উপর পা তুইলে পুকুরে কেমন করে ডুইবে গেল পাঁকের নিচে! আর ফুটো হাঁড়ির মতোন ভাইস্যা গেল রিলিফের চাল… হ্যাগো খোকা হ্যাগো নৌকো হ্যাগো কীসব যেন ভুরভুর ভুরভুর কইর‍্যা মোর পেছনে আসতেছে… মোর মাথার ভেতর ঘুরপাক খাসতেছে কীসব বদ হাওয়া – এই যেন ভেঙে পড়তেছে ঘরবাড়ি, এই যেন ঝড় উঠতেছে, এই যেন গেরামের পর গেরাম, গেরাম-কে-গেরাম, মানুষ-কে-মানুষ, আদিম-কে-আদিম সব হুইহুই কইরে ছোঁ মারতেছে! দৌড়ুচ্ছে। কোনো খেয়াল নাই। আর হালিমার বাপ, যদ্দিন বাঁচল বউকে এট্টু সবুর দিল না, পয়দা কইরে গেল এক-দুই না, ছয়খানা নোনো। সে ব্যাটা নিজের ছাবালকে কোঁচরে নে’ গিইছ্যালো ক্যাম্পে। কিন্তুন নৌকো থেকি নেইমে যেই কোঁচর খুইলেছে দেখে ছাবাল নাই। গেল কই! গেল কই? এইসব করতি করতি সে খালি পানি ঝাপ্টাতেছে। হ্যাগা কোনোদিন শুইনছো বাপের হাত থেকি ছাবাল পইড়ে গেছে? পানিতে ভেইসে গেছে? তইলে গেছে জমিনের উপর! হ্যাগা কীসব রিলিফ, কীসব সরকার, সরকারি আদমি, সরকারি কাজজ – সব উইড়ে উইড়ে যাসতেছে। হেই দেখো কোন দেশ, হেই দেখো ঐ দেশের ভেত্রে ক্যাম্বানা নাচ হসতেছে, ক্যাম্বানা গান হসতেছে, যেন শাদিবাড়ি, যেন খানাবাড়ি, যেন খানাবাড়ির ভেতর একখানা মোষ ঢুইকে গেছে, আর মোষের পিঠের উপর মোরা বসব বলে উঠতিছি – মুই আর তুমি নুরুদ্দিনভাই – মোকে বে’র দিন পরথম যখন দ্যাখলে ক্যাম্বানা চোখের মইধ্যে, চোখের মণির ভেতর খপলখপল কইরে কীসব বলতেছ্যালে গো? তুমি কি ভেবেছ্যালে মুই বুঝিনি? মুই বরের সাথে ঘুরতিছি আর তুমি মোর পেছন-পেছন নিঃশ্বাস ফেলতোছো, হ্যাগো ষাঁড়ের মতোন তেইকে আছো, হ্যাগো কুত্তার মতোন আঁচলের নিচে ছুইপে আছো… কিন্তুন মোদের ভেতর কী আছে? কিস্যু নাই। এসপারওসপার সব দেখা যাসতেছে। বেড়ার ছিট, কাজজের ঘর, হাওয়ার আস্তানা… সব চৌপার হইগ্যালো। আর কী বেবাগ মানুষ মুই। কী বলতি গি’ কী বলি ফেললুম। সবে ভাতের হাঁড়ি নামাতি গিছি, আর উনি গঞ্জ থেকি ফিরে এইসে বললে, ওরা ভাঙ্গি দেছে। মসজিদ ভাঙ্গি দেছে। এদিকে মোর যেন কিছুই হয়নি। মুই হাসি হাসি মুখ কইরে যেই তার দিকে তাইকেছি, অমনি মোর চুলের মুঠি ধইরে আছাড় মাইরল উঠোনে। বলল, হারামি মাগি, ভাতারখাঁকি, গুদের ভেতর সব ঢুইকে নিবি তুই। কিচ্ছু রেহাই দিবি না? যা, বেরো এইখান থেকে। বেরো। কিন্তু বেরোবো কই বলো। সেই যে দেখেছ্যালুম সতীনের টুকটুকে পা, আর পুকুরের পাড়ে টুকটুক করে হেঁটে যাসতেছে একখানা বক; বক আর মোর সতীন – এরা কি আলাদা কিছু? এরা তো নজর মিইলে ইশারা দিসতেছে। বক বলতেছে, কই, কই, কই। সতীন বলতেছে, এই, এই, এই। ওদিকে মুই ছুইপে দেখতিছি মোর মরদটা পাছার উপর থামি তুইলে সতীনের দিকে এইগে যাসতেছে – টুক, টুক, টুক। বকটাও হাঁটতেছে – টুক, টুক, টুক। এই তো দেশ ছ্যালো মোদের। এইরম দেশ ছ্যালো মোদের। এইরম। মাছখেঁকো পাখির মতোন নীল আর সবুজ। ডোরা দাগ। চৌকো দাগ। ষোলোঘুটির ঘর। খালার দাওয়ায় বসে চাল থেকি কাঁকড় বাছতুম। বাছতি বাছতি খালা বলল, কইলির ভাতারকে দেখছোস? তিরপলের মতোন চওড়া ছাতি। লুঙ্গির গিঁটের ভেতর সাপ লুইকে রাখে। একদিন কইলিকে বলে, এইটার বিষদন্ত তুইলে ফেলো। এইটারে নাচার কইরে দাও। একবার ফোঁস করতি যেন না পারে। তা কইলি করে কী? দুরুম করে জানলা ভেঙ্গে পাইলে গেল মোস্তোর বাগানে। মোস্তোর বাগানে, সাঁঝেরবেলা, ধোঁয়া ধোঁয়া কীসব জ্বলতেছ্যালো তখন। ধোঁয়া ধোঁয়া দ্বিনের আস্তানা। পরেজগার মানুষরা অজু করতেছে। গোড়ালি ধুইতেছে। পাশে আগুন। আগুনের উপর কুত্তার গোশ ঝুলতেছে। বেড়ালের ছাবালরা কুঁই কুঁই করতেছে। ছাল ছাড়ানো ছুঁচো শুইকে কাঠ। তবু তেইকে আছে কুইলির দিকে। বলতেছে, হ্যাগা কোথায় আইলুম? কোন দেশ এইটা? এইরম করে কি মোদের দেশ পেল্টে যাবে, হ্যাগা। ও নুরুদ্দিনভাই, এইদিকে এসো, শরম ছাড়ো, তুমি যখন মোর হাতটা খপ কইরে ধইরলে তখন কি সন্ধ্যেবেলা ছ্যালো? তখন কী টাইম হইছ্যালো? কিছুই তো বুঝতে পারতিছিনি। খালি আন্ধার আন্ধার দিন, আন্ধার আন্ধার রাত, আন্ধার আন্ধার আলো, আর সাঁকোটাও দেখো কী সরু আর কুচকুচে। কী কইরে পার হইব? পার হয়েই বা যাব কই? ওসপারে কী আছে? ওইখানে কি শ্যামবাবু আছে? রামবাবু আছে? শ্যামের বাপ আছে? বাপের বাপ আছে? হ্যাগা, কোথায় নে’ যাসতোছো? কেন নে’ যাসতোছো? এসব তোমারে পুছব না। কীই বা পুছতাছ এহন! মোর বুকের দুধ শুইকে গেছে। থলির মতোন ঝুলতেছে। থলিটাও ফক্কা। কিস্যু নাই তাতে। শাক নাই, সব্জি নাই, আলু-পটল কিস্যু নাই। তবু মরদের চোখ তোমার। সেইদিকে তেইকে আছো আড়চোখে। তা নুরুদ্দিনভাই বুকের কী দোষ ছ্যালো? শুধু হাত ধইরলে কেন? হাত যখন ধইরেছো, তালি চলো মোর সাথে। ওগো ব্যাটা চলো এইখান থেকি ওইখান, সেইখান থেকি সেইখান, চলো ব্যাটা যতোসব আতাফল আমফল জামরুল ফলের ভেতর ঢুইকে গে’ মোরা ফের নেবে আসব জমিনে। উইঠে যাব হুই আসমানে। খইসে পড়ব জমিনে। যেন মোরা কতো পুরাতন মানুষ। কতোসব কাহিনি, আফসানা। মোরা গোরোস্থান থেকি উইঠে আসব। মোদের দেইখে নজুর বাপ ভাববে, হ্যাগা, ও মিঞা, এরা কি কব্বরের মানুষ? এরা কি মোর দাদার দাদার পরদাদার ওই সময়কার মানুষ? আচমকা এইখানে চলি এইচে? এইখেনে এসে মোদের ভয় দেখাতি এইচে? ডর কীসের মরদ! মোর তো কিছু নাই। ছুরি-কাঁচি নাই। তবু কেন কিলবিল কইরে মোর দিকে তেইকে আছো? কেন বোলতোছো, হ্যাগা, এই মেয়েছেলে ক্যা? কী জন্যি এইচে? কী জন্যি এইচে? এ কাদের মানুষ? কাদের সংসারের মেহমান? এর আস্তানা কই ছ্যালো? তাপ্পর তো চাতালে পানি দে’ পরিস্কার করা হইবে। গম্বুজের ভেতর থেকি মোরা নেইমবে আসব। কতোকালের পুরনো ফল। ফলের ভেতর বীজ, বীজের ভেতর উদ্ভিদ, আর উদ্ভিদের ভেতর মোদের হাঁকপাঁক। বুকের মইধ্যে ধরাস ধরাস কইরে কোদাল চলতেছে। ডাঙা লাফ কাটতেছে। আইসো, চাতালটা সাফ করো। ফেনাইল মেরে পাক করো। আইসো, নাপাক শরীলখানা জুইড়ে দাও। আইসো, বসো। এট্টু বাতাসা দাও তো ভাই। খাবার লেগে খানিক পানি দাও তো ভাই। ওগো নুরুদ্দিন, বসো। মুই তোমার জন্যি ভাত রাঁইধ্যে আসি। মুই ভাত রাঁইধবো আর তুমি মোর চুলের মুঠি ধইর‍্যা আইছড়ে মারবে দেবালে। মোর কপাল ফেইট্যে পড়ুক। অক্ত চৌচির হইয়ে বেইরে আসুক। কোঁচর থেইকে ফলসার দানার মতোন বেইরে আসুক ছাবালরা। হুই ছাবালদের বড়ো খিদে গো। রিলিফের চাল খেতি এইচে। খবরদার এট্টু তফাতে রইও। এখন ভালোই ভালোই বের কইরে ফেলো চাল, চিঁড়ে, ভিন্ডি, টমেটম। খুইলে ফেলো তালা। গুদামঘরে চুলোর ধোঁয়া উইড়তে থাকুক। ও শ্যামবাবু, আইসো, চাবিখানা মোর ছাবালেরে দাও। ঐটা দাওগো। শ্যামবাবু, শ্যামরাই, জোয়ারের পানিতে সাঁতার কাইটে আইছি মোরা, বহুত হাবুডুবু খাইছি, কানা কলসি ডুইবে গিইছে, কলসিতে হালিমার বাপ নিজেরে বাঁইন্ধে ছ্যালো, উনার ইন্তেকাল হইছে গো, ইন্নে লিল্লা পড়ো। বাপের জান তো। বড়ো নরম কিসিমের জান ছ্যালো। যে-পানিতে ছাবালকে দাফন কইরেছে, সেই পানিতেই নিজেরে চুইবে মারল। আহা, ব্যাটা আমার, ডাঙায় খালি পানি ঝাপটা দিসতেছে, জমিনে খালি লটপটাচ্ছে, ঘর-বাড়ি-আস্তানা-ভুঁই সব উপরনিচ নইড়ে উঠতেছে, কী যে হসতেছে, কী যে আছর নেইমেছে, নিজের বাজু থেইকে ফেরেস্তাদের নেইমে লাথি কষাসতেছে, বলতেছে – মা-খাঁকি আজ তোর মুরোদ মোর চেনা হইগেছে, আইসো, মোর গর্দানে ছোবল মাইরা যাও। আইসো। গর্দানখানা নীল কইরে দাও। তাপ্পর মুই ভোলাবাবা সেইজে ভিখ মাঙতে বেরোবো। মোর পোঁদে পোঁদে আইসো ছাবালরা, আইসো। খপ কইরে হাত যখন ধইরা নিছো তখন মোকে নে’ চলো। লিকলিকে মানুষের দেশে লে’ চলো। আছাড় খাইয়া দাও। গলায় বঁটির প্যাঁচ পইড়ে যাক। আন্ধারে সেই প্যাঁচখানা দেইখে তোমাকে পেরেশান কইরে ছাড়ব। ব্যাটা লে’ চলো মোকে…

পায়ের নিচে মাঠ, না কাদা? ওই কাদা সরালি কি খলবল কইরা মাছগুলি মোর বুকের ভেতর উইঠে আসবে? চাতাল ভাইস্যা যাবে? আস্তানা ফানুসের মতোন হুস কইরা হাবা হই যাবে? নুরুদ্দিন গো আর কতোকাল হাঁইটা মরব! একঝটকায় কোঁচর থেকি ছাবালগুলিকে রেহাই দিলি মুই কি খালি হই যাব? ওরা কান্না জুইড়ে দেবে? মোকে বদ্দোয়া মারবে? ভাঙা মজ্জিদ থেকি মুয়াজ্জিন বেইরে আসতেছে। ওনার গলায় গান নাই। আবাজ নাই। যতোসব আজান মোর ছাবালের কান্নায় বসত গেড়েছে। ঢোল বাজতেছে। ফিনকি দে’ জমজমের পানির মতোন বদ-খুন মোকে ভিইজে দিসতেছে। কী আন্ধার আন্ধার আজান, কী আন্ধার আন্ধার নামাজ… সাঁকোর নিচে আইসো। নিয়েত বাঁইন্ধে খাড়াও খানিক। মাথা খুইলে রাইখো ধর থেকি। শরীলটারে টাঙায়ে রাইখো ডালে।

ডর কী নুরুদ্দিন। আইজ তুমি ব্যাটা হইছো। মোর থলির ভেতর থেকি মুই তোমারে বের কইরে এনিছি। আঃ নিন্দ যাও। নতুন দেশে ডর নাই। মোকে মা ব’লে ডেইকে ওঠো নুরুদ্দিন। খোয়াবের ভেতরে খপ কইরে মোর হাত ধইরে নাও। ডর নাই। মায়ের কাছে জবাই হসতোছো তুমি। ডর কী ব্যাটা!

Facebook Comments

Leave a Reply