হেমন্ত, তোমার অরূপ আলোয় আছো হৃদয়জু্ড়ে : সুদীপ ঘোষাল

হেমন্তের বুকে প্রকৃতির রূপ, খেজুররসের আঁকিবুঁকি মনোমুগ্ধকর ক্ষণিকের কবিতার মত সাবলীল।জীবনের পরম সত্যর মত তার আগমণ আর প্রস্থানের প্রস্তুতি। মাঠে-ঘাটে ঘাসের ওপর, গাছের পাতার উপর পড়ে থাকতে দেখা যায় শিশির। সমগ্র শরৎকাল জুড়ে উৎসবের উত্তেজনাকে স্তিমিত করে হেমন্ত যেন প্রকৃতির বুকে একরাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস। কখনো কখনো হেমন্তকালের বিভিন্ন সময়ে দু-এক পশলা বৃষ্টিও দেখতে পাওয়া যায়। এই বৃষ্টি প্রকৃতপক্ষে হেমন্তের পরবর্তী শীতের আগমনের পটভূমি প্রস্তুত করে। না গরম, না ঠান্ডা- এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ এই সময় মানুষের জন্যও অত্যন্ত আরামদায়ক।বাংলার হৃদয় স্বরূপ গ্রাম বাংলা প্রতিটি ঋতুতেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে সজ্জিত হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মে তার রূপ এক, বর্ষায় সে অনন্য; শরতের উৎসবে সেই গ্রামবাংলাই হয় তুলনাহীন, আর হেমন্ত সে অপরূপা। হেমন্তের প্রকৃত রূপ এই আধুনিক সভ্যতার যুগে এখন অব্দি প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায় গ্রাম বাংলার বুকেই।বাংলার বুকে ষড়ঋতুর বছরব্যাপী ঘুরতে থাকা চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত যদি কেউ হয় তবে নিঃসন্দেহে তার নাম হেমন্ত। একথা সত্য যে বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমান ভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়না; তার প্রচ্ছন্ন অনুভূতি উপলব্ধ হয়।হেমন্ত আসে তার রূপের পসরা নিয়ে।পুকুরের ধারে কাশ আর শিউলি মাথা নাড়িয়ে আমাদের আহ্বান করত।আমরা কাশের বনে লুকোচুরি খেলতাম।শৈশবটাকে বেঁধে রাখলে ভাল হত কিন্তু সময় তো বয়ে চলে নদীর স্রোতের মত।আধুনিক সভ্যতার যুগে বাংলার বুকে সব জায়গায় বিশেষভাবে অনুভূত হয় মাত্র চারটি ঋতু। সেগুলি হল: গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত। সভ্যতার করাল গ্রাসে বর্তমানে বাংলার ঋতুচক্র থেকে হেমন্তের নাম একরকম লুপ্তই হয়ে গেছে। শহরের বুকে তার রূপ অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন, তবে এখনও গ্রাম বাংলার বুকে অল্প দিনের জন্য হলেও হেমন্তের আভাস পাওয়া যায়। হেমন্ত বঙ্গভূমির প্রকৃতি প্রত্যেকটি ঋতুতে বাঙালির জীবনে এনে দেয় নব নব রূপ ও রসের অপরূপ ছন্দ। বাংলার বুকে এই ষড়ঋতুর চতুর্থটি হলো হেমন্ত। বর্ষার পর উৎসবমুখর শরৎ কালের অবসানে গুটি গুটি পায়ে শীতের পূর্বে আগমন ঘটে হেমন্তের। বাংলার বুকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তের ব্যাপ্তি। বাংলার বুকে ষড়ঋতুর বছরব্যাপী ঘুরতে থাকা চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত যদি কেউ হয় তবে নিঃসন্দেহে তার নাম হেমন্ত। একথা সত্য যে বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমান ভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়না; তার প্রচ্ছন্ন অনুভূতি উপলব্ধ হয়।তবে গ্রাম বাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবু হেমন্ত ঋতুচক্রের সবার মধ্যে অনাদৃত, এবং কিছুটা অবহেলিত। শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনাকে ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই হয়তো প্রকৃতির এমন ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসবের অবসানে হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দ থেকে। অর্থাৎ হেমন্তের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে কমে আসে মেঘের ঘনঘটা, গোটা শরৎকাল জুড়ে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। হেমন্তের সেই মেঘ আরো কমে আসে। শরতের শেষে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকাল গুলিতে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ।হেমন্তের প্রতিটি প্রহরই যে মুগ্ধতার। হেমন্তের ঘুঘু ডাকা দুপুর, বাঁক খেয়ে ধানক্ষেতে নেমে আসা বালিহাঁসের ঝাঁক, কাকতাড়ুয়ার মাথায় বসে থাকা ফিঙে, শেষ বিকালে পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে দেয়া সাত রঙের রংধনু। আর ভাবুক সন্ধ্যার প্রফুল্লতা ছেয়ে যায় মানুষের ভেতর জগৎ। জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাতও যে প্রকৃতিকে করে তোলে লাস্যময়ী। হেমন্তের এমনই মায়াময় প্রকৃতি মানব মননে অদ্ভুত তন্ময়তার সৃষ্টি করে। সেই তন্ময়তায় জেগে ওঠে প্রেম। এ প্রেম যেমন ঐশ্বরিক, তেমনই স্রষ্টার নিপুণ সৃষ্টি প্রকৃতিরতবে গ্রাম বাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবু হেমন্ত ঋতুচক্রের সবার মধ্যে অনাদৃত, এবং কিছুটা অবহেলিত। শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনাকে ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই হয়তো প্রকৃতির এমন ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসবের অবসানে হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দ থেকে। হিম হেমন্তের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার রঙ রূপের অপরূপ লক্ষ্মণ । ঘনবর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে কমে আসে কালোমেঘের ঘনঘটা, গোটা শরৎ কাল জুড়ে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। হেমন্তের সেই মেঘ আরো কমে আসে। শরতের শেষে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকাল গুলিতে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ। হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমের রাতে ওই গানটিতে লিখেছেন,
“হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
বিশ্বকবি তার নৈবদ্যে স্তব্ধতা কবিতায় লিখেছেন,
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে, জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’।
প্রিয় হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই মুট আর নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে মুট পুজো হয়।অনেক জায়গায় ১লা অগ্রহায়ণে মুট পুজো হয়।ধানক্ষেতে গিয়ে ছেলেরা একগোছা ধানগাছ কেটে লাল কাপড়ে মুড়ে মাথায় করে মুট নিয়ে আসে।লক্ষী ও নারায়ণের পুজো করা হয়।বছর বছর ভাল চাষআবাদের প্রার্থনা করে এই পুজো করা হয়।এই হেমন্তেকালেই হয় কার্তিক পুজো।
বাংলায় কার্তিক সংক্রান্তির সাংবাৎসরিক কার্তিক পূজার আয়োজন করা হয়।পূর্বের তুলনায় এখন কার্তিক জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া কাটোয়া অঞ্চলের কার্তিক পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুর্গাপূজা সময়ও কার্তিকের পূজা করা হয়।কলকাতাতে তার মন্দির আছে।কার্তিক ঠাকুরের সাথে ছয় সংখ্যা জড়িয়ে আছে৷ সেজন্য হয়ত স্ত্রী ষষ্ঠীর সাথে তার মিল৷তিনি বাচ্চা বড় না হওয়া অব্দি তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন ৷তার কৃপা পেলে পুত্রলাভ , ধনলাভ হয় ৷তারপর নবান্ন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়।নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ আর নলেন গুড়ের মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।ইউরোপে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে হেমন্তের শুরু। সেখানে একে বলা হয় বৈচিত্র্যময় রঙ ও পাতা ঝরার ঋতু। ঝাউ গাছগুলো ছাড়া সব গাছেরই পাতা এ সময় ঝরে যেতে শুরু করে এবং শীতের আগমনের আগেই সব বৃক্ষই ন্যাড়া হয়ে যায়।হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস, শীতের আগে ঝরে যাবার পূর্বে শেষবারের মতন সজ্জিত হয়ে ওঠা গাছের পাতা গ্রামবাংলায় যেন সকল ঋতুর মধ্যে হেমন্তকেই রানীর মুকুট পরিয়ে দেয়। তাই বলা হয় বসন্ত যদি ঋতুরাজ হয়, তবে নিশ্চিত ভাবেই হেমন্ত হলো ঋতুদের রানী। গ্রাম বাংলার বুকে ভোরের হালকা কুয়াশায় ধানক্ষেতে ধান গাছের উপর জমে থাকা বিন্দুবিন্দু শিশির যেন সমগ্র গ্রামের পরিবেশকেই এক অপরূপ মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে।প্রকৃতির বুকে উৎসবের উত্তেজনার পর স্বস্তির প্রতীক হিসেবে হেমন্তের আগমন হলেও প্রকৃতি এই ঋতুকে প্রাকৃতিক দানের সমারোহ থেকে এতটুকুও বঞ্চিত করেনি। বরং সমগ্র হেমন্তকাল পূর্ণ হয়ে আছে বিভিন্ন প্রকার ফল ফুল ও ফসলের আড়ম্বরে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় হেমন্তকালে ফোটা বিভিন্ন প্রকার অনিন্দ্যসুন্দর ফুল গুলির কথা। শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি ফুলের মাধুর্যে সমগ্র হেমন্তকালের প্রকৃতি যেন মাতোয়ারা হয়ে থাকে।ফুল ছাড়া মানুষের জীবন যেন রুক্ষ, প্রাণহীন। হেমন্তকাল মানুষের জীবনকে তার ফুলের ডালি উপুর করে দিয়ে সেই রুক্ষতায় নিয়ে আসে পেলবতার ছোঁয়া। অন্যদিকে হেমন্তের পরিবেশ বিভিন্ন প্রকার ফসল চাষের জন্য বিশেষভাবে অনুকুল। এই ঋতুতেই বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে বাঙালির প্রিয় আমন ধান। অন্যদিকে সমগ্র হেমন্তকাল জুড়ে গাছে গাছে শোভা পায় কামরাঙা, চালতা, আমলকি, কিংবা ডালিমের মতন বিভিন্ন ফল। তাছাড়া এই ঋতুর প্রধান ফল হলো নারিকেল।অনেক আগের কথা তখন বাদশা আকবরের রাজত্ব, সে সময় পহেলা অগ্রহায়ণকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সময়ে প্রধান দুটি খাদ্য শস্য রোপণ করা হতো একটি আউশ এবং অন্যটি আমন। বেশিরভাগ সময় হেমন্ত কালে এই শস্যটি রোপণ করা হয় বলে অন্য কোন শস্য উৎপাদন হতো না। তখন সমস্ত দেশ এই শস্যে ছেয়ে যেতো। সে সময়ে আউশ বেশ জনপ্রিয় এবং ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন একটি শস্য। সারাদেশে এর চাহিদা ছিল প্রচুর। এদিক দিয়ে আমন চালের শস্যটি সারা বছরই কম বেশি উৎপাদন হয়ে থাকত বলে এই শস্যটি পাওয়া যেত সারা বছরই। অগ্রহায়ণ এর কিছুটা আগে মানে কার্তিক মাসে আউশ শস্যটি রোপণ করা হতো যার ফলে, হেমন্ত কাল এসে পোঁছাতেই শস্যের মাঠ হলুদে ছেয়ে থাকতো। ধান পেকে মাঠ হলুদ হয়ে আছে এই দৃশ্যের চেয়ে সুখকর কোন দৃশ্য পরিশ্রমী কৃষকরা দেখেনি। হলুদ মাঠ দেখে কৃষকদের মুখে ফুটে উঠত রাজ্যের হাসি। এ আনন্দ যেন থামবার নয়। তখনই ঐ সময়টাকে উৎসবে পরিণত করা হল, নাম দেয়া হয় “নবান্ন উৎসব” মানে “নতুন চাল বা অন্নের উৎসব”। এই সময় ধান কেটে শুকিয়ে সিদ্ধ করে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠাপুলি বা খাবার। সবাই এক হয়ে উপভোগ করে এই উৎসব। এবং মিলেমিশে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে।
শিউলির নেলপালিশে রঙিন শিশুর মন আর শিশিরের নোলক পরা ঘাস, মন মাতানো সুবাসে ছেয়ে থাকা শিউলি ফুল যখন আপন আঙিনার উজার করা প্রেমে পড়ে থাকে তখনই হেমন্তের শুরু হয় হৈমন্তিক শুভেচ্ছা মেখে।শুধু শিউলি ফুল নয় অপরূপ দোলনচাঁপার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুগন্ধ আমাদেরকে হেমন্ত কালে আবদ্ধ করে রাখে জীবনের যৌবনরসে। সাদা রঙের পবিত্রতা আর হাওয়ার সুবাসে মোহিত হয়ে চলে হেমন্ত কালকে বরণ করে নেওয়ার পালা ।প্রিয় হেমন্ত এমনিতেই তো আর রানীর মুকুট পায়নি। তার এমন প্রাচুর্য্যের ঢের তাকে এনে দিয়েছে এই খ্যাতি। শরৎকাল বর্ষার কিছুটা পরে আসে। শরতের শেষ ভাগে এসে বৃষ্টি কিছুটা কমতে থাকে। সারি সারি মেঘ ভেসে বেড়ানো আকাশের গায়ে এসে পড়ে কুয়াশার আলতু স্পর্শ। হেমন্তের শুরুটা সেখান থেকেই। তবে শহরে হেমন্তের ঋতু আসে কিছুটা ভিন্ন রূপে । মনভালোর দিনগুলো একটু একটু করে কীভাবে যেন ছোট হয়ে আসে। বেলা পড়ে গেলেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে দ্রুত। রোদও হারিয়ে ফেলতে থাকে তার তেজ। এসব দেখেই সকলের অনুভব হয় বদলে যাচ্ছে ঋতু। হেমন্ত চলে এসেছে। মনমুগ্ধকর এই ঋতুতে চাইলে আপনি অনেক কিছু করে সময় কাটাতে পারেন। যে কারণগুলোর জন্য হেমন্ত কাল সকলের কাছে প্রিয় জানতে লেখাটি পড়তে থাকুন। শরতের কাঁচা হলুদের মতো সোনলি রোদ দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে দেয় চিরায়ত রূপের সুধা আর সৌন্দর্য। তাকে অনুসরণ করে হেমন্ত ঋতুর আবির্ভাব ঘটে ধীর পদসঞ্চারণে। প্রকৃতির হরিদ্রাভ সাজ দিকে দিকে নতুনের জাগরণ ঘোষণা করে। বর্ষার জল সরে গিয়ে মাঠঘাট মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে। শীতের পূর্বসূরি হেমন্ত হচ্ছে পাকা ধানের ঋতু। এসময় ঘরে ঘরে নতুন ধানের পিঠা খাওয়ার উৎসব শুরু হয়, ভোররাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চিঁড়ে কোটার শব্দ ওঠে। তবে এ চিত্র সম্পূর্ণ গ্রামবাংলার। অথচ আজকাল বিশ্বব্যাপী যে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, তার রেশ এসে পড়েছে বাংলার গ্রামেও। ষড়ঋতুর বিচিত্র বিকাশ আজ এই ভাটি বাংলার হৃদয় হতে মুছে যেতে বসেছে। তথাপি শীতের প্রাক্কালে হিমঋতু হেমন্তের পাতা ঝরার দৃশ্যের ভেতরে যে শূন্যতা ধরা পড়ে, তা আরো বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে আমাদের শিল্পসাহিত্যে।প্রকৃতির বুকে উৎসবের উত্তেজনার পর স্বস্তির প্রতীক হিসেবে হেমন্তের আগমন হলেও প্রকৃতি এই ঋতুকে প্রাকৃতিক দানের সমারোহ থেকে এতটুকুও বঞ্চিত করেনি। বরং সমগ্র হেমন্তকাল পূর্ণ হয়ে আছে বিভিন্ন প্রকার ফল ফুল ও ফসলের আড়ম্বরে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় হেমন্তকালে ফোটা বিভিন্ন প্রকার রঙীন ফুলগুলির কথা। শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি ফুলের মাধুর্যে সমগ্র হেমন্তকালের প্রকৃতি যেন মাতোয়ারা হয়ে থাকে।ফুল ছাড়া মানুষের জীবন যেন রুক্ষ, প্রাণহীন। হেমন্তকাল মানুষের জীবনকে তার ফুলের ডালি উপুর করে দিয়ে সেই রুক্ষতায় নিয়ে আসে পেলবতার ছোঁয়া। অন্যদিকে হেমন্তের পরিবেশ বিভিন্ন প্রকার ফসল চাষের জন্য বিশেষভাবে অনুকুল। এই ঋতুতেই বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে বাঙালির প্রিয় আমন ধান। অন্যদিকে সমগ্র হেমন্তকাল জুড়ে গাছে গাছে শোভা পায় কামরাঙা, চালতা, আমলকি, কিংবা ডালিমের মতন বিভিন্ন ফল। তাছাড়া এই ঋতুর প্রধান ফল হলো নারিকেল।
জানা যায়, চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দেশজ আচার ও লোকসংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও এর সঙ্গে মানব-সম্বন্ধের যে অকৃত্রিম প্রকাশ ঘটিয়েছেন।কবি মুকুন্দরামের কাব্যে যা লক্ষ করা যায়, বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। কবিকঙ্কণ বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে প্রভাব-সঞ্চারী এ দেশের ষড়ঋতুর বিকাশ বৈচিত্র্যকে চমৎকার কাব্যরূপ দিয়েছেন। তাঁর ষড়ঋতুর এই ব্যঞ্জনায় শুধু হেমন্ত সম্পর্কে বলেন, ‘নিকেতন পরাণনাথ কৈলে বসবাস/আইল কার্ত্তিক মাস হিমের প্রকাশ’। আবার এ বাংলার প্রবাদ-প্রবচনও এই ষড়ঋতু কেন্দ্রিক কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত। চিরায়ত ঋতুর এই চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যগুলো আবহমানকালের প্রকৃতিকে মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ, শুভাশুভ নির্ধারণে দিকনির্দেশনা দেয়। আর হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রথম প্রহর। শরতের কাশফুল মাটিতে নুয়ে পড়ার পরপরই হেমন্তের আগমন ঘটে। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয়ে শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তে সকালবেলা আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারদিকের মাঠঘাট। হেমন্তে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল ফোটে। হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের আমেজ। হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। এ ঋতুর বিশেষ কিছু ফল হল- কামরাঙা, চালতা, আমলকী ও ডালিম। হেমন্তকাল জুড়েই আমরা দেখতে পাই আমন ধানের ক্ষেত- যা খুবই সুন্দর ও নয়নকাড়া। কচিকাঁচা ধানগাছগুলো সতেজ হতে আরম্ভ করে ক্রমেই। আর পাকা ধানের ক্ষেত সোনালি সূর্যের আলোয় চিকচিক করতে থাকে।প্রকৃতির বৈচিত্র্য জীবনকে করে তোলে বর্ণময়, আর সেই বৈচিত্র্যের রূপ জীবনের একঘেয়েমি দূর করে নতুন রঙে রাঙিয়ে দেয়। বাঙালির সৌভাগ্য যে, আমাদের স্বদেশ বঙ্গভূমিতে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। বছরের বারো মাসে ছয় ঋতুতে প্রকৃতির নতুন রূপে নতুন লীলা বাংলার মানুষের জীবনকে অনাবিল স্নিগ্ধ আনন্দে ভরিয়ে তোলে।
শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো ছেলেটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।আমার বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করে ঝরা ফুলের দল। প্রকৃতি জানে ফুল ঝরে গেলে তার কদর কম হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ঝরে যায় হেমন্তের শিউলিঝরার মত।

Facebook Comments

Leave a Reply