শেষ মেট্রো : তৃষ্ণা বসাক
[এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ও কথাকার তৃষ্ণা বসাক।
তৃষ্ণার মুক্তগদ্যের ধারাবাহিক, ‘শেষ মেট্রো’, ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]
শুধু মানুষই পায় কৈশোরের স্বাদ
‘বাসমতী চালে ভেজা শাদা হাতখান
রাখো বুকে, হে কিশোরী…’
আচ্ছা কবিতা নিয়ে, তার অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে কত তর্ক, প্রতর্ক তো হয় হামেশাই। এমন প্রশ্ন কি কখনো ওঠে ওই কিশোরীকে নিয়ে, যার বাসমতী চালে ভেজা সাদা হাতখানির স্পর্শ বুকে পেলে ধন্য হয়ে যাবেন কবি, যে, কে ওই কিশোরী? সে কি কোন মানবী? না কি মনুষ্যেতর কোন প্রাণী?সোনালি ডানার কোন রূপসী চিল না ছলনাময়ী কোন ঘাই হরিণী? ওঠে না, পাঠকের মনেও না, হয়তো কবির চিন্তাতেও ঠাঁই পায় না এমন অদ্ভুত কোন কল্পনা। বেড়াল, শেয়াল হরিণ- কত প্রাণীই তো ফিরে ফিরে আসে, গল্প, কবিতায়। জীবনানন্দ দাশই তো লিখেছেন বেড়াল নিয়ে সেই বিখ্যাত কবিতা-
সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতে নিমগ্ন হ’য়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে।
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রং-এর সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতে থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে,
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিলো।
কিন্তু সে বেড়াল কিশোর না কিশোরী তা তো লেখেননি জীবনানন্দ, কারণ বেড়ালের কৈশোর দেখেনই নি তিনি!
এমনকি বেড়াল ছাড়া বেড়ালের হাসি, সেও দেখার সৌভাগ্য হয় পাঠকের। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের সেই হাওয়ায় ঝুলে থাকা বেড়ালের হাসির কথা কেই বা ভুলতে পেরেছে? কিন্তু কোন কিশোর বেড়াল কিংবা রাইকিশোরী গাভীর কথা পড়েছেন কি কেউ? পড়েননি। জ্ঞানে বা অজ্ঞানে, মনুষ্যেতর জীবের কৈশোর দেখান নি কোন স্রষ্টা। আসলে, এই বিশ্বের স্রষ্টাও তো সেই কাজটাই করেছেন। মানুষ ছাড়া আর কারো ভাগ্যেই লেখেননি কৈশোর।
না, এ কোন স্বরচিত তত্ত্ব নয়, বিজ্ঞানের একেবারে প্রতিষ্ঠিত একটি সত্য। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার টিন এজ বা বয়ঃসন্ধি আছে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী (নাকি পূর্বপুরুষ) গ্রেট এপদের থেকে আমরা বড় হতে দ্বিগুণ সময় নিই। জন্মের পর প্রথম তিন বছর ধরে মানব সন্তানের বৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে কমে, এর পরের আট বছর এই হার বাড়লেও খুব উল্লেখযোগ্য নয়। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে এটা ঝপ করে বেড়ে দাঁড়ায় বছরে ১২ সেন্টিমিটার। এর পরের তিন বছর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কিশোর কিশোরীরা প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়ে। অন্যান্য প্রাণীদের বৃদ্ধির হার কিন্তু প্রথম থেকেই জোর কদমে চলে।
বিজ্ঞানীরা এর একটা ব্যাখ্যা দেন এই রকম। মানুষের ক্ষেত্রে শুধু তো শরীর নয়, উন্নত মস্তিষ্কের বাড়বৃদ্ধির খেয়ালও রাখতে হয়। তার ওপর মানুষকে শিখতে হয় জটিল ব্যবহার বিধি, যার জন্যে মগজের কোষে কোষে রাখতে হয় জটিল সব প্যাটার্ন। এত সব কিছুর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে শরীর তেমন বাড়তে পারে না। এই পুরো প্রকল্পটা কিন্তু মানুষের জন্যে লাভজনক।ছোটখাটো থাকলে খাবার যোগান লাগে কম আর মা বাবার সদা সতর্ক স্নেহ আর মনোযোগ পেয়ে থাকে ক্ষুদ্র মানবক।
অনেকে মনে করেন প্রথম যে ফসিলে মানবের কৈশোরের প্রমাণ মেলে তা হচ্ছে তুর্কানা বালকের। হোমো ইরেকটাস এই বালকটির ফসিল ১৬ লক্ষ বছরের পুরনো। যদিও এর কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে একটা ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা একমত। বয়ঃসন্ধি আর লম্বা আয়ুর মধ্যে একটা গভীর সম্বন্ধ আছে। হোমো স্যাপিয়েন্সের গড় আয়ু অন্যান্য প্রাণীর থেকে বেশি। এই লম্বা জীবনে বয়ঃসন্ধির জন্যে দাঁড়ানোর অবকাশ আছে। অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই ফুরসত কোথায়? তাকে তো যা করতে তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে। কবি তাই যতই আক্ষেপ করুন ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’ কিন্তু আসল কথা হল মানুষ বাঁচে অনেকদিন আর এই বিশাল সময়ের প্রেক্ষাপটে হাত পা ছড়াতে পারে কৈশোর। অভিব্যক্তির গবেষণায় এটি একটি সাড়া জাগানো তত্ত্ব। এই নিয়ে কাজ করছেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যা চেল ক্যাসপারি।
কৈশোরের আরও একটি দিক আছে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে এই সময়টাতেই কিশোর কিশোরীরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও যৌন কার্যকলাপের জন্য প্রস্তুত হয়। এটাই শিক্ষানবিশির সময়। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার সুযোগ অন্যান্য প্রাণীরা পায় না। তাই তাদের থেকে মানুষের প্রথম সন্তানের মৃত্যুর হার কম।
ভাবতে অবাক লাগে, এত সব না জেনেও কবিরা যে কিশোরীর প্রেম চান, যে রাইকিশোরীর ভজনা করেন, সে একটি হোমো স্যাপিয়েন্স। কোন কিশোরী ঘোটকীর জন্য হাহুতাশ বা কোন রূপসী মার্জারী কিশোরীর জন্যে লেখা সনেটগুচ্ছ আজও চোখে পড়ল না। জয় হোক মানবের, জয় হোক কৈশোরের।
Posted in: November 2021 - Serial, PROSE