ইঁদুর, রাষ্ট্র ও ইত্যাদি : প্রলয় নাগ

ক্ষুধার্ত ইঁদুরদের রাষ্ট্রে কিছু মানুষ এখনও বেঁচে আছেন। তবে ওটাকে বেঁচে থাকা বলে না, নিজেদের কোনও ভাবে টিকিয়ে রেখেছে বলাই বরং ভালো।
ইঁদুরদের নিয়ে মানুষদের কোনওকালে মাথা ব্যথা ছিল না বলেই মানুষদের নিয়েও ইঁদুরদের কোনওরকম মাথা ব্যথা হয়নি। কিন্তু যবে থেকে ইঁদুরেরা উষ্ণ রক্ত-মাংসের স্বাদ পেল, ঠিক তখনই বিবাদের সূচনা।
ইঁদুরেরা নিজেদের মাংসাশী প্রাণীর তালিকাভুক্ত করতে উদগ্রীব হয়ে উঠল এবং প্রচলিত বিধিব্যবস্থায় তাদের মাংসাশী রীতিনীতিগুলো চালানোর জন্য তোড়-জোড় শুরু করে দিল।
চাইলেই তো একটা রাষ্ট্রের বিধি ব্যবস্থা পাল্টে ফেলা যায় না, তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সংবিধান সংশোধন, প্রয়োজন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধির সমর্থন। যার জন্য ইঁদুরদের আরও সময় অপেক্ষা করতে হল। ইঁদুরদের হাতে সময় ছিল, তারা অপেক্ষা করছিল একটা মোক্ষম সুযোগের। আর মোক্ষম সুযোগটাও একদিন আসে।
আর এই মোক্ষম সুযোগে তারা সমবেত হয়ে জিগির তুলল এবং কোটি কোটি ইঁদুরেরা সংঘবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক মহোৎসবে ভোটদান ও ভোট লুণ্ঠন পর্বের শেষে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি নিয়ে রাষ্ট্রপিতার কাছে দরবার শুরু করে দিল। রাতের আঁধারেই শুরু হল সংবিধান বদলে ফেলার কাজ।

ইঁদুরদের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া দেখে মানুষেরা রীতিমতো ভীত। ভয় পেল না কেবল মানুষদের মধ্যেই বসবাসকারী একটি আধাক্ষ্যাপা, যাকে মানুষেরা সমাজচ্যুত করে রেখেছে বহুদিন। ইঁদুরদের সঙ্গে তার সখ্যতা দেখে সকলের মস্তিষ্কে এই ধারণা শক্তিশালী হল যে, একমাত্র এই লোকটাই পারে ইঁদুরদের পোষ মানিয়ে মনুষ্য সমাজকে বাঁচাতে।
লোকটা যদিও অতিসাধারণ। কিন্তু লোকটাকে মানুষেরা কেন সাধারণের মধ্যে ফেলে না, বুঝি না। সাধারণের মতোই ওঁর চলাফেরা, কথা বলা। সাধারণের মতোই ওঁর ভেতর খিদে, সাধারণের মতোই ওঁর চাহিদা ও অভাব, দুটোই।
লোকটা ইঁদুরদের দেওয়া উপহারস্বরূপ গামছাকে নেংটির মতো পরে থাকে। শোনা যায়, লোকটার মানুষদের মতো একটা গোছানো সংসার ও কিছু প্রতিবেশী ছিল। কোথায় ছিল কেউ জানে না, তবে ছিল, ইঁদুরেরাও জানে।
মানুষের মধ্যে থেকে নির্বাসিত হয়ে লোকটা প্রথমে পাখিদের মতো গাছে বাসা বাঁধে। ডিমে ওম দেওয়ার মতো করে গাছের ডালে বসে নেংটিপরা গামছার ফাঁক দিয়ে তার দুটি পার্থিব আলু সদৃশ অণ্ডকোষ ঝুলিয়ে দেয়। আপনারা নিশ্চয়ই গেছো আলু দেখেছেন, ওই গেছো আলুর সঙ্গে লোকটার আলু সদৃশ অণ্ডকোষকে আলাদা করতে পারবেন না। এটাও বলে রাখি, মানুষের গলা যদি জিরাফের মতো লম্বা হতো তবে আলু দুটো প্রত্যেকের মাথায় ঠেকতো নয়তো, শিবঠাকুরের মন্দিরে ঢোকার মতো একবার করে সকলে ঘণ্টা নেড়ে দিয়ে বলতো ‘ভোলে বাবা পার করে গা।’

মানুষের পরিচালিত রাষ্ট্রে মন্ত্রী, আমলা, উকিল, মোক্তার, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, গণতন্ত্র বাঁচাও কমিটি, শ্রমিক কৃষক ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, কবিয়াল, সমস্ত পেশার মানুষেরা যে-পথে রোজ যাতায়াত করে, লোকটা ওই পথেই আলু ঝুলিয়ে দিয়ে বসেছে। না, ওকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি।লোকটার ইঁদুর মিত্ররাও বলে দেয়নি, কেন না, তখনও ইঁদুরেরা নিজেদের মাংসাশী প্রাণী বলে দাবি করতে শেখেনি।

ঝড় এলে পাতা নড়ে, লোকটার আলুও নড়ে। শীত এলেও লোকটার আলু থেকে শিশির জমে জমে গড়িয়ে পড়ে। আর বর্ষা এলে আলু ধোয়া জল গড়িয়ে পড়ে মানুষের মাথায়।
লোকটার এই উদ্ভট কাণ্ডকারখানা দেখে কোনও ব্যক্তির মনে লোকটার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন জাগতেই পারে। প্রশ্নটা চেপে না-রেখে যদি কেউ করেই ফেলে, তবে মোটামুটি একটা গদবাঁধা জবাব সে পাবে।
যেমন,
— লোকটা এক সময় হেঁটে বেড়াতো। গ্রামেগঞ্জে, হাটবাজারে, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
— তারপর?
— লোকটা দৌড়তে লাগলো।
–তারপর?
–ডিগবাজি খেতে শিখে গেল। কিছুদিন ডিগবাজিও খেল।
— লোকটা আগে একটা দলে ছিল। সুযোগ বুঝে দলটা ছেড়ে দিল।
— কেন?
— কেন এমন করলো কেউ জানে না, তবে লোকে বলে আরেক দলকে শায়েস্তা করবে বলে ছেড়ে ছিল
কিন্তু যাদের শায়েস্তা করবে তাদের দলেই এখন লোকটা।
— তবে এখন কাকে শায়েস্তা করবে?
— কেউ জানে না। তবে ইঁদুরদের সঙ্গে ওর খুব ভাব।
প্রথমে যখন লোকটা দল ছাড়ল, চারপাশে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল। চায়ের দোকান, পাড়ার মোড়, বুদ্ধিজীবীর ডায়েরিতে তত্ত্ব ও তর্জমায় ভরে উঠল। ভাবা যায়? এই লোক এই দলে? কী করে সম্ভব? সব আগুনখেকো লোকেরা দল ছেড়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়বার যখন দল ছাড়ল লোকটাকে শুনতে হল কিছু মা-বাপ তোলা নিকৃষ্ট গালিগালাজ। লোকটা ততদিনে এসব গায়ে মেখে নিতে শিখে গেছে।আসলে রাজনীতি করতে গেলে গায়ের চামড়া গণ্ডারের মতো করে নিতে হয়।

লোকটা প্রথম দলে থাকাকালীন গায়ে থলথলে মাংস ছিল।বুক-পিঠ-হাত ও ফর্সা গালে রক্তের ছোপ।
লোকজন বলতো, টাকা খেয়ে তো পেট ভালোই মোটা হয়েছে, দেখেছিস গুলজারি চেহারাটা।
লোকটা যখন দ্বিতীয় দলে যোগ দিল তখন কিছুদিন থম মেরে বসে রইল। মিটিংয়ে, মিছিলে যায় না। তারপর ধীরে ধীরে যাওয়া অভ্যেস করল। কীসব জয়-টয় এর বদলে অগণিত মানুষকে ‘কমরেড’ বলে
সম্বোধন করে বসল। প্রথম প্রথম দল ছাড়লে যে এমন হয় লোকজন তা বুঝতে পেরে ভুল বলেই মেনে নিল। আর দ্বিতীয়বার দল বদলের পরই লোকটার চেহারার জেল্লা শুকিয়ে গেল। যেন শুকনো শাল গাছ। চোখ দুটো গর্তের ভিতর ঢুকতে শুরু করল, সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবি-পাজামাটাও হারিয়ে গেল। লোকটা তৃতীয় বার দল বদল করার পর কেউ তাকে আর বিশ্বাস করল না। ‘ও..ও তো তরমুজ।উপরে সবুজ ভিতরে লাল।’ শরীরের বাকি মাংসটুকু মিলিয়ে গেল। হাড় জরজরে বুক, হাড়গুলো বাতাসে নড়ে। শতচ্ছিন্ন গেঞ্জির ভেতর দিয়ে হাড়গুলো গোনা যাবে, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ করে। তারপর থেকে লোকটা সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে দল বর্জিত হয়ে গাছের ডালে আলু ঝুলিয়ে দিয়ে বসে পড়ল। আর ওই বছরই দেশে আলুর সঙ্কট। বাংলায় যে-আলুর ফলন হওয়ার কথা কেন্দ্রীয় হিসেবে তা মেলেনি। বাংলায় আলুর ভরতুকি বন্ধ, বাংলা ফলন তাদের খুশি করতে পারেনি। অকাল বর্ষণে দক্ষিণে আলু ডুবেছে জলে।উত্তরে আলুর ফলন হলেও চাষারা আলু বেচবে না। চাষাদের কথাগুলো একটা খবরের কাগজ সস্তা ভাবে ছেপে দেয়।
— আলু?
— বেচবো না।
–তো?
– ঠাণ্ডা ঘরে রেখে দেব।এবার তো ভোট আছে। দাম হবে।
— আমরা খাবো কী?
— কাঁচা কলা খান। সস্তায়..
চাষারা বোকা, ওরা এটা বোঝে না যে, আলু যতদিন তাদের হাতে থাকবে ততদিন দাম থাকবে না, তাদের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়তে শুরু করবে।এবারে যখন ওরা ঠিক করেছে, চাষারা আলু বেচবে না, তো বেচবেই না।

আলুর দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোকটার আলু দুটোর আয়তন একটু একটু বাড়তে শুরু করল। ক্রমশ এক হাতের তালু ছাড়িয়েও দু’হাতের তালুতেও কুল পাচ্ছে না। এতদিন লোকের চোখের আড়ালে থাকলেও ভর ও আয়তন বৃদ্ধি’র সঙ্গে সঙ্গে লোকের চোখের সামনে চলে আসে। গামছাটাও আলু দুটি ঢাকার জন্য আর যথেষ্ট নয়। ধীরে ধীরে আলুর আয়তন এতটাই বড়ো হতে থাকে যে, দেখে মনে হয় লোকটা প্যারাসুটের ন্যায় আলু থেকে ঝুলে আছে। যে-আলু লোকটা এতদিন ঝুলিয়ে বসে থাকতো এখন উল্টে সেই আলুতে ঝুলে আছে।
লোকটাকে যে নেমে আসার আহ্বান কেউ জানায়নি তা নয়।আলুর ওজন বাড়তে বাড়তে কোনও দিন ছিঁড়ে এসে রাস্তার ওপর পড়বে, আর বিপদের আশঙ্কা দেখে অনেকেই লোকটাকে নেমে আসতে আহ্বান জানিয়েছিল। লোকটাকে নেমে আসার আহ্বান জানানো হলে লোকটা বারবার জানিয়েছে, ঝুলে থাকতে তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
লোকটার অসুবিধা নাহলেও আলুটার হঠাৎ আয়তন বৃদ্ধিতে অনেকের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াল। চিরকাল তো এমনটাই হয়, ব্যতিক্রম কিছুকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। লোকটার আলু কেন আর সবার মতো নয়? কেন বড়ো? আয়তন নিয়ে একদল মানুষ যেমন প্রশ্ন তুলল তেমনি আরেক দল মানুষের কাছে যেন একটা ভরসার জায়গা হয় দাঁড়াল। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল, একদিন সবাইকেই ওই আলুর নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
তবে এরকম একটা আর্ট-কালচারের শহরের মধ্যিখানে একটা লোক ওরকম করে আলু ঝুলিয়ে বসে থাকবে, তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। যেভাবে হোক সরাতেই হবে। কানাঘুষো, ফিসফিস থেকে প্রকাশ্যে দাবি উঠল, সংস্কৃতিবান এ জাতির পক্ষে এ ঘটনা বড়ই অসম্মানজনক।
লোকটাকে নিয়ে নগরপালের কাছে চিঠি জমা পড়ল বেশ কয়েকটা। একজন লিখেছে, আমি লোকটাকে ব্যক্তিগতভাবে বহুবছর ধরে চিনি। ও একটা আস্ত ঘুঘু। এতদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষীর খেয়ে এখন উলঙ্গ হয়ে ভোলা মহেশ্বর সেজে বসেছে। শহরের মধ্যেখানে এমন দৃশ্য খুব অশ্লীল। ওখান থেকে ওই লোকটাকে যেন অবিলম্বে সরানো হোক।
আরেকজন লিখেছে, এই আলু সঙ্কটের দিনে লোকটার আলু দুটো কেটে বিলিয়ে দেওয়া হোক, তাতে আলু সঙ্কট অন্তত কিছুটা মিটবে।

আলু নিয়ে সমস্যা যখন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে তখন এক লম্বা গলাওয়ালা বুড়ি এসে তার খাসি জবাই করার ছুরিটা দিয়ে একটা কেটে নামিয়ে নেয়। বুড়ি পাঁঠা-খাসি কেটে মাংসের যোগান মেটাতে পারছিল না। মানুষেরা পাঁঠা-খাসি-গো-নারী মাংস ছাড়াও অন্যকিছু চাইছিল। স্বাদ বদল। এই অবাঞ্ছিত, হঠাৎ বেড়ে ওঠা, যাকে নিয়ে চারপাশে এত শোরগোল, লোকের মাথা ব্যথা, তাকে বুড়ি কিছুটা হালকা করে দিল। টুকরো টুকরো করে কেটে শহরের নামীদামী রেস্তরাঁগুলোতে সাপ্লাই করে দিল। দিব্যি চলে গেল সে মাংস, স্বাদ বদলে বাহবা দিল। প্রাণীদের মধ্যে মানুষের বোধবুদ্ধি এতই কম যে নিজের মাংস খেলেও চিনতে পারে না। কত মাংসই তো শহরে বিক্রি হয়। আর লোকটা আরেকটা আলু হাতে করে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। যন্ত্রণায় গোঙয়াতে গোঙয়াতে কসাই মেয়েছেলেটাকে গাল দিতে থাকে।

গোঙানি শুনে লোকটার মিত্র ইঁদুরেরা ছুটে আসে দলে দলে। আলু থেকে চুয়ে পড়া রক্তে ইঁদুরদের শরীর ভিজে যায়। মাঝ রাস্তায় রক্ত পড়ে পড়ে লাল হতে থাকে। রক্তমাখা ইঁদুরেরা পরস্পরকে বলে, লালে লাল লাল সেলাম। রক্তের ঘ্রাণে ইঁদুরদের নেশা লাগে, নেশার ঘোরে ইঁদুরেরা উষ্ণ রক্ত চেটে খায়। রক্তের স্বাদ পেয়ে ইঁদুরেরা সবকিছু ভুলে ভুলে বসে, মিত্র লোকটাকে কেবল খাদ্য ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এবারে খাওয়া-খাওয়িতে ইঁদুরে ইঁদুরে লড়াই বাঁধে। একজন শ্লোগান ধরে:
শহিদের রক্ত…
হবে নাকো ব্যর্থ…
কয়েকটা ইঁদুর খুব সন্তর্পণে খায়। পাপ করে পাপ লুকানোর মতো মুখে লেগে থাকা রক্তের দাগ দু’হাতে মুছে ফেলে। নিজেদের মধ্যে মানুষের রক্তের স্বাদ নিয়ে আলোচনা করে, বৃথা এতদিন তারা শাকাহারী ছিল। আপনি ভাবতে পারেন, ইঁদুরেরা তো শাকাহারী তবে মাংসাশী হল কেন? জীববিদ্যার বইয়ে অন্য ব্যাখ্যা লেখা থাকতে পারে, নাও পারে। আর এভাবেই ইঁদুরেরা ধীরে ধীরে শাকাহার ছেড়ে মাংসাশী হয়ে ওঠে। তাদের সুপ্ত চেতনায় মাংসাশীসত্ত্বা জেগে ওঠে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে-ঘোরের ভেতর ইঁদুরদের রাখা হয়েছিল, তা রক্তের স্বাদ পেয়েই কেটে যায়। মানুষের জন্য ইঁদুরেরা বিপজ্জনক প্রাণী হয়ে দাঁড়ায়।

লোকটার কাছে দুটো রাস্তা খোলা ছিল, এক- ইঁদুরদের পোষ মানানো। দুই- নিজেকে এই মাংসাশী হয়ে ওঠা ইঁদুরদের হাতে তুলে দিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া। লোকটা তাই করলো। নিজেকে ইঁদুরের হাতে তুলে দিল। হাভাতের ঘরে মাংসের জোগাড় হলে যেমন করে উৎসব হয় তেমনি ইঁদুরেরা রক্তের লোভে এক এক করে গাছে চড়ে লোকটাকে ঘিরে খাদ্যের উৎসব শুরু করে দিল। ইঁদুরদের বারোমাসের তেরো উৎসবে নতুন করে যুক্ত হল এই খাদ্যোৎসব। লোকটার আত্মচিৎকার ইঁদুরের সমবেত চিৎকারে ঢাকা পড়ে গেল।

লোকটা ইচ্ছে করলেই ইঁদুরগুলোকে পোষ মানাতে পারত। পোষ মানানোর বিদ্যা তো লোকটার জানা ছিল, আগেও তো কতকিছুকে পোষ মানিয়েছে।কুকুর বিড়াল পায়রা এমনকী বিরোধী দলের নেতাকে পর্যন্ত পোষ মানিয়েছে। মানুষকে পোষ মানাতে পারলে সবচেয়ে লাভবান হওয়া যায়। মানুষকে দিয়ে একমাত্র পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কাজটিও করানো যায়। আর যারা বুদ্ধিমান তারা জন্তু-জানোয়াদের পোষ মানানোর চাইতে মানুষকে পোষ মানাতে বেশি পছন্দ করে। একটা দেশ বা রাষ্ট্রের মানুষকে যদি পোষ মানানো যায় তাহলে দিনের পর পর দিন ক্ষমতায় টিকে থাকার পক্ষে এর চেয়ে আর ভালো কী আছে।

শস্যভোগী শান্ত ইঁদুরদের হঠাৎ করে মাংসাশী হয়ে ওঠা লোকটার কাছেও বেমানান মনে হয়েছে। লোকটা ইঁদুরদের ক্রাইম হিস্ট্রি খুঁজতে গিয়ে মাংসাশী হয়ে ওঠার ইতিহাস খুঁজে আনে। অতীতে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সাপ ইঁদুরেরা একসাথেই লড়েছিল। তারপর স্বাধীনতার নামে সাপ ইঁদুরদের জন্য দুটি দেশ গড়ে ওঠে। সাপেরা থাকে একটা মস্ত বড়ো নদীর ওপারে, এই ধারণা যে, কোন দিন তারা নদী পার হতে পারবে না। আর ইঁদুরেরা থাকে নদীর এপারে। ইঁদুরেরা চিরকাল সাপেদের মাংসাশী স্বভাবের জন্য দোষ দিয়ে এসেছে। এসব তো লোকটা সবই জানে। অতীতে ইঁদুর-সাপের মধুর সম্পর্ক দেখেছে—সে একটা সময় ছিল, তখন লোকে লোকের কথা শুনতো। ইঁদুররাও শুনতো সাপেরাও শুনতো। আর এখন ইঁদুররা যখন শাকাহার ছেড়ে মাংসাশী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তখন সামান্য লোকটার পক্ষে ঠেকানো অসম্ভব। তবু লোকটা ইঁদুরদের হিংস্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ‘তোরা হঠাৎ করে কেন রক্তমাংস খেকো হয়ে উঠলি?’ ইঁদুরেরা বলে, ‘আমাদের এতদিন ভুলিয়ে রাখা হয়েছিল। রক্তের স্বাদ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। যেমন করে দেবতারা অসুরদের কাছ থেকে ছল করে অমৃত ছিনিয়ে নিয়েছিল, তেমনি আমাদের এতদিন বঞ্চিত করা করা হয়েছে।’

তারপর লোকটা আর কিছু বলেনি। ধীরে ধীরে ইঁদুরেরা সারিবদ্ধ হয়ে গাছে ওঠে। খাদ্যকে ঘিরে ধরে। রোজ খেতে খেতে একদিন লোকটার সমস্ত শরীর ইঁদুরদের পেটে চলে যায়। অবশিষ্ট পড়ে থাকে শক্ত হাড়। ইঁদুরের দাঁতে হাড় ভাঙার শক্তি থাকলে হয়তো এগুলোও পড়ে থাকতো না৷

লোকটাকে খেয়ে শেষ করে ইঁদুরেরা এবার দলবদ্ধ হয়ে আরও শিকার খুঁজে বেরায়। সভা করে তারা ঘোষণা করে, যে মানুষগুলো এখনও তাদের দেশে আছে তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ‘এই দেশ ইঁদুরের দেশ।’

কিছু মানুষ তখনও বেঁচে ছিল, তারা বড় নদী সাঁতরে সাপেদের দেশে ওঠে, আবার কিছু মানুষ গা-ঢাকা দেয় ইঁদুরদের দেশেই। রাত হলেই তির ধনুক তলোয়ার বর্শা হাতে করে তারাও নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে ইঁদুর শিকারে বের হয়। এভাবেই ইঁদুরদের দেশে কিছু মানুষেরা বেঁচে থাকে।

Facebook Comments

Leave a Reply