ভাস্করদার গল্প : রঙিলী বিশ্বাস
এ গল্পটা ভাস্করদা থাকলে অন্যভাবে লিখতেন।বা বলতেন।এ কথাটাই আমার প্রথম মনে হয়েছিল।আজ সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।ফলে অন্য দিন যেসব পাখিরা আমার বাগানে চরতে আসে, কাগজফুল আর মাধবীলতার ডালে বসে মানেহীন দোল খায়, আর যাদের নাম আমি অনেকসময় গুলিয়ে ফেলি – পাখিদের নিয়ে আমার এই সমস্যাটা আছে, আমি ছাতারেকে দোয়েল বলি, বুলবুলিকে হাঁড়িচাচা, ফিঙেকে পাপিয়া – তারা আজ নেই।হয়ত তারা নেই বলেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে, জোলো হাওয়ার বওয়া-বওয়ির অন্তরালে, মাটির থেকে উত্থিত খসা পাতা/ না উইঢিবি/ না ছিন্ন শামুকখোল / না অন্য সবকিছু কে জানে তার মিশ্রিত ঘ্রাণের আবডাল থেকে ভাস্করদা আসেন আমার কাছে। বলেন- ‘মাননীয়াসু, ভালো আছেন?’
ভাস্করদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ কোথায় এখন আর মনে নেই।কিন্তু অনেক আলো ছিল, বহু লোকের চিৎকার ছিল চারপাশে, সুমন্ত একজনের সামনে গিয়ে বলেছিল, ‘এটা রঙিলীদি’, পরের মুহূর্তে সুমন্তকে আর দেখতে পাওয়া গেল না, আদ্ধেক কাজ করা ওর স্বভাব যেমন আমার স্বভাব পুরোটা না শোনা।ফলে দীর্ঘকায় লোকটিকে এক সময় জিগ্যেস করতে হল, উনিকে।উত্তর এলো, “আমার নাম গোবিন্দ ঘটক, মছলন্দপুরে বাস।আপনার লেখা আমি পড়েছি, আমার কথা হয়ত তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু আমি একটু –আধটু সাহিত্যচর্চা করি, আমাদের ওই লাইনে মানে শেয়ালদা-বনগাঁ লাইন ধরে অনেকেই করে, জানেন।”
সেই সন্ধ্যায় যতবার এদিক ওদিক ঘুরতে গিয়ে দেখা হল, উনি “আমাদের মছলন্দপুরে একবার আসুন, সাহিত্যচর্চা কেমন হচ্ছে দেখে যান” বলে মাথা খারাপ করলেন।অনেক পরে সুমন্ত কোথা থেকে ঘুরে এসে বলল, ‘তাহলে তো ভাস্করদার সঙ্গে আড্ডা জমে গেছে রঙিলীদি?’
“উনি আমাকে নিজের নাম গোবিন্দ ঘটক বলেছিলেন।”
সুমন্তর উচ্চকিত হাসির মধ্যে উত্তর এলো, ‘চিন্তা করবেন না, ওটা আমার আরেকটা নাম, আসলে আমাদের মছলন্দপুরে’-
এই পরিচয়ের পরে ফোনের পর্ব যে আশ্চর্যতর হবে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। “আজ রাস্তায় বেরোতেই দেখি সন্দীপন আসছে বকের মতো পা ফেলে, তাই ভাবলাম আপনাকে ফোন করি” – এই বলে ফোন এলো একদিন।এবং সে ফোন ঘণ্টা দুয়েকের আগে থামল না।গান, সাহিত্য, দর্শন এবং পৃথিবীতে-একটাকা- না ফেলতে- পারলে -লাইন- কেটে- যাবে – র চেতাবনি সামলালেন ভাস্করদা।
মেঘ ডাকছে দুপুর থেকে কিন্তু বৃষ্টি নেই এমন ঘামের বিকালে, আমি দুহাতের মুঠোয় চেপে রেখেছি মাথা এত যন্ত্রণা, ফোন বাজল আবার।
‘বলুন, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।’
‘আপনার কি মাইগ্রেন আছে?’
‘সে তো আছেই।’
‘আমার এত বন্ধুর মাইগ্রেন আছে যে কী বলব আপনাকে, মানে মাইগ্রেন ছাড়া আমার কোনো বন্ধু আছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।ওইজন্য আমার কবিতায় স্যারিডন থাকে।’
‘এটা আমারো মনে হয়েছিল আপনাকে দেখে’
‘মাসীমাকে দিন।’
অন্ধকার আর বৃষ্টি একসঙ্গে নামল তখন, ঘরে ডিমলাইটের অব্যাপ্ত আলো।আমার দুহাতের মধ্যে মাথার উন্মার্গগামী শিরা – ভেজানো দরজার মধ্যে দিয়ে মার কথা ঘরের ফাঁকফোকরে ঢুকছে –
“রঙিলী বলেছে আমি সিনোলজিস্ট? ওর কথাকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন? দেশটায় গিয়েছি, ইতিহাসটা পড়েছি -এইমাত্র।হ্যাঁ, লাওৎজা লাউজি দুটোই বোধ হয় ঠিক, উচ্চারণের তারতম্য হয়, আসলে ম্যান্ডারিন উচ্চারণের সঙ্গে এবিষয়ে কি আপনার বহুদিনের উৎসাহ? কনফিউসাসের সমসাময়িক বলেই তো জানি……।হ্যাঁ, লাওৎজা লাউজি দুটোই ঠিক, ম্যান্ডারিনে লাউৎসা হওয়াই উচিত…শোনা যায় জন্মেছিলেন সাদা চুল, অতি বৃদ্ধ এক রূপ নিয়ে।তারপর একদিন মোষের পিঠে চেপে চলে যান কোথায়, চারপাশ ছেড়ে, চারপাশে যে সভ্যতাকে দেখলেন তাকে সভ্যতা মনে হয় নি বলে…………’
মার গলা নিভে আসছে, গুন্গুনানিতে শেষ হচ্ছে কথা যার মধ্যে স্তব্ধতা, মৌন আছে।ঘুম আছে অধিকন্তু।যখন চোখ খুললাম – দু হাতের তেলো কপালে – এক-দুই শব্দ ঢুকল মাথার শিরার উচ্চাবচতায় – লং মার্চ, লং মার্চ।তারপর সে দীর্ঘতার ছায়া পড়ল অন্ধকারে, বৃষ্টি পান করল সে সম্মোহিনীকে, মনে হল টেলিফোন সরিয়ে রেখে ভাস্করদা একা একা বলছেন, আমিও রাস্তার কথা বলেছি, বলিনি কি? আবার রাস্তার কথা? যার বেঁকানো শিংয়ের কাছে খড় ঝোলে, আমাকে দূরে নেবে সভ্যতা থেকে যে, সে মোষের ফোলা পেটে চলকে পড়া পিচ্ছিল আলো- তাও আমার।আমার, আমাদেরও।
এপার থেকে দেখা গেল না।রাস্তায় বেরোতে দেখলাম।
‘কখন এসেছেন’
‘আধ ঘণ্টা, কী আরো বেশি’
‘এতক্ষণ?’
‘চেয়ে ছিল?’
‘শুধু চেয়ে থেকে ক্ষান্ত হয় নি, মেয়েদের জন্য ফুল কিনতে গেছে বিডন স্ট্রিটের মোড়ে।’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘আমিও গেলাম তো, কত যত্ন করে ফুল কিনছে, দেখলাম।’
‘আপনার কি কাজ নেই ভাস্করদা?’
‘ওটা বড় কাজ ছিল, এখন কফি হাউস যাব।সেটা আরো বড় কাজ।আপনার মাইগ্রেন, সে কেমন আছে?’
‘পরম প্রিয়জনের মতো আছে।’
‘শুনুন, আজ পুণ্যতিথিতে, ফাঁকা কফিহাউসে – বইমেলায় এত বিদ্বজ্জন যে দেখবেন আড়াইটা টেবিল মাত্র ভরা – আপনাকে বলতে চাই, মাইগ্রেনে আপনার যতখানি মন লেখায় তার সিকিভাগ ও নেই।’
“এসব বললে কি সুবিধা হবে?
“অসুবিধা করার জন্যই বলছিলাম, তাহলে যদি লেখাটা হয়, এখন তো বলতে পারছি, পরে আর নাও পারি, গলা বন্ধের ক’দিন নিজে থেকে সিগারেট কিনি নি, সামনে কেউ খেলে চেয়েছি-‘
‘আর দিয়েছে লোকে?’
‘বেশির ভাগই দিয়েছে, কেউ কেউ বলেছে ব্রহ্মহত্যা মহাপাপ জেনেও দিলাম।’
‘এই প্রতিভাবানেরা কারা?’
‘চিন্তা করবেন না।শান্ত কোনো অঘ্রাণের মতো গান দরকার এখন আমার, আবার কবে দেবেন ইফ্ফাত আরা খান?’
কাল রাত সাড়ে তিনটের সময় আমি একটা কেক খেয়েছি, শুনুন ম্যাডাম, ঘুমোতে গিয়েছি তারও পর, আমার ঘর, চোরাকুঠুরি, তাতে শান্ত হয়ে শুয়েছি, আজকাল নামি না বড়, বাড়ির অন্যদিকে যাই না, এলে দেখতেন অদ্ভুত দেশ, একেবারে আরেকটা ভূগোল আমার, একটা বড় মাপের কড়াই এর স্বপ্ন দেখি আমি মাঝে মাঝে, গাছের শুকনো বাকল আর কড়ার গায়ে লেগে থাকা ডালের মুছে নেওয়া ভাবি, ভাবি মা নিঃসাড় আসে যায় আমার রান্নাঘরে কখন।
খবরের কাগজ যা পড়লে বা না পড়লেও চলে, সারাদিন খাটে থাকে, আমি কড়ি বরগা দেখি, মন দিয়ে নখ খুঁটি, ডিঙি নৌকো আর ওইসব ডানাঝাপ্টানো শামুকখোল পাখিদের কথা মনে করি মাঝ দুপুরে। রোদ পড়ে গেলে মোমবাতির মতো মেয়েরা খয়েরি শাড়ি গায় ইস্কুল থেকে বেরোয়।আমি বাটিভর্তি মুড়ি দূরে রেখে ভাবি এত যে যুক্তিসিদ্ধ মন, তর্কের বাহার, কীহবে এসবে আর, জীবন তো খসখসে মেদবহুল অপ্রয়োজনে অঙ্গ উপড়ানো ডাক্তার এক, বরং চলুন কফির দিনগুলো খুঁড়ি, অভীককে ডেকে বলি রেলইয়ার্ডে শেষ কবে গিয়েছে এবার, শিবাজীর গুণাগুণের এক সর্বগ্রাহ্য তালিকারও এ-মুহূর্তে দরকার খুবই।
‘বাবা, তোমার কেবিনে এত বড়ো টিভি, তুমি সারাদিন দেখো, না?’
‘না, সারাদিন টিভিই আমাকে দেখে।আর ওই সোফাটা আর জলের গ্লাসের ঢাকা ওরাও দেখে।’
প্রৈতি বারান্দায় লাফাচ্ছে, সিঁড়িটা ঘোরানো নয় ততো, বিকালের যতটুকু হাওয়া তাতে ছায়া-ছায়া গাছের নিচে জৈষ্ঠ্যদিনে শাল-জড়ানো মানুষেরা ঘুরছে।বাসস্টপে ভেঙে যাওয়া পাথরের কোণ থেকে ধুলো-লাগা পাতার হঠাৎ উড়ে আসার মতো নির্ভার শব্দবন্ধে এঁটে আছে কবরডাঙা নামটা।
‘তোমার প্রেসক্রিপশন দাও, নার্স চাইছেন, ন’দি সকাল থেকে কাঁদছে, আজকেই এলো সবে, বারণ শুনছে না, নিয়ে এলাম, কিন্তু তোমার পা এরকম কেন, ওরা বলল আজ স্নান করিয়েছে, এটা কেমন স্নান, চামড়া উঠে গেছে যেন, দগদগে হয়ে গেছে, সিস্টার প্রেসক্রিপশন, সিস্টার আপনার, আমি কয়েকটা বিল মিটিয়ে আসছি, ন’দি থাকল একটু, সোফায় বোস না ন’দি, ওতো বলছে ভালো আছে, আমার সঙ্গে আসতে হবে না, কিন্তু পা- টা এমন কেন, এটা কীসের লক্ষণ?’
‘আমাকে চিনতে পারল না, আমাকেও চিনতে পারল না এমন একটা রাত-’
জানতাম সমুদ্রের শহরে যাচ্ছি।ঠাণ্ডায় বরফ পড়ে না, সবুজ অনির্ণেয় ঘাস শুধু জমে যায়।একাদশ শতকের শতচ্ছিন্ন দুর্গ পিঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মধ্যে – তার এপাশে বন্দর, হাওয়ালাগা মাস্তুল, অপেক্ষারত জাহাজ; ওপাশে রাস্তা, অতিদীর্ঘ ট্রামঘন্টি, বাদামি হওয়া বসন্তের গাছ।
অথচ আমার পাশে গঙ্গা ছিল এই সেদিন।কাঠকুটো ছিল বা ছিল না, মনে নেই।জলরাশির দিকে তাকালে সূর্য, তাই জল, জলবিন্দু উল্লম্ব লাগছিল। গঙ্গার পিছনে শ্মশান।আমি আগুন দেখছি না।বেদির উঁচু জায়গায় বসে শূন্যতা দেখেছি।
আগুনের দিকে কোলাহল, জনপদ।আর আমার অদূরে জানলাহীন ঘর।অপ্রশস্ত মেঝেতে শোয়া শব।তাদের মাথা ঠেকছে দেয়াল থেকে দেয়ালে,পা ফুঁড়ে উঠছে খণ্ডীকৃত ভিত।পুড়তে অপেক্ষমাণদের মধ্যে একা বসেছিলাম, তাই দাহ আর ধুলোর অন্তরাল থেকে ভাস্করদা এলেন।ভাদ্রবেলার রোদ-আকীর্ণ মুখে জলকণা, মনে হল ফেটে যাওয়া, থেঁতো হওয়া বটফল, তাতে রাঙানো হাত, অসংবৃত পায়ের শিরা গুচ্ছ গুচ্ছ লাল…
এখন এই নদীসর্বস্বতা থেকে বেরোতে চাইছি আমি, জলজ বাতাস আর পাখিদের নাম ভুলে যাওয়া থেকে বিরতি কিছুটা, জাহাজঘাটায় শিকলে শিকল ঘষার শব্দের মতো ঘুমহীন হয়ে যাচ্ছে চরাচর, ভাবি যদি খুঁজতেই হয় আর এভাবে খুঁজব না ভাস্করদাকে, প্রস্তরীভূত সময়ের অন্য কোনো ভাস্কর না হয় কিছুকাল খুঁজুক আমায়।
[‘পরের ট্রাম’ সাহিত্য পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত।]
Posted in: December 2021 - Cover Story, STORY