হেমন্ত করিডোর : সৌগত ভট্টাচার্য
উঁচু বাঁধের একদিকে একটা অলস রেল লাইন চলে গেছে জলপাই রঙের জঙ্গলের দিকে। অন্যদিকে বিরাট একটা পানা ঝিল, কয়েক দিনের মধ্যে ভরে যাবে কুয়াশা আর শাপলায়। বাঁধের ওপর পাকা রাস্তাটি সদ্য সারাই করে চওড়া করা হয়েছে। সেখানেই বিশ্বজিতের চা পান সিগারেটের দোকান। বিকেলে স্কুল ফেরত মাস্টারমশাই দিদিমণি আসলে চপ ভাজা শুরু করে বিশ্বজিৎ। লেনিন রায় আলোয়ান মুড়ি দিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করে দোকানের সামনে। বাঁধের ওপর দোকানে বসলে ট্রেনের ছাদ দেখা যায়, হাওয়ায় না উড়ে যাওয়া পাতা জড়িয়ে থাকে ছাদে। ট্রেনের ছাদ বাঁধের রাস্তার সমান। এই পথ দিয়ে যোগীঘোপা মাথাভাঙা চ্যাংড়াবান্ধা হয়ে লিস ঘিস চলে মাল সেবক গুলমা পেরিয়ে শিলিগুড়ির দিকে ট্রেন যায় দিনে একবার, ট্রেন ফিরে আসতে আসতে হেমন্ত নেমে আসে দোমোহানি স্টেশনে। ট্রেন সন্ধ্যায় দোমহানিতে ফিরে আসলে, লেনিন রায় বাড়ি ফেরে।
বিশ্বজিতের দোকানের কিছুটা দূরে আরেকপাশ দিয়ে চলে যায় আসামের লাইন। ওপরের লাইনের আড়াআড়ি করে টানেলের ভেতর দিয়ে সকাল বেলায় ট্রেন এসে থামে দোমোহানি জংশনে। বাঁধের প্রায় গায়ে লাগোয়া এই স্টেশন। স্টেশনের পর বাঁধ তারপর তিস্তা। খুব সকালে ট্রেন দোমোহানিতে ঢুকলে লেনিন রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে লটারির টিকিট নিয়ে বিশ্বজিতের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। এই ট্রেন থেকে দোমহানিতে কেউ বিশেষ নামে ওঠে না। হেমন্তের সব গন্ধ নিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার দিকে রওনা হয়।
পুজোর পর থেকে তিস্তা চরের কাশ বন ফাঁকা হতে শুরু করলে নদীর চড় বাড়তে বাড়তে বাসুসুবা পর্যন্ত পৌঁছায়। গত বছর তিস্তার বন্যায় বাসুসুবা অঞ্চলের পূর্ব দিক জলের তলায় চলে গিয়েছিল। হেমন্ত আসার অপেক্ষায় ছিল বাসুসুবার লোকজন। নতুন ধান বেচে কিছু টাকা আর ধান ঝাড়ার পর কিছু খড় হাতে এলে দোমোহানি থেকে পলাশ মোড় যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে আবার ঘর বাঁধবে তারা। দোমোহানি মোড় থেকে পলাশ মোড় পর্যন্ত রাস্তাটা তিস্তার চরের ওপর দিয়ে চলে যায় ধরলা পর্যন্ত। হেমন্ত আসলে নদীর বাতাসের শব্দ পাল্টায়। বর্ষার প্রবল জলহাওয়ার শব্দ শোনার পর হেমন্ত যেন নরম গান হয়ে যায় বাসুসুবায়। একটু একটু করে শীত করিডোর তৈরি করে হেমন্ত। কাঁসার থালার মত চাঁদ ওঠে।
পুজোর ছুটির পর স্কুল খোলেনি দুই বছর। এই বছর হেমন্ত এনেছে স্কুল খোলার চিঠি। কার্তিকের কাঁচামিঠা রোদ এসে দাঁড়ায় বিশ্বজিতের চায়ের দোকানে। রোদ লোভী মাস্টারমশাই দিদিমণি পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভার সেলস ম্যান দুধ চায়ের কাপ হাতে নেয়। লেনিন রায় কয়েকটা টিকিট হাতে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, ওর হাত পা গুলিতে নদীর শুকনো হাওয়ায় চিড় ধরতে শুরু করে। কার্তিকের দুপুরে রোদের তাপ বাড়লে লেনিন একটা প্যাসেঞ্জার টোটোর সামনের সিটে বসে। টোটোতে ভাড়া লাগে না, নদী থেকে শুকনো বাতাস লাগে গায়ে। পলাশ মোড়ের রাস্তার দুই ধারে এখন সবুজ হলুদ একটার পর একটা ঢেউ, ঢেউয়ের শেষে কালচে বাঁশবন। মাঝেমাঝে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। খড়ের স্তুপ থেকে গন্ধ ভেসে আসে নাকে। মাঠে এখন কালো নুনিয়া কাটার ব্যস্ততা। ঝাড়ার পর পড়ে থাকা ধান রাতের শিশির মাখার অপেক্ষায়।
বিশ্বজিতের দোকানে সন্ধ্যা নামে সময়ের আগেই। অসম্ভব মন খারাপ উদাসী সন্ধ্যার ছায়া পড়ে ঝিলের জলে। বর্ষার ভরা ঝিল আর শীতের কুয়াশা ঝিলের মাঝেই শুধু সুন্দরতম বিষণ্ন সন্ধ্যা ছুঁয়ে যায় অঘ্রান মাখা কচুরিপানা ফুলকে। পলাশ মোড় থেকে বাসুসুবা হয়ে তিস্তার সব হাওয়া ঝিলে এসে পাক খায় নতুন ধানের গন্ধ নিয়ে। শ্রাবণের পাট পচা গন্ধের জন্য পরের বছরের অপেক্ষা দীর্ঘ হয়। টং ঘরের লণ্ঠনের আলো থেকে ভেসে আসে নেশা মাখা গান, ধান পাকে মাঠে। নদীর হাওয়ায় লেনিনের ঠান্ডা লাগে। বিক্রি না হওয়া টিকিট হাতে লেনিন দোমহানি স্টেশনটির দিকে ধান কাটা মাঠের মত শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকায়…
দোমোহানির নতুন বাজার থেকে একটা রাস্তা যায় বাসুসুবা পলাশ মোড় হয়ে ধরলার দিকে, অন্যটি আর পি এফ ক্যাম্প হয়ে সিঙ্গিমারি মোড়ের দিকে। দুই রাস্তার মাঝে ত্রিভুজ দ্বীপের মত জেগে ওঠে হেমন্ত চরাচর। ধান কাটা হলেও তোলা হয় না তখনই। ক্যাম্প থেকে শূন্য হলুদ মাঠের পর সিঙ্গিমারী স্কুল দেখা যায়, অল্প ধোঁয়াশায় ঢাকা। স্কুল থেকে কখনো কখনো শোনা যায় ট্রেনের আওয়াজ। ট্রেনের হর্ন শোনার জন্য কোনো এক হেমন্তের অপেক্ষায় ছিল সিঙ্গিমারী স্কুল। শ্মশানের রাস্তায় লাল সাদা শাড়ি জড়ানো গাছটার পাতা সব ঝড়ে গেছে। হলুদ মাঠের ওপর দিয়ে যাওয়া হাইটেনশন লাইন দীর্ঘ বর্ষায় এই মাঠকে সবুজ দেখেছিল। এখন ধানের গোড়া ফিকে সাদা হয়ে ওঠে বিকেল নামার আগেই। গাড়ি বাইক করে যাওয়া স্কুল কলেজ অফিস যাত্রীরা গাড়ির জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে শূন্যতার দিকে। গ্রীষ্ম বর্ষা শীত থেকে হেমন্ত অনেকটা বেশি অভিমান সূক্ষ্মতা দাবি নিয়ে আসে দোমহানি বাসুসুবা তিস্তা চরাচরে। যা শীত বা গ্রীষ্মের মত চামড়ায় অনুভবের না। সরালগুলো মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যায় ঝিলের দিকে। খাটো ধুতির ওপর আলোয়ান পড়া লেনিন রায় আলোয়ান খুলবে না পড়বে বোঝে না। লেনিন পাহাড়ের নীল রেখার দিকে তাকিয়ে বিড়ি ধারায়।
স্বাধীনতার আগে দোমোহানি বিরাট জংশন ছিল, কয়লার ইঞ্জিন জল নিয়ে তিস্তার গা ঘেঁষে চলে যেত কাঁটাতারহীন বাংলাদেশে। একসময়ের তিস্তা পারের অন্যতম গঞ্জ, বাণিজ্যকেন্দ্র আজ ধান কাটা হেমন্ত মাঠের মতোই শূন্য। স্টেশনের পাশে পলহয়েল স্কুলের গাছ স্টিম ইঞ্জিনের আশ্চর্য জলপানের সাক্ষী। বছর পাঁচেক আগে এই স্টেশনে উন্নয়নের ধুম লেগেছিল। পুরানো স্টেশনের সংস্কার হয়। বর্ষা সবুজ টিন লাগানো হয় কর্মচারীহীন স্টাফ কোয়াটারে। ধানের মাঠ থেকে প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত তৈরি হয় ফুট ব্রিজ। অপেক্ষায় থাকে ট্রেন সংখ্যায় বৃদ্ধির। ট্রেন বাড়লে লটারি দিয়ে যদি ভাগ্য খোলে লেনিনের। সিঙ্গিমারী রাস্তার লেভেল ক্রসিং থেকে স্টেশনের বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ি দেখা যায়। কিন্তু সকাল সন্ধ্যার প্যাসেঞ্জার ছাড়া কিছু ভাগ্যে জোটে না লেনিনদের। হেমন্তের হাওয়া এসে লাগে স্টেশনের গায়ে। ভারত বাংলাদেশ রেল যোগাযোগের বদলে শরতের পর শীত আসার হেমন্ত করিডোর হয়ে ওঠে নির্জন রেল স্টেশনটি।
পুজো শেষ হলে সবজি ফলানো মানুষের দল চরা পড়ে নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়া অঞ্চলে খেতি শুরু করে। বাড়ির টিনের ওপর লাউ উঁকি দেয়, মাটিতে বেগুন কুমড়ো সিম নতুন আলু। হেমন্তের সবজির দর শীতে গিয়ে ঠান্ডা হয়। গ্রীষ্মের আগেই চলে যেতে হবে চর থেকে, তাই প্রাণপনে হেমন্তকে আঁকড়ে ধরে থাকে সবুজ ফলানো লোকজন। ফড়েদের ভীড় বাড়ে, লেনিনের টিকিট কখনো ভাউচারে খেলে। দোমহানিতে রাত নামলে কাঁথা গায়ে দেয় লেনিন।
পরিযায়ী পাখিরা আসে বিশ্বজিতের দোকানের উল্টোদিকের ঝিলে। আকাশের কাছে গচ্ছিত রাখা ক্যালেন্ডারের ঋতু মানুষের কাছে অধরা হলেও পাখির কাছে না। শাপলার কুঁড়িগুলো ফুটতে শুরু করে। সকাল বেলায় লেনিন এসে পাখি দেখে ঝিল দেখে দূরের তিস্তা ব্রিজ দেখে। যদিও কিছুটা দূরের তিস্তা কে খুব পরিষ্কার দেখা যায় না। প্যাসেঞ্জার ট্রেন হর্ন বাজিয়ে দোমহানি স্টেশনে ঢোকে।
জলপাইগুড়ি শহর থেকে তিস্তা পেরিয়ে বারো কিলোমিটার রাস্তা দোমহানির বাঁধ, বিশ্বজিতের দোকান, ঝিল, স্টেশন আর একটা আস্ত হেমন্তকাল। শহরে শীত আসার আগে দোমোহানি হল্টে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায় একলা হেমন্ত। ঠিক যেমন বাংলাদেশে যাওয়ার আগে দোমহানি থেকে জল নিত স্টিম ইঞ্জিন। কিংবা এত আয়োজনের পরও নতুন করে সাজানো দোমোহানি স্টেশনে সারাদিনে সকাল ও বিকেলে দুইবার মাত্র ট্রেন এসে দাঁড়ায় দোমহানি হল্টে, চোখের পলকের জন্য। কেউ ওঠে না কেউ নামে না সে ট্রেন থেকে তবু বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ি প্ল্যাটফর্ম সব সাজানো থাকে। শীত শহরে ঢোকার আগে হেমন্ত দোমোহানি করিডোরে ক্ষণিক এসে দাঁড়ায় তার শরীরের সমস্ত চিহ্ন নিয়ে।
বিশ্বজিতের দোকানের অন্য পাশ দিয়ে আসাম লাইন হয়ে দূরের উঁচু রেল বাঁধ দিয়ে হুহু করে চলে যায় নন স্টপ এক্সপ্রেস ট্রেন, এক নগর থেকে অন্য নগরে। দোমহানিতে যে ট্রেনের কোনো স্টপ নেই।
সন্ধ্যা বেলায় নগর থেকে সামান্য দূরে হেমন্ত করিডোরের দাঁড়িয়ে লেনিন রায় লটারি হাতে নন স্টপ মেইল ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ডুয়ার্সের হেমন্ত গন্ধ মাখা প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি দোমহানিতে আসার অপেক্ষা করে।
Posted in: November 2021 - Cover Story, PROSE