২২/৭ : অভিষেক ঝা
কেউ তার জন্য অপেক্ষা করত না কোনোদিন। তার ধারণাতেও ছিল না কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে । সে অপেক্ষার সঙ্গে জুড়েছিল বস্তুদের । ভাত, ট্রেন, পায়খানা। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করত, পেটে প্রবল পায়খানার ভার নিয়ে অপেক্ষা করত পায়খানা ফাঁকা পাওয়ার, খিদা বেলাগাম হয়ে গেলে ভাতের অপেক্ষাও তার চেনা ছিল। এমন নয় যে এইগুলি অভাবের সমানুপাত। বরং এইগুলো নিয়ে অপেক্ষা তার চোখ দিয়ে জল বার করে আনত। এই বেরিয়ে আসা চোখের জল তাকে এক নীল দেওয়ালের সামনে দাঁড় করায়। টিকটিকির মতো উঠতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি মানুষ আসলে মাকড়সা। তার জালে আটকায় মা। মা’কে সে খাবে? কোথায় গিয়েছিলি? ভাত বেড়ে কতক্ষণ অপেক্ষা করছি! ড্রেনের ধার থেকে মিউ মিউ। গিয়েছিলাম। একটা বেড়াল ছানাকে মাথা থেঁতলে ফেলে গেছে কেউ। মিউ মিউ। মায়া হচ্ছিল। জল দিচ্ছিলাম। মিউ থেমে খোলা চোখ, তার চোখে। সামনে ভাতের থালা পেয়ে যাচ্ছো তো, তাই এই। খুব খিদা। তাকে ডাকা হচ্ছে। তাকে মনে পড়ছে সবার। মিউ মিউ। মরার আগে নাকি জলের অপেক্ষা হাজার বছরের ঠেকে। একটা আধলা ইট যথেষ্ট জীবনকে হাজার বছরের অপেক্ষার কাছে নিয়ে আসতে। জল দিলাম। মায়া করলাম। খোলা চোখ থামে তার চোখে, মিউ ডেকে। ভাতের থালা অপেক্ষা করছে তার জন্য। কোনো বদমাইশ একটা বেড়ালছানাকে মাথা থেঁতলে ড্রেনের কাছে ফেলে গিয়েছিল। জল দিচ্ছি। মায়া হচ্ছে। কোথায় গিয়েছিলি? ভাত বেড়ে কতক্ষণ অপেক্ষা করছি! মায়ের খ্যাঁকানিতে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে তার। বেড়াল ছানাটির যত্ন না নিয়ে সে কী করে ভাত খেতে আসতো? চোখ দিয়ে জল গড়ায়। এই যে শীতল দেওয়ালের সবুজ তাকে মাকড়সা হতে ডাকে আবার। জাল বুনতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি সাপ আসলে মানুষ। খোলস ছেড়ে মা রাতে রবিনা ট্যান্ডন হয়। খোলস পরে মা দিনে মা হয়ে যায়। এই খেলায় তাকে ডাকা হবে? তাকে মনে পড়বে সবার? এতক্ষণ কেউ পেচ্ছাপ আটকে রাখে! রবিনা ট্যান্ডনকে দেখে ফেলার ভয় লাগছিল আমার। প্যান্ট জুড়ে তার রবিনা ট্যান্ডনের জন্য অপেক্ষার ভিজা ভাব। জল তোমাকে নীল দেওয়ালের কাছে নিয়ে আসবে। তুমি আবিষ্কার করবে মানুষ আসলে মানুষের জন্য একটি অপেক্ষা। এইসব কথা শুনতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বহু বছর। বহু, বহু বছর। মানুষকে মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে শুধু একটি জায়গাতেই সে দেখেছিল — হাসপাতাল। বড় চিকন হয়ে আসে মানুষের চোখ হাসপাতালে অপেক্ষা করতে করতে, আমি খেয়াল করেছিলাম । হাসপাতাল ছিল তার পৃথিবীর সবচেয়ে নরম সুন্দর এক অনুভূতি যেখানে মানুষ নিজের মানুষদের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে। সেই থেকে আপনার একটিই শখ যে হাসপাতালে টানা অনেকদিন ক্যাঁতরে পড়ে থাকবেন আর বাইরে অপেক্ষায় থাকবে তার নিজের মানুষজন, তাই তো? তারা উদ্বিগ্ন হবে। ঘনঘন চা খেতে যাবে। খিদা চোট দিলে স্যান্ডুইচ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাঁটাবে। স্কোয়ার ফিটের দাম নিয়ে দু’পুয়াক গপ্পাবে। কোন এস আই পি’তে রাখলে রিটার্ন বেশি হতে পারে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আরেকবার চা খেতে যাবে। বাজার তো আগুন বলে ক্ষোভ উগড়াবে । আর অপেক্ষা করবে কখন কোলাপসিবলটা টেনে খুলে দিয়ে হাঁক আসবে। দু’জন করে যান। আস্তে। সঙ্গে কার্ড রাখবেন। স্বপ্নটা আমি মনে মনে যতবার রিহার্স করেছি ততবারই পরম এক প্রশান্তিতে ভরে যেত মন। বি পজিটিভ, অলওয়েজ থিঙ্ক পজিটিভ। এমন এক পরিতৃপ্তির পজিটিভিটি তোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে যেখানে মারা গেলে আর পুর্নজন্মের কোনো আশ বা আশা কিছুই থাকে না। এটাই মোক্ষ। …এইসব সময় সে দেখতে পেত সবুজ শীতল দেওয়াল বেয়ে একটি সাপ তার দিকে এগিয়ে আসছে… ঠিক কবে থেকে সে এটার অপেক্ষা শুরু করল তার আর মনে পড়ে না। আমার মা যখন মারা গেছে, তখন আমার বয়স পাঁচ। খুব আদরে রাখতো আমায়। জীবনে কখনো খ্যাঁকায় নি আমার উপর আমার মা। বোধহয় , তার কোনো এক আত্মীয়, মায়ের দিক দিয়ে, মারা গিয়েছিল হাসপাতালে। খুব ছোটো সে নয়, তখন। মরার প্রায় সপ্তাহখানেক আগে থেকে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেত তার মা। সে অপেক্ষা করত কখন তার জন্য বরাদ্দ ম্যাঙ্গো বাইট পকেটে করে নিয়ে আসবে তার আরেক আত্মীয়। ম্যাঙ্গো বাইটের অপেক্ষায় হাসপাতাল যেতাম আমি। আপনার কিচ্ছু হয়নি। এমনি এমনি চলে এলেন? একটা বেড আটকে রাখলেন ৪৮ ঘন্টা আপনি সিম্পলি ডিসগাস্টিং একটা মানুষ। সিক, নার্সিসিস্ট । ওসিডিপনা চোদাবেন না। সবাইকে হ্যারাস করে কি পেলেন বলুন তো? এগুলো শুনতে শুনতে আমি দেখছিলাম বাইরে একটা পাখি। চড়ুই-চড়ুই দেখতে কিন্তু চড়ুই নয়, একমনে তাকিয়ে আছে হাসপাতালটার দিকে । তোমার পাখিদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল? পাখিদের কেউ তো পাখিদের জন্য হাসপাতালে অপেক্ষা করে না। পাখিদের জন্য কি তাহলে কোনো অপেক্ষা, অপেক্ষা করে না? ভাবতে ভাবতে সে ব্যাগ গুছোচ্ছিল। বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে । নিজের জন্য খুব কষ্ট হল তার। হাসপাতাল থেকে বাইরে পা দিয়েই আবার আমি স্বপ্নটা মনে মনে রিহার্স করে নিলাম। তারা উদ্বিগ্ন হয়েছে। ঘনঘন চা খেতে যাচ্ছে। খিদা চোট দিলে স্যান্ডুইচ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাঁটিয়ে নিয়েছে। স্কোয়ার ফিটের দাম নিয়ে দু’পুয়াক গপ্পাচ্ছে। কোন এস আই পি’তে রাখলে রিটার্ন বেশি হতে পারে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আরেকবার চা খেয়ে এসেছে। বাজার তো আগুন বলে ক্ষোভ উগড়েই চলেছে । আর অপেক্ষা করছে কখন কোলাপসিবলটা টেনে খুলে দিয়ে হাঁক আসে। দু’জন করে যান। আস্তে। সঙ্গে কার্ড রাখবেন।…এইসব সময় সে দেখতে পেত নীল দেওয়াল থেকে একটা মাকড়সা তার দিকে তাকিয়ে আছে… সেইবারের পর আরও বার দুই-তিনেক আমি হাসপাতালে গেছি । ফেরত এসেছে ৪৮ ঘন্টার ভিতর। তার চারপাশে কত লোক হাসপাতাল গেল, থাকল কতদিন! সে ঈর্ষা করত এদের। আর করত অপেক্ষা। একটি ওষুধ গন্ধের বিকেলে আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে দেখা করতে এসেছে আমার মানুষজন । সেকেন্ড টেস্টেও একই এসেছে। ডিফাইন্ড কেস অফ কার্সিনোমা। রেডিয়েশন- সার্জারি – কেমো। সার্জারির পর হাসপাতালে রাখতে হবে বেশ কিছুদিন। কেমো চলাকালীন একুশ দিন পরপর ভর্তি হতে হবে । প্রায় সাত আট মাস সব মিটতে মিটতে। আপনার সঙ্গে কেউ আসে না কেন কখনো? তারপরেও ব্লা ব্লা ব্লা করে কীসব বলছিল ডাক্তারবাবু। আমি আর গা করিনি । আমি জানি এবার সত্যি সত্যি হাসপাতালে ভর্তি হবে । আর কেউ না কেউ তার সঙ্গে চিকণ সব বিকেলে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করবে । আমার নিজের মানুষজন সব ।…সে দেখতে পেল রকমারি ফুল হাতে একটি মেয়ে রাস্তা পার করছে…
Posted in: December 2021 - Cover Story, STORY