পুংলিঙ্গ : শান্তনু ভট্টাচার্য

কবেকার সেই পুরোনো গন্ধটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজ নিজেকে একটা মাছি বলে মনে হচ্ছে—যদিও আমার এই মনে হওয়ার মধ্যে নতুন কিছু নেই। অনেকেরই নিজেকে অনেক কিছু মনে হয়। আমার এক গুরুজন, একসময় সে নিজেকে বাঘ ভাবত। আবার কখনো তার মনে হত, সে একটা সাদা ঘোড়া। কখনো আবার সে বলত, আমি একটা হলুদ প্রজাপতি।
থাক ওসব কথা, আমি বরং এখন আমার মাছি হয়ে ওঠার পিছনের ঘটনাটা বলি : সে-দিন সন্ধ্যাবেলা, আমি ভাত খাচ্ছিলাম মেঝেতে বসে, ডান পা ছড়িয়ে, বাঁ-পা ইংরাজি বর্ণমালার প্রথম অক্ষরের আকারে হাঁটু থেকে মুড়ে। তখন পা গুটিয়ে বসে খাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমি। বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে আধা ইঞ্চি উঁচুতে হাড়ের ওপরে তখনও দগদগ করছে ক্ষতটা, চারপাশে কুঁকড়ে থাকা সাদাটে চামড়ার মাঝে লাল গর্তের নীচে তখন টনটনে যন্ত্রণা। সবরকম স্পর্শ থেকে ওই থেঁতলানো ছাল-মাংসকে বাঁচাতে আমি নতুন নতুন উপায় খুঁজে আনার চেষ্টা করছি তখন। সেসব চেষ্টার মাঝেই একবার একটু অসাবধানে চৌকাঠে পা ঠুকে যেতে বুঝেছিলাম, একটা জীবন্ত মানুষের গলায় ছুরি গিঁথে দিলে মানুষটার মাংস-মজ্জায় ছড়িয়ে পড়া অনুভূতিটা ঠিক কেমন!
মাথা থেকে সদ্য ঢেলে আসা চৌবাচ্চার জল তখনও দানা দানা হয়ে ছড়িয়ে আছে আমার পিঠে-বুকে। ভেজা মাথা থেকে একটা-দুটো জলরেখা তখনও নেমে আসছে ঘাড় ছুঁয়ে কাঁধে, কপাল ছুঁয়ে গালে। বাটিতে থাকা সব ডাল আমি ঢেলে নিলাম ভেঙে আনা ভাতের স্তূপে। ডাল মাখা দু-তিন দলা ভাত গালে তোলার পর ঘড়ির দিকে তাকালাম। আমাদের অনেক কিছু বেহিসেবি হয়ে এলেও সাদা দেওয়ালে লেপ্টে থাকা ঘড়িটা এখনও তার দায়িত্ব মতো সঠিক সময় জানিয়ে যায় ঘণ্টা বাজিয়ে—ঘড়িতে তখন সাড়ে ছ-টা। হাতে অবশিষ্ট থাকা অতি মূল্যবান সময়টা অপচয় না করার চেষ্টায় হলদে ডাল-ভাতের ওপরে উলটে নিলাম ট্যাংরা মাছের লালচে ঝোল ভর্তি বাটিটা। আলুর টুকরো দুটো আঙুলের চাপে ভেঙে মিশিয়ে নিলাম ভাতের সঙ্গে। মাছের ছোটো শরীরে তর্জনী রেখে মেরুদণ্ডের ওপর থেকে খুবলে আনা মাংস গালে ফেলে খেয়াল করে দেখলাম, ডাল-ঝোলের মিশেলে থালায় ছড়িয়ে থাকা ভাত এমন এক রঙের হয়ে উঠেছে, যে-রঙ আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
আমি যখন জিভে-দাঁতে মাছ নিয়ে ভাত দেখছিলাম, তখন হঠাৎ শিরশিরিয়ে উঠল বাঁ-পায়ের লাল গর্তের গভীরে। যন্ত্রণার সঙ্গে শিরশিরানির যোগফলে এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হল শরীরে। তাকিয়ে দেখলাম একটা মাছি বসে আছে গর্তের মাঝে, যেন রক্তমাংসের নোনা স্বাদ নিতে পায়ে-শুঁয়োয় মাংস খুবলে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে আরও নীচে নামার! আমি মেঝেতে পা ঠুকলাম, আঙুল নাড়ালাম। উড়ে চলে গেল মাছিটা। আমি কপ কপ করে ভাত তুলে চললাম গালে। একটু দূরে বসে আমার খাওয়া দেখছিল দুজন—আমার পোষা বিড়াল ভানু, যে বসে ছিল আমার পাতে রেখে যাওয়া মাছের কাঁটা, এঁটো ভাত পেটে পোরবার মতলবে; এবং ভানুর পিঠ থেকে দেড় হাত দূরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল শ্রীযুক্ত ভরতচন্দ্র, সম্পর্কে যে আমার বাবা। আমি উঠে গেলে থালা-বাটি-গেলাস যে তুলে নেবে মেঝে থেকে। যে-যত্নে সে ভাত-ডাল-মাছ রান্না করেছে, যে-যত্নে সে ভাত-ডাল-মাছ সাজিয়ে দিয়েছে মেঝেতে, সে-যত্নেই সে কুয়োতলায় গিয়ে মেজে-ধুয়ে ঝকঝকে করে তুলবে থালা-বাটি-গেলাস।
খাওয়া যখন অর্ধেক, পাতে তখনও ক-দলা ভাত, আবার সুড়সুড়িয়ে উঠল পায়ের লাল ক্ষতস্থানে। তাকিয়ে দেখলাম, আবার এসেছে মাছিটা। আমি মেঝেতে পা ঠুকলাম তীব্র আক্রোশে। বাবা সামনে না থাকলে ভানুকে সাক্ষী রেখে ঘর কাঁপিয়ে যে-খিস্তিটা দিতাম, তা উচ্চারণ করলাম বিড়বিড়িয়ে। মাছিটা উড়ে গেল বটে, তবে রাগে বুদ্ধি হারিয়ে মেঝেতে পা ঠোকার আহাম্মকিতে ব্যথাটা ফিরে এল প্রায় দ্বিগুণ মাত্রায়। অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞ আমার বাবা বুঝল ব্যাপারটা। বলল, এটা একটা কানামাছি। পথ হারিয়েছে।
প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট দূরত্ব থেকে মাছির দৃষ্টিশক্তি বিচার করে, সেটাই তার পথ হারানোর কারণ হিসেবে তুলে ধরায় সে-দিন বুঝেছিলাম, আরও অনেক কিছুর মতো মাছি সম্পর্কেও বাবার অভিজ্ঞতা নেহাত কম নয়! কিন্তু পথ হারানো অন্ধ মাছি বার বার কীভাবে একই জায়গায় এসে বসছে, তা আর বাবাকে জিজ্ঞাসা করিনি শুধু হাতের মুঠোয় সময় কম থাকার কারণে নয়, বুড়ো লোকটার সঙ্গে কথায় জড়ানোর ইচ্ছা না হওয়ার কারণেও। ঘরে আর দশটা মানুষ থাকলেও তাদের কানে পৌঁছোবে না, কাছে এসে এমনই স্বরে বাবা জানতে চাইল, পা-টা জখম হল কবে ও কী করে!
সকাল থেকে আকাশ অন্ধকার হয়ে ওঠা অবধি কাটিয়েছি মান্না কোম্পানির চাল-ডাল-তেল-নুনের রাক্ষসে গুহার মতো গোডাউনে; পুরোনো স্টকের সঙ্গে নতুন স্টকের গ্রাম-কিলোগ্রামের হিসেব মিলিয়ে এসে তখন তামাটে আলোর এই ঘরটাকে আমার মনে হচ্ছিল আরেকটা গুহা।
রাতে ডিউটি করব আলি গার্মেন্টসে; তার আগে একবার করাত কলে যাব, কাল বিকালে ওদের কিছু খুচরো কাজ আছে—বাবার জোড়া প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে বললাম এই কথা দুটো, যার দ্বিতীয়টা সত্যি হলেও, প্রথমটা মিথ্যা। বাবা একটাও প্রশ্ন না রেখে সম্মতি জানাল বাঁদিকে অনেকটা মাথা কাত করে। কাঁচা পয়সা আমদানির সম্ভবনা দেখলে লোকটা সাধারণত আর কিছু জিজ্ঞাসা করত না।
করাত কলের কাজ মিটিয়ে সে-দিন আমি গিয়েছিলাম শশাঙ্কর কাছে। শশাঙ্ক আমার অনেক দিনের বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু। তবে শশাঙ্ক ভালো ছেলে নয়। শহর থেকে একটু দূরে হাঁস-মুরগির ছোটো এক পোলট্রিতে কাজ করে শশাঙ্ক। মাসে এক দিন বা দু-দিন বাড়ি ফেরে। চাকরি থেকে যে-টাকা আয় করে, তার বেশ কিছুটা সে খরচ করে মদে, তাসের জুয়ায়, এবং অন্ধকার গলির ঘুপচি ঘরের বিছানায়। বাড়ি থেকে দূরে কাজ করতে যাওয়ায় শশাঙ্কর সঙ্গে আমার দেখা হয় কম। যখন ও বাড়ি আসে এবং সুযোগ পায়, তখন ডেকে নেয় আমাকে। শশাঙ্কদের সাত-শরিকি ভাঙা বাড়ির তিন তলার ঘরে শুয়ে-বসে ওর নিষিদ্ধ আমোদের বর্ণনা শুনি আমি। শশাঙ্কর ক্যানকেনে স্বরে ওই গল্পগুলো শোনাই আমার একমাত্র নেশা। অনেকরকম কাজে-অকাজে নিজেকে জ্যান্ত রেখে আমি অপেক্ষা করি, কবে শশাঙ্ক আসবে, আমায় ডাকবে—ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে সে-দিনের আমন্ত্রণ অনেক আগেই দিয়ে রেখেছিল শশাঙ্ক।
রাতে, ধুলোবালি ছড়ানো মেঝেয় বসে শশাঙ্ক যখন মদ আর জলের মিশ্রণ তৈরি করে কাচের গেলাস ঠোঁটে তুলছিল বার বার, তখনও শিরশিরানি উঠছিল আমার পায়ের লাল ক্ষতের নীচে শিরা-ধমনীতে। ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দেওয়ালে ঝুলে থাকা বালবের হলদেটে আলোয় শশাঙ্কর নিষিদ্ধ-লোভনীয় আত্মকথা থেকে আংশিক মন সরিয়ে দু-তিন বার চোখ নিয়ে গিয়েছিলাম বাঁ-পায়ের ছেঁড়া-কাটা চামড়ার ওপর। আমার অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছিল, সেখানে কোনো মাছি ছিল না। ঘন রাতে নিশ্চিত হয়েছিলাম, আমার বাড়ি থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ চিনে উড়ে আসা কোনো কানামাছির পক্ষে সম্ভব নয়।
সে-দিন শেষরাত অবধি শশাঙ্কর গলায় তার নানান নিষিদ্ধ, রঙিন, উষ্ণ অভিজ্ঞতা শোনার পর ওর চৌকির শক্ত বিছানায় মাথার বালিশ কোলে আঁকড়ে আমি কোনো মাছির স্বপ্ন দেখিনি, শশাঙ্কর শোনানো কাহিনি থেকে উঠে আসা কোনো আমিষ স্বপ্নও নয়। কোনো স্বপ্নই সে-দিন তৈরি হয়নি আমার দু-চোখের সামনে। স্বপ্ন দেখেছিলাম তার পরের দিন। রাতে ভাত খেয়ে বিছানায় ওঠার আগে জল খেয়েছিলাম অনেকটা। ঘুম না আসায় আরও ভারী হয়ে উঠেছিল তলপেট। তলপেটের ভার কমাতে গিয়ে দেখি, আমাদের চার-পুরুষের ভগ্নস্তূপ বাড়ির দোতলার পুব কোণের সাড়ে তিন ফুটের পাঁচ-কোণা বিদঘুটে বাথরুমের ঘুলঘুলি দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সাদা, গোটা একটা চাঁদ। মনে পড়ে গিয়েছিল, আজ পূর্ণিমা। চাঁদে চোখ রেখেই আমি হালকা করে ফেললাম তলপেট, এবং চাঁদে চোখ থাকতেই মনে পড়ে গেল শশাঙ্কর নিষিদ্ধ বৃত্তান্তের একটা দুটো অনুচ্ছেদ। শরীরের নরম মাংস খণ্ডটা নিজেকে তপ্ত করে, শক্ত হয়ে মাথা তুলল উঁচুতে। আমি সেটা পাঁচ আঙুলে কামড়ে নাড়িয়ে চললাম ডান হাত। চাঁদের গায়ে চোখ রেখেই ফাটল ধরা মেঝেতে ছড়িয়ে দিলাম সাদা পলি। ঘামে বুক ভিজিয়ে, চাঁদ থেকে চোখ ফিরিয়ে, শ্বাস ওগরালাম অনেকটা। নীচে, দু-পায়ের মাঝে জমে থাকা খোলা দরজার ফিকে অন্ধকারে চোখ নামিয়ে মনে হল, যেন থুকথুকে সাদা ফুল ফুটেছে ছাই রঙের মেঝেতে। ভাবলাম, সারারাত ফুটিয়ে রাখি এই ফুল। এই ফুলের স্বাদ-গন্ধের লোভে যদি একটা অন্তত হলুদ প্রজাপতি আসে মাঝরাতে! যা ভাবলাম, তা-ই করলাম। যদিও তাতে প্রজাপতি এল না, মাছি এল। ঘুমের ভিতর। মাছিটা ভ্যানভ্যান করে চলল একটা দগদগে ক্ষতের ওপরে। সে-ক্ষত আমার পায়ে নয়, বুকে। অনেকক্ষণ ওড়াউড়ির পর একসময় আর দেখা গেল না সেই মাছিকে। ঘুমটাও সরে গেল চোখ থেকে। ঝুপ করে অনেকটা ভয় নেমে এসেছিল আমার বুকে। বুকে হাত এনে দুটো ভাবনায় ভাবিয়ে তুলেছিলাম নিজেকে—এক, রক্ত-মাংসের লোভে মাছিটা কি ডুব দিল বুকের ওই গর্তের গভীরে? দুই, আঘাতটা কিসের! আমার বুকে কি কেউ বুলেট ফুঁড়ে দিয়েছে?
পরের দিন একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি, তার পুরোনো, কোন কালের সেই কাঠের চেয়ারটার ওপর চার হাত-পা এক জায়গায় এনে দলা পাকিয়ে বসে আছে বাবা। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার বাবার গালে দাড়ি নেই। হরমোনের তারতম্যে দাড়ি-গোঁফ না থাকায় বাবার মুখে সবসময়ই কিছুটা বাড়তি উজ্জ্বলতা লেগে থাকত। মুখের সেই চাকচিক্যই বোধহয় তাকে করে তুলেছিল অতিরিক্ত রঙিন এক পুরুষ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রেমিকা-রক্ষিতাদের পরেও লোকটা আইনি বিয়ে করেছিল তিনটে। বিনা সন্তানে প্রথম দুজনকে বিদায় করে ঘরে এনেছিল আমার মাকে।
সেই রঙিন বাবা ঝুলঝুলে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। বয়সের ভার ও অনেক রং-বাহারি কৃতকর্মের ধকলে মানুষটার মুখ যেন তখন আর ঠিক মানুষের নেই, একটা বানর বা শিম্পাঞ্জির মতো হয়ে গেছে!
বানর, শিম্পাঞ্জি বা ওই জাতীয় কোনো প্রাগৈতিহাসিক বন্যপ্রাণীর মুখের সঙ্গে বাবার মুখমণ্ডলের মিল খোঁজার চেষ্টা না করে আমি বাথরুমে গেলাম। তলপেটের ভিতরে থাকা জলভরা থলিটা হালকা করতে-করতে ঘুলঘুলি দিয়ে আকাশে তাকালাম। ধবধবে সাদা আকাশে তখন ফ্যাটফেটে আলো ছাড়া কিছুই নেই। কিছু না থাকাটাই আমাকে মনে করিয়ে দিল আগের রাতে সাদা পলি দিয়ে মেঝেতে ফুল আঁকার কথা। বুঝে নিলাম, আজ সকালে বাবা জল ঢেলে মুছে দিয়েছে সেই ফুল।
আমার খুব হাসি পাচ্ছিল। ঘরে ফিরে বিছানায় ছড়িয়ে বসে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা আগের মতোই চোখ ফেলে রেখেছে আমার মুখে। মনে হল, আমি চৌকি ছেড়ে বাথরুমে গেলেও এমনই পলক না-পড়া দৃষ্টি বিছানায় ধরে রেখেছিল বাবা, আমি যে চৌকি থেকে নেমে ঘরের বাইরে গেছি, তা যেন চোখেই পড়েনি তার—আমার খুব মজা লাগল।
বাবাকে দেখে আমার মজা লেগেছিল এরপর আরেক দিন—বাবা সে-দিন সারাক্ষণ তার হাতে ধরে থাকা তালপাতার ভাঙা পাখাটা ডানে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিল। অনেক মাছি। মাছির ঝাঁক। মাছিগুলো যেন বাবার চারপাশে ভনভন করছিল কোনো পুরোনো শত্রুতার হিসেব মেটাতে! বাবা তার শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে বেপরোয়া হয়ে উঠছিল ক্রমশ। আমি বাবার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। দেখি, লোকটা শেষপর্যন্ত কী করে! হাসি চেপে রেখেছিলাম আমি।
খানিক পরে হাতের পাখা থামিয়ে আমার দিকে ফিরে বাবা বলল, আজকাল ঘরে এত মাছি আসছে কেন?
অসহায় দেখাচ্ছিল লোকটাকে। অনেক চেষ্টাতেও উত্তর খুঁজে না পেয়ে, শেষে একান্ত অনিচ্ছাতেই যেন প্রশ্নটা করে বসল আমাকে। উত্তরটা অনেক গভীর থেকে তুলে আনার ভান করলাম আমি। কিছুটা সময় হাতে নিয়ে গাম্ভীর্য আনলাম চোখে-মুখে, বললাম, এরা বোধহয় সব ব্লাইন্ড ফ্লাই, অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছায় রাস্তায় নেমেছিল, তারপর পথ হারিয়ে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসে পড়েছে।
আমার কলেজ গমনের বিদ্যা থেকে বানিয়ে নেওয়া ইংরেজি শব্দটার অর্থ যে কানামাছি, তা না বুঝলেও আমার প্রায় নিরক্ষর পিতা তার পুত্রের রসিকতাটা ধরে ফেলল। পালটা কথায় না গিয়ে আরও জোরে নাড়িয়ে চলল রঙ চটে কালচে হয়ে আসা হাতপাখাটা। মাছিগুলো ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কায় ভিড় ভেঙে এলোমেলো হয়ে গেলেও বাবা তার ডান হাতের গতি কমাল না, থামাল না। হাওয়া ছড়িয়ে চলল সারাঘর ঘুরে-ঘুরে। বরং ক্রমেই বাড়তে লাগল তার হাত-পায়ের বেগ। দু-একটা ঘর ছেড়ে গেলেও বেশিরভাগ মাছিই থেকে গেল ঘরের মধ্যে। এলোমেলো হাওয়ার দাপটে দিশেহারা হয়েই হয়তো ইচ্ছা থাকলেও তারা যেতে পারছিল না ঘরের বাইরে।
মাছি উড়ছিল, বাবা ছুটছিল—আমি রগড় দেখছিলাম। মজা লাগছিল খুব। শেষ-দুপুরের সেই মজা আমি আরও কিছুক্ষণ উপভোগ করতাম, কিন্তু তা করা হয়নি। আমাদের বিশ্বস্ত দেওয়াল ঘড়িতে ঘণ্টা বাজছিল ঢংঢঙিয়ে। আগে থেকে বার-তারিখ দাগিয়ে ঠিক করা একটা কাজে—ভুল বলা হল, কাজ নয়, এক অভিযানে সে-দিন বের হতে হয়েছিল আমাকে। সঙ্গে ছিল শশাঙ্ক। পরের দিন শশাঙ্ক ফিরে যাবে ওর চাকরির জায়গায়, তাই সে-দিনই ও সেরে ফেলতে চাইছিল ওর অভিযান। ঘটনাটাকে অভিযান বললেও, কী, কেমন এবং কোথায় সেই অভিযান শশাঙ্ক তখনও বলেনি আমাকে।
দু-একটা হাতের কাজ সেরে, ভরা বিকেলে রাস্তায় নেমে আমি হাঁটতে শুরু করলাম শশাঙ্কর সঙ্গে, সময় মেপে। দু-পা হেঁটে শশাঙ্ক আক্ষেপ করল, গতকাল জুয়ায় অনেকগুলো টাকা হেরেছি রে!
ভাবলাম, বলি, কেন জুয়া খেলিস শশাঙ্ক!…কিন্তু বললাম না, চুপচাপ হেঁটে চললাম ওর পাশে। মুখ দেখে ধারণা করলাম, খুব সম্ভব জুয়ায় টাকা খুইয়ে মানসিক চাপে আছে ও। আরও কিছুটা হাঁটার পর জিজ্ঞাসা করলাম, হ্যাঁ রে, আমরা কোথায় অভিযান করতে যাচ্ছি? কী অভিযান?
শশাঙ্ক কোনো উত্তর না দিয়ে হেঁটে চলল। আমি ভেবে নিলাম, জুয়ায় হেরে যাওয়া টাকার দুঃখে মনটা ভারী হয়ে উঠেছে ওর, হতাশা-আক্ষেপ সরাতে পারছে না মন থেকে।
অনেকটা হেঁটে আমরা বড়ো খালের ধারে গিয়ে থেমেছিলাম। শহরের ওই দিকটা আমি আগে কখনো যাইনি। শশাঙ্ক বিড়ি ধরাল। একটু দাঁড়িয়ে হুস হুস করে ক-টা টানে খানিকটা ধোঁয়া ওড়াল, বোধহয় অতটা হেঁটে যাওয়ার পরিশ্রম থেকে একটু বিশ্রাম নিতে চাইছিল বিড়ি ফোঁকার ছুতোয়। আমি আবার পুরোনো প্রশ্নটা রাখলাম। প্রশ্নটা কানে তুলে শশাঙ্ক সাঁকোয় পা দিল, ফ্যাকফেকিয়ে হাসল, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর জানাল না। ও আমাকে চমক দিতে চাইছে ভেবে আমি আর কোনো প্রশ্ন না তুলে ওর সঙ্গে পা মিলিয়ে চললাম। ধরে নিলাম, অভিযানে নামিয়েছে বলেই এতটা রাস্তা রিকশায় না এনে হাঁটিয়ে নিয়ে এল আমাকে।
সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল। হাঁটতে-হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিল, বাবা এখনও ফাঁকা ঘরে ছুটে-লাফিয়ে মাছি তাড়িয়ে চলেছে।…সাঁকো পেরিয়ে আরও অনেকটা হেঁটে শশাঙ্ক একটা ভাটিখানায় ঢুকল। এক বোতল দেশি মদ নিল, সঙ্গে নুন-লঙ্কা-মশলা মেশানো ছোলা সেদ্ধ। আমি পাশে বসে একটা-দুটো ছোলা তুলে গালে ফেললাম, আঙুলের আগায় নুন নিয়ে জিভে রাখলাম। অনেকটা হাঁটার কারণেই চিনচিন করছিল বাঁ-পায়ের ছেঁড়া চামড়ার তলায়। মাথা নামিয়ে, আলোর দিকে একটু পা তুলে দেখলাম, লালচে গর্তটা কেমন মরচে রঙের হয়ে উঠেছে!
বোতল ফাঁকা করে উঠে দাঁড়াল শশাঙ্ক। বলল, পেটে একটু মদ না পড়লে বুকে জোর আসে না।
দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা ছোলার এক কুচি খোসা আমায় অস্বস্তিতে ফেলেছিল খুব। সেটা আঙুলের খোঁচায় নামিয়ে এনে শশাঙ্কর চোখে চোখ রাখলাম। বুকটা কেঁপে উঠল ভিতর থেকে—শশাঙ্ক কি কাউকে খুন করতে যাচ্ছে!…প্রশ্নটা ছুড়েই দিলাম ওর দিকে। শশাঙ্ক হে হে করে হাসল। হাসির সঙ্গেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল সদ্য পেটে ফেলা দেশির টক গন্ধ। উত্তর দিল না শশাঙ্ক। নিস্তেজ আলোর ভাটিখানা থেকে বেরিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম মিহি অন্ধকার এক রাস্তায়। একটু আগে বুকে ঢুকে পড়া ভয়টা হঠাৎ বেরিয়ে যেতে স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম আমি। আরও কিছুটা হাঁটার পর শশাঙ্কর নির্দেশে থামলাম রাস্তার ছোটো এক বাঁকে। পাশেই ছিল মাথা ঝাঁকড়া এক গাছ। কী গাছ, বুঝতে পারিনি অন্ধকারে। শশাঙ্ক বলল, তুই এখানে দাঁড়া, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরছি।
শশাঙ্ক চলে গেল লম্বা লম্বা পায়ে। পুরোনো ভয়টা ফিরে এল আমার ফিনফিনে বুকে। শশাঙ্ক কি চুরি বা ডাকাতি করতে গেল?…আমি এটা-সেটা ভাবনা নিয়ে থেমে থাকলাম না-আলো, না-অন্ধকার রাস্তার বাঁকে। পায়ের চিনচিনানিটা যন্ত্রণার পর্যায়ে চলে যাওয়ায় একটু পরে সামনে মাটির একটা টিপিতে গিয়ে বসলাম। খুব মশা। হাঁটু ভেঙে বাঁ-পা তুলে নিলাম ডান পায়ের ওপর। অনেকটা চোখ নামিয়ে আনলাম খোবলানো ত্বক-মাংসের মাঝখানে। একটু দূরের উঁচু পোস্ট থেকে নেমে আসছিল পাতলা আলো, সেই আলোয় বুঝে উঠতে পারলাম না গর্তের ভিতরকার অবস্থা। পা নামিয়ে নিলাম মাটিতে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও মশার আক্রমণ থেকে বাঁচানো যাচ্ছিল না হাত-পা-নাক-কান। কিছুটা দূরত্বে এক জায়গায় অনেকগুলো জোনাকি তাদের গা থেকে আলো ছিটোচ্ছিল। আমি জোনাকি দেখছিলাম। আকাশ দেখছিলাম। দূরে, শশাঙ্কর হেঁটে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম বার বার।
হাতে ঘড়ি ছিল না, তাও অনুমানের হিসেবে বলা যায়, পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট পর ফিরে এল শশাঙ্ক। একটু যেন কাঁপছিল। তা পেটে থাকা মদের প্রভাবে, নাকি অনেকটা হাঁটাহাঁটির পরিশ্রমে, বুঝলাম না। ওই আবছা আলোতেও বোঝা যাচ্ছিল, কপাল-গাল-গলার মতোই ঘামে চিকচিক করছে বোতাম খোলা জামার নীচে লোম ছাড়ানো ওর কালো বুকটা। আমার চোখে চোখ রেখে লালচে ছোপ পড়া দাঁতে শশাঙ্ক খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠে বলল, শালা, অনেক দিনের ইচ্ছা মিটল…সবে উনিশ…আজই শিল ভাঙল…দারুণ…বুড়ো জ্যাঠাটাকে আগে থেকে হাত করা ছিল, সে-ই সব ব্যবস্থা করবে বলেছিল…তাও একটু টেনশনে ছিলাম…কিছু নোট খরচ করতে হল বটে, কিন্তু বহুত মস্তি এল।
কিনে আনা সুখ ও সাফল্য থেকেই সম্ভবত বিনা জিজ্ঞাসায় এতগুলো কথা শশাঙ্ক উগরে দিল আমার সামনে। আমি ওর ঘোলাটে চোখে চোখ রেখে সব কথা শুনলাম। একদলা গরম শ্বাস উঠে এল আমার বুক ঠেলে। ডান হাতের পাঁচ আঙুল গুটিয়ে ওর চওড়া বুকের মাঝখানে একটা আলগা ঘুসি মেরে বললাম, হারামি, একা গিয়ে ফুর্তি মেরে এলি, আর আমি এখানে বসে-বসে আকাশের তারা গুনলাম! এক বারও তোর আমার কথা মনে পড়ল না!
ওকে আমি কুকুরের সঙ্গে তুলনা করলাম। কুত্তার বাচ্চা। খুব বিচ্ছিরি একটা খিস্তি দিলাম। আমার তেতে ওঠা এবং সবে সেরে আসা ওর কাজের সঙ্গে চরম মিল থাকা খিস্তিটা শশাঙ্ককে যেন বেজায় খুশি করল। আমাকে প্রায় বুকে জাপটে ধরে বলল, তোর এত ইচ্ছা, তুই তো আমাকে আগে বলবি! চল-চল, আরেকটা আছে, সেটা পরের বারের জন্য রেখেছিলাম। আজ তুই ওটা বউনি কর।
বাতাস জমে উঠছিল আমার ফুসফুসে। দেহ-মনের উত্তেজনা, নাকি হাঁটার গতিতে, কেন কে জানে, ঘামে ভাসছিল আমার বুক-পিঠ। কিছুটা হেঁটে আমায় থামাল শশাঙ্ক। হনহনিয়ে হেঁট গেল সামনে, একটু দূরে একচালা এক বাড়ির দিকে। আমি দেখছিলাম, দাওয়ার কোণে দাঁড়িয়ে শশাঙ্ক কথা বলছে একজনের সঙ্গে। লোকটা কোমর থেকে কুঁজো। তার হাতে ধরা হারিকেনের আলোতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, লোকটার মুখ তার শরীরের মতোই অদ্ভুত রকমের ভাঙাচোরা। বেঁকেচুরে যাওয়া ওই বুড়োর খুব কাছে দাঁড়িয়ে শশাঙ্ক চাপা স্বরে কথা বলে যাচ্ছিল। কী বলছিল, ওর ওপর নজর রেখে আমি অনুমান করছিলাম তা।
হারিকেন হাতে পা ঘষে-ঘষে ঘরের ভিতরে চলে গেল বুড়োটা। তখন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল শশাঙ্ক। ধনুকের মতো বাঁকা চেহারার বুড়ো লোকটা কয়েক মিনিট পর আবার এসে দাঁড়াল শশাঙ্কর সামনে। শশাঙ্ক ঘাড় নাড়ছে। পকেট থেকে টাকা বের করে গুনছে। গোনা নোট তুলে দিল অস্থিসার লোকটার হাতে। তারপর প্রায় দৌড়ে এল আমার কাছে। আমার একেবারে বুকের কাছে এসে আগের মতো খ্যা-খ্যা করে হাসল; বলল, কথা হয়ে গেছে, চ। বুড়ো সব রেডি করে ফেলেছে। এবার তুই গিয়ে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দে।
শশাঙ্কর হাসি আর থামছিল না। আমার বাঁ-পায়ের লাল গর্তের গভীরে টনটনানি বাড়ছিল। ভাবলাম, গর্তের চারপাশে একটু আঙুল বুলিয়ে নিলে আরাম পাব। কিন্তু সুযোগ হল না সেই আরাম নেওয়ার। একসঙ্গে হাঁটা শুরু করেও আমাকে পিছনে ফেলে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল শশাঙ্ক। হাঁটার উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছিল, যেন আমি না, ও-ই আবার খেলায় দান ফেলতে যাচ্ছে। শশাঙ্কর প্রতি কৃতজ্ঞতায় হালকা হয়ে এল আমার মন, ফিসফিস করলাম নিজের কাছে—আমাকে পুরুষ প্রমাণের দায়িত্বটা কত আন্তরিকতায়, কত আগ্রহে তুই পালন করছিস শশাঙ্ক!
বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শশাঙ্ক আমাকে উপদেশ দিল, ভয় পাবি না, অন্য কিছু ভাববি না।
অভিজ্ঞ শশাঙ্কর উপদেশ মাথায় ভরে আমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছিলাম। পিছন ফিরে, খোলা পাল্লা ভেজিয়ে, শব্দ না করে তুলে দিয়েছিলাম ছিটকানি। একটুও ভয় করছিল না আমার। আমি ভুলে গিয়েছিলাম পায়ের মাংস ওপড়ানো ব্যথা। ছোটো তক্তপোশের এককোণে বসে একজন দেখছিল আমাকে। কুপির আলোয় স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল না তার মুখ। আমি এগিয়ে গেলাম তক্তপোশের কাছে। আমার দৃষ্টির সামনেই শরীরের একমাত্র ঢাকনাটা সরিয়ে সে পাতলা বিছানায় টানটান করল তার শরীর। ঠান্ডা মেঝেতে দাঁড়িয়ে আমি তৈরি করে নিলাম নিজেকে। না, আমার তপ্ত শরীরে তখন এতটুকু ভয় নেই, কিছু ভাবছিলাম না আমি।
আমি চলে গিয়েছিলাম তার অনেকটা কাছে। তার মুখে গিয়ে পড়ল আমার দৃষ্টি। শিউরে উঠলাম আমি—এ কি কোনো মানুষ, নাকি এক প্রেত!…দুলে ওঠা শরীর সামলে আমি চোখ নামিয়ে আনলাম তার বুকে। নড়ে উঠল আমার ত্বক-মাংসের তলায় থাকা হৎপিণ্ড, ফুসফুস,পাকস্থলী, পাঁজর, শিরা-ধমনীগুলো। স্বপ্নে দেখা আমার বুকের ক্ষতের মতো এই মেয়েটার বুকেও বোধহয় কেউ বুলেট বিঁধিয়ে দিয়েছে! লাল দগদগে ঘা থেকে উঠে আসছে কাঁচা রক্তের গন্ধ। আমি তার বুকে বুক নামালেই এই রক্ত মাখামাখি হয়ে যাবে আমার বুকে।
আমার সন্দেহ হল, গা ঘিনঘিনে এই থেঁতলানো মাংসের নীচে কি শরীর ডুবিয়ে আছে অজস্র কালো মাছি? যারা উল্লাসে খেয়ে চলেছে রক্ত-পুঁজ! আমি মেয়েটার শরীরে শরীর ডুবিয়ে কাঁপন তুললেই তারা সবাই উঠে আসবে ওপরে! তাদের আমোদপ্রমোদে ব্যাঘাত ঘটানোর শাস্তি মেটাতে তারা ছিন্নভিন্ন করবে আমার সারাশরীর।
মেয়েটার শরীর থেকে ছিটকে এলাম আমি। লাফিয়ে নামলাম তক্তপোশ থেকে। ছেড়ে রাখা প্যান্টে গলিয়ে নিলাম দুটো পা। মনে হয়, কেরোসিনের অভাবেই কমে এসেছিল কুপির আলো। জামাটা খুঁজলাম অন্ধকারে। শুনতে পাচ্ছিলাম মেয়েটার ডাক। অতি মরা গলায় সে আশ্বাস দিচ্ছিল আমাকে—এসো, চলে যেও না। অনেক সুখ দেব।…ছিটকানি খুলে, দরজা হাট করে আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম ঘরের বাইরে। ছুটে উঠোন পেরোলাম। পিছন থেকে শশাঙ্ক ডাকছিল আমাকে। খুব সম্ভব, দাওয়ার কোণে অন্ধকারে বসে ও বিড়ি টানছিল কোমর বাঁকা বুড়োটার সঙ্গে। আমি শশাঙ্কর কথা ভাবছিলাম না, ওই মেয়েটার কথা ভাবছিলাম না, নিজের কথাও ভাবছিলাম না। শুধু ছুটছিলাম। একসময় দমে টান পড়ায় ছোটা থামিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম জোর গতিতে, যাকে ছোটাই বলা যায়। বাড়ির দরজায় এসে ঘামে শরীর ভিজিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে খেয়াল করলাম, আমার গা খালি, জামা নেই। হুক খোলা থাকলেও কোমরেই আছে প্যান্টটা। কাঁপা পায়ে ঘরে এসে, জেলে যাওয়া আসামীর মতো নিঃশব্দে বসে পড়লাম বিছানার একপাশে। চেয়ারে কুণ্ডুলী পাকিয়ে বসে বাবা তাকিয়ে ছিল জানলার বাইরে অন্ধকারের দিকে। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে খুব ধীরে চেয়ার ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, খুব চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, কী হয়েছে রে! কী হয়েছে! কোথায় গিয়েছিলিস?
চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছা করছিল, বাবা, আমি আজ…
কিন্তু শেষ করতে পারিনি কথাটা। বাঁ-পায়ের মাংস খুবলানো গর্তের ভিতর শিরাগুলো যেন ছিঁড়ে-ছিঁড়ে যাচ্ছিল একটার পর একটা। অতি কষ্টে মাথা নামিয়ে দেখলাম, ইট-খোয়া-পাথরের খোঁচায় আধ কাঁচা মাংস থেকে রক্ত পড়ছে গলগলিয়ে।
বাবা আর কোনো প্রশ্ন না করে এগিয়ে দিল এক গ্লাস জল। আমার মনে হচ্ছিল, বাবার এই জল এগিয়ে দেওয়া, আসলে আমাকে ব্যঙ্গ করা। দাঁতে দাঁত চেপে ভাবলাম, আমার মতো শক্তিমান পুরুষকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শাস্তি দিতে বাবার গলাটা চেপে ধরি এখনই। অনেক দিনের পুরোনো ইচ্ছাটা মিটিয়ে ফেলি আজকেই!
এক হাতে ধরার ঝুঁকি এড়াতে আমি দু-হাতে ধরলাম গেলাসটা। অনেকটা জল খেলাম ঢকঢক শব্দ তুলে। জলের ধাক্কায় ব্যথা করে উঠল গলা। বাবা বলল, রক্ত মুছে শুয়ে পড়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আলগা হয়ে এল বুক; একটু আগে যা ঘটেছে, বাবা কি তা দেখে নিয়েছে স্বচক্ষে! অনেক অভিজ্ঞতা জুড়ে-জুড়ে বানানো তার জীবনের ছায়ায় তাই এখন আগলাতে চাইছে আমাকে!…তখন শশাঙ্কর দিকে ছুড়ে দেওয়া বিচ্ছিরি খিস্তিটা আমি বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করলাম ঠোঁটের ফাঁকে।
খালি গেলাসটা আমার হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বাবা বলল, আমি ভাবছি…
কোমর থেকে সোজা থাকা শরীরটা আমি ধপ করে ফেলে দিয়েছিলাম বিছানায়। আমি ভাবি, আমি ভাবছিলাম, আমি ভেবে দেখলাম— বাবার এইসব কথাগুলো সচরাচর শেষ হত না আমার শোনার অনিচ্ছা ও বিরক্তিতে। কখনো কখনো খুব ফিকেভাবে শেষ হলেও তা থেকে যেত আমার কানের বাইরে। ‘আমি ভাবছি’-টাও সে-দিন তলিয়ে গিয়েছিল আমার ঘুমের নীচে।
এখন বাবা ঘুমিয়ে আছে, আমি জেগে। জেগে আছি বলেই তো গুছিয়ে-সাজিয়ে, বাছা বাছা শব্দে বলে যেতে পারলাম এতগুলো কথা—কথাগুলো বড়ো নাটকীয় তাই না!
বাবা আজ যা করেছে, এখন বুঝতে পারছি, তা অনেক আগেই কোনো একদিন আমাকে জানাতে চেয়েছিল—আমি ভাবছি, আমি ভাবি, আমি ভাবছিলাম, কথাগুলোর শেষে। উদাসীন না থেকে কথাগুলো শুনে নিলে আজ আমাকে আক্ষেপ করতে হত না। লোকটাকে গলা টিপে না মারার আক্ষেপ আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর এইমাত্র চোখে পড়ল, বাবার গলায় যেখানে আমি আমার দু-হাতের দশটা গোলাপি আঙুল কামড়ে ধরতাম, সেখানে ফুটে উঠেছে আবছা একটা কালচে মোটা দাগ—বুঝতে পারছি, আমার সঙ্গে এটাই বাবার শেষ ঠাট্টাতামাশা। তা না হলে, আমার খুব পছন্দের, খুব কাজের মোটা কালো দড়িটা, যেটা দিয়ে মায়ের পুরোনো লোহার ট্রাঙ্কটা চিলেকোঠার কাঠে বাঁধতে গিয়ে সে-দিন দেওয়ালের ভাঙা গজালে বাঁ-পায়ের মাংস খুবলে গেল, সেই দড়িটা গলায় জড়িয়ে বাবা কড়িবড়গায় ঝুলে পড়বে কেন!
যে-লোকটা নিজেকে বাঘ ভাবত, কখনো মনে করত সে একটা ঘোড়া কিংবা হলুদ প্রজাপতি, তার গোঁফ-দাড়ি না থাকা বানর বা শিম্পাঞ্জির মতো মুখের ওপর এখন একটা-দুটো মাছি বসে আছে। আমার হাতের খুব কাছে বাবার সেই তালপাতার পুরোনো ময়লা পাখাটা। আমি ইচ্ছা করলেই হাওয়া ছড়িয়ে উড়িয়ে দিতে পারি মাছিগুলোকে। কিন্তু তা করব না। চারপাশে জমে থাকা মাংস পোড়া এই গন্ধটা, আমি চাই না তা উড়ে যাক হাওয়ার ঝাপটায়। কতদিন পর গন্ধটা আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে! আমি জানি, গলায় কালো দাগ নিয়ে শুয়ে থাকা লোকটা যে-গন্ধটাকে সারাজীবন ভয় পেয়েছে, গন্ধটার ছোঁয়া থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেরিয়েছে, আজ, এখন সেই গন্ধটা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে তার শরীরে। জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর শাস্তি ভোগ করছে বুড়ো লোকটা। ওকে যে-শাস্তি আমি দিতে পারিনি, সে-শাস্তি দিক ওই কালো মাছিগুলো—ওরা শুষে-খুবলে খাক ওর শরীরের সব রক্ত-মাংস। নিজেকে হঠাৎ মেরে ফেলার মজা পাক লোকটা!
ঝলসে কালো হয়ে যাওয়া আমার মায়ের ফর্সা শরীর থেকে উঠে আসা পোড়া মাংসের গন্ধ নিতে-নিতে এতক্ষণ খেয়াল করিনি, একটা মাছি বসে আছে আমার বাঁ-পায়ের শুকিয়ে যাওয়া মরচে রঙের চামড়ার ওপর। আমি কিছু করলাম না, খুব সাবধানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নামিয়ে আনলাম শুধু এটা নিশ্চিত হতে, মাছিটা অন্ধ। অন্ধ না হলে সে আরেকটা মাছির শরীর থেকে রক্ত খাওয়ার চেষ্টা চালায় কী করে!

Facebook Comments

Leave a Reply