সোনালি ধান : সাগরিকা রাজবংশী

সকালগুলো যখন নরম তুলতুলে রোদ মেখে টিনের চালের ওপর শরীর উল্টে পড়ে থাকে এবং পেটের ভিতর সদ্য জ্বালানো উনুনের আঁচ জ্বলে ওঠে, তখন ধীরে ধীরে পাকস্থলীর সূর্য্যির জ্বলন মাথা অব্দি ঠেকে। সেই সময় ছেঁড়া গেঞ্জি, ন্যাতা শাড়ির শরীর ঢেকে ডালি, ঝাঁটা হাতে কূল অব্দি সাঁতরানো যায়। তীরে উঠলেই ধান। সুনালি ধান। ধানের আবার কুনো জাত আচে? যে চাষ করে, লাঙ্গল বায় তার ধান। যে ডালি হাতে কুড়ায়, তার ধান। ধান কাটা হয়ে যায়। জমিতে পড়ে থাকে খিদা মিটানোর ওষুধ। একটা-একটা করে ধান কুড়ায়ে ডালি নিয়ে সার বেঁধে ঘরে আসে। তার পর ঢেঁকিতে স্বপ্নেরা ভানে। রাত্তিরবেলায় উই ফুটন্ত গরম ভাতে জোনাকিরা বসে। কাঁটা ছিঁড়া উনানের গায়ে লাইগ্যা থাকে বসন্ত। গরম ধুঁয়া উঠা বাষ্পগুলা সীমান্ত ভুইল্যা যায়। কিন্তু চোখে লাইগ্যা থাকে সপন। সপনগুলান ঠিক উই কুয়াশার মতন; না আচে রং, না কাউরে ডরায়। শরীর জুইড়্যা ডুব মারে। আর যে পর্যন্তি না মাতাল হয়্যা উল্টে পড়ে, স্বপন কাউরে ছাড়ান দেয় না। আন্ধার রাইতের অন্ধকার দেকচিস? শরীল দেহা যায় না। স্বপনগুলান ও তাই। শরীল মাথা সব ঢাইক্যা দেয়। আর চোহে, চোহে তো হেই সপন। ঠিক সুনালি ধানের মতন। নরম ঘাসের ডগায় পিঠ ঠেকিয়ে হারানের বাপ তার বাপ দাদাদের কাছে বংশপরম্পরায় শেখা এই একমাত্র গল্পই সেইদিন শোনাচ্ছিল তার ব্যাটাকে। অথচ, কতদিন হল? এক বছর? রাতের আকাশে জ্বলতে থাকা টিমটিম তারা জ্বলছে আর জ্বলছে। আলো এসে পড়ে চোখের কোনায়, খানিক গা এলিয়ে নেয় চোখের নরম বালিশে।

সদ্য সকালের আড়মোড়া ভাঙা রাস্তায় কাটাকুটি খেলার গলি গজিয়ে উঠতে না উঠতেই পৃথিবীগুলো সব ঘেরাটোপে ঢাকা পড়ে। তারই এক গলি বেয়ে কোন একসময় হারানের বাপ লাঙল কাঁধে জমিতে যেত। আধি জমি। চাষ করে দিলে, ঘরে ফসল তুলে দিলে কিছু ধান পাওয়া যায়। যাইহোক না কেন কিছুদিন তো পেটে খাবার জুটবে। তারপর না হয় সেই হাতে কাস্তে নিয়ে আবার জমি জমি ঘুরবে। জমি নিড়ানি দেবে। সেই গোটা দিন মাঠে পড়ে থাকলে কিছু কাজ তো জুটিয়েই নেবে ।

“সূর্য্যিও বড় বাড় বাড়চে, সারাদিন খালি আগুন আর আগুন! শরীল পুড়ায়া দিল! ঘামাচির মদ্যে শরীলটারে খুঁইজ্যা পাওয়াই মুশকিল।”

কয়েকটা ঘামাচি গালতে গালতে জবাব দেয় সুকু। গোগ্রাসে গিলতে থাকা ভাতের দলা তখন গলা বেয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছেছে কি না পৌঁছেছে, আবার ধান কাটা শুরু হল। কাস্তে হাতে জমিতে নামলে যত কাস্তের তেজ বাড়ে, ততই ধারে শরীর চিরে চিরে যায়। তখন তার শরীর দেখলে চলে না।

“শরীল দেখলে কাম হোবো কি? আর কাম না করলে কেউ পুছপোও না। এনে কামের আদর, গতরের না।”

কাজ করতে করতে কথা বলতে হয় সুকুর, না হলে সেই সারাদিন ধরে কাস্তে হাতে আগুনের নীচে কাজ করা কম কথা না। সারা শরীর জুড়ে ঘাম ঝরছে। তারই একটা ফোঁটা মাথায় সৃষ্টি হয়ে কপাল, গাল-চিবুক পেরিয়ে মহাশূন্যে ডুব মারতে না মারতেই দেখতে দেখতে তাকে ঘিরে ধরলো সেই শেষ রাত্রের বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা ফুটো টিনের ফাঁক খুঁজে ভিতরে এলো; সব ভিজিয়ে একসা করে তারপর থামল। পাটকাঠির গায়ের জলের স্রোতের ঝাপটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার মুখ, জল জমছিল বিন্দু বিন্দু। গুটিসুটি মেরে বসেছিল দুইজন, সংসারের দুটো প্রাণী। সারা ঘরটা যেন আসমান হয়ে গেছিল। আকাশে রাত যেন মেঘ মুড়ি দিয়ে উপুড় হয়ে ফোঁপাচ্ছিল।

গোটা গ্রামটাই যেন অসুস্থতার বোঝা মাথায় নুইয়ে পড়েছে। জড়তা গ্রাস করলো। প্রথমে গ্রামের পর গ্রাম, তারপর সারা পৃথিবী। সুকুর নিজের সংসারও বাদ যায় নাই। হারানের বাপ কাজে যাওয়ার দুইমাস হয়েছে কি হয় নাই, এইরকমই নির্বিকার সময়ে সুকুমারী গায়ে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আবার উঠছে। জ্বর আসছে শেষরাত্রে পোড়ামুখী স্বপ্নের মত। ঘুমের অতলে ডিঙি বেয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ডিঙি ফুটো হয়ে জল ঢোকে হু হু করে। তারপর সেই জল চোখ, নাক, মুখ, কান দিয়ে প্রবেশ করে সারা শরীরে কাঁপুনি ধরায়। হারানের কাঁপুনির তরঙ্গ তখন সারাঘরে ছড়িয়ে পড়ে হারানের ঠাকুমা আর তার মায়ের সযত্নে লালিত ঘুমপাড়ানির মাসি পিসি গানে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ঘরের চালের ছইয়ে ঘুণ ধরায়। অতঃপর, খানিকটা বাধ্য হয়েই কাঁপুনির প্রভাব কমাতে হারানের ঠাকুমা তার সদ্য ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে সেলাই করা নতুন কাঁথা হারানের জ্বরের শরীরে চাপিয়ে দেয়। এতে তরঙ্গ খানিকটা বাধা পেয়ে এদিক ওদিক ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরোনোর রাস্তা খুঁজতে থাকে। জ্বরের গন্ধ সারাঘর ভাসিয়ে পাটকাঠির ফাঁক খুঁজে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে সুকুর নাকে আটকে যায়। সুকুর মনে হয় জ্বর যদি স্বপ্ন না হয়ে জোঁক হত, তাহলে সে কবেই হারানের শরীর থেকে টেনে ছাড়িয়ে লবণ দিয়ে মেরে ফেলত। খেত নিড়ানোর সময় জমিতে নামলে জমি মানুষের গন্ধে ম ম করে, সেই গন্ধে পাগল হয়ে জোঁকগুলো কাদার বিছানা ছেড়ে উঠে এসে গরম রক্তের ওম নিতে শরীরে হাতে পায়ে লেপটে যায়। কাস্তের ধারালো মাথায় টেনে ছাড়িয়ে লবণে ডুবিয়ে দিলে জোঁকের বাপ তো বাপ, জোঁকের সাত পুরুষের ক্ষমতা নাই বেঁচে ওঠার। তবে সুকুর সন্দেহ হয়, এই স্বপ্নের সাথে লড়ার ক্ষমতা তার নাই। স্বপ্নের সাথে কি কেউ লড়তে পারে? আর তা ছাড়া এ তো যেমন তেমন স্বপন না! কুণ্ডলী পাকিয়ে শিকারকে কব্জা করে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়। শিকার তা টেরও পায় না। যদিও টের পায়নি কেউই। পোড়ামুখী স্বপন শেষদিন যখন এলো, শিকারকে একমুহূর্তও কাছছাড়া করেনি। ধীরে ধীরে দোলনায় দুলুনি দিয়ে, ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তবে গেল।

“হারানের আর অর বাপের বছরকি এক সাথেই সারবি না?”

আচমকা প্রশ্নে ধাক্কা খেয়ে শব্দগুলো সুকুর মাথার এলোমেলো চুলে বিলি কেটে বেরিয়ে যায়। সেদিনের মত কাজ শেষ। সূর্য্যি বিছানায় গড়াতে গড়াতে শেষ সোনালি লাল আভার কয়েকটা কুচি ছুঁড়ে দিল।

“হারানের আর অর বাপের বছরকি এক সাথেই সারবি না?”

দ্বিতীয় প্রশ্ন পালাবার জায়গা না পেয়ে জাঁকিয়ে বসে সুকুর মাথা-বুক আচ্ছন্ন করতে থাকে।

“হ, কয়েকদিন আগে পরে তাই এক সাথেই সারুম ।”

খানিক কথার তোড়েই হোক, বা পায়ের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে শব্দগুলোর টুকরো টাকরা চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে। হাবুডুবু খায়। ফিরতি পথে আঁধার নামছে। ধীরে ধীরে চৌকি থেকে ক্লান্ত শরীরখানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে কুয়াশা পাতলা মশারি টাঙিয়ে দেয় যত্র তত্র। ন্যাড়া শিমুলগাছটার নীচে, ভাটিগাছের গায়ে সার বেঁধে শুয়ে পড়েছে। ঘুম। সরষে খেত একমনে আত্মভূত করতে থাকে কুয়াশার ক্ষীণ শরীর। তার মধ্যে সদ্য জন্মানো কুয়াশা শিশু ঝাঁপিয়ে পড়ে; মিশে যায় সরষে শরীরে। জোনাকির দল মশারির ভেতর ফাঁকা অংশ জুড়ে আলোর পসরা সাজিয়ে বসতে না বসতেই তিরতির করে কাঁপে সদ্য শৈশব পেরোনো সরষে গাছ। সুকু দাঁড়িয়ে পড়ে কুয়াশা মাখা ন্যাড়া গাছটার মত। শরীর জুড়ে কুয়াশা নামতে থাকে। প্রথমে পায়ের পাতা, তারপর গোড়ালি হয়ে বুক, চিবুক পেরিয়ে নাক-মুখ বেয়ে জমা হতে থাকে পেটের ভেতর। সেখান থেকে শিরা, উপশিরা বেয়ে পৌঁছে যায় প্রত্যেকটি কোষে। জিভে ভিজে কুয়াশার চনমনে স্বাদ পায় সুকু। রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুয়াশার শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যস্ততা শুরু হয়। ততক্ষণে আকাশের বুক চিরে কয়েকটা তারা উঁকি দিতে শুরু করেছে। যেন সর্বশক্তি দিয়ে মশারির ভেতরটা একবার দেখে নিতে চায়। সূক্ষ্ম জাল আরও গাঢ় হবার আগে আলোর ঢেউ সাজিয়ে খানিকটা অন্ধকার ঠেলে বের করে দেয়। খানিকটা ছিটকে বেরিয়ে চোখে মুখে ঝাপটা মারে। তারপর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে অপেক্ষাকৃত কম গাঢ় জালে ডুব মারে। সুকুও তাকায় তারাগুলোর দিকে। প্রাণপণ শক্তিতে শুষতে থাকে শেষ আলোকবিন্দু। প্রাগৈতিহাসিক উত্তেজনায়, শিহরণে তার সর্বাঙ্গ কাঁপে। তারপর অন্ধকার ঠেলে হাঁটতে থাকে। তারার আবছা আলোয় এবার ঠিক পথ ঠাহর করতে পারবে।

Facebook Comments

Leave a Reply