লুক্কায়িত পাঠক্রম : শতানীক রায় ও শানু চৌধুরী

[It is not good for man to keep reminding himself, that he is man. — E.M. Cioran
খুব বড়ো একটা পৃথিবীতে বসবাস করি। প্রতিদিন অনেক কিছু বদলায়। ভাঙে গড়ে। আমরা নিজেই ভেঙে আবার গড়ে উঠি। আমরা ভাবি। আমাদের এই নিগূঢ় অস্তিত্ব যাপনের পদ্ধতির মধ্যে এসে পড়ে অন্বেষণ। জানি না কক্ষনো। জানতে পারি না। গানটা কেন এভাবে হচ্ছে কেন এভাবে হেঁটে চলেছি আর শেষপর্যন্ত ভাবতে বাধ্য হই কেন বেঁচে আছি। এই অন্বেষণের একটা বড়ো অংশ হল বই। আর পৃথিবীর নানা ভাষার বই থেকে আমরা কিছু বই বেছে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, একটি বই কিন্তু আবার জীবনও। মানুষ অদ্ভুতভাবে সেখানে লুক্কায়িত আছে। তারই পাঠ করতে করতে আমরা গড়ে উঠি। শব্দ। বাক্য। বাক্যের মধ্যে মধ্যে লুপ্ত শব্দ। শূন্যতা আর কীভাবে যে নিজেদের সংশয়কে এসে যেতে দেখি। নিজেদের অস্তিত্বচিন্তা চেপে বসে। এঁটে যায়। এই ধারাবাহিক সেরকমই কিছু বই। সেরকম জীবনের সন্ধান যার কোনো-না-কোনো অণুর ভেতর আমিও আছি। আর চাইছি সেই বিচ্ছুরণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাক। এই ধারাবাহিকে শতানীক রায় সে-সব বই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবেন। আর শানু চৌধুরী সে-বইয়ের কিছু অংশ অনুবাদ করবেন। আসলে কোনো পাঠই সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ-না আপনি সে-পাঠের অংশ হয়ে উঠছেন।]

পর্ব ৪

দি আনওম্যানলি ফেস অব ওয়ার
স্বেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ্

যুদ্ধের থেকে মানুষ মহৎ
[A HUMAN BEING IS GREATER THAN WAR]
ভাষান্তর: শানু চৌধুরী

তাঁরা কীভাবে আমাকে গ্রহণ করবে?

তাঁরা আমাকে “ছোট্ট মেয়ে”, “সোনা মেয়ে”, “সোনা বাচ্চা” বলে ডাকত। সম্ভবত যদি আমি তাঁদের সময়ের হতাম, তাঁরা হয়তো কিছুটা অন্যরকম ব্যবহার করত আমার সঙ্গে। নম্রভাবে আর সমনকস্কতায়। যে-কোনো রকম আনন্দ-উচ্ছ্বাসকে সরিয়ে রাখলে, একজন তরুণী ও বয়স্ক মানুষের সাক্ষাতের উপহার এর চেয়ে আর কী ভালো হতে পারে। একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দিক, সে-সময় তাঁরা তরুণী ছিলেন তবে এখন তাঁরা বৃদ্ধ, সেই তরুণী সময়কে তাঁরা স্মরণে রেখেছেন। জীবনের চল্লিশটা বছর পেরোনোর পরও তাঁরা মনে রেখেছেন সেই সময়কে। ওঁরা আমার কাছে সন্তর্পণে নিজেদের জীবনের গল্প বলেছেন— “ঠিক যুদ্ধের পরপরই আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার স্বামীর আড়ালে আমি আত্মগোপন করেছিলাম। শিশুর ডায়পারের আড়ালে লুকোতে চাইতাম। আমি আত্মগোপন করতে চাইতাম। মা আমাকে বলত: ‘চুপ করো! চুপ করো! কিছু বোলো না।’ আমি মাতৃভূমির জন্য নিজের কর্তব্য পালন করেছি। কিন্তু একটা কথা আমাকে গভীরভাবে ভারাক্রান্ত করে যে, আমি সে-সব গল্পের অংশ ছিলাম। সে-সব আমি জানতাম… এবং তুমি ছিলে খুবই তরুণ, আমি তোমার জন্য দুঃখ অনুভব করি…” প্রায়ই আমি লক্ষ করি তাঁরা কীভাবে বসেন এবং নিজেদেরই কথা শোনেন। তাঁদের অন্তরের ধ্বনি। কথাস্রোতকে পৃথক করে শোনেন হৃদয়ের ধ্বনি। অনেক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁরা অনুভব করেন যে, সেটাই তাঁদের জীবন তবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। সমস্যা হল যে তুমি বেরিয়ে আসতে চাও না কিন্তু তোমাকে বেরোতে হবে বিলীন হতে হবে। সহজভাবে। এগিয়ে যাওয়া। আবার যখন তুমি ফিরে তাকাবে তোমার ইচ্ছে হবে সেই জীবনটাকে সুপ্ত রাখার, তবু তার রহস্য নিয়ে ভাবতে তোমার ভালো লাগবে। নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগবে: কেন এ-সমস্ত কিছু আমার সঙ্গেই ঘটল? তুমি এসব কিছুকেই একটা আধো বিষাদ মাখা দৃষ্টিতে দেখবে। প্রায় ভিন্ন একটা দৃষ্টিভঙ্গি… যেখানে নিজের বা কারো সঙ্গে প্রবঞ্চনার কিছু নেই। এটা পুরোপুরি পরিষ্কার যে মৃত্যু চেতনার উন্মেষ ছাড়া কোনো কিছুরই মীমাংসা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। রহস্য এখানেই নিহিত।

যুদ্ধ আসলে এক অন্তহীন প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা। মানুষের জীবনের মতোই বাঁধনহীন…

একবার একজন বিমান চালক (একজন মেয়ে) আমার সঙ্গে দেখা করতে চাননি। তিনি ফোনে আমাকে বলেন: “আমি পারছি না… আমি সে-সব আর মনে করতে চাই না। আমি তিন বছর যুদ্ধে কাটিয়েছি এবং সেই তিন বছরে কখনোই নিজেকে মেয়ে মনে হয়নি। আমার শরীরের মৃত্যু হয়েছিল। এমনকী আমি রজঃস্রাবীও হইনি তখন, নারী শরীরের কোনো চাহিদাই কাজ করেনি তখন। আমি তখন সুন্দরী ছিলাম… যখন আমার হবু স্বামী আমাকে বিবাহপ্রস্তাব দেয়… সেটা বার্লিনের রেইস্টাগের ঘটনা। সে বলেছিল: “যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমরা জীবিত আছি। আমরা ভাগ্যবান। চলো এবার আমরা বিয়েটা করি।” আমি কাঁদতে চাইছিলাম। চিৎকার করতে চাইছিলাম। তাকে আঘাত করতে ইচ্ছে হচ্ছিল! বলতে ইচ্ছে করছিল, বিয়ে, মানে কী বলতে চাইছ তুমি? এখন? এই সবকিছুর মাঝে— বিয়ে? এই অন্ধকার সময়ে পোড়ো ইটের মাঝে… আমার দিকে দেখো… দেখো আমি কেমন আছি! আবার আমাকে নারীত্বে ফিরিয়ে নিয়ে এসো এভাবেই শুরু করো: আমাকে ফুল দাও, ভালোবাসা দিয়ে লালন করো, সুন্দর কথা বলো। আমি এখন খুব করে এসবই চাইছি! অপেক্ষা করছি এসবের জন্য! আমি তাকে আঘাত করতেই যাচ্ছিলাম… সত্যি যাচ্ছিলাম। তার একটা গাল পুড়ে গিয়েছিল, বেগুনি হয়ে গিয়েছিল আর: আমি দেখছি সে বুঝতে পারছে সবই, তার ক্ষতবিক্ষত গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছিল। এবং আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আমি তাকে বলছি: “হ্যাঁ, আমি তোমাকে বিয়ে করব।”

“ক্ষমা করো আমাকে… আমি পারব না।”

আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাঁকে, এই ঘটনা হয়তো আমার ভবিষ্যৎ বইয়ের এক-আধ পৃষ্ঠার বিষয় হিসেবে জায়গা করে নেবে।

টেক্সট আর টেক্সট, চারিদিকে বিষয়। শহরের বহুতলে, গ্রামের ছোট্ট বাড়িতে, রাস্তার মাঝে এবং ট্রেনেও… আমি শুনি… আমি নিজেকে শ্রবণযন্ত্রে পরিণত করেছি… সবসময়ই অন্যের বক্তব্য শুনে চলেছি… আমি বয়ানকে “পড়ি”।

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

Leave a Reply