ভয়চক্র : অর্ক চট্টোপাধ্যায়

লোকগুলো বড় ভয় পেয়েছিল। ‘বড়’ ভয় না ‘বড্ড’ ভয়। না। বড়। বড় ভয়। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে বাড়ির ভেতরকার বাতাস ছোট আর বাইরের যে হাওয়া দূর আকাশের নক্ষত্র পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে তাকে বলা হয় ‘বড় বাতাস’। বড়। লোকগুলো ‘বড় ভয়’ পেয়েছিল।
ভয়ের আকার কি হতে পারে? চৌকো না গোল? আয়ত, বর্গ নাকি রম্বস? ভয়ের মুখমন্ডল থেকে কি তার আকারের কোন হদিশ মিলতে পারে? কিভাবে বোঝা যায় কোন ভয়টা বড় আর কোনটাই বা ছোট? মৃত্যুর ভয় কি সবচেয়ে বড়? নিজের মৃত্যু না স্বজন হারানোর ভয়? আর অপমানের ভয়? ঘরবাড়ি হারানোর? জীবিকা? আধপেটা থাকার ভয়? খিদেরও একটা ভয় থাকে। কথা বলে। ভাত চায় আর না পেলে ভয় ক্রমশ রাগে বদলে যেতে থাকে।
যা বলছিলাম: লোকগুলো বড় ভয় পেয়েছিল। কারা ওরা? কেন ভয় পেয়েছিল? কি হয়েছিল ওদের? সজাগ রাষ্ট্র এই গল্পে নজর রাখছে। তাই যা বলবে রহস্য করে শূন্যস্থান ছেড়ে ছেড়ে বলতে হবে।
লোকগুলো বড় ভয় পেয়েছিল। মাংসের ভয়। ওদের জীবন ছিল মাংসের কাছাকাছি। মরা মাংস। মরা মাংসের ওপর যেমন আস্তে আস্তে সবার অলক্ষে এসে বসে বুভুক্ষু মড়াখেকো বিনবিনে পোকা তেমনই ছিল ওদের জীবন। আমাদের কাছে ওরা ছিল অমন বুভুক্ষু মড়াখেকো বিনবিনে পোকা।
মরা _র লাশ কিনেছিল ওরা। চামড়া ছেঁচে নিচ্ছিল, মাংসের কাছাকাছি পৌঁছতে। খাবে বা বিক্রি করবে। জন্তুর মরা মাংস খাওয়া বা বিক্রি করা। এই দুটো সামাজিক রাস্তাই ওদের জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছিল। বাকিটা আবর্জনা পরিষ্কার। স্বচ্ছ _ অভিযান।
_র দল যখন চড়াও হল, মরা গোমাংস ফেলে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে দৌড় লাগলো ওরা। লোকগুলো বড় ভয় পেয়েছিল। মাংসের ভয়। কয়েকজনের হাতের থলিতে তখনো কিছুটা গরুর মাংস ধরা ছিল। ভয়ের একেকটি দীর্ঘ তরঙ্গ মৃত গোমাংস থেকে তাদের জীবন্ত মাংসের ভেতর রক্তের সদাবহমান স্বভাবের গভীরে স্থানান্তরিত হচ্ছিল।
সন্ধ্যা নামছিল মরা মাংসের ওপর। নিকষ কালো হয়ে আসা মাংসের ওপর শেষবেলার লাল সূর্য চিকমিকিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছিলো মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে। লোকগুলো বড় ভয় পেয়েছিল। ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে দৌড়চ্ছিলো বড় বাতাস চিরে। পরনে সাদামাটা জামাকাপড়। তার ভিতর চামড়া। তার ভিতর মাংস। ভয়ে শুকিয়ে কুঁচকে যাচ্ছে যেন।

_র দলের হাতে ছিল লাঠি। কয়েকজনের হাতে কাটারি আর নানচাকু। পিছু নিয়েছিল ধানক্ষেত ধরে। ওদের পা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল মাটি। সূর্য ওদের পিছনে। টকটকিয়ে লাল। ভয়ের রক্তাভ গোলক। চৌকো চৌকো গোলক।
আকাশটা যেন ছেঁড়া জামা পরা ভিকিরি মানুষ। ফুটিফাটা জামা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে লাল কিছু একটা। কি ওটা? ভয়ের উপশম? খিদের ভয় থেকে মৃত্যুর ভয় পর্যন্ত সুদূরপ্রসারিত আলপথ। সেই বরবারই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সান্ধ্য চেইস সীন।

“হঠাৎ আকাশের এক প্রান্ত যেন জড়িয়ে গুটিয়ে গেল কাগজের মতো, আর সেই ছিদ্রপথে যেন এক বিকটমূর্তি নারী উন্মাদিনীর মতো আলুথালু বেশে নেমে আসছে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে চার পাশের বনে শেয়ালের দল আবার ডেকে উঠল, বিশ্রী মড়া পচার দুর্গন্ধে চারদিক পূর্ণ হল, পেছনের আকাশটা আগুনের মতো রাঙা-মেঘে ছেয়ে গেল, তার নিচে চিল, শকুনি উড়ছে সে গভীর রাত্রে। শেয়ালের চিৎকার ও নর-কঙ্কালের ঠোকাঠুকি শব্দ ছাড়া সেই ভয়ানক রাতে বাকি সব জগৎ নিস্তব্ধ, সৃষ্টি নিঝুম!”

উপরোক্ত অনুচ্ছেদটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প থেকে নেওয়া। এখানে বলা হয়েছে মুধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাবের কথা। এটা কেবল কাট আপ বা রেফারেন্স নয়। সেদিন সন্ধ্যা যখন রাতের মোড় নিল, আকাশের ছিদ্রপথে পেট কাটা চাঁদের মতোই আবির্ভাব হল মধুসুন্দরী দেবীর।
লোকগুলোকে ধরে _র দল মোহল্লার সামনে পোস্টে বেঁধে ন্যাংটো করে মারধোর করছিল। পুলিশ তখনো এসে পৌঁছয়নি স্পটে। পুলিশের আগে আসেন মধুসুন্দরী দেবী। তাঁর ঐ ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ত্রস্ত _র দল লোকগুলোকে ঐ অবস্থাতে রেখেই পালিয়ে যায়। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিল এই অত্যাচার, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এগিয়ে এসে ওদের খুলে দেয়।
ওদের মাংসের ওপর দগদগে ঘা, রক্ত বেরোচ্ছে অসংখ্য ক্ষতস্থান থেকে। মধুসুন্দরী দেবীর চোখে তেমনই লাল রক্তের ছটা। রক্তেরা মিশে গিয়ে তাদের অন্তর্গত ভয়ের বিস্ময়কে জাগিয়ে তুলছে।
লোকগুলো বড় ভয় পেয়েছিল। ওদের জেলে পুরে দিয়েছিল। এই ঘটনা এবং এমন অনেক ঘটনার প্রতিবাদের জন্য। ওদের মধ্যে অনেকে বয়স্ক, অসুস্থ। জেলেই কাটবে বাকি জীবন এমনটা জেনেও তারা প্রতিরোধ থামায়নি। তাদের অন্ধকার কুঠুরিগুলোর ওপর কেবল যে রাষ্ট্রযন্ত্রের নজর ছিল তা নয়। মধুসুন্দরী দেবীও নজর রাখছিলেন তাদের ওপর। অভিভাবকত্বের অবলোকন ছিল সেই দৃষ্টিতে। মধুসুন্দরী দেবী ভয় পাচ্ছিলেন না। মাংসের ভয় ছিল না ওঁর সূক্ষশরীরে।

লোকগুলো আর ভয় পাচ্ছিল না। চক্রাকারে শূন্যস্থান পূরণ করছিল।

Facebook Comments

Leave a Reply