একটি কুয়াশার বিবরণ : সমর দেব

আজ শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর। অমাবষ্যা শুরু বিকেল ৪-০২ মিনিটে, শেষ আগামীকাল, শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, দুপুর ১-৪৩ মিনিটে।
আজ বহুকাঙ্ক্ষিত অমাবষ্যা। আজ পাখিরা আত্মহত্যা করবে দলে দলে। সারাদিন ঘন কুয়াশায় ঢাকা সমস্ত চরাচর। সেই সঙ্গে লাগাতার ঝিরিঝিরি বর্ষণ চলছেই। ঘন কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা পড়েছে পাহাড়গুলো, ফলে তেমন স্পষ্ট করে নজরে পড়ে না কিছু। শুধু সিলুয়েটের মতো একটা আভাস পাওয়া যায়। আর, প্রবল বাতাস বইছে, যেন ঝড় উঠেছে। তুমুল বাতাসে বৃষ্টির সূক্ষ্ম ফোটাগুলো এমনভাবে উড়ছে, মাটিতে ধেয়ে আসছে যে, দেখে মনে হয় তুষারপাত হচ্ছে। কিন্তু তুষারপাত হবে কী করে, তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছিও নয়। মোবাইলে নেট সার্চ করে সে দেখে নিয়েছে বর্তমানে তাপমাত্রা প্রায় তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রবল ঠান্ডা ঠিকই, বলা যায় অসহনীয়, তবু তুষারপাতের কথা নয়। তাছাড়া, তুষারপাত হলে, অবরুদ্ধ আবহাওয়ায় তাপমাত্রা যেন খানিকটা বেড়ে যায়। ফলে, তেমন শীতের বোধ থাকে না। পরিবেশে একটা গুমোট স্তব্ধতা যেন আঁটোসাটো হয়ে বসে থাকে। সেরকম আবহাওয়া এখন নয়। তীব্র শীতের কামড়ে যেন ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে সমস্ত হাড়গোড়। অনেক হুজ্জোতি করে যখন এসে পৌঁছেছে তখন দুপুর ঠিক বারোটা। আগে থেকেই অনলাইনে বুক করে রাখা ছিল থাকার এই জায়গাটা। ফলে, কোনো অসুবিধে হয়নি। ঘরটা কাঠের টংঘরের মতো। ভেতরে তেমন ঠান্ডা ঢোকে না। ঘরের ভেতরে একটা লোহার পাত্রে আগুন রাখা আছে। একজন লোক সারাক্ষণ সেখানে কাঠ গুঁজে দিচ্ছে। আগুনের শিখা মাঝে মাঝে একটু দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে, তারপর ফের নেতিয়ে পড়ছে যেন। তবে, গনগনে আঁচ থেকেই যাচ্ছে। খানিক বিরতিতে ফের সেখানে কাঠ ফেলে দিচ্ছে লোকটা, জ্বলে উঠছে শিখা। ফলে, ঘরটা বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়ার এই অবস্থায় বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডার কামড়। প্রচণ্ড শীত যেন হাড়মাংস কামড়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। অনেকগুলো গরমের পোশাক জড়িয়েও বাগে আনা যায় না। একটু আগেই দরজার একটা পাল্লা একটু খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল অনিমেষ। হাওয়ার ঝাপটায় ঠান্ডা বৃষ্টির ছাঁট এসে লেগেছিল গায়ে, মুখে। তখনই টের পেয়েছে শীতের কামড় কী ভয়ানক। থরথর করে কাঁপছিল সে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, সাংঘাতিক ঠান্ডায় দাঁতের দুই পাটিতে যেন ঠকঠক করে আওয়াজ হচ্ছিল। তখন, সুমিতা বিছানার ওপরে পা ছড়িয়ে বসে ঘোলাটে কাচের জানালায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। কপালে চূর্ণ চুল খানিকটা এলোমেলো। ঠান্ডার প্রহারে ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে উঠেছিল। ফলে, তাকে দেখতে অপরূপ মনে হচ্ছিল। কিন্তু, সুমিতা কেমন গুম মেরে আছে যেন। কেন, জানে না অনিমেষ। জিজ্ঞেস করতে ভরসা হয়নি। বাড়িতেও মাঝেমধ্যে এমন দেখেছে। আগে এরকম হলে জিজ্ঞেস করত। এখন আর জানতে চায় না। কেননা, হয় স্পষ্ট করে কিছু বলবে না, নতুবা কেন জিজ্ঞেস করা হলো- তাই নিয়ে ঝগড়া করবে। খুব কম হলে, কোনো জবাবই দেবে না, একইভাবে গুম মেরে বসে থাকবে। অথচ, এখানে আসার আগে কেমন আগ্রহ দেখাচ্ছিল। এমনকি, আসার পথে এতটাই উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিল যে প্রায় প্রগলভ হয়ে উঠেছিল। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছিল। তারপর, এখানে এসে পৌঁছনোর পর ঘরটাও তার পছন্দ হয়েছিল। এটা অনেকটা স্টে-হোমের মতো। তবে, দেখভালের জন্য ওই একটি লোকই, মাইনে করা বোধহয়। লোকটা প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে না, বলেনি। যেমন জিজ্ঞেস করেছিল দুপুরের খাবার তো রেডিই আছে, রাতে কী খাবে? আয়োজন সে সবই করে রেখেছে, শুধু ইচ্ছেটা জানালেই হবে। প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও কারেন্ট আছে। আসলে পর্যটন কেন্দ্র বলেই এই প্রত্যন্ত গ্রামে কারেন্টের ব্যবস্থা করেছে সরকার। কারেন্ট আছে, অতএব ফ্রিজও আছে। ফ্রিজে মাছ, মাংস, ডিম, সবজি থেকে শুরু করে সবই মজুত করে রাখা আছে। মাটন আছে, আবার চিকেনও আছে। সুমিতাকে জিজ্ঞেস করেছিল রাতে চিকেন না মাটন। সে কোনো জবাব দেয়নি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল মাত্র। ফের তাকে জিজ্ঞেস করেছিল রাতে কী খেতে চায়। তাতে সে বলেছিল, কিছুই না। এসব হেঁয়ালি নতুন নয়। ঘরেও এরকম হেঁয়ালি সে করে প্রায়ই। ব্যাপারটা মোটেই এরকম নয় যে, তার স্পষ্ট কোনো মতামত নেই, তার কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই। কিন্তু, কোনো কোনো সময় সে কোথায় হারিয়ে যায় যে, তার সামনে কেউ আছে বলেও মনে হয় না। তাকে যে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে সেটাই যেন সে জানে না, বোঝেইনি। এমনকি, এরকম সময়ে সে নিজেও কোনো প্রশ্ন করে না, কিছু জানতেও চায় না। বাস্তবিকই সে এরকম সময়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। কেন কে জানে। একটু অপেক্ষা করে অনিমেষ নিজেই জানায়, রাতে মাটন হবে। লোকটা চুপ করে শোনে। ঘাড় নাড়িয়ে সামনে থেকে সরে যায়। ওপাশে এক চিলতে কিচেন। সেদিকে সে হারিয়ে যায়।
পাখিরা এখানে দলে দলে আত্মহত্যা করতে আসে। সেটাই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দূর দূর থেকে পর্যটকরা এখানে আসে, এই রহস্যের স্পর্শ পেতেই। নিজের চোখে পাখিদের গণ আত্মহনন দেখতেই আসে। তারা পর্যটক, দুদিনের জন্যই আসে। তারপর ঘরে ফিরে যায়। জাতিঙ্গার খোঁজ আর নেয় বলে মনে হয় না। শুধু স্মৃতিতে থেকে যায় পাখিদের দলে দলে আত্মহত্যার রহস্যটি। পরিচিতদের কাছে জমিয়ে গল্প বলে। বন্ধুদের সান্ধ্য আসর জমে ওঠে পাখিদের গণ আত্মহননের গল্পে। সকলে চোখ বড় বড় করে শোনে কাহিনি। আজকাল ইন্টারনেটের যুগে হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। এসব মোবাইলে যখন তখন নেট সার্ফিঙের সুবিধে আছে। আর, ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজতে থাকে জাতিঙ্গার সংবাদ। এভাবেই দুনিয়ার মানুষ এতদিনে জেনে গেছে এই সংবাদ। তবু, সংবাদ পেলেই তো হয় না। অনিমেষের ইচ্ছে হয়েছিল হাতে গরম অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের। কিন্তু সমস্যা তো তার একটা নয়। প্রথমেই অফিসে ছুটির প্রশ্ন। তারপর, ঘরদোর পাহারার জন্য কাউকে ম্যানেজ করা। প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা। গোছগাছ করা। থাকার জায়গা ঠিক করা। জাস্ট গিয়ে পোঁছলেই তো হয় না। তারপর রাত কাটাবে কোথায়? আর, গাদাগুচ্ছের টাকা। ইন্টারনেট থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে দেখে নিয়েছে নানা প্রয়োজনীয় তথ্যপাতি। যেমন, বছরের যে-কোনো সময়ে গিয়ে লাভ নেই। যেতে হবে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। শুধু তাই নয়, একটা রাত অন্তত সেখানে থাকতেই হবে সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখার জন্য এবং সেই রাত অমাবষ্যা হলেই ভালো। তখনই সবচেয়ে বেশি ঘটে সেই অলৌকিক ঘটনাটা। জায়গাটা খুব কাছেও নয়। গুয়াহাটি থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে, ডিমা হাসাও জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম জাতিঙ্গা। ডিমা হাসাও জেলার হাফলং শহর থেকে মোটামুটি নয় কিলোমিটার। জাতিঙ্গার অবস্থান উত্তুঙ্গ পাহাড়ের খাঁজে, যাকে বইয়ের পাতায় বলা হয় গিরিখাত। জায়গাটা মূলত খাসি-প্নার এবং ডিমাসা জনজাতি উধ্যুষিত। অন্যান্য কিছু মানুষ আছে নানা সম্প্রদায়ের। তবে, ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হয় না। সকলেই মোটামুটি হিন্দি জানে। ফলে, কাজ চলে যায়। সে পাহাড় লাইনের ট্রেনে লোয়ার হাফলং জংশনে নামবে এবং সেখানেই স্টেশনের বাইরে এসে অটো রিকশা ভাড়া করে নিতে হবে। অনেককে ফোন করে এবং ইন্টারনেট দেখে পুরো ভ্রমণসূচি সে স্থির করেছে। এই ঘরটাও সে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই আগাম বুক করেছে।
এখানে আসার পর থেকে আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তন নেই। একইভাবে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। একইভাবে তুমুল ঝোড়ো বাতাস এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে চলেছে। বৃষ্টির বিন্দুগুলো তির্যকভাবে এসে হমড়ি খেয়ে পড়ছে মাটিতে। ঘন কুয়াশার মতো আস্তরণে ঢেকে আছে সমস্ত চরাচর। খানিকটা দূরে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের ঢালে গাছের আভাস। আশপাশে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। বহু দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে দুয়েকটা ঘর। নীচের গিরিখাতে কিছু জনবসতি আছে। কিন্তু এই ঝড়জলের মধ্যে, ভয়ানক শীতের আবহাওয়ায় রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, থাকার কথাও নয়। মাঝে মাঝেই সে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইছে পরিবেশটা। ঘড়িতে দেড়টা বাজে। দেখভাল করার লোকটা একটু ইতস্তত করে বলে, বাবুজি, খানা লাগাও। অনিমেষ বলে, ঠিক হ্যায়। তারপর ছোট্ট টেবিলটায় একে একে আসতে থাকে গরম ভাত, মাংস, কিছু সবজি, অপরিচিত একটা ভাজি। সুমিতা একইভাবে জানালার পাশে বসে আছে। অনিমেষ বলে, চলো খেয়ে নিই। বাড়ির বাইরে অনেক দূরে বলেই কিনা কে জানে, এখন কিন্তু সুমিতা গোঁজ হয়ে বসে থাকলো না। সে উঠে ওপাশের বেসিনে হাত ধুয়ে এলো। হাতে ঠান্ডা জল লাগতেই সারা শরীর হুহু করে উঠলো। তাকে দেখে, হা হা করে দৌড়ে আসে কোলা নামের লোকটা। কিছুক্ষণ আগেই লোকটার নাম জেনে নিয়েছে অনিমেষ। কোলা বলে, ঠান্ডা জল ছোঁবেন না। আমি আছি তো। বললেই গরম জল এনে দেবো। অনিমেষ অবশ্য কোলার এনে দেওয়া গরম জলেই হাত ধোয়। খেতে খেতে অনিমেষ খেয়াল করে, প্রতিটি রান্নার দারুণ স্বাদ। কোলা জানতে চায়, ক্যায়সা লাগা? অনিমেষ বলে, বহুত খুব। কোলার মুখে তৃপ্তির হাসি। বলে, আপ লোগ খুশ তো ম্যায় ভি খুশ হুঁ।
খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নেবার পালা। কোলা বলে দিয়েছে, এখন একটু শুয়ে থাকতে। সন্ধ্যায় পাখিদের আত্মহত্যা দেখাতে নিয়ে যাবে সে। শুনেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অনিমেষের। দলে দলে পাখি আত্মহত্যা করবে আর সেটা মুগ্ধ হয়ে দেখবে তারা! কেমন গা গুলিয়ে উঠলো শুনে। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। ওপাশের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কোথাও চলে গেল কোলা। ঘরে দুটো বিছানা। তবু দুজনে একটা বিছানাতেই শুয়ে পড়ল। ভারী কম্বলের ভেতরে দারুণ ওম। বড় ভালো লাগছে। তবে, চোখ বন্ধ করা যাচ্ছে না। ঘরে আলো জ্বলছে। এই ভর দুপুরেও ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। হবেই তো, একেই জঙ্গুলে জায়গা, তার ওপর বাইরে সূর্যের আলো নেই। বাইরেটা সারাদিনই সন্ধ্যার মতো, হাল্কা একটা আলোর আভাস মাত্র। ঘরের ভেতরটা স্বভাবতই গাঢ় অন্ধকার। আলো ছাড়া উপায় নেই। ফলে, শুয়ে থাকলেও চোখ মেলেই থাকতে হচ্ছে। সুমিতা একেবারে নিশ্চুপ, পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সেই তখন থেকে একটিও কথা বলেনি। দুয়েকবার এক তরফা এটা সেটা প্রসঙ্গ তুলেছে অনিমেষ, কিন্তু সুমিতার কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে সেও অনেকক্ষণ চুপ করে আছে। এখন সুমিতা এপাশে ফিরল। অনিমেষ ভাবে, মেঘ কাটছে বোধহয়। পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে সম্ভবত। সে অপেক্ষা করে সুমিতা কিছু বলে কিনা শোনার জন্য। সত্যিই মুখ খোলে সুমিতা। সে বলে, পাখিরা যেমন আত্মহত্যা করে তেমন ভাবে আমিও যদি আত্মহত্যা করি?
চমকে ওঠে অনিমেষ। হঠাৎ এমন কথা কেন! বিশ্রী লাগে কথাটা শুনতে। কিন্তু সুমিতার কথার মানেটা আসলে কী বুঝতে পারে না। আশা করে, আরো কিছু বলবে সে। সুমিতা ফের চুপ। খানিক পরে বলে, খুব শীত।
অনিমেষ জবাবে বলে, হ্যাঁ, খুব শীত।
সুমিতা বলে, শীতের সঙ্গে মৃত্যুর একটা সম্পর্ক আছে মনে হয়।
অনিমেষ বলে, হ্যাঁ, বলেই তো, মৃত্যুর শীতলতা। সেটা তো সাহিত্যে। বাস্তবে বোধহয় আরও অন্য কিছু। যাক গে, এখন এসব থাক।
সুমিতা বলে, এলাম দুজনে, তোমাকে একা ফিরতে হবে।
অনিমেষ বলে, মানেটা কী! কী হয়েছে তোমার, বলো তো?
সুমিতা চুপ। সময় কেটে যায়। সুমিতা চুপ। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা কেটে যেতে থাকে, সুমিতা চুপ। অনিমেষের যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসে। সব আনন্দ এখন মাটি হবার জোগাড়। জানে না, আরও কীসব মুখ দিয়ে বেরবে সুমিতার। বেড়াতে এসে এসব শুনতে কার ভালো লাগে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কিন্তু কী বলবে ভেবে পেল না। দরজায় টোকার আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়ল অনিমেষ। ঘরে ঢুকলো কোলা। এখন সময় হয়েছে। সে রেডি হতে বলল। এখন সময় হয়েছে বাইরে বেরনোর। তাগাদা দিয়ে কোলা আবার কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।
দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো তারা। জাতিঙ্গায় এলে ছাতা আনতেই হবে জানাই ছিল। অতএব, তারা সঙ্গে এনেছে দুটো ছাতা। ডাকতেই ফের ঘরে এলো কোলা। তিনজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কাঠের টংঘরটায় ওঠা-নামার জন্য কাঠের সিড়ি আছে। সিড়ি ভেঙে তারা নেমে এলো মাটিতে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। একটু দূরে বড় বড় গাছও আছে। বৃষ্টি এখন অনেকটাই ধরে এসেছে। তবে, বাতাস বইছে সেই আগের মতোই। কুয়াশা আরও বেড়েছে, কমে গেছে দৃশ্যমানতা। ফলে, অল্প দূরের বস্তুও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। সব কেমন ছায়া ছায়া, মায়া মায়া যেন, নরম, ভেজা ভেজা, মেদুর, করুণ। দূরে দূরে আগুন জ্বেলেছে কারা। কোলা বললো, গ্রামবাসীরা এভাবে আলো জ্বেলে রাখে। তাতেই এসে ঝাঁপ দেয় পাখিরা। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেলো, আশপাশে বেশ কয়েকটি জায়গায় আগুন জ্বলে উঠেছে। এসব আগুন জ্বালিয়েছে গ্রামের মানুষরা। আরও অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল অধীর প্রতীক্ষায়। তারপর আকাশ কালো করে কোত্থেকে উড়ে এলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। তারা সন্ধ্যার অন্ধকারে কুয়াশা ঘেরা আকাশে উথালপাথাল উড়ছে, উড়ছেই। ঘুরির মতো পাক খাচ্ছে। হঠাৎ করেই কেউ কেউ কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে নেমে আসছে মাটির কাছাকাছি। আগুনের ওপরে এসে পড়ছে ঝুপ করে। আগুন ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা চার-পাঁচজন লম্বা বাঁশ নিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করছে। আগুনের কাছাকাছি চলে আসা পাখিরা বাঁশের আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে। কিন্তু পাখিরা মোটেই পালাচ্ছে না। আরও অনেক পাখি এসে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করে ফেলছে। আরও আসছে, আরও, আরও। গ্রামবাসীরা লম্বা বাঁশের প্রহারে পাখিদের একের পর ধরাশায়ী করছে। তাদের তুমুল উল্লাসের আওয়াজ আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ সুমিতা বলে, চলো।
তার দিকে বিস্ময়ে তাকায় অনিমেষ। এই দেখতেই এতদূর থেকে এত ঝক্কি ঝামেলা করে আসা। মাত্র দুদিনের জন্য। কপাল ভালো যে, একদিন অমাবষ্যা পাওয়া গেছে। কালকেও এখানে থাকবে তারা। পরশু রওনা হবে বাড়ির পথে। তো, হাতে সময় খুবই কম। ফলে, অনিমেষের ইচ্ছে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা। সে একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি নয়। অথচ, সুমিতা চলে যেতে চাইছে। কীই বা হবে টংঘরটায় ফিরে গিয়ে। রাতে তো একটাই কাজ, খাওয়া। তারপর ঘুম। আর, এই ভরসন্ধ্যায় টংঘরে ফিরে গিয়ে সময় কাটাবে কী করে! শীতের এই রাতটা কাটবেই বা কী ভাবে। সে বলে, এখনই ফিরবে? কেন?
সুমিতা বলে, আমার ভালো লাগছে না।
-ওই নির্জন ঘরটায় ফিরে এখন কী করবে? সময় কাটবে না তো। জাস্ট শুয়ে শুয়ে এত লম্বা একটা রাত কাটানো সম্ভব?
সুমিতা একটিও কথা বলে না। সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনিমেষ বুঝে যায়, সুমিতাকে বলে কোনো লাভ নেই। দারুণ মনখারাপ হয় তার। তীব্র হতাশার বোধে বিষিয়ে ওঠে সমস্ত মন। কী দরকার ছিল, এক ঝামেলা করে, এতগুলো পয়সা খরচ করে আসার! সবটাই জলে যাবার মতো। একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এটাও তার জানা যে, ভেবে লাভ নেই। যেমন সুমিতাকে বোঝানো অসম্ভব। সে সন্দিগ্ধ চোখে দেখে সুমিতাকে। কী করণীয় বোঝে না। বাধ্য ছেলের মতো সুমিতার কথায় সায় দেয়। কোলাকে বলে, সুমিতার শরীর খারাপ করেছে। তারা টংঘরে ফিরে যাবে। কোলা আর কী করে। সেও তাদের সঙ্গে ফেরে। তখনও গ্রামবাসীদের অগ্ন্যুৎসব চলছে। তখনও গ্রামবাসীদের উল্লাসের আওয়াজ ভেসে আসছে। তখনও গ্রামবাসীদের হাতে হাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল। যেন অকালে দীপাবলির উৎসবে মেতেছে এই গ্রামটি। এখন টংঘর থেকে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল আলোর অসংখ্য বিন্দুতে উছলে উঠেছে সম্পূর্ণ গ্রাম। এরপর বসবে ভোজসভা। পাখির মাংসে গ্রামবাসীদের রসনা সিক্ত হবে। অনিমেষেরও এখন মন খারাপ এসব ভেবে। কোলা বলেছে, এই রাতে প্রেতাত্মারা নেমে আসে পাখি হয়ে। তারা গ্রামের সর্বনাশ করতে আসে। সেজন্যই গ্রামবাসীরা পাখিরূপী প্রেতাত্মাদের পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। যুগ যুগ ধরে এটা চলছে। গ্রামবাসীরা এখনও প্রেতাত্মাদের কোপ থেকে রক্ষা পায়নি। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সর্বনাশ বয়ে আনে পাখিরূপী প্রেতাত্মারা। অথচ, তীব্র শীত, কুয়াশা, ঝোড়ো হাওয়া মিলিয়ে এই গিরিখাতে যে পরিবেশ রচিত হয় তাতে সকলেরই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার কথা। সুমিতার মন যে আক্রান্ত সেটা দুপুরের দিকেই খেয়াল করেছে অনিমেষ। এখন তারও মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। কিছুই ভালো লাগছে না। মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগছে। কপালে চিনচিন করছে একটা চাপ। বিশ্রী লাগছে। এই রাত কীভাবে কাটবে কে জানে! ভাবতেই আরও মন খারাপ হয়ে আসে।
ঘড়িতে রাত আটটা বাজতেই চলে আসে কোলা। সে জানতে চায়, এখন খাবার দেবে কিনা। কিছুই করার নেই। অতএব, অনিমেষ সম্মতি জানায়। খাবারগুলো গরম করে আনে কোলা। তারপর মাটন সহযোগে খায়। কিন্তু এখন জিভে কোনও স্বাদ পায় না। অনিমেষ গোগ্রাসে খানিকটা গিলে ফেলে। সুমিতাও সামান্য খায়। তারপর দুজনেই নিঃশব্দে উঠে পড়ে। কোলা এটা সেটা গুছিয়ে চলে যায়। যাবার সময় বলে, কাল খুব সকালে সে আসবে। ফ্লাস্কে গরম জল রাখা আছে। কোনও অসুবিধা হবে না। সে পাশেই থাকে। এসব বলে সে চলে গেল।
তারপর রাত। আরও গভীর হয়ে আসে। গ্রামের উল্লাস থেমে গেছে বহুক্ষণ। শুনশান চরাচর। মন খারাপ সত্ত্বেও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে অনিমেষ। সুমিতাও হয়ত। রাত আরও গভীর হয়। আরও বাতাস বইতে থাকে। কুয়াশা আরও ঘন হয়ে আসে। অন্ধকার আরও নিশ্ছিদ্র হয়ে আসে। সবটাই তাদের অগোচরে। খুট করে একটা আওয়াজ হলে আকস্মিক ঘুম ভেঙে যায় অনিমেষের। সে টর্চ জ্বালে। পাশে সুমিতা নেই। ইউরিনালে গিয়েছে বোধহয়। সে অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করতেই থাকে। যেন অনন্ত সময়ে কেটে যেতে থাকে। একসময় বিছানা ছেড়ে ওঠে অনিমেষ। হাড়কাঁপানো ঠৎান্ডার মধ্যেই ইউরিনালের দরজায় আলতো স্পর্শ করে। সেখানে টর্চের ফোকাস করে দেখে শূন্য। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। সুমিতা কোথায়? মৃদু কণ্ঠে সে ডাকে-সুমিতা? কেউ সাড়া দেয় না। ফের ডাকে। তবু সাড়া নেই। সে ডাকতেই থাকে ক্রমাগত। কেউ সাড়া দেবার মতো নেই বোধহয়। কী করবে সে! উথালপাথাল ভাবতে থাকে। অন্ধকার ঘরে ভূতের মতো সে অনন্ত অপেক্ষা করে যেন।
ভোর হবার আগেই দরজা ঠেলে ঢোকে কোলা। ছ্যাঁত করে ওঠে বুকের ভেতরে। দরজাটা তাহলে আবজে রাখা ছিল! সে বিস্মিত হয়। কোলা ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না। অনিমেষ তাকে অপলকে দেখে, দেখতে থাকে। সেও প্রশ্নহীন স্তব্ধতায় ডুবে যেতে থাকে। অনেক পরে কোলা বলে-ওই খাদের নীচে। অনেক লোকজন। পুলিশ এসেছে। ‘আপ চলিয়ে বাবুজি’।
অনিমেষ সত্যি সত্যিই একাই ফিরবে।

Facebook Comments

Leave a Reply