যাত্রা : ঝুমুর পাণ্ডে
আকাশে শব্দ করে এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল। চমকে তাকালেন সুমন। হ্যাঁ সুমন দত্ত রায়। শহরে ছাদের উপর এই ছোট্ট এক টুকরো আকাশ। এটাই যেন অনেক শান্তি এনে দেয় সুমনকে। উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢেকে যাচ্ছে পুরো শহরটা। বাড়ি কোথায় সব যেন বাক্স। এই যে সামনে বিরাট ফ্ল্যাটটা এখনও তৈরি হচ্ছে। এর ভেতর মনে হয় একটা বিরাট পাড়া ঢুকে যাবে। এখানে কত বড় একটা জলাশয় ছিল । কত বড় বড় পিতামহের মতো গাছেরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। ছিল আরও কত সব ছোট বড় গাছের জটলা। একটা পিপল গাছে ছিল চিলের বাসা। চিল দুটো ঐ গাছ থেকেই উড়ে যেত। আকাশে চক্কর কাটত। হয়ত ওই গাছে বাসা বেধে ডিমও পাড়ত। ওই ডিম ফেটে বাচ্চা বেরুত। আরও কত সব পাখিরা ছিল। শীতের সময় ঝাঁক ঝাঁক পরিযায়ী পাখিরা এসে প্রতিবার এখনে ডেরা বাধত। আহারে মনটা খুশিতে ভরে উঠত। এত সাদা সাদা হাঁস আরও কত কী? গাছগুলো যখন কাটা হচ্ছিল মনে হচ্ছিল যেন ওর উপরেই এসে পড়ছে ঘা। আকাশটা আজ বড় নীল । ফোনটা বাজছে।
হ্যালো।
শ্রীমত্ত দেব কাল চলে গেলেন আর তুমি গেলে না সুমন। আশ্চর্য । একই শহরে থাকো। একই পথের পথিক। কি বলছ আবোল তাবোল?
আবোল তাবোল?
হ্যাঁ। গেলাম তো অনেকক্ষণ ছিলাম ।
কিন্তু আমি তো আজ তিনটে দৈনিকই নেট–এ পড়ে ফেললাম। কিন্তু অনেক আবোল তাবোলের নাম আছে, কিন্তু কোথাও তোমার নাম নেই।
কি মুশকিল সাংবাদিকরা আমার নাম না লিখলে আমার কি করার আছে?
তোমার মতো এক বিখ্যাত গায়কের নাম সাংবাদিকরা জানবে না? কি বলছ তুমি?
বাদ দাও । আমার কথা যখন বিশ্বাসই করছ না তুমি
বাদ দেব?
বড় ঝগড়াটে হয়েছ তো তুমি আজকাল?
আকাশে আবার এক ঝাঁক পাখি।
কি করব বল। ছেলে ছেলের বউ থাকে সেইতো সুদূর আমেরিকায়। আর বউ তো…
গিজারের সুইচ দিয়ে দিয়েছি।
কাজের মেয়ে রিনি এসে বলে গেল।
আবার আকাশের দিকে তাকালো সুমন।
শ্রীমত্ত দেবের চলে যাওয়া কাল সকালেই শুনে ছিলেন সুমন পাশের বাড়িতে তখন বাজছিল-
বেলা বয়ে যায় …
মাধবী কুঞ্জে রাখা আছে দেহ তাও শুনেছিল মনটা কেমন করে উঠেছিল।চায়ের কাপটা রেখে তখনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে গেছিলেন। ড্রাইভারের অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যেত। সারা গায়ে ফুলের বোঝা নিয়ে শুয়ে ছিলেন শ্রীমত্ত। চারদিকে কত ক্যামেরা, মিডিয়ার লোকজন দুলাইন গাইতে পারে না ওরাও ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। কে কীভাবে প্রচারে আসবে ওখানে হুটোপাটি লেগে গেছিল। চোর গায়ক, চোর লেখক, চোর কবিরাও ওখানে ইন্টারভিউ দিতে ব্যস্ত ছিল। অনেক সংস্থার সভানেত্রী, সভাপতিরাও ওখানে মজুদ ছিলেন। একজন মহিলা তো নিজের ছেলেমেয়ের সাফল্য শোনাতে ব্যস্ত ছিলেন। আরেকয়েজন তো ….। আর গেটের সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল এক সব্জি বিক্রেতা । ঢোকার সাহস পাচ্ছিল না বোধহয় ।হয়ত শ্রীমত্তকে খুব ভালবাসত। মন্ত্রী আসতেই সব কিছু আর যেন বদলে গেল। সুমন তো চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো। বিশিষ্ট গায়ক সুমন। রাতেও টিভিতে ইন্টারভিউ গুলি শুনছিলো সুমন। প্রায় সবাই বলছিলো গানের জগতে বিশেষ ক্ষতি হল। কেউ বলছিলো অপূরণীয় ক্ষতি হল। অথচ শ্রীমত্ত আজ বিশ বছর ধরে গাইছে না। এটা কি জানত না লোকে। যাক, ছাদে গোলাপ গাছটায় অনেক ফুল ধরেছে। টকটকে লাল। আহা বড় সুবাস ছড়াচ্ছে। তাঁর মানে হাইব্রিড না। আসল গোলাপ। ছোট বেলায় দেখতেন গাঁয়ে এক সাধু গাইত-
আর কি আমার গোলাপ গাছে
ফুটবে গোলাপ ফুল
জল ঢেলে দাও গোড়ায় গোড়ায়
ফুটবে কলি মেলবে পাতা
ফুটবে গোলাপ ফুল-
সাধুটার কথা এখন খুব মনে পড়ছে। আরেকজন বৈষ্ণব ছিল। অনেক দূরের গাঁ থেকে আসত। কোথাও আখড়ায় থাকত বোধ হয়। কাঁথাকে লুঙ্গির মতো করে পরত। গায়ের ফতুয়াটাও কাঁথার । ভিক্ষের ঝুলিটাও। সবাই বলত কাঁথা বৈষ্ণব । কাঁথা বৈরাগী। উঠোনে এসে মন্দিরা বাজিয়ে গাইত-
আমার কৃষ্ণ কুথা পাই
আমি কুন দেশেতে যাই
শেষে ওই বৈষ্ণবের সঙ্গে একদিন বৈষ্ণবীও জুটেছিল। বৈষ্ণবীর গলাটা খুব মিঠে ছিল। কত গান যে গাইত। আহারে-
ললিতা আর বৃন্দা সখি
ফুল মেরেছে শ্যামের গায়
ফোনটা আবার বাজছে। বাজুক । নদীর বাতাস আসছে হু হু করে। ওই সামনেই তো বরাকর। ছোট বেলায় মধুরা নদিতে কত চান করতেন । নৌকা ভাসাতেন। সঙ্গে একটা মেয়েও থাকত । ফ্রক পরা দুদিকে দুটো বিনুনি বাধা একটা মেয়ে। আহা কি সুন্দর দেখতে। যেন পরি। কিন্তু আশ্চর্য কোন দিন কোনও মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন নি সুমন। হ্যাঁ, আকর্ষণ ছিল ক্লাসের একটা ছেলের প্রতি।ভীষণ আকর্ষণ । ছেলেটারও বোধহয় ছিল।এখন কোথায় আছে কে জানে। একবার শুনেছিলেন দুবাই আছে।মা অনেক বিয়ের চেষ্টা করেছিলেন রাজী হননি সুমন। গানের জগতেই ডুবে ছিলেন। ডুবে আছেন। এরকমই থাকতে চান। দূরে কোথায় ডাহুক ডাকছে। কু কু কুউ কুউ কু ……………
ছাদের দোলনাটায় বসলেন। ফুলগুলোর দিকে তাকালেন। আহারে মন ভালো করা ফুল।মা ভীষণ ফুল ভালোবাসতেন।ভালোবাসতেন গাছপালা। গ্রামের বাড়িতে ওদের কত বড় বড় গাছ ছিল। আম, জাম, কাঁঠাল, অর্জুন, সজনে, শিমূল, বাতাবী লেবু। সজনে গাছে ফুল এলে কত পাখি যে আসত। আবার আকাশের দিকে তাকালো।একটা চিল ডানা মেরে ঘুরে ঘুরে উঠছে।অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সুমন।এই সমাজের বানানো নিয়মের মধ্যেই সবাইকে থাকতে হয় কেন? একটু এদিক সেদিক হলেই সমাজ রে রে করে আসে! কখনও সশব্দে কখনও বা নিঃশব্দে! দুবাই চলে যাওয়া ছেলেটার কথা এখন খুব মনে পড়ছে।পাশের বাড়িতে গান বাজছে বেগম আখতারের গান-
জোছনা করেছে আড়ি
আসে না আমার বাড়ি
গলি দিয়ে চলে যায়
সুমনের খুব প্রিয় গান। কিন্তু এসময় কেন এ গান? আগে লোকে প্লেয়ার বাজিয়ে শুনত বড় বড় থালার মতো ডিস্ক চালিয়ে। ছেলেবেলায় দেখেছেন বাড়ি তারপর রেডিও, টিভি আর এখন তো লোকে ইউটিউব খুলে শোনে সাথে দেখেও…
রিনি আবার এসে বলছে— জল বোধহয় গরম হয়ে গেছে বাবু। সুমন কতদিন বলেছেন আমাকে বাবু বলিস না কাকু বলিস। মেয়েটা তবু বাবুই বলবে। রিনির বাপ মরেছে ময়নামতী বাগানে বাজ পড়ে। আর মাকে শেষে ডাইনি বলে মেরে ফেলেছে মানুষ। এক দুটো নয় ছ’ ছটা ভাই বোন এখন এদিক সেদিক ঘুরছে। কারও সাথে দেখাও হয় না । ওর মাইনেটাও নিয়ে যায় এক কাকা। কাকাই এনে দিয়েছে কি না।অন্যান্য ভাই বোন গুলোকেও জানি কোথায় কোথায় দিয়ে টাকা তুলছে কাকা। ইনকামের ভালই রাস্তা হয়েছে কাকার।যাকগে কি আর করা। দুনিয়াটা ধান্দাখোরে ভরে গেছে।সুমন কি আর কম ঠকলেন জীবনে? কত রকম মানুষ দেখলেন জীবনে? বাবার কথা মনে পড়ে না। কিন্তু মা ছাড়া আর কারও জন্যই চোখে আজকাল জল আসে না।জ্বর হলে এখনও মা শিয়রে এসে দাঁড়ান কপালে হাত রাখেন। পাশের বাড়িতে এখন সেতার বাজছে রাগ ইমন। হায়রে এ সময়ে কি এই রাগ বাজাতে হয়? পাশের বাড়ি সব কিছুই বাজায়, সব কিছুই শোনে। কিন্তু কোনও রসবোধ নেই।রসবোধ না থাকলে কি করে শোনে ভেবে পান না সুমন, যাকগে কি আর করা।মানুষকে অনেক কিছু শেখানো যায় কিন্তু রস শেখানো যায় না।
সখি হে ভাব শিখলে না
জানতে যদি ভাবের কথা
নয়নেতে পড়ত ধারা
সখি হে
আকাশে আবার পাখির ঝাঁক।এত পাখি আজ কোথায় যাচ্ছে। কে জানে। চিলকায় গিয়ে দেখেছিলেন এক পাখি আহারে যান পাখির দেশ। প্রাণভরে পাখি দেখেছিলেন বুক ভরে ধারণ করেছিলেন সেই কলতানকে এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পান সেই হাজার হাজার পাখির উড়োউড়ি।ছুটোছুটি! হ্যাঁ আরেকটা ছবি দেখেছিলেন ‘চরাচর’ সেই ছবিটাতেও এত পাখি এত পাখি।
ফোনটা আবার বাজছে ।
হ্যালো
কেটে দিলে কেন?
কাটিনি। কেটে গেল।
হ্যাঁ। নেটওয়ার্ক বড় ঝামেলা করছে আজকাল।
হ্যাঁ।
না বলছিলাম।
হ্যাঁ বলো।শুনছি।
যাঃ। আবার কেটে গেল।
এখন আবার হোয়াটস অ্যাপ-এ টুং টাং।
রিনি চা দিয়ে গেল।
চান যখন করছইনা বাবু।চা খাও।
রিনি ভাল করে জানে সুমন চা খেতে ভাল বাসেন ভীষণ। চা বাগানে চাকরি করতেন বড়মামা। তখন মাঝে মাঝেই ওখানে চলে যেতেন সুমন।চা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে প্রাণভরে চায়ের ঘ্রাণ বুকভরে নিতেন সুমন। কখন ফ্যাক্টারির আওয়াজ আবার কখনও ভেসে আসত মাদলের মিঠে আওয়াজ। কখনও ভেসে আসত ঝুমুর গাম-
টুসু পরবে আইলি নাই কেনে
তোর লাগি পিঠা বানাইছিলি
যাঁতায় করে গুড়ি পিষে পিষে
হামার দুখায় গেল হাত
সখা দুখায় গেল হাত
কখনও বা নীল পাহাড় বড়াইল পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এত নীল। এত নীল। আর আকাশে কত কত রঙের আলপনা।ওই আলপনায় হাত রাখতেন সুমন। তখন কত মেঘেরা হাত ধরাধরি করে এসে মুছে দিত সেই আলপনা। আর সুমন তখন…
মা তুমি?
চায়ের কাপটা এখন ঠক করে পড়ে গেল হাত থেকে। সব মেঘেরা এখন নেমে এসেছে ছাদে। পাখিরাও । হাত ধরাধরি করে সবাই নাচছে মহানন্দে। ওদিকে কারা যেন গান করছে। বেলা বয়ে যায়।।..
Posted in: December 2021 - Cover Story, STORY