হেমন্তের বর্ণমালা : কৌশিক চক্রবর্তী
হেমন্ত কোথায় থাকে?
একলায়…
ওই যে যেখানে চাবির দুঃখগুলো একা একাই দোলনায়। একটা লোক জানত এই একলা ধূসর সন্ধ্যায় বড় রাস্তার মোড়ে ছাতিম গাছের তলায় টুক করে এসে বসে সন্ধের ট্রাম। তার কামরায় বিষণ্ণতা বসে থাকে। এই হাল্কা কুয়াশা ঘেরা গন্ধ নিয়ে সে ফেরি করে টিমটিমে হলদে বাল্বের কুয়োতলায়। অনেক চুপিচুপি বাক্সরা এই শিরশিরে গানে ভিড় করে আসে। অথচ কেমন ছায়ামায়। দেখা যায় না সহজে সেই নীরবতার স্বরলিপি। আমাদের ব্যক্তিগত পাহাড়েরা কোনো একদিন তাদের নাম জানত। কাচশহরের সবকটা জলপাই বারান্দায় আজ বিজয়া দশমীর পরও কেমন ফুল ছোপানো আলো।
ওই যে যখন দেখা যায়, মনোক্রোমের লজেন্সওয়ালা নিজের ভাষা হারানোর মাঠে একা একাই ভিজছে, তখন হেমন্ত আসে। তুমি জানো? ছুটি আঁকা রুমালে রাত রেখেছিলে বলে শরীরের ডাকনামগুলো আজ জাফরানি। বহুদিন জল লিখিনি। শীত করে। গল্প বলা মেঘেরা স্নান বলতেই কেমন খোলামেলা লাগে আজকাল। কাঁচা এলাচের শাড়ি পরে সেই ফাঁকে পাখিরা কেমন দেখি বড় হয়ে যায়।
আহা, হেমন্তকাল। কতদিন পর তোমার ভিড় জমা ধুলোর চিবুক। ধার নিচ্ছি। সাদা সাদা চৌকাঠ বাজাচ্ছ চটির নকশায়। থেকে থেকে মুখ বাড়ায় গন্ধলেবুর নৌকো। কী একটা গান মনে পড়ছে, নাম হারানো? আচ্ছা, এই ভোরবেলা যখন সাদা হয়ে থাকা ট্রামলাইনের ধারে ধোঁয়া ওঠে, তুমিও কি চা খাও? নোনতা বিস্কুট? আদরের নৌকো ভেসে যায়? নাম ভুলে গেলে গানের অ্যাভিনিউ দিয়ে বড়ি ফেরো তখন?
পাখিলাগা বাটিকের গায়ে সেই কখন থেকে গানের পাপড়িরা শুকোচ্ছে। লালনীলের আলুথালু পেরিয়ে গড়িয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট। অনেকগুলো অচেনা প্রচুর পেরোলে সেখানে ভুল বাক্যের বাড়ি খুঁজে পাই। এলোমেলো কথা বলতে কী ভালো লাগে আজকাল। তোমার ধূসর দিয়ে বিষাদ দিয়ে কথা বলি। নিজেই শোনে আমার আয়না। কথা রাখা চোখের এই ছেড়ে আসার কোনো রোজনামচা নেই। আদরে আদরে তারা বর্ণমালা ভুলে গেলে – আয়নায় তখন নেমে আসে ঘুমের উল্টোপিঠের গল্প…
চলো দিলদার চলো। ঝমঝম হলে বারবার তোমার নাম লেখা পাতাদের মানচিত্র ভাসে। কে জানে, আজকাল কেন পত্রমর্মর বললে : নোনতা নোনতা কোনো জন্মরাতের কথা মনে হয়…
হেমন্ত কোথায় থাকে?
জীবনানন্দে…
ওই যে যেখানে দরদালানের ভিড়। ওই যে যেখানে পৃথিবীর শেষে শুয়ে থাকে শব্দহীন… ভাঙা… যেখানে আমাদের চুপিচুপি বিষন্নতার জামা পরে হরতুকি গাছের পিছনে হেমন্তের বিকেলের সূর্য চুপে চুপে ডুবে যায়— জ্যোৎস্নায়।
আর তিনি দেখতে পান পিপুলের গাছে বসে পেঁচা… সেই প্রগাঢ় পিতামহী… হয়ত ধরবেন দু-একটা ইঁদুর এবার… একা… চেয়ে দেখেন সোনার বলের মতো সূর্য আর রূপোর ডিবের মতন চাঁদের বিখ্যাত মুখ-দেখা।
নিস্তব্ধতা… বাদামী পাতার গন্ধ… মধুকুপী ঘাস… আহ কী শরীরী। শশী মাস্টার তবু কেন শুধু মনের বর্ণমালা লেখে। শরীর জাগে। জেগে ওঠে। তীব্র। আর সেই নারী… যেন ঈশ্বরীর মতন… তার পুরুষ: নবীন; জেগে ওঠে স্বপ্ন-কামনায়। জেগে উঠে পুড়ে পুড়ে যায়। খোঁপার ভিতরে পুরুষের গোপন জল ম্লান হয়। ডুবে যায় বৃষ্টির ভেতরে। ডুবে গিয়ে জন্ম হয় আবার। যেন কোনো শব্দ নেই; যেন শুধু মহাজাগতিক এক স্বরলিপি।
আর তারা টের পায় ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে… কোথাও কোথাও যেন সংকেতে গান … সারা রাত্রি জুড়ে গান ক্রমে কাছে টানে তাদের… এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে ওই চূর্ণ বাতাসে।
এ হেমন্তকাল বার বার ধরে নিয়ে যায় বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে। সেই ঘন রাত্রি। গান হয়। সংকেতে তারা জানে বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন শেষ হয়ে গেলে অদৃশ্য রঙে ভরে ওঠে অতল…
এই হেমন্তকাল। ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার মুখে এক মনকেমন লেখা নিস্তব্ধতা… সন্ধের আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে জলে; দুজনের জীবনের অনেক ব্যাপ্তি যেন লেগে আছে ফিরে আসা পাখিদের বহতা পাখায়; নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতন নীরবতা ছড়িয়ে রয়েছে … এই প্রান্তরে … হেঁটে চলি… আজ কোনো কথা হয় না আমাদের; সারা রাত বৃষ্টি পড়ে গান্ধারে নিষাদে
হেমন্ত কোথায় থাকে?
কল্পনায়…
সোনাঝুরির মাঠ… পাতা ঝরে… ঝরে যায়… কে একজন কেবল একজন হয়ে হেঁটে যায়… আরেকজনের পিছু পিছু… রোদের ইশারা আস্তে আস্তে নিবে আসে যেন… পাতা খসে পড়ার শব্দ… পাতার স্তুপের ওপর দুজনের পায়ে চলার শব্দ… পথ বেঁধে দেয় বন্ধনহীন গ্রন্থি… তারা দুজন হয়ে যায়… দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী… কোথায় যেন একতারার ভিজে ভিজে টুং… কিছুদিন মনে মনে শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে… পাতার দাদরায় তারা হাঁটে… আর হারানো সে আলো আসন বিছিয়ে যায় দুজনের চোখে… হাঁটতে হাঁটতে খোয়াইয়ের ধার… আলো পড়ে আসে তাদের করতলে… তারা দুজনে সেই আলো ছুঁয়ে দেখে… খোয়াইয়ের তীর… দুজনের ঘোর লাগা মায়া লাগা চোখ… কিছু বলতে হয় কি এসময়ে? কোনো কথা না বললেও কি বোঝা যায় না সবটুকু… সন্ধে হয় হয়… একজনের করুণ মুখ হেলান দেয় অন্য সেই একজনের কাঁধে… তারা গোধূলি স্পর্শ করে… আর কি কখনও কবে এমন সন্ধ্যা হবে… তারা গান হয়… হেমন্ত হয়… তারা দুজন একাকার হয়…
হেমন্ত কোথায় থাকে?
এই কলকাতায়…
কী অদ্ভুত এই সার্কাস এরিনা। প্রতিদিন খেলতে খেলতে গা বাঁচিয়ে চলতে চলতে এই অদ্ভুত বেঁচে থাকা। এখানে রাত্তির বেলা চাঁদ ওঠে, ফুলও ফোটে, হয়তো কদম তলাতেও কেউ কেউ গিয়ে দাঁড়ায়। সেইসব কোন কোন রাত্তিরে পাড়ার চায়ের দোকানের ভাঙা টিন শেড অথবা সাজানো বসবার ঘরে নরম সোফা সেটের আদরে ফুলদানির বাসি গন্ধ ভেসে আসে। অন্ধকার পাতাল বা আলোকিত সিনট্যাক্স থেকে সেইসব আলতো ছোঁয়াছুয়ি খেলা এসে চারপাশ ঢেকে দেয়। মায়াসিম্ফনির স্টাফ নোটেশনের তালে তালে কর্ডসের পায়ে পা দিয়ে আলো ঝলমলে এই তাঁবু জুড়ে তখন চলতে থাকে বিপজ্জনক ট্র্যাপিজ… উৎসাহী দর্শকদের ছুঁড়ে দেওয়া আট খানা আর অচল পাঁচ পয়সা কুড়িয়ে নেয় সময় নামক এক রিংমাষ্টার আর তার গলিঘুঁজি।
এ শহরে হেমন্তের আশ্চর্য দুপুরবেলায় কী অদ্ভুত গন্ধ… বিকেলের মুখে কী মায়াময় আলো চুইয়ে নামে আকাশের বারান্দা বেয়ে লেকের গায়ের মধ্যে দিয়ে। চারদিকে শুধু ভিজে দুপুরের গন্ধ … কোথায় সময় হারিয়ে যায় কোথায় সে তার লুডোছক এঁকে রেখে যায়… ঘাসের মধ্যে যে এক টুকরো বীজ…আর এই নক্ষত্র মালার সাংকেতিক ভাষা… এই অ্যাপোক্যালিপস তার গ্যালারির এক কোণে একখণ্ড বেঁচে থাকা…
কেউ কাউকে দেখতে পাইনা। কেবল আন্দাজে ভর করে ভেবে নিতে হয় ভরকেন্দ্রগুলির স্থানাঙ্ক। লোডশেডিং এর শরীর চিরে একা একা রাস্তায় হাঁটবার মতন অবকাশ….যখন নিয়ন বোর্ড গুলো থেকে ছিটকে আসে ব্যর্থ দেশলাই… যখন একপাশে আধা ঝাপসা গড়ের মাঠ আর অন্যদিক জানলার নিচ থেকে সরে যাওয়া হলদে আলোর চলমানতা…তার প্রক্ষেপণ, তার অচেতনতা, তার আপাত কেয়স থেকে চলকে পড়া পাতাবাহারের জঙ্গল, একে একে দৃশ্যপটগুলোকে ক্যামেরা বন্দি করে যেমন সময় সরে যায়, এক পার্কের বেঞ্চি থেকে অন্য কোথাও এক ছাদের চিলে কোঠা থেকে অন্য লেটার বক্স এক সাদা পৃষ্ঠা থেকে অন্য পোস্টকার্ড… যেমন করে মিশে যায় শরীর আর হলদে পাতা…যেমন করে চাঁদের আলোয় বিমর্ষ তাঁবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে লাফ দেয় বুড়ো রিং-মাস্টার।
সদর দরজা খোলার আওয়াজ হলে ছড়িয়ে পড়ে সারা পাড়ায়। এই সময়টায় কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে বাড়ির দেওয়ালে রেন পাইপের লোহায় ফুটপাথের সিমেন্টে ম্যানহোলের ঢাকনায় বাজারের আস্তাকুঁড়ে রিকশাওয়ালার তৃপ্ত ঢেঁকুরে অনাহারী কুকুরের কবরদর্শনের ঘুম নামে। তীব্র এক ঘুম। তার চোখালো তেষ্টা শুষে নেয় পরাগমুখর রাত্রি। নির্জীব করে দেয়। টি ভি খুললে সারাদিনের ক্লান্তিকর পল-অনুপল যাপনের পর রঙিন আলোকবিন্দুবর্গ, তাদের হুরীপরী আর বাসস্টপ আর ক্যাসুরিনা আর ছায়াপথ আর শেষপর্ব… সবটুকু নিয়ে কোটরে গিয়ে ঢোকে। আবার কখনো কখনো অভ্যাসবশত কী অসম্ভব দ্রুততায় সরে যেতে থাকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। মনে হয় কি কোন সার্কাস এরিনার কথা? যার বালির ওপর তখনও দুর্দান্ত ট্র্যাপিজ হুজ্জোত…তার হাসির সঙ্গে মিশে যায় আমাদের তুমুল হাততালি।
তার আত্মজীবনীর ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো ভারী করে রাখে দেবদারুতলা।
সাদাকালো পৃথিবীতে… দু চোখ বন্ধ হয়ে আসে… সামনে সময়ের আলসেমিতে সেলুলয়েডের উষ্ণতা থেকে বিজ্ঞাপিত হতে থাকে কাচের বাক্সের ভেতরে রাখা শূণ্যতার ছাদে বসে থাকা এক
অন্তহীন
অন্তরীণ
ব্যক্তিগত নিঃশব্দের কাহিনিচিত্র
হেমন্ত কোথায় থাকে?
গানের ওপারে…
কেন যে মনে পড়ে অশথের ছায়ে মাঠের প্রান্তে দূরে… রাখালি বাঁশির বেজে বেজে ওঠা সুরে… একটা গানের স্বরলিপি লেখা… একটা কন্ঠস্বর… যার সামনে নতজানু হয়ে থাকা যায় সারাটা জীবন। পরাগ ঝরানো স্বপ্ন ভরানো বনে… ঝরা পাতাদের মর্মরধ্বনি মাঝে… সেই গান অদ্ভুত এক বিষন্নতায় আচ্ছন্ন করে। একটা নেশার মতন। একটা বাড়িতে সেই সুর ঘুরে ঘুরে যায়।
সে বাড়িতে বারান্দা নেই, ছাদ নেই, থাকার মধ্যে ওই এক জানলা। এতকাল ঘরটার একটা জানলার পিছন দিকে দুটো বড় বড় বাড়ির ফাঁকে একটা একতলা বাড়ি ছিল। আর একটা নিমগাছ। তার ওপর দিয়ে একটুকরো আকাশ দেখা যেত।
একতলা বাড়ি আর গাছ? এই কলকাতায়? কী করে যে তারা থাকতে পেরেছিল এতটাকাল, সেটাই তো আশ্চর্যের!
মনে পড়ে, দু বছর আগে, এই হেমন্তকালেই একদিন দুপুরে ছোট্ট রেডিওটায় বাজছিল – “আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী…” মেঘ আর রোদ্দুর এসে পিছনের সেই পুরোনো খোলা জমিটার এক কোণে ঘাড় কাত করে দাঁড়ানো সেই বোকাসোকা নিমগাছটার পাতায় খুনসুটি করছিল। আর ঠিক সেই সময়টাতেই দেবব্রত বিশ্বাস কেন যে গেয়ে উঠলেন – “রৌদ্র মাখানো অলস বেলায়, তরু মর্মরে ছায়ার খেলায়, কী মুরতি তব নীল আকাশে, নয়নে উঠে গো আভাসি… ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর…” আর আরও একবার, সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল।
এ বছর কয়েকদিন আগেই টের পাওয়া গেল, সেই ফাঁকা আল্সে জায়গাটায় একটা বিশ্রি চারতলা বাড়ি উঠে আকাশটাকে পুরোপুরি গিলে নিয়েছে। নিমগাছটাও ঢাকা পড়েছে। কে জানে, হয়ত সে নেই-ই। এই হেমন্তকাল আর সেই রোদ্দুর আর সেই দুপুরবেলা আর ওই গান … দেখা থেকে স্মৃতিতে, স্পর্শ থেকে অনুভবের দিকে চলে গেল কী সহজেই।
এ বাড়িটায় সুর ভাসে। আজও। শুধু আর ওই একচিলতে আকাশ দেখা যায় না…
হেমন্ত এইখানেই তো থাকে… এই গানে… এই সব হারানোয়… এই বিষাদে…
ঠিক রাস্তা পেরোনোর মুখে ভেসে আসে… একটা আগে না শোনা গান… ও বিষাদ বারবার হাতে হাত রাখো… ভয় নেই হারাবার যদি পাশে থাকো… আমি যদি ভিড় হয়ে যাই…
আর ঠিক তখনই সন্ধে নামে এই শহরের হেমন্তে…
Posted in: November 2021 - Cover Story, PROSE