একটি শিশির বিন্দু : শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

দেড় মাস হয়েছে এবার পূজোর আগে বই রোদে দেওয়ার। সারাদিন রোদ। তবে এই বুঝি বৃষ্টি এলো বলে, তার ঝক্কি সামলে খুঁজে বের করে আনলাম হেমন্তকালকে। আমি জানি আমার ঋতুগুলো কোথায় থাকে। দম্ভ। ঋতু বরাবর রেখা বদলে যায়। তাই হেমন্তকালের রচনা লেখা যায় না উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে।

হেমন্ত আগেও ছিল। হেমন্ত আমার প্রিয় ঋতু নয়। বাড়িতে এখন পোস্টম্যানরাও আর আসেনা, ক্যুরিয়ার এলে তারা ফোন করে, তবে আসে। আচমকা কোনো জাহাজের গল্প তাই হেমন্তের সকালে অবান্তর। ‘একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি।’

হেমন্তকাল এখনো আমার বাড়িতে আসে। কাক ভোরে। কার্তিক মাসে। সদ্য কাঁথার ওম মেখে চোখ খুলে আলোর খুনসুটি দেখে যেই পাশ ফিরেছি, দূরে তখনই খঞ্জনি, করতাল… কার্তিকের কীর্তন। হেমন্ত তাই এই কলোনিতে এখনো আছে।

স্কুলে পড়তে ঋতুরঙ্গ। হেমন্তকাল নিয়ে কি লিখতাম মনে নেই। একে সহজে ভুলে থাকা যায়। কোনো আবদার নেই, অভাব নেই, অভিযোগ নেই, অসুবিধা নেই, কেবলই তো সূর্যের পতন কোণ। তাকে ঘিরে আর কি বা আবেগ! উপেক্ষা।

আই ক্যান নট চেঞ্জ দা উইনড। হেমন্তকাল নিয়ে লিখতে বসে কেউ কি অস্থিরতা অনুভব করে? অস্থিরতা এই বিষয়ে নয়। বাস্তবিক হেমন্তকালে বসে কি হেমন্তের কথা লেখা যায়! বর্তমানকে নিয়ে লেখা সততই কষ্ট বয়ে আনে কি! হেমন্ত কি কিছু বিশ্ময়? হেমন্ত… হেমন্ত… হেমন্ত… না সত্যি ড্রিবল হচ্ছে না শব্দটা মাথায়। তার ধারক বাহক নেহাতই জলবায়ুগত। হেমন্তকে আমি ঘৃণা করি না। আমেন।

লেট অটাম। কেবল আলোর পরিবর্তন। নৈসর্গিক। হয়তো! কনফিউশনটা রয়েই যায়… চরাচর জুড়ে মোহময় আলো এই লেট অটাম। হেমন্ত কিছু নয়। হেমন্ত মানেই তো থাকা না থাকার লড়াই। এই বুঝি আছি অথবা নেই। ওদিকে লেট অটাম, সে আহা! মনোরম… মৃদু বায়। প্রশান্তি। মায়া এসে আপনি জুড়ে যায়। হেমন্তের রং কি? হেমন্ত রং! হেমন্ত রং? হেমন্ত…

হেমন্ত কখনো ঘাড়ে ধরে লিখিয়ে নেয় নি। বর্ষা নিয়েছে, শীত নিয়ে যায় এমনকি গ্রীষ্মের দাপট সেই বা নেই এমন নয় তবে হেমন্তে নয় কেন? এই না থাকার মধ্যে কি তবে সে নিজেকে খুঁজে পায়।

ঋতু তো নয় আসলে কথা হল সে থাকে কোথায়? তা সে হেমন্ত। ঋতু। ঋতুকাল। হোক না লেট অটাম। ঋতু নিয়ে কোনো শ্রেষ্ঠ নিবন্ধ লেখা যায় না। একটা ঋতু সে তো এই আছে এই নেই আবার তার চক্র! সে তো আবার আরো গোলমেলে। চক্রবৎ, চক্রবৎ, ঋতুচক্র, চক্রবৎ…

তো হেমন্তের রং কেমন? রেখাই বা কি! কোন প্রকার? হেমন্তের ছবি আমি তো আঁকি নি কখনো। শৈল্পিক ইগনোরেন্স তাকে মানায় ভালো। হেমন্ত নিয়ে দু-এক লাইন কখনো-সখনো, তবু সে ওই শীতের প্রসঙ্গে নয়তো শরতের লেজ ধরে। আস্ত একটা ভাবনার ভরকেন্দ্রে… নৈব নৈব চ! ইগনোরেন্স নাকি কোনো ইনার্শিয়া? আহা জড়তা।

এই বুঝি ঠিকঠাক। জড়তাই তো! হেমন্ত নিয়ে রয়েছে জড়তা। জড়তার ঋতু। এও এক প্রকারের স্ব-ক্ষমতা। হেমন্ত এক প্রত্যাবর্তনের কাল। শুধু যে মৌসুমী বায়ু ফিরে যায় সে সবই শুধু নয় এই যে আবার শীত আসছে তার আগে পরিষ্কার করে রাখা অলিন্দগুলোকে,পরিষ্কার করে ফেলে দেওয়ার সাহস পাওয়া যায়, সে তো সেই এই লেট অটামই, হে-ম-ন্ত। প্রত্যাবর্তন থাকে, ফিরে যাওয়া থাকে, তাই না জড়তা। তাই বলে কি জড়তাকে উদযাপন? তাও কি…!

একটা উদযাপন তবু তো জরুরী। অবশেষে তাই সে থাকে কোথায়? উচ্চারণ। তবে কি থাকতেই হবে? না থাকলে তো আবার পরিবেশপ্রেমীদের তরফে গেল গেল রব। না তা ঠিক নয়, তবু সকলেই চায়, সে তো থাকুক। থেকে যাক। থাকাটাই জরুরী। তার প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সকল নিয়েই সে থাকুক। থেকে যাক। থাকাটাই কি জরুরী না কি থাকার অভ্যেস, না থাকার মধ্যে যে নেই সেই থাকার মান্যতাকে মান্য করা। জড়তা।

বিষয়টির প্যারাডক্স এখানেই যে বর্তমানে বসে কি বর্তমানকে লেখা যায়? বর্তমানে বসে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন, আহা! অথবা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। সে মন্দ নয়। কিন্তু বর্তমান। হেমন্তকালে বসে আস্ত হেমন্তকালকে নিয়েই লেখা! তা হচ্ছে কোথায়? অতএব সে থাকে কোথায়!

বিগ এন্ড নথিংনেস! নাহ! অযথা সেদিকে এখন আর এই হেমন্তের মাঝরাতে নাই বা গেলাম। হৈমন্তিক সত্তা। হেমন্তিকায় জ্বালাও আলো… হেমন্তের আকাশে তারা গুনেছি কি কখনো! মনে পড়ে না। করলাম কি তবে হেমন্তেকে নিয়ে? তাকে নিয়ে আসলেই কোনো গদগদ মাখামাখি দেখি না কোথাও। হেমন্ত তাই এক ডায়াসপোরা।

ঋতুর একটা রাজনীতি থাকে। তেমনি থাকে ঋতুবদলের। চক্রবৎ। তাই সে আসে আবার যায় কিন্তু এই যাওয়া-আসা বড় নিভৃত। কোনো উচ্চকিত আনাগোনা নেই। বর্ষায় বর্ষামঙ্গল, শীতে লোনলি কোরাস, গ্রীষ্ম না হয় গনগনে গণসঙ্গীত, শরৎ সুধা সে তো সকলকে ছাপিয়ে রোমান্টিক, বসন্ত? উদাসী গজল, কিন্তু হেমন্ত তাকে ঠিক কোন চৌখুপে? নাকি সে নিজের দোষেই এতোটা কোণঠাসা!

হেমন্তকে ঘিরে কোনো সুপারস্টিশন নেই। না আছে কোন স্পিরিচুয়ালিটি। অথচ লেট অটামের স্পিরিটটাই যেন এই দুই শব্দবন্ধ নিজেই। অর্থাৎ আছি অথচ নেই। বর্তমানে বসে বর্তমানকে এক্সপ্লেন করা। শেক্সপিয়ার এখানে টেনে এনে দারুণ এক গদ্য নামানো যায় হয়তো বা কিন্তু কি লাভ! হেমন্তের তাতে কি বা যায় আসে। যে প্রসঙ্গে একথা বলছি তা হল একটা কার্টসি তো চলেই আসে কবিদের প্রতি। হেমন্তের কপালে তাই জুটেছে অবমাননা। সে অনেক সীমাবদ্ধ। অপরায়ন। লেট অটাম আর হেমন্ত যে একদমই এক নয় এ কথা এ প্রসঙ্গে উচ্চারণ অব্যর্থ। লেট অটামের যে কুলীন অবস্থান হেমন্ত কিন্তু তাতে হা-ভাতে, হ্যাংলা… সে ঘর শূন্য, সে আসলে থাকেটা তবে কোথায়?

এখন মনে হচ্ছে হেমন্ত নিয়ে এইরকম একটা কাজ হয়তো মন্দ নয়। সে যে ঋতুরঙ্গ নয় সে কথা বলাটাই দরকার। কেন তাকে খুঁজতে হয় তবে? এ কোনো ফরমায়েশি নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে এক অবশ্যম্ভাবী সিরিয়াস এবং মেইনস্ট্রিমের দাপটে তলানিতে গিয়ে ঠেকা এক অস্তিত্ব। আত্মবিশ্বাস। তাই খোঁজো… খোঁজা… খুঁজতে…

খুঁজে দেখা প্র্যাকটিস করো…

গ্রামের হেমন্ত। শহরের হেমন্ত। শহরতলী কলোনির হেমন্ত। আর একদা এক পাহাড়ি হেমন্ত। স্মৃতি সততই মধুর। এসবের বিস্তর রোমহর্ষক বর্ণনায় পাঠিকাকে আপ্লুত করা লক্ষ্য নয়। কেননা অতীত লিখছি না, ভবিষ্যতে তাকাচ্ছি না, বর্তমানে বসে বর্তমানকে চাইছি খুব। লেট অটাম যেটা বলতে পারে না, হেমন্ত দেখছি আবার সে উচ্চারণে উচ্চকিত, “ইয়েস আই এম রেস্পন্সিবল…”

এই যে নবান্ন রাত পোহালে, তাকে বাঙালি কসমোপলিটান কিভাবে দেখবে জানিনা, কিন্তু ওই চাল কলার ডালায় প্রথম ওঠা কমলালেবুর খণ্ডগুলো যেন হেমন্ত রং। ঠিক এই রংটাই হেমন্তের আকাশ, সাঁঝবেলায়…

এই রঙের মধ্যে অস্থিরতা নেই আবার আছেও। লিখতে বসে যে অস্থিরতা হেমন্ত যেন সেই অস্থির রঙের ভেতরে চালকলার মৃদু থকথকে আঠালো গাঢ় আঠার মতো আবেগঘন মুহূর্তে নিয়ে না যায় চেতনাকে সেই দিকে সচকিত হয়ে আছি। কারণ বর্তমানে বসে বর্তমানকে লেখার যে মেক আ মাইন্ড কাজ করে তা বিজ্ঞান বিচ্যুত নয়। হেমন্তের প্রকৃতি নিষ্ঠ বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। আমার প্রকৃত কাজ তাকে জটিল বানানো। এক জটিল আবর্তের মধ্যে ঋতুকে ঢুকিয়ে সঞ্চালিকা হয়ে বসবো তবে না এ লেখার স্বার্থকতা। তবে একথা বলি হেমন্তকে নিয়ে কোনো ভয় নেই। সে যেন এক বাবা-বাছা শান্ত প্রাণ।

লেট অটামের কাছে কোন ডিপেন্ডেন্সি থাকে না। যেমনটা থাকে, যেমনটা রয়েছে বর্ষায় বা শীতে। সে বর্তমানের মতো স্বতন্ত্র। তবে এটা ঠিক কখন আমার নিজের হেমন্ত খুঁজে পাবো সে কথা কিন্তু নির্ভর করে একটা প্রাইড ট্র্যাডিশনের ওপর। কেন বলছি একথা? বাঙালি বলে। বাংলায় লিখে থাকি বলে। লেট অটাম যতই বায়বীয় হোক না কেন হেমন্ত তো আমার ভাষা। আ মরি বাংলা ভাষা। বাঁধন।

হেমন্ত কি নির্ভেজাল? একদম নয় কিন্তু। বরং ডিপ্লোম্যাটিক। এক তো আছি অথবা নেই। অন্যদিকে আবার চলে যাচ্ছি বা আগতপ্রায়। বড় তাড়া কি? হেমন্ত তো তবে রাগী নয়, দাপুটে নয়, ক্ষীণ অথচ পলিটিক্যাল।

হেমন্ত নিয়ে কিছু ছবি দেখেছি বৈ কি। যেমন ফায়ার ইন দা ইভিনিংকে আামার মনে হয় হেমন্তের ছবি। কেননা আমার দেখা গ্রামের রাস্তা পেড়িয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার দিনে দিগন্তের কাছে ধোঁয়ার রেখা সে তো হেমন্তের আগুন। এই ইভিনিং কিন্তু আমার লেট অটাম ইভিনিং। এই রং, পরিপূর্ণ হেমন্ত বেলা আমার কাছে।

ভ্যান গঘ কি কখনো হেমন্তের রাত আঁকেনি বা একটাও সাইপ্রাস, সূর্যমুখী, উইলো যার গায়ে হেমন্তের গন্ধ। না ‘ছবিতে হেমন্ত’ এটাও চমৎকার হাতছানি দিলেও তাতে প্রবেশ নিষিদ্ধই রাখছি। ধরতে চাইছি বর্তমানকে। বর্তমান বলে কি আদৌ কিছু হয়? হেমন্ত কি সত্যিই থাকে কোথাও। কোথায়? হৃদয়ে বলবে কবি, মস্তিষ্ক বলবে ব্যাপারী কিন্তু “প্রকৃত হেমন্ত” তাও কি কিছু হয়! আসলে তাকে না যায় ধরা, না যায় দেখা, তার গায়ে শীত কপালে রৌদ্রকণা। সে ক্ষণিক। সে ভাস্বর। ক্ষণজন্মা।

হেমন্ত তাই আকাশ প্রদীপ। ক্ষিতি আছে, আছে মরুৎ, অপ, ব্যোম, তেজ… প্রদীপ জ্বালাও, জ্বালাও আলো, আপন আলো… অগ্নি সঞ্চয়! আকাশ প্রদীপ, একটা ক্ষয়িষ্ণু শিল্প। একটা সেন্টিমেন্ট। বার্তা। বেদ কিন্তু আকাশ প্রদীপের প্রাণে উদ্বেলিত। রাতজাগানিয়া।

আমার স্মৃতিতে হেমন্ত শিশির কুড়িয়ে, আমার বর্তমান শিশির কুড়োতে, আগামী শিশিরের খোঁজে… এক বিন্দু শিশির, গহীন রাতে গড়িয়ে পড়া চোখের কোণের এক বিন্দু জল, নিটোল, টলমল। অমলিন। হেমন্ত।

কার্তিক মাসটা ম্যাজিস্টিক, পূর্ব পুরুষেরা বুঝি সত্যিই আছে। ভাবতে তো ক্ষতি নেই, যেমনটা ঠিক পরজন্ম। পরজন্মে তবে হেমন্তের শিশির নয় কেন?

হেমন্ত পলিটিক্যাল। দেব দীপাবলি। হেমন্ত একটা চয়েস। সে আছে অথচ নেই। তাই হেমন্ত কোথায় থাকে কোনো প্রশ্ন নয়। হেমন্ত আছে হেমন্তেই…

লেট অটাম হতে হেমন্ত তাই দৈহিক গঠনেও আলাদা, মননে, আত্মিক চরিতার্থতাতেও সে স্বতন্ত্র। লেট অটাম যদি হয় কায়া হেমন্ত তবে কিন্তু তার ছায়া নয়! এই প্যারাডক্সটাই হেমন্তকে করেছে অবিস্মরনীয়।
চক্রবৎ হয়েও সে সরলরৈখিক। এটা চক্র রেখা সে যতক্ষণ বর্তমান ততক্ষণ তো সে সরলরেখাই। হেমন্তও সরল। হেমন্তের রেখা তাই সরল। চক্রবৎ সরল। এ কথা আলাদা যে, আই ডিজলাইক স্ট্রেট লাইন। তাই বলে কি হেমন্ত মিথ্যা! তা তো নয়।

হেমন্ত রাত তাই নিঃঝুম নয়। সঙ্গে থাকে পূর্বপুরুষ। হেমন্ত রাতে ভয় নেই। আছে ভরসা। সুদূর দূরে কোন রমনী আকাশ প্রদীপ নামিয়ে আনছে- রাত পোহালো কি! আকাশে বাতি দেওয়ার কাল হেমন্ত… রাত পোহালো কি! আজ নবান্ন। বাঙালির ঘরে ঘরে নতুন চাল। বাঙালির মাঠে নতুন শস্য। দোদুল্যমান। বাংলা কি তবে শস্য-শ্যামলা!

হেমন্ত শুধুই কি একটা পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট… একটা চয়েস…। দ্রব।

Facebook Comments

Leave a Reply