অপ্রকাশিত কবি

[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।

“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।

বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]

দেবমিত্রা চৌধুরী

জন্ম: ২৫ এপ্রিল ১৯৯১
জন্মস্থান: চাঁচল, মালদহ
কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়: শুধুমাত্র লিখতে ভালো লাগে বলে…

প্রথম প্রকাশ: শাঙ্খিক

এক কথায় তেজি কবিতা। ভাষা-ভাব নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা বা নিরীক্ষণ নেই ঠিকই কিন্তু এমন লেখাও ইদানীং খুঁজে পাওয়া বিরলই। উচ্চারণের সততা, গভীরতা আর বলার গতি লেখাগুলিকে পাঠ্য করে। নিজেকে নিয়ে নিজের ভেতর ডুবতে ডুবতে হঠাৎই আবার কখন ঘোর ভেঙে ‘তুমি’কে ছাড়িয়ে ‘আপনার’ নিষিদ্ধ আস্তানায় উঁকি মারে এ লেখারা। পড়া যাক দেবরাজের পর দেবমিত্রাকে।

মৃত্যু পরবর্তী

অঘোর অন্বেষা আমি,
আমার এই দীর্ঘ শরীর, রক্তে প্রসারিত।
তবে কে আমাকে বিশ্বরূপ দেখাচ্ছে হৃদয়ের?

আমি তাই শয়তান আগুনের শিখা নিয়ে খুঁজতে এসেছি তোমাকেই,
আর এই খুব শুভ রাত্রির আগে
তুমি যদি ঠান্ডা রক্ত নিয়ে মরে যাও, তাও
শেষপর্যন্ত আমি তোমার কাছেই পৌঁছাবো—

তুমি হয়তো জানো, মৃতরাই ফিরিয়ে আনে সব মৃতদের অভিপ্রায়…

আমি ও ইরাবান

সহজেই যারা ভুলে যায়
তাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস রাখো, ইরাবান,
যারা আগুনের থেকে দূরে থাকে,
তাদের জন্য সূর্যাস্ত রেখে যাও তুমি…

তারপর চলো যাই—
নীল মার্চ পার হয়ে যাওয়া সেই রাতে
যেখানে অন্ধকারে গভীর গোলাপ ফুটে আছে,
তোমার চোখের মতো একা, ইরাবান,
তোমার লোভের চেয়ে লাল…

অলৌকিক পিপাসার খোঁজে

উন্মত্ত গোলাপি রঙে কেঁপে ওঠা আকাশ আর হিমগ্ন প্রবাহের নীচে শুয়ে থাকা, কোনো এক শহরের মহাশান্ত ঘুমে, যখন আমি অর্ধেক আলোকিত আর আমার সমস্ত শরীরও আছে থেমে,

হয়তো তখন,
কোনো মুখহীন পিপাসার খোঁজে,
জেগে ওঠে নিচু তারে বেঁধে রাখা সুর, অন্ধকার রক্ত থেকে ভেসে আসে অলৌকিক অরোরার নাচ…

অবলিভিয়ন

কেউ হয়তো মারা যাচ্ছে,
অথবা কোথাও
বিপদ লাফিয়ে উঠছে দশহাজার কুকুরের মতো—
তবু কেন ছাদে বসে একা ভিজতে ইচ্ছে করছে আরো কিছুক্ষণ?

ভুল হচ্ছে হয়তো ফের—
এসব আমাকে আর অন্ধকার করেনা এখন।

আমার ইচ্ছেটাও এভাবে চরিত্র হয়ে ওঠে।
আমি ওর চামড়ায় ঢুকে পড়ি খুব চুপচাপ।
ভেতরে অধ্যায়ী মুখ আরো এক বিভ্রমের দিকে সরে যায়…

একটি নৈতিক কোমা

প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটে;
আপনি একটি নৈতিক কোমায় চলে যান,
এবং আপনাকে মৃতদেহের মতোই দেখায়।

মাতৃত্ব, ফেসবুক অথবা লেবুজল, কিছুতেই সুখী হওয়া যাচ্ছেনা যখন, চশমার ওপরে কিছু আনন্দ ছিটিয়ে নিন—

না, আপনি তো জটিলতা চান, যেভাবে সাপের চোখে জল জমে ওঠে।

যেহেতু পরিকল্পনা ছাড়াই সব পরিকল্পনারা শুরু হয়, আপনার অসমাপ্ত মুখ তাই, উত্তরের আকাশ আর দক্ষিণের প্রাচীরের শেষে থেমে থাকে।
আর যতক্ষণ না ঘুম আসে, গরম কাচের মতো তুলতুলে হতে থাকে দিন…

মুখোমুখি মূহুর্তরা

ছোট্ট টেবিলটাতে মুখোমুখি বসে,
আমরা কাটিয়ে দিই এক-একটা সংসার।
আমি আর বন্ধু আমার।

মাঝে মাঝে আগুনের মতো হাত তুলে
ও আমাকে ঘিরে ঘিরে নাচে।
একদিন সব তাপ ছাই হয়ে এলে,
বন্ধুটি নদী হয়,
আর আমি রূপ ধরি অববাহিকার…

শোক

কথা বলো কথা বলো
জেগে থাকা রাতের অধিবাসী,
আমারও যে ঘুম নিভে গেছে।
মৃত্যুর গ্রন্থি খুলে হাসে শুধু
শোক-দুঃখের অশরীরী,
উন্মাদ মহাকাশে ক্রোধী নক্ষত্রেরা ঝুঁকে থাকে—

সেসব আগুন কবে জল হয়ে গেছে দুই চোখে…

আগুন

অনুপূর্বা আলো থেকে আবার আগুন শুরু হলো
শিখা থেকে দ্রৌপদী, জ্বলে ওঠো সুন্দরী রাগে—
সমিধ রেখেছো আজ লীলাময়ী তপ্ত সোহাগে—
দ্রোহ, নাকি অভিমান? নিজেকে নিজের কাছে খোলো।

অপার শূন্য নাও। শূন্যেরই সাথে কথা বলো।
বিশল্য চোখে দেখো দিন আগে নাকি রাত আগে।
শ্রাবণ নষ্ট হলে ধ্বংসের বৈশাখ জাগে—
সুন্দরী আলো থেকে সোনার আগুন শুরু হলো।

Facebook Comments

Leave a Reply