অনুবাদে অর্ধেক আকাশ : মালিনী ভট্টাচার্য
[মালিনী ভট্টাচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় জনসংযোগে কর্মরত। কথাসাহিত্য, তথ্যভিত্তিক লেখালিখি ও অনুবাদের কাজ করছেন প্রায় এক দশক। সাহিত্যে ও শিল্পে নারীত্ব ও নারীর সত্ত্বায়ন বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী মালিনী।‘অনুবাদে অর্ধেক আকাশ’— এই ধারাবাহিক কলামে বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি উপন্যাসে নারীত্ব ও নারীর সত্ত্বায়ন প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য অংশের অনুবাদ করছেন মালিনী।]
পল্লীগ্রামে
আমার যে বন্ধুটি কর্মসূত্রে হামেশা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, শহর থেকে দূরে, পল্লীগ্রামে, তার একটা বাড়ি আছে। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে আসব ভেবেছি। প্রস্তাবটা বন্ধুরই; সে বলল, “তোমার মনমেজাজ তো ভালো নেই দেখছি ইদানিং, ঘুরেই এস না। টাকাপয়সা লাগবে না, জায়গাটা ছোট, লোকজন-ভিড়-ঝামেলা নেই, ভালো লাগবে।” সত্যিই আমার সময়টা খারাপ যাচ্ছে। যাওয়াই ঠিক করলাম। ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনে ওঠা। স্টেশনে বোর্ডে অজস্র ছোট-বড় শহরের নাম লেখা। কত জায়গা, অবাধে যাওয়া যায়, কেউ আটকাবে না। আমিও তো চলেছি খেয়ালমাফিক দুদিনের ছুটি কাটাতে। জায়গাটা কাছেই, খবরের কাগজ শেষ হতে না হতেই ট্রেন থামল। দেখা গেল, বন্ধুর মালী তার গাড়িটা পার্কিং লট-এ রেখে গেছে আমারই ব্যবহারের জন্য।
এখানকার ল্যান্ডস্কেপ, এই পাহাড়ের কোলের অজস্র ছোট ছোট দুর্গ, গরমের সময়ে স্বপ্নের মত সুন্দর নিশ্চয়। বহুদিন গাড়ি চালাইনি, কিন্তু স্টিয়ারিংয়ে অসুবিধে হচ্ছে না। গাড়িটা ছোট, এঞ্জিনে জোর আছে। চড়াই রাস্তা। বন্ধু বলেছিল, পথে দু-তিনদিনের খাবার কিনে নেয়া ভালো। তাই করলাম। আর আমাকে বেরোতে হবে না। দেখলাম এখানকার দোকানিরা আমার বন্ধুকে চেনে, ভালোওবাসে। সেইজন্যই বোধ হয় খরিদ করার আগে চীজ টেস্ট করা গেল। শুনলাম ভয়ানক ঠান্ডা পড়বে আজকালের মধ্যেই। দিনতিনেক প্রবল হাওয়া হবে, বরফ পড়াও অসম্ভব নয়।
পৌঁছে দেখলাম, বাড়িটা নিচু জমিতে। চারপাশের দৃশ্য দুর্দান্ত, বিস্তীর্ণ আকাশ উজ্জ্বল। দূরে কিছু ঘরবাড়ি। সুইমিং পুলে জল নেই, ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। দুটো গাছের ডালের মাঝে দড়ির দোলনা তিরতির করে কাঁপছে। বাগানের পথে মাচা ঘিরে আধশুকনো লতানে গাছ উঠেছে।
একটা পাথরের নিচে চাবি রাখা ছিল। দরজা খুলে ঢুকলাম। ব্যাগ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ক’টা জিনিস বের করে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বাললাম, কফি বানালাম। রান্নাঘরটা বেশ বড়, মার্বেল পাথরের সিঙ্কে পড়ন্ত আলো। টেরাকোটার বাসনপত্র। রঙ-করা জলের পাত্র, বয়াম। ছাতের ঠিক নিচেই সারি সারি পুরোনো লোহার চাবি ঝুলছে, দীর্ঘ অস্পষ্ট এপিগ্রাফ যেন। সবই অপ্রয়োজনীয়, অতিরিক্ত চাবি, যা দিয়ে খোলা যাবে এমন দরজা আজ আর নেই।
সূর্য ডোবেনি তখনও, স্নিকার্স পরে নিয়ে হাঁটতে বেরোলাম। গমের ক্ষেতের ভিতর সরু পায়ে-চলা পথ। পৃথিবী এখানে নির্জন, সহজসুন্দর। বছরের খড়ের গাদা তৈরী হয়ে গেছে। এই অঞ্চল পরিবর্তনকে কাছে আসতে দেয়নি। এখনও এখানে একরকমের প্রাচীন সৌন্দর্য্য রয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা খাঁড়ির ধারে পৌঁছলাম, ঘড়ি দেখে আবার ফেরা। একা থাকতে গেলে সময়কে অন্তরঙ্গভাবে চিনতে হয়, এ আমি জানি। খানিকটা পকেটে রাখা টাকাপয়সার হিসাবের মত: কতটা সময় কাটাতে হবে, রাতে খাওয়াদাওয়া করার আগে কতখানি খরচ করা চলবে, শোবার সময় বাকি রইলো কত, তার ধারণা থাকা চাই। তবে এখানে সময়ের চরিত্র আলাদা। আমি বাইরে ছিলাম মাত্র এক ঘন্টা, অথচ মনে হচ্ছে বহুক্ষন কেটে গেছে।
সন্ধ্যেটা রান্নাঘরেই কাটলো। শহরে থাকলে সচরাচর তৈরী খাবার কিনে খাই – ধরা যাক কাঁটাচামচ দিয়ে ক্যানের টুনামাছ – এই দিয়েই একেকদিন চলে যায়। এখানে একটু অন্যরকম কিছু করতে ইচ্ছে হল। হোক খাটনি, সমস্যা নেই। একটা বেকিং প্যানে মুরগির টুকরো সাজিয়ে তার ওপর অল্প থাইমপাতা, রসুনের কোয়া, নুন, লেবুর ফালি রাখলাম। ওভেনে প্যান ঢুকিয়ে অলসভাবে বন্ধুটির বাসনপত্র দেখছিলাম। হলুদ রঙের চিনেমাটির পুরু থালা, হালকা কাচের গ্লাস আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিছু বইও আছে। নিজের সঙ্গে আনা বইগুলো না খুলে উল্টেপাল্টে একটা পুরোনো এক্সহিবিশনের ক্যাটালগ দেখে খানিক সময় কাটল। আমার নিজের নয় এমন জিনিসপত্রের ভিড়ে থাকতেই আমার ভালো লাগে।
রাতের খাবার খেয়ে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসে কিছুক্ষন বই পড়লাম। ঘুম এসেছে। গান চালিয়েছি, এবাড়ির মালিকদের পছন্দের গান। গতবছরের ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে দেখছি। ঠিক করেছি বন্ধুর মেয়ের ঘরে শোব। সে ঘরে সিঙ্গল খাট, ছাত নিচু হয়ে ঝুঁকেছে একধারে। আলমারিতে লেপকম্বল রাখা, দুয়েকটা জ্যাকেট, সুইমস্যুট-ও আছে। এই ছোট ঘরের মেজাজ অন্তরঙ্গ। আসল শোবার ঘরের কারুকাজ করা ভারী কাঠের শয্যার চেয়ে এই উষ্ণতা আমার মনের মত।
পরদিন শীত বাড়ল। মাঠ দিয়ে চলতে চলতে দেখলাম পায়ের নীচে মাটি কঠিন হয়ে উঠেছে। খুব হাওয়া, দূরের কত ঘরে আলো জ্বলেছে। মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, অপরিচিত জায়গা, কাউকে চিনি না, এই নিঃসঙ্গতার ওজন বড় বেশি।
বাড়ি ঢোকার আগে রাস্তায় একটা ধূসরমত কি চোখে পড়লো। ছোট জন্তু। নেংটি ইঁদুর। মরা। শক্ত হয়ে উঠলাম। মুহূর্তে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি, তবুও শীর্ন পাকানো লেজটা, নরম ঘন পশমে ঢাকা ছোট্ট শরীরটা দেখে ফেলেছি। আরো ভয়ানক, ইঁদুরটার মাথা পরিষ্কার করে কাটা।
কিকরে? আর কেন? অন্য কোন জানোয়ার ওর মাথাটা খেয়ে থাকবে নিশ্চয়ই । হয়তো কোনো হিংস্র পাখি। মাথাকাটা ইঁদুরের শরীরটা দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘেন্না করলো। সেইসঙ্গেই, কেন জানি না, ডুমুরফলের অপূর্ব লালচে রঙ মনে পড়ল। গরমকালে সে ফলের রোদে তাতানো, মিঠে স্বাদ আমার ভীষণ প্রিয়। এই সাংঘাতিক ঠান্ডায় মরা ইঁদুরটার মুন্ডহীন ধড় দেখতে দেখতে সে কথা ভাবছিলাম।
ইঁদুরটা অসাড়। আমার ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে। ভয়ের কিছুই নেই,তবু এক লহমায় এই শান্ত, সুন্দর পল্লী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
এত স্পষ্ট করে মাথাটা কাটলো কিভাবে? যেন ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে। আশেপাশে অন্য কোনো জানোয়ার আনাগোনা করছে না তো? শরীরটা বাদ দিয়ে মাথাটা খেল কেন? কিন্তু আরও জরুরি, আমার এই অদ্ভুত উগ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কেন? একটা ছোট মরা ইঁদুর, আর তো কিছু নয়। কাল রাতেই মুরগির টুকরোতে নিজের হাতে তেল মাখিয়েছি, ওই কাঁচা নির্জীব মাংস ছুঁতে একটুও অসুবিধা হয়নি। বেকিং প্যানে ছিটেফোঁটা রক্তও লেগেছিলো। কই, একবারও অস্বস্তি হয়নি।
এই প্রাণীটিকে দেখতে, ছুঁতে ইচ্ছে করছিলো না। উপায় থাকলে ছুটে পালিয়ে যেতাম, এই ন্যুব্জ মরদেহের চেহারা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতাম। গাড়িতে উঠে শহরে ফিরে যাব? লাশ সরাতে কাকে ডাকবো? মালিকে? না, বাড়াবাড়ি হবে। কোনোরকমে বাড়িতে ঢুকলাম। মনে হচ্ছে এই বুঝি ইঁদুরটা লাফিয়ে উঠে আমার গায়ে পড়বে, মেরে ফেলবে আমায়! হাস্যকর।
ওকে চাপা দেয়ার কিছু খুজলাম। একটা ক্যানে কাঁচা টমেটো ছিল, সেটা খালি করে ধুলাম। এবার ওকে চেঁছে তোলার জন্য পাতলা বোর্ডজাতীয় কিছু লাগবে। একটা কার্ডবোর্ড বাক্স থেকে চৌকো টুকরো কাটলাম। এভাবেই ওকে কবর দেব, কিন্তু আগে এক কাপ চা। এই সামান্য কাজটা করতে হবে ভাবলেই অস্বস্তি হচ্ছে, শরীর থেকে জোর চলে যাচ্ছে।
শেষে সব সরঞ্জাম নিয়ে আবার বেরোনো। ময়লার বালতির ঢাকা খুলে ভেতরের প্লাস্টিক ব্যাগের মুখটা খুলে ফেললাম। ইঁদুরের দেহটা ক্যান দিয়ে ঢাকা পড়তেই আমার ওপর ওর ওই আশ্চর্য বিকৃত প্রভাব কমে এলো। এখনো কাঁপছি অবশ্য, ঘামে ভিজে গেছি। কার্ডবোর্ডের টুকরোটা দিয়ে ওর নিথর শরীরটা তোলার চেষ্টা করতেই বাধা, ফলে একটু ঠেলাঠেলি করতে হলো। চোখ সরিয়ে রেখেই একটু একটু করে ওকে তুললাম।
কাজ-চালানো কবরযন্ত্র হাতে আমি দাঁড়িয়ে উঠেছি। মরা ইঁদুরটার ওজন আমার হাতের তালুতে। কতটুকুই বা, কয়েক আউন্স মাত্র। তবু , ভারসাম্য ওলটপালট করার পক্ষে যথেষ্ট। ভিতরে নড়াচড়া টের পাচ্ছি। আমারই তৈরী এই শবাধার। ফেলে দিয়ে ময়লার ব্যাগের মুখ বন্ধ করে দিলাম। মরা জানোয়ারটা ঢাকা পড়লো, কিন্তু ফিরে দেখি, সৎকার করতে গিয়ে কোনো সময়ে ছোট শরীরটা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে রাস্তায়।
কপাল ভালো, সে রাতে বৃষ্টি হলো। পরদিন রোদ উঠলো, রক্তের দাগ মিলিয়ে গেলো। তবু সবে মরা মাথাকাটা ইঁদুরটার কথা ভাবলে আমার এখনও গ্রীষ্মের লালচে ডুমুরফলের কথা মনে পড়ে। মুখের মধ্যে সেই স্বাদ-গন্ধ, সেই তাপ।
Posted in: December 2021 - Serial, TRANSLATION