দাহাড়দস্তুর : অজিত রায়

কয়লার কালিখ মাখা উদাস উজাড় দুনিয়া ….
এ এক আজব নিরালা নিসর্গ, যেন আরেক কর্ণোপাখ্যান, কিন্বা দাগা বলেছে যাকে, নিদেন তাহারই অন্ত্যমিল। সাঁঝবধূ হেথায় বিকেল ঢলার আগেই গলায় ফাঁসগেরো মেরে ঝুলে পড়ে। আগুনের থালার মাফিক কয়লা-রাবিশের কালো থাক বেয়ে গুঁড়ি মেরে উঠে আসে ধুসর চাঁদ। মালকাট্টারা গাঁইতি-বেলচা-খাপচুরি কাঁধে গাময় কালো ডাস্ট মেখে চান করতে নামে মাইঠালে, ধাঙ্গি মহল্লায়, বাউরি ধাওড়ায় আখার ধোঁয়া আর চুল্লু-মাড়ির গন্ধে বাতাস তখন বেজায় ম-ম। বাজারে চা-সিঙাড়া-ঘুগনির পসরাগুলো খুলে গিয়ে, পাশাপাশি মুর্গা লড়াই, তুকতাক, ঝাড়ফুঁক আর চুহামারেকা দাওয়াই, দাদ-খাজ-খুজলির মলম বিক্রির ধুম।পচা নর্দমার খানা মাড়িয়ে গামলাভর্তি চালধোয়া জলের মতো তাজা তাজা মল খাটা পায়খানা থেকে উপচে পড়া নোনতা আর হলুদ, একজাই দেখলে দীর্ঘ ওয়াক বেরিয়ে আসার হেকমত। ফেরাফেরি দৃশ্যে, তাহারই মাঝে, চোখে পড়ে, একটা ধাড়ি শকুন লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে গুটিগুটি এগিয়ে এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে মরা বিল্লির ছা। ওদিকে হরদম মাইক বাজছে মসজিদে, আজানের শোর, বাজুতে মহাবীরজীর আখড়া, লাল, তেকোনা শলু উড়ছে বাঁশের মাথায়, খঞ্জনি বাজিয়ে দেহারায় রামা-হো গাইছে কেউ…
হাঁলাকি এসবে কিছু এসে যায় না কোল-ক্যাপিটাল ঝরিয়ার। নিজের চালেই পার করছে সে পুজোপালার সিজিন। দশেরা গেছে, দেওয়ালি পেরিয়ে, শীতও আসছে জেঁকে, হাওয়ায় এসময় খানিক বেশিই দোলা, আর আসছে তালাব ঝেঁপে আঁখ চাউল হলুদ সিঁদুর ছট মাইয়ার ঢাউস সংসার। তো, পর-কি-সালের মাফিক এবারেও তাই বিশাল তাঁবু পড়েছে জেমিনি সার্কাসের, ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে, দড়িতে ঘাঘরা শুকোচ্ছে, পেছনে সাউথ ঝরিয়ার বাতিল খাদানে জল এখন পুরোই নাব্য।খাদের চাদ্ধারটা কোলবারির মা-বুনদের দু’বেলা রেচনখানা তো সম্বৎসরের, এবাদে কিছু সবুজ গিজিয়ে হালফিল চরবাহাও ব’নে যায় এই পালাপার্বণের সিজিনে। আশপাশের শোরের বাচ্চা, মবেশিরা টুংটুং ঘুঙুর নেড়ে ঘাসফুস চরে আর ঘুঙট ঝোলানো মা-বুনেরা শবনমে পাছা ভিজিয়ে ঝাড়া ফিরে চলে। বেচারি সার্কাসের আনাড়ি ঘোড়াটাও দেখাদেখি চরতে এসে পা লুড়কে একদম গাভরার জলে। আল ঘিরে শিয়ার আর গিধ্-শকুনের বেজায় জমঘট এখন।
কিন্তু শুধু যে ছট আসছে কি শীত, কিন্বা সার্কাসের ঘোড়া পড়ে গেছে খাদানে, সে কমই বলার। বেড়ে যে খবরটা, তাশাপার্টির কান-ভেদানো হর্ষ শুনে গড় খাইতে হাগতে বসা ললনাগুলোও যেটা আন্দাজাতে পারে, আবকি বার পাক্কা তিন সাল বাদ জেল থেকে ছুটেছে মহান মজদুরদরদী রাজপুত নেতা বীর বাওনপ্রতাপ সিং, আর তাইতে শহর ফিলাল একজাই ফুল্ল।
বহুত দিন বাদ তল্লাটে শানদার জুলুস। শেষ পটাখা ফুটেছিল আরজেডি নেতা ভুনেশ্বর যাদোর ঢাই হাজার ভোটে জেতা, বিজয় মিছিলে। সেদিনও এরম, ভাগা বনিয়াহির এনাকোঠি ঝরিয়ার দিগ্বিদিক জুড়ে বিশাল হুল্লোড়। তাশাপার্টি, মৌগা নাচ আর গুলাল-ফাগুয়ার রঙিন ধুলোয় আটকা পড়েছিল কয়লাকুঠির তামাম ঝড় আর ঝট্কা।
আজ তারই জবাবী জুলুস। পুরো তিন সাল জেলের হাওয়া খেয়ে কায়া আর মিজাজ বিলকুল দুরুস্ত করে ফিরেছেন বীর বাওন সিং। বদনের ছব্বা দেখে দিমাগ একদম চকরে যায়। গঠিলা, আগের চেয়ে আরও তন্দরুস্ত, এক বুঁদ চর্বি নেই, কোথাও।তারবাদে একদম সাফ মলমলি ধোতি-কুরতা, ডাহিন হাতে ইস্পাতের বালা, বাঁয়ে সোনার জঞ্জির। মাথার বাল জেলে যাবার আগে-থাকতেই এক-খামচা। পহেলবানদের ঐ নিশানি, মাথার চাঁদি থেকে গর্দান অব্দি, বিলকুল চাঁছা। বিহানে ফের দাড়ি বানাতে গিয়ে চুক করে অস্তুরা চালিয়ে জুলপির তলহাটিও খানিক চেঁছে ফেলেছে দারোর হাজাম, তাইতে কিঞ্চিৎ
সভ্য-ভব্য, আর মোচটাও রাজপুত রুচির বিপরীত, ঈষৎ সরু, দু-ফালি কালিমির্চা যেমতবা। গোটটাগুলি মিলিয়ে অনেকটাই মার্জিত আর পরিপাটি তিনি আজ, আজকের জুলুসের মধ্যমণি তো তিনিই, তামাম কোলফিল্ডে রাজপুত শানের শেষ ধিকি আগুন, আখেরি দাপট। মাফিয়া ডান, ঘোটালা সরগণা, খুনি দারিন্দা — দরপরদা লোকে যে-যাই বলুক, সমুখে সবাই কিন্তু জোড়হস্তে ‘বাবুসাহাব’।
আজ ফজিরে যখন হবন চলছিল হাভেলিতে, তাঁকে বরণ করে পূর্ণমাসি যাগ, হনুমানজীর দেহারা থেকে অগোর-চন্দনের টিকা লাগাতে এসে মিসিরবাবার চক্ষু ছানাবড়া। যজমানের শানে চার চাঁদ লেগে গিয়েছে। গেঁদাফুলের বরমালা-হাতে জিলা মহকুমা থানা বা লোকাল পোলটিশনদের কে না হাজির ছিল দর্শনাভিলাষীদের কাতারে! তার সঙ্গে গত তিন তিন ইলেকশন ধরে তিনিই তো জন্ প্রতিনিধি, আঙারপাথরা জিনাগড়া আকাশকিনারি এনাকোঠি লোদনা আর মোহানা কোলবারিতে বিশাল ইউনিয়ন তাঁর, হাজার হাজার মজদুর-কার্যকর্ত্তা, এজমালি ভাই-বিরাদররা তাঁকে এক ঝলক দিদার করার জন্যে মুখিয়ে, জাতভাইরা হাত মেলাবার ঠেকায় পরিশান; সর্বোপরি পাবলিককে জানান দিতে হবে তাদের মহান দরদী নেতা বীর বাওনপ্রতাপ সিং এখনো জিন্দা আছে, কোওনো মাই-কে-লালের এতনা তাকৎ নেই যে তাকে তিন সালের বেশি ঠুঁসে রাখতে পারে জেলে। জিলা মাজিস্ট্রেট বদ্রিকা ঝা-রও নেই, থানা প্রভারী চন্দরদেও যাদবেরও নেই। জিলা মাজিস্ট্রেট হায় হায়! থানা প্রভারী চন্দরদেও যদো কা তবাদ্লা করো! পুলিশ-প্রশাসন মুর্দাবাদ! মুর্দাবাদ! মুর্দাবাদ!….
বিজয় মিছল চলেছে কাতরাস মোড় ছাড়িয়ে ঝড়িয়া বাজার মুখে। চকটা মূলত চৌমোহনা। রাজ কলেজের ঢাল বেয়ে নেমেছে যেটা, ধানবাদ-সিন্দ্রি মেন রোড, সেটা যাবে মোড়ের প্যাঁচ খেয়ে সোজা উপ্পর কুল্হির নামুপথে। আর, দ্বিতীয় যে বড় রাস্তাটা, ভায়া-কেঁদুয়া করকেন্দ রোড, সে যাচ্ছে ঝরিয়া মণ্ডি টপকে চার নম্বর বস্স্ট্যা’। এ-বাদে, ছোটোমোটো ভাঙা বেবন্দেজ ছিটপুট সুঁড়িঘুঁজির তো খামতি নেই, সবই আস্তব্যস্ত ধাবার মেরেছে এই জংশনে।
জংশনটা স্রেফ গাড়িদের নয়, গাড়িবানদের নয়, চকের চার মোহানাই এখন বাওন সিংয়ের কজায়। তাঁর জাতভাই, চামচা, উঠতি লিডার, পায়দল সিপাহি, বডিগার্ড আর যুবরাজদের দখলে। মুহুর্মুহু বাজি ফুটছে, হাউই, রকেট, তুবড়ি, রংমশাল। গদাম গদাম ঢেঁড়া পিটছে, নাকাড়া, দুন্দুভি। তাশার হাফরে পাছা মুচকে ধুন্ধুমার কারবা। আর উড়ছে ফাগুয়া, হরা-পিলা-লাল গুলাল। রংবাহারি আলোর ফোয়ারা, সমাজবাদী পতাকা। পেছনে বিশাল জনসাগর, পেছনে কাজ ছেড়ে ছুটে আসা মানুষের বেসামাল দাহাড়। কানে কান, মুণ্ডিতে মুণ্ডি ঠুকে যাচ্ছে, আইসান্ হুড়।
সবচে মুশকিলে ফেঁসেছে, রিক্সায় চড়ে মরদ আর বাল-বুতরুকে নিয়ে মাসোয়ারা ইভলিন্শো দেখতে বেরিয়েছে ভালগোরা ধাওড়ার গুলাবী বাউরি, দেশবন্ধু টাকিজ, বহুতদিন বাদ ঝক্কাস পিকচার লেগেছে অমতাবচ্চনের; এখন মাথার নওরতনে, গ্রীবার হিমানীতে ধুলো লেগে মজাটাই ফুর হয়ে যাচ্ছে অনর্থক, তদুপরি তাশার গগনচেরা গোঙানিতে বুতরুটার ঘুম লোপাট হয়ে বডিসে পোরা মাই-দুটো হেবি পরিশান। গুলাবী ছটফট চোখে ঘনঘন এদিক-ওদিক চায়, আর অসহায় সন্দিগ্ধ স্বরে মরদকে শোধায়,—‘এ নিমুয়া কে বাপু, পিকচর শুরু না হো জেতেই?’
ফুউস করে একটা হাউই ছুটে গেল আকাশে, উড়ে গিয়ে নামতে লাগল,— ফটাশ-বুউম্! ততক্ষণে আরেকটা ছেড়ে দিয়েছে। তাশাপার্টি জোরসে।
পুরুলিয়া-ফেরত লজঝড় বাসটা আসছিল চৌথা কুল্হির প্যাঁচ ঘুরে, এসে গাঁক-গাঁক করে পাশ চাইছিল, বডি বাজিয়ে একলপ্তে বাসটার মুখ ঘুরিয়ে দিল বাওন সিংয়ের রংদাররা। দু-জন কন্ডাকটার আর একজন হেলপার তড়বড়িয়ে নেমে টিকিট-না-কাটা পসিঞ্জারদের ঢুঁড়তে লেগে গেল। হেলপারটা গেটের রড ধরে তড়াক করে উঠে গেল বাসের মাথায়। ময়লা চেকলুঙ্গি, গেঞ্জি আর জালিদার টুপি পরা একটা লোক লম্বা দাড়ি লম্বা কান লম্বা থনঅলা একটা রামছাগল নামাচ্ছিল গলার দড়ি হিঁচড়ে, হেলপারটা খপ্করে ওর কব্জি চেপে ধরল। ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে পাইলটের খিড়কি দিয়ে ঝুলে সোজা চা-দোকানের তক্তায় গিয়ে ঠ্যাং উঁচিয়ে বসল।—‘চাহ্ পিলাও হো দসরথ্ ভৈয়া।’
মাঝখান থেকে বিক্রি বেড়ে গেল দশরথ সাও চা-অলার।
হনুমানজীর পিছুয়ারি ঘেঁষে হাজার গণ্ডা হলুদ সুতো, গোবর, সিঁদুর আর মানতের ঢিল বাঁধা দেড়শো সাল পুরানা বটবাবা। তার মাজা ঠেসে বড়মতন আমকাঠের তক্তায় চানার ঘুগনি, ফুলৌরি-লিট্টির টুকরি আর চায়ের প্রভূত সরঞ্জাম। খোন্চার একপাশটা খালি। ওখানে তিন-চারজন লোক বসে দিনভর তাশ পেটে, গাঁজাভাঙ খায়, দেশের জমিজিরেত আর বর্ষার হালচাল নিয়ে গল্প করে, মেহরারুর দুঃখে গানা গায়, অথবা ভোঁসভোঁস নিদ্রা মারে। দশরথও মনে হরিষ পায়। মুখ বুজে নিজের কাজ করে। উনানে ঝিক দেয়। কড়াইয়ে ছোলনি নাড়ে। কিন্বা, কাজ না থাকলে পাছার কাপড় তুলে খোস পাঁচড়া খোজায়, নচেৎ গামছি নেড়ে মাছি। ঢাবাটা ফুটপাত খারিজ করে মেন রোডের কাঁখে চড়তে বাকি, কিন্তু কারো মজাল নেই উংলি তোলে। পবনপুত্রের কৃপা, কিন্বা খোদ বাবুসাহেবের ছত্রছায়া—যাহাই হোক, সরকারি অতিক্রমণ হটাও পার্টির কাছে বারদিগর মুকুব পেয়ে এসেছে দশরথ।
সাঁঝঢলার আগেই মায়ের আঁচলে ফিরতে চাইছিল দুজন বাঙালিয়া—বিপলানু আর ওরজুন।ট্রাক-ডাম্পারের লেলিহান কাতার ঘেঁষে ঘষটে-ঘষটে এই অব্দি এসে, আর পারে না। অগত্যা মেজাজ খাট্টা করে বাইক খাড়িয়ে গমন স্থগিত রাখতে হয়েছে ওদেরকেও। দশরথের গাঁহক উপচে পড়ে এখন বসার জায়গা লোপাট। দু-পেয়ালি চা কোনমতে হাসিল করে ওরা তাই একটু নির্জনে, বাসের পাশটায় এসে দাঁড়াল। প্যাসেঞ্জারের ওঠানামা তখনও জারি। একজনের হাতে কুটুমবাড়ির মিঠাইয়ের ভাঁড়, রস চুঁইয়ে পড়ছে। তার কাঁধে ঠ্যাং ঝুলিয়ে একটা বাচ্চা, বাঁদরছানার মতো ড্যাবড্যাব করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বিপলানু ভুরু নাচাল, বাচ্চাটা হাসি ফোটালো। ওরজুন ভেংচি কাটল, বাচ্চাটা লাথি দেখালো। বিপলানু মজা পেয়ে হাসতে গেল, সোঁৎ করে একটা মশা ঢুকে গেল ওর মুখে। বিপলানু খাঁকলো কিন্তু বেরল না। ‘হ্যায়াক থুঃ’ করে থুকে দিল। ‘শালাহ্’—ফের খইনির ডিবে বের করে হাতে রাখল, —‘এ বাঞ্চেৎ পাণ্ডে সাহেবের কুত্তাটা পাণ্ডে সাহেবের চেও হারামি আছে। আমাকে দেখলেই ভুঁকতে লেগে যায়, ভোউ ভোউ ভোঃ ভোঃ! আমি শালা চোর আছি, না গাণ্ডু! আঁ?’ — বলে, বকেয়া হাসিটা ফিনিশ করে খইনি ডলতে লাগল।
খুরিতে চুমুক লাগিয়ে দাড়িয়াল ওরজুন সিগারেট ধরিয়ে ভলভল করে ধোঁয়া ছাড়ে। চতুর্দিকে অনুকম্পার চাউনি, আর ক্ষণে ক্ষণে হাঁটু নাচায়। একটা বিশাল কিংসাইজ মহিলা নামছিল বাস থেকে, ওরজুনের নজর বরবস ওদিকে। লাইট পোস্টের মন্দিম আলোয় গোদনা-উল্কি ভেসে ওঠে। বিশাল উভাওদার ছাতি, হাঁটার ছাঁদে থপ-থপ লচক খায় বিপুলা নিতন্ব। বদনে হলদি-মির্চার মহক অল্প দূর থেকেও যথার্থ টের পায় সে, ওরজুন। বাপস্, বিহারী বউগুলোর বডিস-ব্রেসারির এক-একখানা কাপের যা সাইজ, সে ভাবল, বাঙালি মেয়েরা পেলে প্যান্টি বানিয়ে পরবে।
ভেবে সে, ওরজুন মচ্ছবের দিকে তাকাল। জুলুস খুব ধীরচালে এগোচ্ছে। বাওন সিংয়ের চামচাগুলো জোর নাচ ধরেছে, হাউই রকেট বাজি ফাটছে, আবিরে-গুলালে রঙিন হয়ে উঠেছে চাদ্ধার। বেদম পিটছে নাকাড়া, ঢোল ঢেঁড়া তাশার চোঙা কান ভেদিয়ে দিচ্ছে। জোড়াপোখরের উচক্কা লৌণ্ডা রামপিরিতিয়া, মওগা নাচ নেচে হাতছুট তারিফ পেয়েছিল গেল-ফাগুনে, খোদায় মালুম কোত্থেকে খবর জুটিয়ে, বুকে নারিয়েলের আইচা বেঁধে, মেয়েদের মতো ঝিলাকানো চোলি, পেটিকোট, গা-ভর্তি কলাপ, নাকে নথুনি, কানে ঝুমকা, গালে রুজ-সিঁদুর, মলের ঝুমঝুম তুলে মাঝ-মচ্ছবে আচকা হাজির—

ঝুমকা গিরা রে,ঝুমকা গিরা রে
ব্যারেলি কে বাজার মে ঝুমকা গিরা রে…

জুলুস থেমে আচম্বিতে, ধড়ফড়িয়ে গেল জটলার ছাতি। মাস্টারের ধুন ফিসলে গেল তাশা হতে। মুহূর্তে লকোয়া-মারা খানখান। লাল-পিলা-হারা আলো ঝরছে রামপিরিতিয়ার অরগানজা থেকে। বুক আর মাজার পোজ নিয়ে সে তালি ঠুকে বাইতের দিকে আঁখ মারল। অমনি চাদ্ধারে হল্লা উঠল— ‘আরে রামপিরিতিয়া গাণ্ড আ গইনি রে, গাণ্ড রামপিরিতিয়া আ-গইনি—‘

চোঙায় নতুন দাপ শুরু হলোঃ
ব্যারেলি কে বাজার মে ঝুমকা গিরা রে…..
ঝুমকা গিরা রে।ঝুমকা।গিরা ঝুমকা গিরা রে।
ব্যারেলি কে বাজার মে ঝুমকা গিরা রে…..

ঠমক-দর-ঠমক রপ্ত করেছে রামপিরিতিয়া। চোখের ঠার দেখিয়ে, ভিরকুটি হেনে, কানখি মেরে, ছলাৎ ছলাৎ চুতড় লচকে নাচছে। পেটিকোটটা ঝটকা খেয়ে ঢোঁড়ির নিচে একেবারে খসে পড়ার চান্স। তাই দেখে সমবেত জনতার বেদম তড়পানি। নাভির ক্রমঢালে, এবং খাস করে পায়ুভাগে সব ক’টা মরদের হাঁপ আটকে রেখেছে রামপিরিতিয়া। বুকটা লাল চোলি দিয়ে আঁট করে বাঁধা। চোলির গিঁট যেখানে, সেখান থেকে শুরু নারকোলের উভার। তিরতির করে কাঁপছে খোপরা-দুটো। শুকনো খটখটে ঠোঁটে সে কী থিরকানি!

ঝুমকা গিরা রে, ঝুমকা গিরা রে
ব্যারেলি কে বাজার মে…

দর্শকেরা গর্মে গেছে নতুন করে। রামপিরিতিয়া নিজের রোঁয়াচাঁছা শীর্ণ উরুতে তালি পিটিয়ে বেদম উছলাচ্ছে। বাজনার তালে তালে নানান নয়নঠার, ছিনাল হরকত।

সঁইয়া আয়ে নয়ন ঝুকায়ে ঘরমে চোরি চোরি
বোলে, ঝুমকা ম্যাঁয় পহনা দুঁ, আ জা বাঁকি ছোরি ……

বাবা ট্রান্সপোর্টের জওয়ান-লাখেড়া ছোঁড়াগুলো তাশ পেটানো থুয়ে ছুটে এসেছে, এর-ওর গর্দানে হাতের জ্যাক রেখে সার বেঁধে সব দাঁড়িয়ে। রামপিরিতিয়া আঙুলের তুড়ি বাজিয়ে এক-এক করে কাছে ডাকছে আর এগিয়ে যেতেই তার সঙ্গে লুকোছিপি খেলছে। ছোঁড়াগুলোর ছাতিতে গুদগুদি, তুফান মচলে গেছে সিনায়। চোখাচোখি হতেই কানখি মেরে দিচ্ছে, রামপিরিতিয়ার কুদন তাতে আরও লাফাঙ্গা। মালা-দুটো কপাৎ কপাৎ লাফাচ্ছে। পাছা দুলছে। পেট কাঁপছে। দেহটা পেছন দিকে বেঁকিয়ে বুকের নারিয়েল-দুটো আরো উঁচু করে ধরছে। সমবেত জমাতের ছাতি ধড়কাচ্ছে, রীঢ়ের হাড্ডি খাড়া। দাঁতের তলায় উংলি দাবিয়ে পলক পুরো চিরে, ‘হায়রে বপ্পা!’ রামপিরিতিয়া তখন নিজের ক্ষয়াটে দেহটাকে ধনুকের মাফিক পাছুদিকে ঝুঁকিয়ে খোপরা-দুটো আইসান্হিলাচ্ছে, তাতেই বুড়ো-বুজুর্গের খুনেও আগুন ধরেএকশা। উত্তেজনায় ফেটে পড়ে হাতের তলপাটিতে থাপ্মেরে ওরা চ্যাঁচাচ্ছে—হায় বপ্পা গে, মার দেল্হা সরওয়া, জান লে লেলস্ গাণ্ডুয়া’—। কেউ-বা বিড়ি ছুঁড়ে মারছে, কেউ টাকার পাত্তি দেখাচ্ছে, কেউ হয়ত হাত-পা ছুঁড়ে ঠোঁটের শিস্মেরে নিজের মধ্যেই হটোপুটি খাচ্ছে। লোদনা কোলিয়ারির এক হাফবুড়ো মালকাট্টা তড়াক করে উঠে বুকে হাত দিতে গেল লন্ডার, চকিতে অমনি ছিটকে গেল রামপিরিতিয়া—

ম্যায় বোলি না, ন্না না বাবা! না কর জোরাজোরি
ম্যাঁয় হুঁ বালম গোরী…..
ওঃ ঝুমকা। গিরা ঝুমকা। গিরা ঝুমকা গিরা রে ……

মুশরটা একটু বেশিই আউট হয়ে গিয়েছে। সবাই ডাঁট-ফটকার করে ভাগিয়ে দিল জমাত থেকে। বাবুসাহেব গরদান তেরছে কড়া নজরে চাইলেন। রামপিরিতিয়া তখন একটা একশো টাকার পাত্তি ঠোঁটে দাবিয়ে বেদম জোরে লাফাচ্ছে। জটলার মধ্যে প্রচণ্ড শোর উঠল, হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি, গায়ে গা গড়াগড়ি, চিৎকার, হাততালি—তাশাপার্টি আরো জোরসে।
একটা নাম্বার প্লেট-নোচা শাদা সিরুস কালারের সুমো এসে দাঁড়াল দশরথের চা-ঢাবার ছই ঘেঁষে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পাল্টি খেল। ঝটিতে টাল খেয়ে গেল বাতাবরন। ভুনেশ্বরের ভাতিজা রজ্জু যাদো এসে গেছে। খবরটা মুহূর্তে মরা ইঁদুরের বাসের মতো ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিক। আশপাশের ভিড় খালি হয়ে গেল। গাঁহকরা যে-যার শালপত্তলের দোনা হাতে এদিকে-ওদিকে ছিত্রে গেল। ফুলৌরির কড়াই চুল্হা থেকে নামিয়ে খোন্চার একপাশে সরিয়ে ঝটপট একটা কাচের গ্লাস ধুতে লেগে গেল দশরথ। একা ওর আট সালের বেটা রাধিয়া, আগের রাতে ফুলিয়ে রাখা খেসারির দাল পাটায় ফেলে পিঁয়াজ আদরক লহসুন সমেত উবুমতো বসে বদনভর তাকৎ ঢেলে মারমার বেঁটে চলেছিল নোড়া,— একা সে-ই খেয়াল করতে পারেনি, কমবক্ত। তাইতে বাবান্ডার।
‘এ তেলিরাম,’— দোকানে পয়ারবিন্দ রেখেই জরিপি আন্দাজে রাধিয়ার দিকে ভুরু খিঁচে খানিক ঠাটানো গলায় জানতে চাইল রজ্জু যাদো,— ‘ই ছোঁড়া কেকর বা হো?’
বয়স বিশ-বাইশের ওধার নয় কোনোক্রমে, শীর্ণ, হিলহিলে, পাক্কা ছ-ফুটিয়া ধুন্বা জোয়ান, ঠোঁটের সৃক্কণী ঘেঁষে রৌয়া-কিছু উগেছে জরুর, কিন্তু সুরত বিলকুল কচিকাচা, মাসুম। তদুপরি এক পাঁইট ভিস্কি হরদম মাথায় চড়া, তাইতে গাল-দুটিও সদাই রাতুল।
‘কা হো, মামলা গোল হোখি কা?’— খইনির হিস্সা দেবার অছিলায় দশরথের পাশে এসে ফিসফিসিয়ে খটকা জাহির করে বস-ডলেবর লোহা সিং। দশরথ পাঁচড়ায় জোর আঁচড়ি মেরে একলপ্তে ভিরুতে এসে দাঁড়াল স্বয়ম্ভু বজ্রপাতের, তদুপরি জোড়হস্ত,— ‘হাঁ হাঁ রজ্জুভৈয়া, ই হমার লইকা বা’ব— কাঠের হাসিও জানাতে ভোলে না—’জুম্মা জুম্মা চার রোজ ভইল, আইলে বানি গাঁও সে। বতরু বা, টোন-শহরকা রীত-রিয়াজ জানত নৈখে। গুস্তাখি মাফ কর দিয়ল জালা ভৈয়া।’—তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় হাঁকল,— আরে, এ রাধৈয়া! হোইজা আন্হার মে কা ধইল বা।হেনে আও’ —
রাধিয়া কী বুঝল কী ভাবল, নোড়া ছেড়ে ঝটপটিয়ে উঠে দাঁড়াল। নাকের ডগায় সিকনির একশা। ভেবুয়া চোখে আটকে থাকে বাপের পানে চেয়ে। ‘হেনে আও’,— বাপে ফের ডাঁট লাগায়,— ‘জরিকো লুর নৈখে তোরা। আরে, রজ্জুভৈয়া আইল বানি, রামরাম বোল, দুইঠো লিট্টি দে পিলেট মে, আর পিঁয়াজ মির্চা নিমক। জল্দি!—‘
ধোয়া গ্লাসটা, আর এক লোটা পানি নিজেই এগিয়ে দিল দশরথ। রজ্জুভৈয়ার গোসা খানিক বাগ মানল তাতে, প্যান্টের পকেট থেকে একটা আফিসর্স চাইসের নিব বের করে বাঁ-হাতের মোচড়ে কড়কড়িয়ে ক্যাপটা খুলে, বোতলের খানিকটা গ্লাসে ঢালল, জল মেশাল, তারপর ঢক করে মেরে দিল পুরোটা। আঃ! একটা ঢেকারও তুলে নিল চটপট, যেন, বেজায় ত্বরা।
ততক্ষণে ওর লোকেরা গাড়ি থেকে নেমে যে-যার নিজের পোজিশন নিয়ে নিয়েছে। বাওন সিংয়ের চামচারা জানতেপারেনি, কিন্তু দশরথ সাওয়ের গাহকরা দোকান খালি করে দিয়েছে। সবাই জানে আসল কাজটা তো সারবে রজ্জু যাদো খোদ, বাদবাকি লোক শ্রেফ ভিড় ফাটাবার জন্য আসে।তারা হল্লা মাচাবে, বড়জোর গুটের কেউ ফেঁসে গেলে উলটো-পালটা ফায়ার করে রাস্তা বানিয়ে দেবে ভাগার জন্য। ওদের একজন এসময় গাড়িতে চাবি ডেলে রেডি থাকে, ‘কাজ’ ফতে হতেই সাঁ করে স্টার্ট দিয়ে সোজ্জা টপ গিয়ার।
রজ্জু যাদো ভেতরে ভেতরে গর জমা করছিল এতক্ষণ। এবার নজর তুলে দেখল দূরে ঠ্যাং-তোলা কুত্তার মাফিক হেলান দিয়ে একটা পুলিশের জিপ, দুজন সিপাহী আয়েশে খইনি ডলছে আর মজা নিচ্ছে মৌগা-নাচের। ইনিসপেক্টর রঘুনন্দন সিংকেও দেখতে পেল। ভূমিহার লিডার শত্রঘন দেওশর্মার সঙ্গে তোড়ে হাত মেলামেলিতে ব্যস্ত। বাওন সিংয়ের চামচা-সব মৌগা ডান্সে বাওরা ব’নে আছে। আর খোদ বাওনা, হারামি, নোটের কবুতর ওড়াচ্ছে ধীচোদোয়া! গাল বেয়ে পানের কষ, জামায় পসিনার ছিটা। ‘মাধার’— সামনে বাঙালিয়া-দুটো না থাকলে মুর্গির গেঁড়ি আর আধ ছটাক ভিষ্কিই উগরে দিত রজ্জু—‘চোত্’ শব্দে পা বাড়ালো। প্যান্টের পকেটে টাটিয়ে আছে, ছটফট করছে ঘোড়াটা।
‘হট জাইয়ে দাদা, বেকার কা গোলি খাকর মরিয়েগা! এ দসরথ ভৈয়া, বিক্রিবাটা বন্দ্ করিও, ভিড় হটাও ভৈয়া, বড়া গোল হোয়েকে বা’ –
ফুল মোশানে হাগা পেলে যেমন, বাঙালিয়া খোকা-দুটো বাইকে পাছা সাঁটিয়েই কিক মেরে দিল। ডলেবর লোহা সিং বাসের সীটে চড়ে স্টার্ট দিল। গুলাৰী বাউরির বুতরুটা ভয়ানক রোল তুলল কান্নার। চুড়ি নাকছাবি ঝিকিয়ে একশা। চপ্পলে ক্ষুরধবনি, হা রে রে রে ধাওয়া পেছন থেকে। একটা কয়লাবোঝাই বোরা ঘুলটে গেল ধড়াম্সে। একা, একা ঐ পাটনাই রামছাগলটা, সে তার মনিবের সাথে পালাবে না কিছুতেই। সুতরাং বিশ্রী বিকট বুব-বু-বু শব্দে নারাজগি জাহির করে যাচ্ছে লাগাতার…
আর, ওদিকে তো এমনি, বাজার সব্জিমণ্ডি ঝুগ্গি ঝোপড়পট্টি পচাখানা আর আবর্জনার স্তূপ থেকে ধেয়ে আসা বেসামাল মানুষের বুক ছলাৎ ছলাৎ লাফান খাচ্ছে রামপিরিতিয়ার ঠুমকায়। আর ঝমঝম বাজছে নাকাড়া, আর কানভেদানো তাশা। আর আবির-গুলাল-ফাগুয়া উড়ছে। আর পতাকা লহরাচ্ছে। আর হুসহাস্ রকেট-হাউই ছুটছে। আর, রাজধানী-শতাব্দীর চালে ভিড়ের ফাট চিরে ভরসন্ধ্যায় ভরা রিভলবার হাতে ছুটে যাচ্ছে অই, ঢ্যাঙা, ঠিনঠিনে, ছ-ফুটিয়া রভ্জো যাদো,—উর্দ্ধাঙ্গে সে কী বাঁও তার! এক-এক স্টেপ তিন সাড়ে তিন ফুটের, জমায়েতি মজলিশের ভিড়ে তাকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না আর।
রামপিরিতিয়া ঘেমে-নেয়ে একশা। শেষ ঠুমকোগুলো লাগাচ্ছে। নারকোলের আইচা-দুটো জোর ফেটে পড়ার মুখে। ঠিক সেই মুহূর্তে,— কপাত্ করে আঙ্রাখার কলার ধরে গরদানে থাবা লাগাল রজ্জু যাদো। নোটের বান্ডিল আর মুঠো-ভর্তি ফাগুয়া সমেত মাটিতে টাল খেয়ে পড়ে, ধুতিতে ধুতি জড়িয়ে, হকচকানি কাটাতে আধমিনিট সময় লেগে থাকতে পারে বাওন সিংয়ের, কিন্তু ততক্ষণে তার কানপট্টিতে পিস্তল সঁটিয়ে দিয়েছে রজ্জু যাদো।
-’আরে, ইসকো ভি মার দিয়া! বাবু সাহেব কো লুড়কা দিয়া রজ্জু যাদোয়া। উ দেখো, দিওয়ার তড়পকে ভাগা, পকড়ো পকড়ো!’—হুড়হুড় করে বলিপ্রদত্ত চামচার কেরবালা,—লাঠি, গাঁইতি, কুদালি, বেলচা, ফাটা বাঁশ, ভোজালি, পিস্তল হাতের নাগালে যে যা পেয়েছে, নিয়ে রজ্জু যাদোর পেছুতে জোর ধাওয়া। একটা বুড়ো ঠিনঠিনে মুটে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল মাঝ ভিড়ে, ওদিকে তড়াসে ছুটে আসা একটা পাঞ্জাব বডির লরি ধড়াম্করে ধাক্কা মারল রজ্জু যাদোর গাড়ির বামফারে। রজ্জু যাদো তখনও ছুটছে, পেছনে বাওন সিংয়ের কেরবালা। গাড়িটা কিছু দূরে সাইড-পুশ মেরে ধড়-ধড়-ধড়াম্ করে আরেকটা ধাক্কা খেলো কালভার্টে। তারপরেই ডানদিকের চাকা-দুটো কাত হয়ে ঘুলটে গেল।বেকাবু দাঁও খাওয়া চার-চাকিয়া মাস্তান, গুবরে পোকার মাফিক তিন পাক চরকি কেটে হুস্ করে আগুন ধরে গেল গাড়িটায়।গলগল করে গড়িয়ে ছিত্রে পড়ল তরল হব্যাশ।
রাজপুত রাজ খতম্। দলিত রাজ শুরু! জয়, রজ্জু যাদো কী জয়!

Facebook Comments

Leave a Reply