জীবন -তোরঙ্গ : অনিতা অগ্নিহোত্রী
মায়া বসে আছে তার তোরঙ্গ খানা নিয়ে। অশ্বত্থ গাছের নীচে রোদ ছায়া মেখে। রাস্তার ধারেই বাড়ী। ইঁটের দেওয়াল। ছাদ অর্ধেক টিন।দুটো বড় ঘর পাকা। পীচ রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাচ্ছে ধসমসিয়ে, গাড়ী , বাস। হর্ণের ডাক আজ কাল ডিস্কো। অনেক ক্ষণ ধরে আকাশ বাতাস মাতিয়ে রাখে।
সকাল বিকেল এই এখন মায়ার কাজ। কাজ কিংবা সময় কাটানোর উপায়।সেই কবে কার তোরঙ্গ, পঞ্চাশ বছরের কম হবেনা বয়স। আঠেরো তে মায়ার প্রথম বিয়ে হয়েছিল, বাপের বাড়ি থেকে তোরঙ্গ খানা নিয়ে সে শ্বশুর বাড়ি এসেছিল। টিনের পাতে গাঢ় কমলা রং করা ছিল তা এখন ফ্যাকাসে, সাদাটে। উপরে ঢিবি ঢিবি নকশা করা ছিল, তা অবশ্য আছে। তোরঙ্গের উপর একখানি হাত রেখে বসে থাকে মায়া, যেন সে কোন ধনরত্নের সিন্দুক আগলাচ্ছে। দিনে চারবার এই তোরঙ্গ ঘরের ভিতর বার করা। মায়া এখন আর বইতে পারেনা। তার পাঁচটি নাতি নাতনির মধ্যে কেউ না কেউ বওয়ার কাজ টা করে দেয়। হাঁক দিলেই হল। ভারি তো নয় খুব কিছু। ভিতরে কি আছে কেউ জানেনা। মায়া তার তালাটি খোলেনা, চাবি থাকে তার আঁচলে বাঁধা। মর্ বুড়ী আমরা কি তোর ব্যাঙের আধুলি হাতিয়ে নেব? সাতবার তোরঙ্গ নিয়ে এধার ওধার। বড় ছেলের বউ বলে। রাগ বিরক্তি যা বলো তারই বেশী, কারণ সেই তো মায়া কে রান্নাঘরের বার করেছে।
বড় ছেলে বলে, হাত থেকে রান্নাঘর গিয়ে মায়ের চেহারা টা শুকিয়ে গেছে, দেখ না? শখ বলতে ঐ একটা জিনিস। তাতেও রাগ করো কেন? রান্নাটা ভালোই করত মায়া। নিরামিষ তরকারী, ছ্যাঁচড়া, কচুর শাগ দিয়ে মাছের মাথা, ডিমের টক, চালকুমড়ো নারকেল । কিন্তু গত বছর কড়াই উল্টে দুটো হাত পুড়ে জখম হয়ে গেল তার। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে রান্না করা মায়ার অনেক কালের স্বভাব। দুই হাত দিয়ে হাঁটু বেড় দিয়ে বসে আপন মনে হাসা। মাঝে মাঝে রান্নাঘরের বাতার দিকে চেয়ে দেখে নেওয়া। এসব ই তার অভ্যেস। শুক্তোর টইটুম্বুর গরম কড়া নামাতে গিয়ে সে কড়াই ধরার ন্যাকড়া দুটো খুঁজে পেলনা। সাঁড়াশি দিয়ে ধরতে গিয়ে কাত হয়ে কড়াই পড়ল হাতের উপর, মায়া কিছুটা শুক্তো বাঁচাতে চাইছিল তাতে আরও বিপত্তি। লাল হয়ে যাওয়া জ্বলতে থাকা চামড়ায় জল নারকোল তেল ইত্যাদি দিয়েও বড় বড় ফোস্কা গজিয়ে ওঠা আটকানো গেলনা। তারপর সেই ফোস্কা গালতে গিয়ে বিষিয়ে গেল ঘা। গালার বুদ্ধি যে দিয়েছিল নাতিবাবু কে ,সেই বড় বৌ ও বোঝেনি এত বাড়াবাড়ি হবে। তাড়সে জ্বর, হাতের ঘায়ের ব্যথা। পনের দিন শয্যাশায়ী মায়া। ছেলে মেয়ে বিয়োতে গিয়ে যে সাত দিনের বেশি আঁতুড়ে থাকেনি , সেই মায়া দুধ সাবু খেয়ে পনের দিন বিছানায়। ভিতর বারান্দায় চওড়া যে বেঞ্চিতে তার বিছানা , সেখানে শুয়ে রান্না ঘরের ছ্যাঁকছোক কানে আসত তার।
নতুন রাঁধুনি এসেছে। তাকে রান্না শেখাচ্ছে বড় বৌমা। তেল কাঁচা থাকছে, ভুলভাল ফোড়ন হচ্ছে। চোখ বুজেই বুঝতে পারে মায়া। কিন্তু কিই বা করবে সে,’ জাগো শ্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী রাই’ গুনগুনিয়ে গেয়ে মুখের হাসিটি পর্দার মত টাঙিয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া? শোবার ঘর গেছে, রান্না ঘর গেল। হাতে রইল উঠোন আর গাছতলা। হাত ভালো করে সারার আগেই বড় বৌমা বলে দিল, তুমি আর হাত পুড়িয়ে রাঁধতে যেওনা বাপু। নাতনী নাতিদের সঙ্গে গল্প গাছা কর। আমরা এদিক সামলে নেব।উঠোন টি তেমন সরেস নয়। বর্ষার জল পড়ে শ্যাওলা। সামনে একটা পুরোন দেওয়াল, ইঁট বেরিয়ে আছে। সেটা শরিকদের বাড়ি থেকে আলাদা হবার জন্য। তার চেয়ে বাইরে ভালো। মস্ত অশ্বত্থ গাছের পাতায় রোদ বাতাস বিকেল পর্যন্ত। বাঁধানো বেদিতে পা ছড়িয়ে বসা। তোরঙ্গটি পাশে নিয়ে। একটা গামছা পাতলে দুপুরের ঘুমটা ও হয়। বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতে হয় এই টুকুই। খাওয়া থেকে তার মন উঠে গেছে বোঝে মায়া। তবু না গেলে নয়। এ রান্না তার জিভে রোচেনা, তবু খেতে হয়। এখন খেতে ডাকছে, পরে হয়তো আর ডাকবেই না ।
অদ্ভুত জীবন টা মায়ার। আটপৌরে তবু যেন চমকদার। আর দশটা মেয়ের মত নয়।দুটো বিয়ে তার।প্রথম বর সুবল। তোরঙ্গ টা প্রথম বিয়ের। দুটি ছেলে তারাও প্রথম সংসারের। বড় মেজ ছেলের বউ নাতি নাতনী সবাই এ বাড়িতে। বাড়িটি কিন্তু দ্বিতীয় বরের। যৌবনবতী মায়াকে ছেলে পুলে শুদ্ধ বিয়ে করেছিল সহদেব। নিজের বাড়িতে ও এনে তুলে ছিল। মন্দ লোকে বলে বিয়ে হয়নি তাদের ।এমনি এমনি একসঙ্গে থাকা। ছেলের বউরাও এতদিন বলত ঠারে ঠোরে।এখন হয়তো সামনেই বলবে।কাগজপত্রে তো কাটান হয়নি সুবলের সঙ্গে। সুবল তার পরেও এ বাড়িতে আসত যেত। বারান্দার এই বেঞ্চিটাতে শুত রাতের বেলা, যেখানে এখন মায়ার জায়গা হয়েছে। এমন কত রাত গেছে মায়ার ঘুম আসেনি। ভরা বুকের উপর সহদেবের হাত আর জানলার বাইরে ঘুমন্ত সুবলের ঘন নিশ্বাস। তার মত বরাত কটা মেয়ের হয়। দুই পুরুষ তাকে জোয়ারের মত টেনেছে দুপাশ থেকে। আর তারই মধ্যে ছেলেপুলে মানুষ করেছে মায়া আর গান গেয়েছে গুণগুণ।রেডিও টিভিতে ভক্তিরসের, কীর্তন অঙ্গের গান যা বাজে গলায় তুলে নেয় সে, আর গুন গুন করে। কিন্তু সুখ সইলনা। দুই পুরুষের লোকদেখানো দোস্তির মধ্যে ফাটল ধরছিল। পাড়াপড়শির চোখ টাটাচ্ছিল। তারাও কিছু বলে থাকতে পারে। একদিন ভরা শ্রাবণের দুপুরে রান্নাঘরের আড়া থেকে ঝুলে পড়ল সহদেব। আর বিপদের আঁচ পেয়ে শ্মশান অবদিও গেলনা সুবল। উধাও হয়ে গেল একেবারে। স্কুলে পড়া দুই ছেলে কে নিয়ে তারপর কত বছর সংসারের জোয়াল টেনেছে মায়া। বর্গায় চাষ দিয়ে নিজে খেত মজুরি , লোকের বাড়ি ধান ভানা, ধাবার রান্নার চাকরি কত কিছু করেছে। বড় খোকা পড়া শুনো ছেড়ে গাড়ী চালানো শিখে নিল। হালে গাড়ীও কিনেছে একটা পুরোনো। ছোটটা মনে হয়েছিল পড়াশুনোয় ভালো। সেও তো কলেজে ঢুকে আটকে গেল। সে এখন জমি জমা দেখে। কিন্তু মায়ের থেকে দূরে দূরে থাকে। কথা বড় একটা বলেনা। অপরাধী ঠাওরায় হয়তো তাকে। যা ভাবে ভাবুক। যা নিজের কানে শোনেনি, চোখে দেখেনি, মায়ার কাছে তার মানে নেই।
একটা অন্য চিন্তা তাকে বড় জ্বালায় আজকাল। এ যেন তার একার মাথা ব্যথা। সেই কবে থেকে সুবলের গুরুবংশের বিধান, সুবল আর তার সন্ততিদের মাটি দিতে হবে মরণের পর। পোড়ানো যাবেনা। বউ এর জন্য বিধান আলাদা। তার বংশ অন্য। সে যদি চায় দাহ করা হবে তাকে। কাঠ কই? বড় খোকা একটা আমের আর একটা বাবলার গাছ দেখিয়ে রেখেছে মায়া কে। মায়ের দরকারে কাজে লাগবে। বাড়ির পিছনের জমির দুটো গাছ পনের কুড়ি বছরের হল। মা বার বার ব্যস্ত করে বলেই দেখানো। তবু মায়ার মনের ভয় যায়না। তার জন্য কি জ্যান্ত গাছের কাঠ সত্যি কাটবে ওরা? আজ কাল একটা বিদঘুটে অসুখ হয়েছ। তাতে শয়ে শয়ে লোক মরল এই কদিন আগে পর্যন্ত। কাঠের দাম আকাশ ছোঁয়া। মানুষের চেয়ে কাঠ দামি। তাকে যদি মাটি দিয়ে দেয় ছেলেরা? মরলে তখনি কি আর জানতে পারবে সে? পরে যদি মাটি চাপা হয়ে দমবন্ধ লাগে? বুক ধড়ফড় করে? ঠেলে উঠতে না পারে? মরা বলে তো আর কাঠ পাথর নয় সত্যি?
মাটি দিবিনা তো খোকা? বড় ছেলেকে ক্বচিৎ কদাচিৎ সে একা পায়। তখন ফিসফিসিয়ে বলে। তোরঙ্গ টা থাকল তোর জন্য। কি আছে তোরঙ্গে কে জানে। মায়েদের শেখানোয় কচি রা মায়ার কাছে জানতে চায়। তোরঙ্গে কি আছে ঠাম্মা? তোমার বিয়ের শাড়ী বুঝি? কানের ঝুমকো? গলার হার? পুরোনো মোহর! মায়া মিটিমিটি হাসে। বলে, আছে রে আছে, সাত রাজার ধন মাণিক ! আমি মরলে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিস। শীত চলে গিয়ে বসন্ত আসার সময় একদিন অশ্বত্থ গাছটা পাতা ঝরায় একটি দুটি করে, তারপর ঝরঝরিয়ে। বাতাসে দুলে দুলে খসে পড়ে পাতা। খসুক। না হলে নতুন পাতার দল ও আসবেনা।মায়ার গায়ের উপর ও এসে পড়ে দু একটা। আজ তার ঘুম ঘুম ভাব। দুপুরে খায়নি। খেলতে খেলতে কাছে আসা নাতি নাতনীদের বলছে, আর কত খেলবি মণিরা? কাঠ টাটের যোগাড় করগে। বড় ছেলে গাড়ি রেখে দুপুরের খাওয়ার পর ঘুমের জোগাড় করছিল। ঠাম্মা কাঠের খোঁজ করছে শুনে সে উঠে বাইরে যায়।কি বলছ মা, দুপুরে খাওনি কেন? মায়া রাঙা রাঙা চোখ মেলে বলে, বলি ঘুমোলে হবে? কাঠের যোগাড় হল না তো!
এই ছিল তার শেষ কথা। ভাত ঘুম দিয়ে এসে বড় খোকা দেখে বিকেলের ছায়া নেমেছে। বাতাসে অল্প শীত। মায়া তখনও ঘুমোচ্ছে। হাতটা ছেতরে পড়ে আছে তোরঙ্গের পাশে। বিকেল ছিল , সূর্য পাটে বসেনি। তবু কাজ সারতে রাত হল। আম গাছটায় ফল আসে। বাবলা গাছটাই চেরা হল। তাইতে লাগল ঘন্টা দুই।শ্মশানযাত্রী রা বাড়ি ফিরে নিমপাতা দাঁতে কেটে উঠতে না উঠতে হাঁড়ি মুখ নিয়ে সামনে দুই বউ । বাবলা গাছ টা তো ফেড়ে দিলে। এদিকে শাউড়ি তো ফাঁকি দিল গো। তোরঙ্গের চাবি পাওনি? সেতো আমি আঁচল কেটে যাবার আগেই খুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু চাবি লাগাব কোথায়? তোরঙ্গ টা উল্টে দেয় বড়বউ। নীচটা ভাঙা, মরচে ধরা। ভিতরে কেবল হাঁফ ধরানো অন্ধকার।
কই সে সাত রাজার ধন মাণিক? মিথ্যে বলে পুড়িয়ে নিল গো!
বড় খোকা বলে, এই জন্য তোরঙ্গ নিয়ে নিয়ে বেড়াত মা, কারো কাছে রাখতনা। জীবন টা তো এইরকম। উল্টে দেখলেই সব পোষ্কার। বাইরে তালা। ভিতরে খালি।
Posted in: December 2021 - Cover Story, STORY