কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ
[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]
১৬
পশ্চিমবঙ্গের বসন্তকাল আর উত্তরপ্রদেশের বসন্তকালের মধ্যে পার্থক্য এতটুকুই, বঙ্গের বসন্ত যেমন মানবিক প্রেম আছন্নতার ভরকেন্দ্র, উত্তরপ্রদেশের বসন্তের মধ্যে ফাগ ফাগুনের অনুভবকে আশ্রয় করে আধ্যত্মচেতনার আবেগ প্রবাহিত হয়। দুই ভিন্ন মেরুর প্রদেশের মধ্যে কিন্তু দর্শনগত একই মিল,- প্রেম…… ঝুলে মেঁ পবন কে আই বহার… ন্যায়নো মেঁ নয়া রঙ লাই বাহার… পিয়ার ছলকে হো পিয়ার ছলকে…………
খুবই সামান্য দূরে, সদর বাজারের উত্তরপ্রান্তে একটি বড় মাঠ আছে, মাঠের পাশেই পাঁচিল দেওয়া সারি সারি ফৌজি কোয়ার্টারের লাগোয়া সিভিলিয়ানদের বাড়িঘর। আর্মির ট্রাকে করে গেলে, গতি রুদ্ধ না হলে এক ঘণ্টা। আমরা তাজমহলের পিছন দিক থেকে শিফট করে চলে এলাম, একটু গভীর জনাঞ্চলের দিকে। সদর বাজারের দিকে, খুবই মসৃণ রাস্তা পার হয়ে এলাম। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার রাস্তা যেমন হয়। নতুন আস্তানায় উঠে এলাম। বাজার দোকানপাট সান্ধ্য মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ, বড় মাঠের মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা, সব বড় বড় ওস্তাদ আসে, সাথে ফাই ফরমায়েশের জন্য সৈন্যবাহিনী। বড় বড় ক্রিকেট ম্যাচ, ফুটবল ম্যাচ ফৌজিদের প্যারেড, খাসা জমে যাওয়া একটি বসবাসের স্থান পেয়ে আমরা সবাই উল্লসিত হয়ে উঠলাম। মায়ের বায়নার ফলে তাজমহলের পিছন দিকের বসবাস গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতে হল আগ্রার সদর বাজারের দিকে। বাবা কেয়ারটেকার অফিসারকে আগেই বলে রেখেছিলেন, জায়গাটি মনোরম হলেও, বসবাসের অনুপযুক্ত। একটি ভালো কোয়ার্টার পেলে শিফট করিয়ে দেবেন। কেয়ারটেকার অফিসার বাবার অনুরোধ রাখলেন। এখানে ফৌজিদের বিনোদনের নানান আয়োজন আছে।
যেখানে আমাদের নতুন আস্তানাটি ঠিক তার পিছনে পুরানো লাল ইটের একটি উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে বেশ ঘন বড় বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাদুর ময়ূর ও লঙ্গুরের (হনুমান) নিবিড় আস্তানা। পাঁচিলের ওপারে উঁকি দিয়ে সম্পূর্ণ খণ্ডিত বনাঞ্চলটিকে দেখা একেবারেই দুঃসাধ্য। তাই নিজেই কল্পনায় ভেবে নিতাম কেমন হবে, সেই অঞ্চলটি। আর কতটাই বা তার সীমানা।
সেই পাঁচিল ঘেঁসেই একটি ছোটো বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে থাকতেন, আমার স্মৃতি যদি খুব বিরোধ না করে, সাহেবের নাম ছিল ক্রিস্টোফার দুগার্তো। এক পর্তুগিজ সাহেব। তিনি পর্তুগালের সান্তানা নামক এক গ্রাম থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। কাঠ ও পাথর খোদাই করে, মূর্তি গড়তেন। চমৎকার খোদাইয়ের হাত ছিল তাঁর। সদরবাজারের অনতিদূরে তাঁর কটেজের মতো একটি দোকানঘর ছিল। তাঁর স্ত্রী মোমের পুতুলের মতো ভারি নাজুক ছিল। পাড়া জুড়ে একটি পোষা স্পেনিয়াল নিয়ে ঘুরে বেরিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। বলতেন, দুগার্তো এবং তিনি একই গ্রামের। গ্রামের কথা তাঁর খুব মনে হয়। নিজের ভাষায় একটি শিস দেওয়া বাদামি পাখির কথা বলতেন। সেই পাখি এখানে বিশেষ দেখা যায়না।
দুগার্তো নিজের ঘরের মাধ্যে একটি চিতাবাঘের শাবককে লালনপোষণ করতেন। পাঁচিলের ওপার থেকেই শাবকটিকে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। গেল শীতের প্রবল ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে শাবকটি নিজের আস্তানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লোকালয়ের মধ্যে চলে আসে। প্রায় সারাদিন দুগার্তো, সেটিকে কোলে নিয়ে বসে থাকতেন। নবজাতক ব্যঘ্রশাবক দুগার্তোর কোলের মধ্যে বসে মনোরম উষ্ণতাকে উপভোগ করে, মাঝে মাঝে ফ্যাসফেসে গলায় ডেকে উঠত। তার পায়ের নোখের ধারালো তীব্রতা, এতটাই প্রখর ছিল, দুগার্তো সবাইকেই সাবধান করে দিতেন।
দুগার্তো একটি টেবিলের ওপরে বসে মাঝে মাঝে ডায়েরি লিখতেন। নানারকমের তাঁর কাজকর্মের হিসেব নিকেশ। আর কখনো কখনো নিজের গ্রাম সান্তানার কথা। কেউ কিছু চুপ করে বসে এক কোণে যদি কিছু লেখে আমার বরাবরই খুব কৌতূহল হত, এখনও হয়। মানুষ কত কিছু লেখে। সাহিত্যের বাইরে মানুষ অনেক অনেক কিছু লেখে। হিসেব নিকেশের কথা, ওষুধের নাম, বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালীর নিয়ম প্রস্তুতের কথা। বিশেষ পরিচিত খেয়াঘাটের মাঝির কথা ও নাম, শহরের বাস কন্ডাকটরের নাম, সাইকেল রিপেয়ারিংয়ের মিস্ত্রির নাম, জলের কলের লাইনের মিস্ত্রির নাম ও ঠিকানা, জীবনের কথা, গৃহস্ত পুরোহিতের ঠিকানা কত কিছু। এই সব বিষয়গুলি কম আকর্ষণীয় নয়। নিজের দুঃখ বেদনা আনন্দপ্রাপ্তির কথা লেখাও কথা কম কিছু নয়।
একটা শীতকাল চলে যায়, একটি গ্রীষ্ম আসে, বসন্ত বড় অভিমানী তাকে অনেক ধরে বেঁধে মানিয়ে ভুলিয়ে রাখতে হয়। দুগার্তোর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের স্মৃতি বসন্তকালের রোদ ঝলমলে সকালে স্টিমারের সাইরেনের মতো। আমি প্রায়ই বিকেলে, তাঁর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে সদর বাজারের বিখ্যাত ময়দানে যেতাম।
তাঁর মাথায় থাকত হালকা ক্রীম রঙয়ের শিকারি টুপি। সাদা ফুল শার্ট ও ঘিয়ে রঙয়ের ফুলপ্যান্ট। পায়ে মোটা শোলের কালো চামড়ার জুতো। কখনো কখনো দুই ঠোঁটের মধ্যিখানে সিগার। তামাকের চিমসে গন্ধে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম। খুবই ভাঙা ভাঙা হিন্দি ভাষায় নিজের কথা বলার চেষ্টা করতেন দুগার্তো। বেশ শুনতে লাগত।
একদিন দুপুরে বৃষ্টি হল। বসন্তকালে দুপুরে বৃষ্টি মানে, মন খারাপের সমস্ত ভাঁজ নিজের থেকেই খুলে যাওয়া। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে বাইরে এসে দেখলাম, জনহীন পৃথিবী। কেউ কোথাও নেই। জনশূন্য চারধার। যে কোনো মানবজীবন জীবনে মাত্র একবারই, এইরকম একটি জনশূন্য পৃথিবীর সাক্ষাৎ পায়। আবার অনেকের সেই সাক্ষাৎ হয় তো সারাজীবনে হয়ও না। আমার সৌভাগ্য জনশূন্য সেই সাক্ষাৎ সেই সময়েই ঘটে গেছিল। সেই সাক্ষাৎ আমার স্মৃতিকে আজও উর্বর করে রেখেছে। একটি জীবনের স্মৃতি আসে যায়, আবার স্মৃতির ঠোকাঠুকিতে কিছু স্মৃতি অক্ষত থেকে যায়। তেমনিই আগ্রা শহরের বসন্তকালীন বৃষ্টির পরে, সদর বাজারের জনশূন্য ভেজা ময়দান আমাকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
দুগার্তো একটি পরিষ্কার কাঁচের শিশিতে বৃষ্টিতে ভেজা কিছু দুব্বো ঘাস ভরে নিয়ে, আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকতে থাকলেন।
আমি বেরিয়ে এলাম, দুগার্তো আমাকে বললেন,- চলো গ্রাউণ্ড থেকে ঘুরে আসি।
আমি আর দুগার্তো পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিলাম, একটি কাঁচা ইটের পাঁচিল পার হয়ে সদর বাজারের ময়দানে প্রবেশ করতে হয়। সবুজ ঘাসের মাঠ, যে মাঠের সঙ্গে আগ্রা শহরের বিখ্যাত সব পতঙ্গবাজদের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। বড় বড় তুক্কল পতঙ্গ বা ঘুড়ি, বগ্গা খেয়ে লাট খেয়ে উড়ে যাচ্ছে মহাকাশে যুগ যুগান্ত ধরে আজও হয় তো। ঘাস খেতে খেতে গাধা ঘোড়া এই মাঠে বিচরণ করে। বৃষ্টিতে ভেজা ঘাস উপ্রে এলে, ঘাসের শিকড়ের একপ্রকার ছিঁড়ে যাওয়া মিহি শব্দ হয়। এই মাঠেই নানা রঙয়ের জার্সি পরে ফুটবল খেলোয়াড় নিজের করিসমার বিনিময়ে করতালি কুড়িয়ে নেয়। দশেরার সময় সুউচ্চ আকারের রাবণরাজকে পোড়ান হয়। আতসবাজির আলোর মালা, আকাশে ভেসে বেড়ায়। আবার হোলির সময় একটি গোটা বৃক্ষ পুড়ে যায়। সাতদিন ধরে একটি বৃক্ষের পুড়ে যাওয়া মানুষ আমোদ ও আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে।
দুগার্তো আমাকে পা চেপে চেপে হাঁটতে বললেন। আর ঘাসের গভীরে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে থাকলেন একরকম পোকা।
খুবই ছোটো ছোটো সেই পোকা। গোল চওড়া পিঠ, গভীর মেরুন রঙয়ের মখমলের কাপড়ে মোড়ানো, মনে হতে পারে। বড় সুন্দর দেখতে। দুগার্তো এক একটি পোকা কাঁচের শিশিতে রাখছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যে, ঘাসে ভরা শিশি মেরুন রঙের পোকায় ভরে উঠল। আমাকে দুগার্তো বললেন,- কোনোদিন দেখেছ এইরকম পোকা? বড় সুন্দর পোকা।
আমি বললাম,- না। কি করে দেখব? আপনি দেখালেন তাই দেখলাম।
দুগার্তো বললেন,- বসন্তকালে বৃষ্টি হলে, এই রকম সিল্কের পোকা দেখা যায়। বাকি সময় কোথায় থাকে, কেউ জানেনা।
দুগার্তো আমাকে শিশিটি দিয়ে বললেন- ভেজা ঘাসে যতক্ষণ জল থাকবে, শিশির ভিতর ঘেমে উঠবে, ঘাস ও ঘাসের জল ওদের ভোজ্য। সারদিন পোকাগুলিকে দেখ, চোখ জুড়িয়ে যাবে। দুইদিন পরে মাঠে গিয়ে পোকাগুলিকে ছেড়ে দিয়ে আসবে।
বড়ই বিচত্র সেই অভিজ্ঞতা। আমার স্মৃতিতে ভেজা ঘাসে গভীর মেরুন রঙয়ের পোকা কুড়িয়ে শিশির মধ্যে দুগার্তোর সংগ্রহ ও সদর বাজারের জনশূন্য ময়দান, আজও স্বপ্নের মতো।
দুগার্তোর একটি ছোটো অস্টিন গাড়ি ছিল। কালো রঙয়ের। গাড়িটির মধ্যেখানের আকারটি ছিল অনেকটা উট পাখির পিঠের মতো। আমাকে নিয়ে একদিন দুগার্তো সেই অস্টিন গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে চললেন, যমুনা নদীর সেইদিকে, যেদিক দিয়ে যমুনা আগ্রা শহরে প্রবেশ করেছে।
দুগার্তো বলেছিলেন, এইদিকটা এলে আমার বারে বারে নিজের গ্রামের কথা মনে হয়। বড়ই নির্জন স্থান। দূরে ছড়িয়ে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলির ওপরে বসন্তকাল যেন মোলায়েম হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। দুগার্তো গাড়ি থামালেন, একটি ছোটো মতো ঘাসের জমি দেখে। সেই জমির ওপরে বাদামি ও কালো রঙয়ের ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছিল। ঘাস খাচ্ছিল। দুগার্তো ঘাসের ওপরে একটি তোয়ালে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন,- এখানে বসে যাও।
আমি বসলাম। এখানকার যমুনা একেবারেই অন্যরকম। বড়ই চুপিসারে একটি মহাকাব্যিক নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর জলের ওপর দিয়ে। ভেসে যাচ্ছে বড় বড় চৌকো লম্বা আকারের কাঠের বড় বড় তক্তা। পরের পর ভেসে যাচ্ছে। কেউ নেই কাঠের তক্তাগুলির গতিকে রুদ্ধ করে।
দুগার্তোকে কেউ একজন ডাকছিল। এই গ্রামের কেউ হবে হয় তো। গ্রামবাসীর ডাক শুনে মনে হচ্ছিল, দুগার্তোর পূর্বপরিচিত।
গ্রামবাসী বলল,- অনেকদিন পরে এলেন যে?
শীতকালে তো আসিনা। আপনি তা ভালোমতনই জানেন।
হ্যাঁ। জানি।
আপনি কেমন আছেন?
আমি কয়েকদিন আপনার কথাই ভাবছিলাম।
আপনি সত্যিই ভাবছিলেন। এই জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ভাবছিলাম, আপনি নিজের দেশে ফিরে গেলেন কি না?
আর নিজের দেশে ফেরা হল কোথায়? আপনার কথাও খুব মনে হচ্ছিল।
আসুন না আমার বাসখানায়? গরম ছাগলের দুধ মুখে ভালো লাগবে। বসন্তকালে ছাগলের দুধের স্বাদ খুভ ভালো হয়। বাসখানার কুণ্ডে এখনও আগুনের তাপ আছে। দুধ তাড়াতাড়ি গরম হয়ে যাবে।
বসন্তকালে বুঝি ছাগলের দুধের স্বাদ খুব ভালো হয়?
হ্যাঁ। এ ভারি অদ্ভুত।
বড়ই সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা বলেন আপনি।
দুগার্তো বললেন,- নদীর জলে কাঠ ভেসে যাচ্ছে।
হ্যাঁ। প্রতি বসন্তকালে, এমন কাঠ ভেসে যায়।
কোথায় যায়?
যায় মানে? এক এক জায়গায় কাঠের খরিদার দাঁড়িয়ে আছে। তহশিলদার ঠিকাদার দাঁড়িয়ে আছে। ওরা জানে ওদের ভাগের হিসেব। নিজের ভাগের কাঠ ওরা তুলে নেবে।
বাকি কাঠ কোথায় যাবে?
বাকি কাঠের জন্য সব খরিদার দাঁড়িয়ে আছে। সবাই নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঠ তুলে নেবে।
এই কাঠ কেটে কারা ভাসিয়ে দেয়?
জঙ্গলের ঠিকাদার। যারা কাঠের কারবার করে।
যে ছাগলগুলি ঘাসের ওপরে চড়ে বেড়াচ্ছিল, ঘাসের মাথা চিবিয়ে উদরে ঠেসে নিয়েছে, গ্রামবাসী ছাগলগুলিকে, এক স্থানে জড়ো করে, নিয়ে চলল নিজের বাসখানার দিকে।
দুগার্তো সাহেবকে দেখলাম, একটু দূরে শুকনো ঘাস দেখে নিজের টুপি উল্টো করে তার ভিতরে জড়ো করছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম সাহেব কি করছে? টুপির মধ্যে বেশ কিছু শুকনো ঘাস সংগ্রহ করে একটি স্থানে শুকনো ঘাসের স্তূপ করে নিল। তারপরে গাড়ির ভিতর থেকে, কেটলি বার করে ফসলের ক্ষেতের পাশে নেমে গিয়ে, অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে পেতে কেটলিকে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে, ফ্লাস্কের ভিতর থেকে জল ঢেলে দিল কেটলির ভিতরে। ঘাসের স্তূপের পাশে কাপপ্লেট পেতে দিল আমার বসে থাকার তোয়ালের পাশে। তারপরে শুকনো ঘাসের স্তুপে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে দিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে কেটলি চাপিয়ে দিল। বেশ আগুন লকলকিয়ে উঠল। জল ফুটে উঠল। দুগার্তো কেটলির গরম জল কাপে ঢেলে পূর্ণ করে, তার মধ্যে কফি চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে তুমি কি নেবে?
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। সাহেব ভাবলেন, আমার সম্মতি আছে।
নিজের কোয়ার্টার থেকে বহুদূরে বসন্তকালের এই নির্জন মাঠে, শুকনো ঘাসের আগুনে, এমন কফির স্বাদের কথা এখন মনে হলে, সঙ্গে জুড়ে দিই দুগার্তোর পাশে বিশ্বসাহিত্যের মহৎ একটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম – গাব্রিয়েল ওক (ফার ফর্ম দি ম্যাডিং ক্রাউড – টমাস হার্ডি) আর তাঁর প্রেমিকা বাথসেবা একটি স্পেনিয়েল নিয়ে সদর বাজারের জনাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে কথা বলে চলেছেন, সংবাদ নিচ্ছেন প্রতিবেশীদের। আমাদের এই সামান্যতর ব্যবহারিক জীবনে, কখনো কখনো মহৎ উপন্যাসের চরিত্রগুলি অজান্তেই এসে ঘুরে বেড়ায়। জীবন বড়ই নির্জন না হলে এই সব চরিত্রেরা ধরা দেয়না। নির্জন একাকী জীবন যা কেড়ে নেয়, সে সব কিছু তো অপূর্ণের অংশ। কিন্তু পূর্ণ অংশ বড়ই নির্জনতা ও একাকীত্ব দিয়ে যায়।
দেশ বিদেশের নানান স্ট্যাম্প জমাতেন দুগার্তো। আর তার কাছে ছিল রেয়ার ফার্স্ট ডে কভারের বিপুল সংগ্রহ। অধিকাংশই স্ট্যাম্প ছিল আলাস্কা ও ফিনল্যান্ডের স্ট্যাম্প। এই দুইটি দেশের স্ট্যাম্প না কি সবচেয়ে উন্নতমানের। আর পোলাস্কা দেশটির নাম তো জানতামই না। দুগার্তো আমাকে অনেক নাম না জানা দেশের স্ট্যাম্প দেখিয়ে বলেছিলেন, অনেক দেশের স্ট্যাম্প দেখে সেই দেশের পরিচয় সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়। দুগার্তোর বাড়িতে বসে কত সুন্দর এবং বিচিত্ররকমের সেন্টের – সুগন্ধির শিশি দেখেছি। ছোটো ছোটো মেমসাহবেদের নাচের ভঙ্গিতে কাঁচের সেসব শিশি। কাঁচের রঙও যে এত নানারকমের হতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।
কত সময় যে কেটেছে, দুগার্তোর ঘরে, নানা রকম বায়না করতাম, কিন্তু চিতা বাঘের শাবকটি তাঁর কোলে উঠে আসার পরে, আমি তাঁর বাড়িতে খুবই কম যেতাম। দুগার্তো আমাকে একদিন বললেন, তোমাদের দেশের বসন্তকাল খুব সুন্দর। আমি খুব উপভোগ করি। বড়ই সুন্দর, শীতকালে পাতা ঝরে গিয়ে, অন্য এক নতুন দুনিয়ার সূচনা হয়।
উনি বেশিরভাগ সময়ই সাদা ফুল শার্ট আর কালো ট্রাউজার পড়তেন। কখনো কখনো কলারের বোতাম আটকে গভীর চেরি রঙয়ের বো-টাই পড়তেন। পায়ে গভীর বাদামি রঙয়ের জুতো। উনি জানতেন আমি ছবি আঁকার চেষ্টা করি। কেন জানি আমাকে তিনি বারে বারে একটি ফাঁকা রেল ওয়াগনের কথা বলতেন। আর বলতেন একটি ফাঁকা রেল ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে এমন একটি ছবি আমাকে এঁকে দেখিও তো? একটি পরিত্যক্ত রেলের ওয়াগন কিন্তু একটি অকেজো মানুষের মতো, অবলম্বনহীন বৃদ্ধ মানুষের মতো অসহায়।
সময় কি ভাবে সময়ের ভাবনাকে মিলিয়ে দেয়।
পানাগড়ে মালগাড়ির পরিত্যক্ত রেল ওয়াগনের ছবি আমার স্মৃতিতে আজও একটুও টসকে না গিয়ে অভগ্ন বসে আছে, সেই কথা দুগার্তো কি করে জানলেন? কে জানে কি ভাবে যেন দুগার্তো আমার মনের গভীরে ক্রমে ক্রমে বসে যাচ্ছিলেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে তাঁকে নানারকম কথা বলতাম। বলতাম ব্রজেন মিশ্রার কথা। কি চমৎকার তিনি এ্যাকোর্ডিয়ান বাজাতেন। এই কথা শুনে দুগার্তো খুব খুশি হলেন। অন্য যে কোনো পরিচিত বা অপরিচিত কারও গুণাবলীর কথা জানতে পারলে খুব খুশি হতেন তিনি। আমার মুখে ব্রজেন মিশ্রার কথা শুনে চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি গিটার বার করে তার ঝংকার দিয়ে বললেন,- কেমন ???
আমি বললাম,- চমৎকার।
বসন্তকালের বিনম্র ভাবটি আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। বাতাস ক্রমশ গরম হয়ে উঠছিল। উত্তরপ্রদেশে যেমন শীতকাল তেমনিই গ্রীষ্ম। কিন্তু বসন্ত যে খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় এমন নয়। গ্রীষ্মের পরে বর্ষাকাল উৎসবের মতো। বাদল ও মেঘ নিয়ে হিন্দি ভাষায় এত কবিতা আছে, এত দোহা ও গান আছে, আছে আঁধিয়ার পরে বৃষ্টির ফোঁটার অভিনব ব্যাখ্যা।
দুগার্তোকে কয়েকদিন দেখতেও পাচ্ছিলাম না।
আসলে তাঁর সঙ্গে আমার দেখাই হচ্ছিল না।
আমাকে কয়েকদিন দেখতে না পালে আমাদের বাসখানার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার নাম ধরে ডাকতেন। কিন্তু উনিও তো আসেননি। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, আর পাঁচিলের ওপার থেকে খণ্ডিত বনভূমি থেকে শেয়াল ডেকে উঠছিল।
ভাবছিলাম, আবার কবে আমরা পানাগড়ে ফিরে যেতে পারব। জানালার কাছেই ছোটো একটি অলিন্দে বসেছিলাম। ঠিক করলাম সকালের নিয়ম মতে পড়াশোনা করে, চলে যাব দুগার্তোর কাছে। নতুন কি স্ট্যাম্প সংগ্রহ করলেন, দেখতে যাব। পরের পর দিন বাদে বাদে দুগার্তো জমিয়ে ফেলেন অনেক স্ট্যাম্প। একজন শিখ যুবক আমাদের বসবাসের সীমানার মধ্যেই, সে দুগার্তোর স্ট্যাম্প বন্ধু। দুগার্তোই বলেছেন,- শিখ যুবক তাঁর ডুপ্লিকেট স্ট্যাম্প বন্ধু। ডুপ্লিকেট স্ট্যাম্প বন্ধসুত্র কত যে দামি, তা একমাত্র স্ট্যাম্প সংগ্রাহকরাই জানে। সেই শিখ যুবককেও কয়েকদিন দেখতে পারলাম না।
দুগার্তোর বাসখানা আমাদের বাড়ির থেকে কয়েকটা বাড়ি অতিক্রম করলেই, উত্তরদিকে তাকিয়ে বাঁদিকে একটি মাটি সুরকির রাস্তা। সেই রাস্তার একেবারে শেষেই দুগার্তোর বাসখানা।
হার্ট অ্যাটাক। তখন ভালো করে বোঝার ক্ষমতা হয়নি। সকাল থেকেই কানাকানি গুঞ্জন চলছিল। গত মাঝরাতেই না কি !!! ডাক্তার এসেছিল বলে গেছেন, শেষ।
হ্যাঁ। প্রথম যখন জীবনে এই কথাটি কেউ শোনে, সে বোকার মতো হ্যাঁ… হ্যাঁ… কি বললে? কি বললেন? নিজের অজ্ঞতার সঙ্গে নিজেই জড়িয়ে পড়ে নিজের বোঝার ভুলকে ক্রমশ বিভ্রান্ত করে তুলবে।
যে কোনো কারও জীবনে প্রথম মৃত্যুর সাথে পরিচিত হতে সময় লাগে। প্রায় সবারই শৈশবকালে প্রশ্ন থাকে,- অমন করে শুয়ে আছে কেন? মৃত্যুর পরে মানুষকে শুইয়ে দেওয়া হয় পাট পাট করে। অধিকাংশই বুকের ওপরে সাদা চাদর টান টান করে মেলে দিয়ে। এই দৃশ্য যে জীবনে প্রথম দেখে তার অনুভূতির স্তরের বিষয়টি বুঝতে হলে, নিজের শৈশবে দেখা প্রথম মৃত্যু দৃশ্যটিকে একবার বুঝে নিতে হবে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাই হল, মহাবিদ্যালয়।
আমি কিন্তু আমার জীবনের প্রথম মৃত্যু নামক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হলেও মৃত ব্যক্তিকে কিছুতেই দেখতে পারলাম না। প্রথমে তো বুঝতেই পারিনি দুগার্তো মারা গেছেন। কারণ ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে তাঁর মৃত শরীরটিকে দেখব, তেমন উপায় ছিলনা। মৃত দুগার্তোকে একটি ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে। সেই ঘরে কারও যাওয়ার অনুমতি নেই।
তাঁর বাসখানার উঠোনে, দেখলাম কয়েকজন কাঠের মিস্ত্রি একটি লম্বা ধরণের কাঠের বাক্স তৈরি করছে। প্রথম জানলাম যারা খৃস্টান, তাঁদের মৃত্যুর পরে একটি কাঠের বাক্সের মধ্যে শুইয়ে দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে, কবরখানার গর্তের মধ্যে মাটি চাপা দেওয়া হয়। সবটাই আমাকে বলা হল, আমি বুঝতে বুঝতে চলেছিলাম। দুগার্তোর কফিন তৈরি হচ্ছে। আমি কফিন তৈরির কাজ কারবারটি খুব মনোযোগের সঙ্গেই দেখে যাচ্ছিলাম। বাড়ি থেকে দুই তিনবার আমাকে ডেকে পাঠানো হল। আমি নড়তেই চাইছিলাম না। কিন্তু রাত বেড়ে যাওয়ার ফলে, বাবা হুকুম করলেন, ঘরে ফিরে আসতে। ফিরেও গেলাম। ঘুম আসছিল না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না।
দুগার্তো আমাকে একটি একাকী বিছিন্ন রেল ওয়াগনের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। আমি পারিনি। এঁকেছিলাম অনেক অনেক বছর পরে, আর্ট কলেজে যখন ছবি আঁকার শিক্ষা গ্রহণ করছিলাম। কিন্তু সে সময় আমার একবারও ক্রিস্টোফার দুগার্তোর কথা মনে হয়নি। তিনি আমাকে একাকী বিচ্ছিন্ন একটি রেল ওয়াগনের আঁকার কথা অনেক অনেক বছর আগেই বলেছিলেন।
একাকী বিছিন্ন রেল ওয়াগনের ছবিটি দেখে জল রঙয়ের শিক্ষক কিষানলাল বলেছিলেন,- এত নির্জন সাইট কোথায় পেলে? এ কি রিয়েল স্টাডি !!!!
আমি স্যরাকে মিথ্যে বলেছিলাম,- হ্যাঁ স্যার।
[চলবে…]
Posted in: November 2021 - Serial, PROSE