গ্রাউন্ড কন্ট্রোল টু নীলকণ্ঠপুর, গ্রাউন্ড কন্ট্রোল টু নীলকণ্ঠপুর : অলোকপর্ণা

কৃষ্ণার কথা মনে পড়ে রূপার। চকচকে রোদ দেখলেই, কৃষ্ণা আর তার মাকে মনে পড়ে রূপার।
মেয়েবেলা থেকে কৃষ্ণাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল,- ক্ষতের ভিতর দিয়ে ত্রাণ মানুষের নিকটে এসে পৌঁছোয়। তাই খেলতে খেলতে কেটে ছরে গেলে সে কাঁদেনি কখনো। তাকে বলা হয়েছিল শিশুদেহে ঈশ্বর বাস করেন। সে বিশ্বাস করেছে। কেউ সেই ঈশ্বর স্পর্শ করতে এলে তাকে সে পুজো বলে গ্রহণ করেছে। তাকে বলা হয়েছে পিতা পরমং তপঃ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সি। সে নির্বিকারে মেনে নিয়েছে। প্রতিবছর আশ্বিন মাসে, ঘি চন্দন সহযোগে সে দৃপ্ত গলায় বলে উঠেছে, “ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা…”, কৃষ্ণার মনে কখনো কোনো বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ উদ্রেক হয়নি। সবকিছু সে জন্মাবধি তার শিরায় শিরায় বয়ে চলা অটুট বিশ্বাস দিয়ে গ্রহণ করতে শিখেছে। সে প্রশ্ন করেনি। বিয়ের পর পরই তাই যখন কানাঘুষোয় সে শুনতে পেল, যে তার স্বামীর আরও দুটো পরিবার আছে,- একটা হাওড়ায়, একটা শ্যামনগরে, তার একটুও অবিশ্বাস হয়নি। তার মারমুখো ভাইয়েরা তাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে”, বলে উল্টে সে প্রবোধ দিয়েছিল তাদের। স্বামী লোকটা হাওড়ার বাড়ি থেকে ঘরে ফিরে এলে সেই রাতে জলের গ্লাস, লুঙ্গি আর গামছা এগিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা রীতি মতো। লোকটার পরিশ্রান্ত দেহ দেখে করুণা জেগেছিল তার মনে, দয়াপরবশ হয়ে সে বলে উঠেছিল, “আপনার কত খাটনি পড়ে, একবার হাওড়া… একবার শ্যামনগর!”
পুরুষটি মনে করেছিল স্ত্রীলোকের এমন বেয়াদপি শায়েস্তা করা প্রয়োজন, তাই সে দরজা থেকে খিল খুলে আনে, তারপর কৃষ্ণার পিঠে আঘাত করতে যাওয়ার সময় কীভাবে যেন নিজেই পা পিছলে পড়ে। এবং বিয়ের যৌতুকে পাওয়া পালঙ্কের পায়ার আঘাতে তার মাথা একেবারে থেতলে যায়।
এরপর কৃষ্ণাকে নীলকণ্ঠপুর ফিরে আসতে হয়। ততদিনে বাবা দেহ রেখেছেন। ভাইয়েরা আছে। তাদের ঈগলের মতো সজাগ বউয়েরা বাড়ির এখানে ওখানে গুপ্ত। কৃষ্ণা মায়ের পাশে বসে সন্ধ্যাবেলা টিভিতে “এক আকাশের নীচে” দেখে। রাতের বেলা পান্তাভাত খায় পেট ভরে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সবার সব কাপড় কাচে। রোদ বাড়লে ছাদে কাপড় মেলতে দিয়ে নিজেও রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। কাপড় জামা শুকোয় ধীরে ধীরে। কৃষ্ণা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ে যায়। রোদে পুড়ে যেতে তার ভালো লাগে। সারাদিন রোদ খাওয়ার পর বিকেলবেলা জামাকাপড় একেবারে শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে এলে কৃষ্ণা তাদের নিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে। রোদের তেজ খুব বেড়ে গেলে ভাইয়ের বউয়েরা জামাকাপড় ঝলসে যাওয়ার ভয়ে আর রোদে দিতে চায় না। সেসব দিন কৃষ্ণা একা একা নাইটি পরে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। নীলকণ্ঠপুরের সকল পথে পথে যতটা রোদ আছে, কৃষ্ণা সমস্ত কুড়িয়ে বেরায়। এমন প্রখর তাপে যখন সমস্ত বাড়ির জানালা বন্ধ, রাস্তায় কোনো মানুষ নেই, কুকুরেরাও নিরিবিলি হতে চাইছে, তাদের পায়ের তলার পিচ পচে গলে আত্মস্থ হয়ে এসেছে, কৃষ্ণা তখন সূর্যের হাতুড়ির নিচ দিয়ে হেঁটে বেরাচ্ছে। এক গলি থেকে অন্য গলিতে, এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায়, কৃষ্ণার বিশ্বাস কৃষ্ণাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে পুড়তে পুড়তে তার ধারণা গাঢ় হচ্ছে, সে বোধি লাভ করছে, সে টের পাচ্ছে আজীবন যা জেনে এসেছে,- ক্ষতের মাধ্যমে মানুষের ত্রাণ হয়, তা সত্য! তা সর্বৈব সত্য! একেকদিন তার ভাইয়েরা তাকে বারণ করে, এমনকি ভাইয়ের বউরাও কেউ কেউ এসে বলে যায় দুপুর রোদে বেরনোর কুফলের কথা। কিন্তু একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে কৃষ্ণার সাথে তার অশীতিপর মাও সূর্যের নিচে বেরিয়ে আসেন। এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায়, প্রখর তাপের মধ্যে, যখন চোখ বুজে আসে, তখন কৃষ্ণা ও তার বৃদ্ধা মা ত্রাণের প্রয়োজনে নীলকন্ঠপুরের রাস্তায় টহল দেন। বহু বছর পর, যখন মানুষ মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান নামালো, পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় রূপা দেখেছিল একটা রোবট, নাম কিউরিওসিটি, সূর্যের প্রখর আলোর নীচে একাকী, নিঃসঙ্গ,- একটা লাল গ্রহ সে টহল দেবে আগামী কিছু বছর। অটল বিশ্বাসে নুড়ি কুড়াবে, লাল লাল পাথরের ছবি তুলবে, নিজের জন্মদিনে নিজেই “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ” গাইবে একা একা, তারপর একদিন হয়তো এইসব রোদের নিচে নিজের বিশ্বাসে বিশ্বাসী সে চুপ করে মরেও যাবে। সাড়া দেবে না কোনো কিছুতেই।- তখন রূপার কৃষ্ণাকে মনে পড়েছিল। নীলকণ্ঠপুরের পথে পথে প্রত্যয়ী পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে যাওয়া নাইটি পরা কৃষ্ণা, যাকে রোদে পিটছে। আর তার ভালো লাগছে। সে আরাম পাচ্ছে। সে আরাম পাচ্ছে।
ঠান্‌ ঠান্‌ ঠান্‌।
“রোদ পড়ছে। ঠোকরাচ্ছে। নীলকন্ঠপুর, ওভার। নীলকন্ঠপুর, শুনতে পাচ্ছো? ওভার। রোদ পড়ছে। ঠোকরাচ্ছে। ওভার।”

Facebook Comments

2 thoughts on “গ্রাউন্ড কন্ট্রোল টু নীলকণ্ঠপুর, গ্রাউন্ড কন্ট্রোল টু নীলকণ্ঠপুর : অলোকপর্ণা Leave a comment

  1. কল্পনার খাটুনির জায়গা এত বেশি যে লেখিকা ওয়াকওভার দিয়ে মাঠ ছেড়েছেন বলে বোধ হয়। অথবা এ আমার অনভ্যাস, পাঠের অভাব।

  2. এই গল্পের বিষয় আর লেখার ধরনের কাছে আমি মাথা নত করি। কত সাবলীল বিষয়কে এত পরীক্ষামূলকভাবে বাংলা গল্পে তুলে আনার জন্য আমি তোমাকে প্রণাম জানাচ্ছি। আর গল্পের ফ্রেমগুলো নিয়ে বিশেষ বলতে হয়। আর টাইমস্কেল। সময়ের এই বয়ে যাওয়া তপ্ত তাপিত। রোদ। ধারণ ক্ষমতা। বিশ্বাস। অবিশ্বাস। আর রূপার চোখ। অবস্থান এখানে কার্যত মূল ভূমিকা পালন করেছে।

Leave a Reply