পারাপারের কথা : সাত্যকি হালদার
বুধবার তালুকপুরের হাট। হাটের শেষে গ্রামে ফিরছে লোকজন। ব্রজেন, সুখো, সত্যেন এবং আরও দু-চারজনকে নিয়ে ছোটখাটো একটা দল। দেবীপুরের ছোট খালটা পার হওয়ার সময় দলের মাঝে ব্রজেনই প্রথম ছাড়ে কথাখানা। পেছনে সত্যেনকে ডেকে বলে, বুঝলে কাকা, মেধোটা দুদিন হল বাড়ি ফিরে এসেছে।
দেবীপুরের খালের কাছে এলে গ্রামটা প্রথম নজরে আসে। খালের ওপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। সাবধানে পা টিপে পেরিয়ে যেতে হয়। খালের আগে পর্যন্ত হাটের আলোচনা, বাজারের দরদাম। এবারের হাটে সরষেয় তেমন দাম পাওয়া যায়নি। মন প্রতি তিরিশ টাকা কমতি। সুখো তার এক বস্তা সরষে চেনাজানা কার গুদামে জমা রেখে এসেছে। নিবারণ কেজি বিশেক ঝিঙে নিয়ে গিয়েছিল। বড় চেহারার হাইব্রিড মাল। সেটা বেচে মোটামুটি দাম পেয়েছে সে।
খালটা পেরিয়ে যেতে চোখের সামনে গ্রাম। কলাঝাড়, বাঁশঝাড়, দত্তদের ভিটের পাশে পুরনো শিবমন্দিরের চুড়োখানা। হাটের আলোচনা কমে আবার গাঁয়ের কথা এসে যায়। ব্রজেনের কথার উত্তরে সত্যেন বলে, মেধো যে ফিরবে তা জানা কথা। এ তো তার লতুন নয়। আগের কবারও তো ফিরে এসেছে ঠিক।
সবার শেষে খাল পার হয় নিবারণ। সত্যেনকে বাদ দিলে দলের মধ্যে তারই যা বয়স। বাঁশের সাঁকোয় বেশি সময় লেগে যায়। পাড়ে নেমে এগিয়ে যাওয়া আলোচনার খেই ধরার জন্য সে বলে, মাধবটা বারবার কোথায় যায় বল দেখি। ঘরে আয়পত্তর তেমন নেই, ব্যাটা মাঝেমাঝেই এদিক-ওদিক ছুট লাগায়!
খাল পেরিয়ে জমির ওপর দিয়ে পথ। দু পাশে আলুখেত। মাঘের শেষে বেশির ভাগ জমিতে আলু তোলা সারা। আল বরাবর হাঁটতে হাঁটতে সত্যেন বলে, এই সুখো, তুই তো মাধবের ঘরের গায়ে থাকিস। মাঝেমাঝে ও কোথায় পালায় বল দেখি।
অন্যদের মতো সুখোরও দৃষ্টি তখন পায়ে পড়ে আছে। আলে হাঁটার এই এক জ্বালা। অন্য দিকে তাকানোর উপায় নেই। সত্যেনের কথায় মুখ না তুলে সুখো বলে, যাওয়ার মধ্যে ওর আছে তো ওই মামা-ঘর। পাত্রসায়রের কাছে, নদী পেরিয়ে অনেকখানি যেতে হয়। যখনই পালান দিক মেধোটা আসলে ওইখেনে গিয়ে থাকে।
ঘেঁচু। হাঁটতে হাঁটতেই সুখোর কথার ছেদ ঘটায় ব্রজেন। হাট-ফেরতা পথে মাধবের আলোচনা সে-ই শুরু করেছিল। তার আলোচনা এখন অন্যদের মুখে। সুখোকে থামিয়ে দিয়ে ব্রজেন বলে, এবার মেধো শুধু মামা-ঘর যায়নি। সেই সঙ্গে সে অন্য তালেও ছিল…।
গ্রামে ঢোকার মুখে মস্ত একটা শিমুল গাছ। নীচে দাঁড়িয়ে দেখলে আকাশ-ছোঁয়া মনে হয়। শীতের শেষে সমস্ত ডালে এখন গাঢ় লাল ছোপ। সন্ধের মুখে এইথানে একটু দাঁড়ায় হাট-ফেরতা দলটা। এরপর থেকে পথ কিছুটা ওপরে চড়ে গেছে। গ্রামও খানিক ওপরে। পেছনের খাল আসলে দামোদরের ফেলে যাওয়া শাখা। এক সময় গ্রাম পর্যন্ত ছিল, এখন মাঝখানে ক হাত মাত্র জল। এখানে দাঁড়িয়ে নিজের কথাটা শেষ করে ব্রজেন। বলে, মেধোটা ফিরেছে ঠিকই, তবে সঙ্গে তার লতুন বউ। লতুন মানে একেবারে টাটকা। পাকুড়তলার মোড়ে বাস থেকে সেদিন একসঙ্গে নেমেছে।
পেছনে খালের সাঁকোতে তখন আরও একটা দল। তাদের পেছনে খোলা মাঠ। সেই মাঠ পেরিয়ে হাট থেকে ফিরছে দু-চারজন করে আরও অনেকে। অনেক দূরে হাটের এলাকাটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবি। শিমুলতলায় দাঁড়িয়ে নিবারণ বলে, মেধো বিয়ে করবে এ তো ভাবাই যায় না। চাল নেই চুলো নেই, ওর সঙ্গে কে মেয়ে দিতে গেল। ব্রজেন নিজে দেখেছ, না কেউ দেখে বলেছে?
ব্রজেন বলে, আমি নিজে দেখেছি কাকা। আজ সকালে সরাসরি মেধোর সঙ্গে দেখাও হয়েছে। ও নিজের মুখে কবুল করেছে কথাটা।
এই সময় ওপর থেকে একটা শিমুলফুল নীচের ধুলোয় এসে পড়ে। গ্রামের ভেতর শিবমন্দিরে কাঁসরের শব্দ শোনা যায়। অন্ধকার জমাটবেঁধে রয়েছে দেবীপুরের খালের ওপর। সামনের চড়াই বেয়ে পুরো দলটা এবার গ্রামের দিকে চলতে শুরু করে। তাদের আলোচনা জুড়ে তখনও মাধব।
দুই
তালুকপুরের হাটে সে-ও সেদিন গিয়েছিল। প্রতি বুধবারেই যায়। এদিকে তালুকপুর শুধু নয়, আরও দূরে বদনগঞ্জ চাঁপাডাঙা এমনকী গোঘাট-বৈতলের হাটেও গামছা নিয়ে যায় মাধব। মাসে এক-দুবার বর্ধমানও যেতে হয়। পাইকারি দামের গামছা সেখান থেকেই কেনা। এদিকের হাটগুলোতে সারা মাস সে গামছা ফেরি করে বেড়ায়।
হাট থেকে ফিরতে সেদিন সন্ধে। অন্য দিন অবশ্য আরও দেরি হয়। মাঝেমাঝে রাতের বেলায় হাটে থেকেও যায় অনেক সময়। হরিণখোলায় মস্ত হাট বসে মুন্ডেশ্বরী নদীর চরে। প্রায় মেলার মতো বড়। হরিণখোলায় গামছা নিয়ে গেলে কোনও দিনই ঘরে ফেরার মন হয় না মাধবের। সারারাত নদীর বালিতে ঘোরাফেরা করে লোকজন। ছোট-দোকানিরা স্টোভ ধরিয়ে রান্নাবান্না সারে। গামছার পেটি মাথায় দিয়ে নদীর বালিতে শুয়ে থাকে মাধব। হরিণখোলার পরের দিন চাঁপাডাঙার হাট। সকালে বাসের মাথায় চাপলে সোজা চাঁপাডাঙা।
কিন্তু তালুকপুরের হাট থেকে সেদিন সে সন্ধের মুখেই ঘরে ফিরে এল। দিন দুয়েক ঘরে তার নতুন লোক। পাত্রসায়রের মামারা প্রায় জোর করেই প্রতিবেশীদের মেয়েটাকে তার ওপর গছিয়ে দিয়েছে। বিয়ে যে করবে এমন কথা কোনও দিন সে ভাবেনি। অন্যদের মতো সে নিজেও নিজেকে বরাবর ফালতু মনে করে এসেছে। গ্রামের কোনও ব্যাপারে তার মতামত নেই। জোর দিয়ে ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা বলতে পারেনি কখনও। তাই হয়তো মামারা কথা না বাড়িয়ে বিয়ে করিয়েছে তাকে। মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে কিনা দিন দুয়েক বাদেও মাধব তা ভালো করে জানল না।
হাট থেকে ফিরে সে দেখে তরুবালা আলো জ্বালিয়েছে ঘরে। হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বেড়ার গা, ঘরের কোনাটোনা। রাতে নিজের ঘরটাকে মাধব কোনও দিন এত সোজাসুজি দেখেনি। যেসব রাতে বাড়ি ফিরেছে সে-রাতে কোনও রকমে শরীরটাকে ছেড়ে দিয়েছে বিছানায়। আলো জ্বালানোর দরকার হয়নি কখনও। এখন বাতির আলোয় ঘরের ভেতরটা দেখে মাধব কেমন অবাক। বিছানার ওপর দলাকরা জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে তুলে রাখা দড়িতে। পায়ের তলের মাটিটাও অল্প আগে নিকানো। সন্ধেবেলা জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে ফিরে এসেছে মাধব। হাট-ফেরত পথে তার পরিচিত মাঠঘাট, খালের ওপর নড়বড়ে সাঁকো, পথে গরুর গাড়ির ক্যাঁচকোচ। এসবের মধ্যে এতকাল যেমন মিশে ছিল সেভাবেই ঘরে ফিরেছে সেদিন। কিন্তু ফিরেই সাজানো ঘরখানা দেখে যেন ঘোর লেগে যায়। সেই সঙ্গে চুলটুল বেঁধে পারিপাটি হয়ে থাকা তরুবালাকে দেখে। কাঁধের একপাশে গামছার পেটিখানা নিয়েই মাধব দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তরুবালাও ততটাই অবাক। মৃদু গলায় সে বলে, কাঁধ থেকে ওসব নামাও। হাত-মুখ ধোও। উঠোনের উনুনে ভাত বসানো আছে, বেশি সময় লাগবে না।
তরুবালার গলার স্বরে আরও ঘোর বাড়ে মাধবের। ঘরে থাকলেও অনেক দূর থেকে যেন কথা আসছে তার। পাত্রসায়র কিংবা আরও দূরে নদীর ধারের কোনও দেশ থেকে। নদীর এপারে মামাদের গ্রাম। নদীর চরে আর ক দিন পর বিশালাক্ষীর পুজো। ওপারে বর্ধমান থেকে দামোদরের বালি উজিয়ে মেলায় আসে লোকজন। সন্ধের বাতাসে চরের বালি ওড়ার মতো তরুবালার কথাগুলো যেন ভাসতে থাকে ঘরময়। মাধব বিড়বিড় করে বলে, ঘরখানা কখন এমন করে সাজালে!
তরুবালা হাসে। আশ্চর্য সেই হাসি। মাধবের আবার আকাশে মিশে যাওয়া দামোদরের চরের কথা মনে হয়। হাসির সঙ্গে জ্যোৎস্না-মাখা বিপুল সেই চর এবার ঢুকে পড়ে তার ঘরে। তরুবালা বলে, আমি তো কিছু সাজাই নাই। তোমার জিনিস সব তোমার ঘরে রাখা আছে।
বউ নিয়ে ফিরলেও তার সঙ্গে গত দুদিন সেভাবে আলাপ করেনি মাধব। বাড়তি একটি দায় বলেই মনে হয়েছে মেয়েটিকে। গামছা ফেরি করে বেড়ানো জীবনে তরুবালা যেন আরও একটি বোঝা। কিন্তু এবার তার কথায় ভিতরে ভিতরে খানিকটা হালকা হয় যেন। তরুবালার আশ্চর্য হাসি হাট থেকে আনা ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে দেয়। হাত-মুখ ধোয়ার আগেই শরীর জুড়িয়ে আসতে থাকে মাধবের।
মাঘ মাসের শেষে বাইরে তখন দক্ষিণের বাতাস। সারা শীতকাল ধরে ঘুমিয়ে থাকা গ্রামের গায়ে চাঁদের হালকা আলো। শিবমন্দিরের দিক থেকে টানা কীর্তনের সুর ভেসে আসতে থাকে। বাইরে কাঁঠালগাছের ডালে হঠাৎ ঝটপটানো শব্দ। বড়সড় কোনও পাখি হবে হয়তো। মাধব তরুবালাকে বলে, এই সময় ঘরে ঢুকি নাই কোনও দিন। জীবনে এই পরথম। নদীর চরে হাঁটতে হাঁটতে কবে কোথায় গেছি তার লেখাজোখা নাই।
বাইরের উনুনে ফুটন্ত ভাতের কথা মনে হয় তরুবালার। দরজা ঠেলে বাইরের দিকে যায়। পেছনে কথা শোনা যায় তার। …নদীর চর শেষ হলে তারপরে ঘর। পথের নিয়ম তাই। আমি ভাত দেখে আসি, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসো।
সে-রাতে খাওয়া শেষ হলে ওরা বাইরে এসে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোয় তৈরি কাঁঠালগাছের ছায়া শীতলপাটির মতো উঠোনের গায়ে বিছানো। রাতচরা পাখি ডাকছে বাঁশবাগানের দিকে। দরজা ভেজিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে জ্যোৎস্নার মধ্যে। সেই হাঁটায় কোনও কারণ নেই, নির্দিষ্ট দিক নেই কোনও। অজানা এক ভালোলাগা চাঁদের আলোয় ওদের ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়।
কীর্তনের গান থেমে যার একসময়। মাধব আর তরুবালা খালের পাড়ে বিশাল সেই শিমুলের তলে এসে থামে। তরুবালা বলে, আর না, এইবার ঘরের দিকে চলো। রাত কম হয় নাই কিন্তু।
সামনের খালের ওপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোখানা। ওপারে চাষ উঠে যাওয়া ফাঁকা মাঠ। তার ওপাশে টানা পথ, লম্বা হয়ে মিশে গেছে তালুকপুরের দিকে। জ্যোৎস্নার আলোয় সব আবছা ছবি যেন। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মাধব বলে, জায়গাগুলা কেমন নতুনের মতো লাগে! এত যাতায়াত তবু কেমন অচেনা!
ঘরে ফিরল ওরা যখন, তখন রাত অনেক। কাঁঠালগাছের ছায়া সরে গেছে। রাতচরাও চুপ। অচেনা দেশ দেখার সখ মাধবের বহুকালের। গত জন্মেরও হতে পারে। ঘরে ফিরে সেই রাতে মাধবকে অচেনা আরেক দেশ দেখায় তরুবালা। সেই দেশ দেখা যখন শেষ বাইরে তখন ভোররাত।
তিন
এর মধ্যে একদিন সকাল থেকেই রবি ময়রার দোকানে হইচই। মাঠের পথ যেখানে গ্রামে ঢুকেছে সেই মুখে রবির দোকান। দোকান লাগোয়া পার্টি অফিস। দোকান আর পার্টি অফিস গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে।
রবির দোকানে খাবার বলতে পাউরুটি আর কড়াইয়ে ডোবানো মার্বেল সাইজের রসগোল্লা। সঙ্গে ছোট গ্লাসে চা। এই নিয়ে সকাল-সন্ধে নড়বড়ে বেঞ্চগুলো সরগরম হয়ে থাকে।
সেদিন সকালে নিবারণের গলা সবার ওপরে। হাত-পা নেড়ে বারবার সে বলে, মেধোটার চাল নেই চুলো নেই, গামছা বেচে খায়, ওর বউ দেখতে ভালো হয় কী করে! ব্যাটা নিশ্চয়ই একটা ধান্দা করে রেখেছে।
তালুকপুরের হাট থাকলে সেদিন এই গ্রাম একটু ব্যস্ত। ছেলেরা সবাই সেদিন হাটে যায়। যাদের কাজ নেই তারাও গিয়ে ঘোরাঘুরি করে আসে। কিন্তু সপ্তাহের অন্যদিন গাঁ একেবারে শান্ত। রবি ময়রার দোকান আর পার্টি অফিস ছাড়া কোথাও তেমন হাঁকডাক নেই। বেলা গড়িয়ে অনেকখানি হয়ে যায়, বেঞ্চ ছেড়ে নড়তে চায় না লোকগুলো। মাঝখানে শুধু খুটখুট শব্দে চায়ে চিনি মিশিয়ে যায় রবি।
মেধো যে ধান্দা-ফিকির করে বউ বাগিয়ে এনেছে এ-নিয়ে অনেকের মনেই কোনও সন্দেহ নেই। তার মতো নড়বড়ে লোকের কপালে বউ জোটারই কথা নয়। গামছা ফেরি করে আরও হয়তো অনেকের সংসার চলে, কিন্তু মাধব হচ্ছে ভবঘুরের এক শেষ। কোথায় থাকে কোথায় খায়, তার ঠিকঠিকানা নেই। এরকম একটি লোকের সঙ্গে কেউ যে মেয়ের বিয়ে দেবে এ-কথাটা অনেকেই বিশ্বাস করে না।
নিবারণ চায়ের দোকানের সবাইকে বলে, ভালো করে খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, এর মধ্যে ঝামেলা কিছু একটা আছে। এখন থেকে খোঁজখবর না নিলে পরে বড়সড় গোলমাল বেধে যাবে। শেষে হয়তো গাঁয়ের সকলকে নিয়ে টানাটানি…।
পরের বুধবার হাট-ফেরত পথে মাধবকে ঘিরে ধরে সবাই। ব্রজেন, সুখো, সত্যেন, প্রায় প্রত্যেকে। সুখো মাধবকে ডাক দিয়ে বলে, কী কায়দায় বিয়েখানা বাগালি বল দেখি। অন্য কারও বউ নিয়ে পালিয়ে আসিসনি তো!
মাধব বরাবরই গ্রামের দলবলকে এড়িয়ে থেকেছে। রবি ময়রার দোকানে সে কদাচিৎ যায়। কেউ কোনও ব্যাপারে মতামত চাইলে তার মাথা নিচু। ঘরে বউ আনার পর রাস্তাঘাটে তাকে নিয়ে যে কথা শুরু হয়েছে, এটা সে বুঝতে পারছিল। সকালবেলা তরুবালা উঠোন ঝাঁটাবার সময় রাস্তায় ঘুরঘুর করে লোকজন। রাতে বেড়ার গায়ে টর্চের আলো পড়ছে কদিন। সুখোর কথায় হাট-ফেরতা মাধব চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর বোঝাখানা এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে নিয়ে বলে, মামারা দেখেশুনে দিল তাই হল আর কি। মেয়েটাও মা-মরা, বাপ কোথায় গেছে তার ঠিকঠিকানা নাই। মামাদের ঘরেই খেয়েপরে মানুষ।
সত্যেন গলা নাচিয়ে বলে, তুই বললি আর আমরা মেনে নিলাম কথাটা? দরকার হলে আমরাও একদিন পাত্রসায়র যাব। গাঁয়ের নাম বলে দিবি, আমরা গিয়ে মিলিয়ে দেখে আসব। বাপ-মা মরা মেয়ে ওরকম ফর্সা হয় নাকি!
এর উত্তর মাধবের জানা নেই। বাপ-মা থাকা না-থাকার সঙ্গে রঙের কী সম্পর্ক সে জানে না। নিচু স্বরে বলে, তা আপনাদের মন নেয় যদি যাবেন। এখান থেকে হাঁটলে ঘণ্টা-চারেক। শিমুলারি গ্রাম। মামাদের কথা বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
কিন্তু খোঁজ নেওয়ার জন্য এদিক থেকে কেউই দরিয়াপুর যায় না। কারণ তাদের যাওয়ার সময় নেই। সেই সময়টুকু দোকানে বসে মাধবের বউয়ের আলোচনা করলে দিন আরও ভালো কাটে। গ্রামের বেশিরভাগ লোক তালুকপুরের হাট ছাড়া গ্রামের বাইরে যায়নি। পাত্রসায়রের নাম শুনেছে বটে, কিন্তু সে-জায়গা পুবে না দক্ষিণে তাই অনেকে জানে না। তাছাড়া মাধব যে ধান্দা করে বিয়ে করে আনেনি তা প্রমাণের দায়িত্ব মাধবেরই, গাঁয়ের লোকের নয়। খামোখা তারা কেন চার ঘণ্টার পথ হেদিয়ে মরতে যাবে।
ঘরের সামনে পেঁপে গাছটা ফলে ভরে উঠেছিল মাধবের। কুমড়োর ডগায় নতুন ফুল। তরুবালা বিকেলে জল ঢালত গাছগাছালিতে। কিন্তু এর মধ্যে এক রাতে ফল সমেত পেঁপে গাছের মাথাখানা উধাও। ঢ্যাঙা গাছখানার মাথায় ধারালো দা-এর দাগ। কুমড়োর ডগাগুলোও এলোমেলো। পর দিন গামছা কাঁধে মাধব যখন হাটে যাচ্ছে, রবি ময়রার দোকানের দিক থেকে হঠাৎই ভেসে আসে একগাদা খ্যাকখেকে হাসি। মাধব পেরিয়ে যাওয়ার পরও সে-হাসি থামতে চায় না। খালের বালিতে নেমে গিয়েও পেছনে সে হাসি শুনতে পায়।
চার
চৈত্র মাসে বুড়োশিবের মেলা, মন্দিরের বড় মাঠখানায়। মেলায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তরুবালার। তার বিয়ের পর এই প্রথম বুড়োশিবের পুজো। সকাল থেকে দলে দলে মানুষ রওনা হয়েছে সেদিকে। তবু তরুবালার কেমন মন ভাঙা।
মেলায় যাওয়ার ইচ্ছা মাধবেরও তেমন নেই। ছোটবেলা থেকে দেখা এই তার গ্রাম। এর মাঠ-ঘাট, শিমুলতলা, এর সঙ্গে বহুকাল ধরে মিশে রয়েছে সে। তবু গ্রামের মানুষের পাল্টে-যাওয়া কথায় সে কেমন অবাক। প্রত্যেকে এখন যেন তাকিয়ে বসে তাদের সংসারের দিকে। তারা কী করে, কোথায় যায়, কীভাবে মাধব কথা বলে বউয়ের সঙ্গে, চারপাশে তাই এখন আলোচনা। এ-সবের ভিতরে থেকে মাধবের মন ছটফটিয়ে ওঠে। ভাবে তরুবালাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলে হয়। কিন্তু যাবেই বা কোথায়! বাইরে কোথাও তো তাদের যাওয়ার জায়গা নেই।
মেলার সারাদিন ঘরে গুমরে থাকে দুজন। বাইরে রোদ চড়া হয়েছে তেমনি। গাছপালা, মাঠের গরুবাছুর সব কেমন ঝিমধরা। তালুকপুরে যাওয়ার পথ চৈত্রের রোদে টানটান। মাধব দেখে, আর দূরের কোনও দেশের কথা ভাবে। তরুবালাও তাকিয়ে দূরের রাস্তায়।
সন্ধের মুখে গরম কিছুটা কম। লাল মাটির দেশ ঠান্ডা হয়ে আসে। বাতাস শুরু হয় একটু একটু। গ্রামের কারও তখন মেলায় যাওয়া বাকি নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। সারা গ্রামটাই তখন মন্দিরের মাঠে। মাধব আর তরুবালা ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। খানিক হেঁটে সেই শিমুলগাছের নীচে। শিমুলের ডালে তখন সন্ধের বাতাস। আকাশে তারা একটা-দুটো। মাধব বলে, চলো পাত্রসায়র চলে যাই। মামাবাড়ির দিকে কোথাও।
সন্ধের আলোয় বিষণ্ণ দেখায় তরুবালার মুখ। দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে সে বলে, এই দিকের হাটে অনেকে তোমারে চেনে। কমবেশি কেনাবেচা হয়। পাত্রসায়র গিয়ে কী করার আছে!
মাধব বলে, সেইটা যে ভাবিনি তা নয়। সব সময় মাথায় ঘোরাফেরা করে। সামনে চলো বলি।
শিমুলের চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া শিকড়ের ওপর বসে দুজন। সন্ধে আরও গাঢ়। বুড়োশিবের মেলার দিক থেকে আবছা একটা মাইকের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। সেখানে বসে মাধব বলে, কিছু দিন তুমি মামাদের ঘরে থাকবা। অল্প কিছু দিন। আমি দামোদর পেরিয়ে চলে যাব। নদীর ওই দিকে বর্ধমান। সেখানে কাজ অনেক। আর যদি দুর্গাপুর যাই তো কথা নাই…
সন্ধের অন্ধকারে তরুবালা হঠাৎ মাধবের হাত চেপে ধরে। ভারী হয়ে ওঠে গলার স্বর। বলে, দুর্গাপুর যারা যায় তারা আর ফেরে না। আমার বাবাও ফেরে নাই।
তার হাতের ওপর হাত রাখে মাধব। বলে, আমার জন্য ভাবনা নাই। ঠিক ফিরে আসব। তোমার টানেই হয়তো।
চৈত্রের বাতাস তখন আরও এলোমেলো। শিমুলের ডালে আবার একটা রাতচরা। অন্ধকারে চোখ বুজে ফেলে তরুবালা। তার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে চর। ধূ-ধু চর। চরের ওপাশে চিমনি আর ধোঁয়া ছড়ানো আকাশ। সেই হল দুর্গাপুর। দামোদরের বালি পেরিয়ে ধীরে ধীরে একজন হারিয়ে যাচ্ছে সেদিকে।
তরুবালা পেছন থেকে চিনতে পারে না লোকটিকে। একবার মনে হয় মাধব, তার ঘরের লোক। পরক্ষণে মনে হয় মাধব নয়, লোকটি তার বাবা। কুড়ি বছর আগে এভাবেই যে হারিয়ে গেছে ধোঁয়া আর চিমনির দেশে।
Posted in: December 2021 - Cover Story, STORY