হেমন্ত কোথায় থাকে? – দেবাদৃতা বসু
বছরের এই সময় বিশেষ করে, উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার পথে বদলে যেতে থাকে গন্ধ, শব্দ, সময়। ফেলে আসাগুলোও এতটাই তীব্র মনে হয় যে গুলিয়ে যেতে থাকে আগে পরের ঘটনা আবার কোথাও সবকিছু এতই স্থবির, ভ্রম হয়, কিছুই যেন বদলায়নি।
১
দুপুরের টেবিলে গল্প শেষ করে উঠতে উঠতে হাতে শুকিয়ে যাওয়া খাবার; কলতলায় জল ঢেলে, কচলে ধুতে থাকে গৌরী। চামড়ায় টান ধরছে এখনই। চট করে একটু গড়িয়ে নিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সময় নেই। আজকাল খুব ঝপ করে সন্ধে নামছে । মেয়েটাকে দোতলায় সিঁড়ির ধারে শুইয়ে রেখেছিল। একবার উঁকি মেরে দেখে নেয় চুল বাঁধতে বাঁধতে। এ বাড়ি এলেই পাড়া বেড়ানোর ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে ওঠে। আজকাল আসা মানে ছুটির এই কটা দিন। সামান্য প্রসাধন সেরে নিচে নেমে উঠোন পার হয়ে দরজা খোলে গৌরী। গলি ধরে এগিয়েই বড় রাস্তা । বাঙাল গলি বলে সবাই। কবেকার সব বাড়ি। অধিকাংশই ঝরঝরে।তাদের সংসারের চামড়াতেও টান ধরতে ধরতে তৈরি হয়েছে বড় বড় ফাটল। সেই ফাটলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে কিছু মেস বাড়ি। রোদ হাওয়া ঢোকা বারণ যেখানে। এক বাড়ির দেওয়ালে জানলা কাটতে গেলে পাশের বাড়ির রান্নাঘর বেরিয়ে পরবে এমনই গা ঘেঁষাঘেঁষি । অথচ সেই কবেকার উষ্ণতার কিছুই অবশিষ্ট নেই । শীত জাঁকিয়ে এলো বলে। সারাদিনে একবারই পাড়া পাড়া লাগে যখন সন্ধেবেলা এক সাথে শাঁখ বাজে কয়েকটা বাড়িতে। এছাড়া কোথাও কোনও উত্তেজনা নেই, গৌরী বাপের বাড়ি এলেও নয়।
গলি দিয়ে বড় রাস্তায় নামলেই লেডিস টেলার্স। এই তো পুজোর আগেই বানানো ব্লাউজ; আঁট হচ্ছে গায়ে। দোকানদার মেয়েটার আলুভাতের মত মুখ। ধূপধুনো দেওয়া শেষ করে তবেই বিল কেটে দিল। অতক্ষণ কি আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে গৌরী। উঁকি মেরে ঠিক দেখে নিয়েছে পাশের দোকানে গরম তেলে কচুরি ছাড়া হয়ে গেছে। পাঁচ ফোড়নের গন্ধ। কিছুক্ষণ আগেই ভাত খেয়েছিল না? দেখে কে বলবে। শালপাতা হাতে দাঁড়িয়ে পরেছে। গরম কচুরি মুখের মধ্যে এপাশ ওপাশ করতে করতে মন্দিরের ঘণ্টা কানে যেতেই মনে পরল, এই যাহ, পুজোর ফুল পাতা কেনার আগেই হাত এঁটো হয়ে গেল। যাইহোক কেউ তো আর দেখেনি। জল দিয়ে ধুয়ে যতটা তেল গেল গেল, বাকিটা শাড়ির আঁচলে। ফেরার সময় ফুল কিনবে না হয়। এখন একটু হাঁটবে। ইচ্ছা ছিল কলেজ পাড়া অবধি হেঁটে আসবে ট্রাম রাস্তা ধরে। ছাতিমের খুব গন্ধ। কিন্তু সে সময় আর নেই।
দেশবন্ধু পার্কে বসে বসে গৌরির মনে হয় কোনও স্লো মোশন বায়স্কোপের মধ্যে ঢুকে পরেছে । ফ্ল্যাশব্যাকে একটা দৃশ্য। এই পার্কেই, অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে খুঁজে অল্প ঘাস পাওয়া গেছে একদিকে। দুজনে বসেছে । গল্প করতে করতে খেয়ালই করেনি সন্ধে নামার সাথে সাথে কিট পতঙ্গ বেয়ে উঠে আসছে ঘাসের গা বেয়ে। চমকে উঠে শাড়ী তুলে লাফালাফি করতেই ফড়িঙের মত কি একটা মাটিতে পড়ল ছিটকে। আর এখানে নয়। চলো বাবা এবার বাড়ি যাই। ডাকাত পিসির মেয়ে কিন্তু সব দেখেছে দূর থেকে। পার্কের কাছেই তো ওদের বাড়ি। ফেরার পথ একটু দেরি করে ফেলেছিল গৌরী। হাটার গতি কমে গিয়েছিল চারপাশে সমস্ত কিছুর সাথে তাল মিলিয়ে। ততক্ষণে বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে। বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে প্রশ্ন, ‘ছেলেটা কে? ব্রাহ্মণ তো নয়?” । সন্ধে হয়ে গেছে। উঠে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে গৌরী।
ইস্কুল, কলেজের আগে অবধি মধ্য কলকাতার ওপারে যায়নি কখনো। প্রথম যেদিন ওদের বাড়ি যায়, দুদিকে খোলা উঠোন দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। নিজের বাড়ির পাশেও ছেলেদের ইস্কুলের মাঠ আছে একটা, কিন্তু এই উঠোন তো পুরো বাড়ির মধ্যে। আবার কুল গাছও। পাশের বস্তি থেকে রূপচাঁদ লালার বউও এসেছিল তাকে দেখতে সেদিন। পরে তো খুব বন্ধুত্ব । গ্রাম থেকে ছেলের বিয়ে দিয়ে ফিরল যেদিন, বরণ করা, প্রণামী সমস্ত কিছুই গৌরির হাতে। আবার সেই ছেলেই যখন বন্ধ ঘরে গায়ে আগুন দিয়ে থাকতে না পেরে ছটফট করে রাস্তায় বেরিয়ে এলো আর দপ করে জ্বলে উঠল, লালার বউ এর রোজকার বুক ঠুকে কান্নার সময়ও পাশে।
শাঁখের আওয়াজ শুনতে শুনতে যখন গলি দিয়ে ঢুকছে তখন খেয়াল হল পুজোর ফুল কিনতে ভুলে গেছে। আর ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না। মেয়েটার জন্য একটা সোয়েটার বুনছে, সেটা নিয়ে বসবে এখন। বাবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সখ করে খাসির মাংস এনেছে। তাও রাঁধতে হবে। সময় কই। ও বাড়ি হলে পেছনের দরজা খুললেই বাজার। রাস্তায় নামতেও হয়না। সব কিছু বাড়ির সামনে এসে দিয়ে যায় ওরা বৌদি বৌদি করে। এবাড়ির সাথে কোনও মিল নেই। এমনকি রান্নাঘরে না আছে একটা কল, না আছে ওই হলুদ আলো। শুধু ওই পেছনের দরজা খুলে বাজারের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে এরকম ভেজা ভেজা শেওলা ধরা গন্ধ, তাও বেশিক্ষণ না। মাছ, সবজি, মন্দিরের পচে যাওয়া ফুল আর মিল্ক পাওডারের গন্ধ সব ঢেকে দিয়ে যায়।
২
দেখো কাণ্ড, মেয়েটাকে সিঁড়ির ধার দিয়ে শুইয়ে রেখেছে, আর ঘুমের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে সে মেয়ে নিচের ধাপে গিয়ে শুয়ে আছে। কি অলুক্ষুনে ঘুম রে বাবা মেয়ের। দিদিভাই, ওঠো, দিদিভাই, ওঠো। ট্রাম দেখতে যাবে না? জর্দা শেষ। আজ না আনলেই নয়। তুলসী নাতনিকে তুলে, নিজে সেজে গুজে, শেষ পানটা মুখে পুরে বেরিয়ে পরে। চট করে ঘুরে না এলে আর মন্দিরে বসার সময় হবে না। দুপুরের রান্নাই তোলা আছে রাতের জন্য। এ বাড়িতে ফ্রিজ নেই। তবে এই সময় চট করে নষ্ট হবার ভয় নেই বাটি গরম করে তাতে তরকারি তুলে রাখলে। ফেরার পথে রুটি কিনে আনবে অনাদির দোকান থেকে না হয়।
গলির মুখ অবধি হাঁটতেই চায় না মেয়েটা। বাবার আদরে এমন দুষ্টু হয়েছে। এই বয়সে এত বড় মেয়েকে কি কোলে নেওয়া যায়। জানো তো দিদিভাই, তোমার মামার বিয়ের সময়, তোমার মা ওই গলির মুখ থেকে শাঁখ বাজাতে বাজাতে ঘরে ঢুকেছিল। আর এই বাড়িগুলো থেকে সবাই উঁকি মেরে দেখছিল। তোমার মা এবাড়ি এলেই পাড়াটা জমে উঠত, জানো তো। মেয়ে কি বোঝে কে জানে। বায়না সে আর করে না। বড় ঝামেলা এই মেয়েকে নিয়ে। তার ওপর এই বিকেল পর্যন্ত ঘুমোল। এই সময় দুপুরে বেশি ঘুমলেই গা ম্যাজম্যাজ করে, শরীরটা ভারি লাগে। না নিয়ে বেরোলেই নয়। বাড়িতে একা থাকলে দাদুকে বিরক্ত করবে। সে খোঁড়া মানুষও আর পেরে ওঠে না। আর এখানে তো বন্ধুবান্ধবও নেই। তাও এই ছুটিটার সময় ওর বাবা ওকে রেখে দিয়ে যায়। বাড়ি থাকলেই চুপি চুপি বেরিয়ে গিয়ে বস্তির বাচ্চাগুলোর সাথে গুলি খেলবে। তবে বলিহারি বাবা। একটু বুদ্ধি থাকতে নেই। সন্ধে বেলা বাসে করে মেয়েটাকে নিয়ে এলি। একটা গরম জামা নেই গায়ে। নিজের ছেলে এমন অন্যায় কাজ করলে ছেড়ে কথা বলত না তুলসী।
নাতনিকে নিয়ে তুলসী ট্রাম থেকে নামে হেদুয়ার সামনে। উল্টোদিকে বিপিনের জর্দার দোকান। কিনে নিয়ে আবার বসবে জলের ধারে। সাঁতার এখন বন্ধ। কলেজের কিছু ছেলেমেয়ে বসে বসে গল্প করছে। তুলসী তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের মেয়েটাও তো এই বেথুনেই পড়ত। তুলসীর খুব ইচ্ছা ছিল ডাক্তারি পড়ুক। যা মেয়ে, ভর্তির লাইন থেকে পালিয়ে গেলো। নাকি মানুষ কাটতে হবে। সেই ভয়ে। উঠতে হবে এবার। গাছের নিচে ঝরা পাতার স্তূপ। তাই নিয়ে খেলছে মেয়েটা। কি করছ দিদিভাই? কুঁড়েঘর বানাচ্ছি। যতবার বানায়, ততবার ভাঙে , তবু মেয়ের কোনো ক্লান্তি নেই।
ফেরার পথে অনাদির দোকানে ভিড়। এক মানুষ সমান একটা উঁচু জায়গায় বসে অনাদি রুটি করে। নিচের খোপে পাশের দোকানের ছাগল বাঁধা। তুলসীকে দেখতে পেয়ে অনাদি হাত চালায় তাড়াতাড়ি। অত নিচ থেকে মেয়েটা বুঝতে পারছে না এতগুলো ছাগলের সামনে তারা কেন দাঁড়িয়ে। পায়ে ভর দিয়ে দেখার চেষ্টা করেও কিছু বোঝে না। ও দিদা, এটা কিসের দোকান। রুটির দোকান দিদিভাই। ফ্রুটির দোকান? কিচ্ছুক্ষণের জন্য চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও আবার ঝিমিয়ে পরে । তুলসী ওর হাত ধরে নিয়ে যায় গোবিন্দ জিউ মন্দিরে। এখানে কিছুক্ষণ বুড়িদের আড্ডা আর মেয়েটা এখন গড়াগড়ি খাবে চাতালে। তবে আজ বেশিক্ষণ না। তাড়াতাড়ি না শুয়ে পরলে সকালে কাজ সেরে বেড়তে দেরি হবে। কাল মেয়েকে বাড়ি দিয়ে আসতে যাবে তুলসী।
প্রথম প্রথম অসুবিধা হত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। খালি ভোগে মেয়েটা। ঠাণ্ডা লাগে, জ্বর বাঁধায়, সেই ছোট্ট থেকে। আর তুলসী তখন বাড়ি বসে থাকতে পারে না। ছুটে যায় নাতনির কাছে, আপেলটা নিয়ে, মোসাম্বিটা নিয়ে। দুধ, দই তো মুখে তুলবে না সে মেয়ে। চিরদিনই দুধে অরুচি। মায়ের দুধ না খেয়েই তো এরম শরীরের অবস্থা। যাওয়ার সময় দাদু একটা করে গল্পের বই হাতে ধরিয়ে দেয় প্রতিবার। এখনও বাংলা পড়তে শেখেনি। কনভেন্ট স্কুল। সবে মাত্র অক্ষরজ্ঞান হচ্ছে। তাও দাদু দেবেই। তুলসীর ইচ্ছা কাল বেরিয়ে বাজার করে নিয়ে যাবে। এই সময় ভালো কাঁকড়া পাওয়া যাবে সকাল সকাল বাজারে গেলে। কিন্তু যা কেনাকাটা সব এ পাড়া থেকে করে নিয়েই বাসে উঠবে। ওই বাড়ির গায়েই লাগানো বাজার। তুলসী যায় না সেখানে।
এমনিতে জমজমাট পাড়া। একদিকে বস্তি। অন্যদিকে বাজার। বাড়ির গায়ে লাগানো মন্দির। সেদিন সন্ধেবেলা জিয়ল মাছ আর রঙিন সবজিতে বাজার ভরে থাকার কথা। অথচ মাছ কাটা হচ্ছে না, সবজির ঝুড়িগুলো বস্তাচাপা । চারদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। মন্দিরে সেদিন ধূপ ধুনো দিতেও ভুলে গেছিল কেউ। রাস্তার দুধারে লোক । চুপ করে। গোটা পারা স্থবির। বাড়ির ভেতরও ভিড়। নতুন খাট এসেছে, নতুন শাড়ি, ফুলের মালা। সবাই মিলে তুলসীর মেয়েকে তখন শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন।
৩
বহুদিন মামাবাড়ি যাওয়া হয় না। পুজোর ঠিক পর পর হালকা উত্তরের হাওয়া দিতে শুরু করলেই মামাবাড়ি যেতে ইচ্ছা হয়। ইচ্ছা ঠিক নয়, একটা নস্টালজিয়া যেন পেয়ে বসে। কেমন একটা মিস করা, যা নেই তার জন্য একটা খোঁজ, একটা মন কেমন। একবার গেলে শুধুই মনখারাপ। আগের মত তো নয়। দিদা যতদিন ছিল, ততদিন একতলার ঘরে দুপুরে ভাত খেয়ে আড্ডা দিতেই বিকেল, সন্ধেবেলা জর্দার নেশা ধরানো গন্ধ, আর হলুদ আলোর বড় বড় ছায়ার বিষণ্ণতা। দিদার কাছে খুব বায়না করে হাত পাতলে চমন বাহার পাওয়া যেত। একবার তো আট মাসের ঘুমন্ত ভাই এর হাঁ করে মুখে চমন বাহার দিয়ে দিয়েছিল গৌরির মেয়ে। এখন বাড়ি বদলে গেছে। হলুদ আলোর বদলে সাদা, মেঝেতে টাইলস। গোটা বাড়ি খুঁজলেও পাওয়া যাবে না সে পানের বাটা।
দুপুরবেলার পর থেকে পার্ক স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের গলিতে আর রোদ ঢোকে না। শুধু বড় বড় ছায়া কেমন জ্যান্ত। হাঁটতে শুরু করলে অদ্ভুত শিরশির করে শরীর। দু পাশের বাড়িগুলো এত গল্পের ভারে যেন ঝুঁকে পরেছে। সবাই বৃদ্ধ। শীত পড়লে বাবার সাথে ঘোরা হবে এরম সব বাড়ি। দরজা দিয়ে ঢুকেই মাকড়সার জালের মত দেওয়াল জোড়া লেটারবক্স । পারসি, সিন্ধি, মারোয়াড়ী, ফরাসি সমস্ত নামের লেটার বক্স। কিছু হয়ত পুরোপুরি বন্ধ। আর খোলা হবে না কোনদিন। তাও জেদ। দেওয়াল আঁকড়ে ধরে অজানা সব গল্পের সাক্ষী হয়ে ঝুলে রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে লম্বা টানা বারান্দার গায়ে অফিস। জিমি আঙ্কেলের। এর ওপরের তলায় লোকজন থাকে। ছোট ছোট ঘরে। সবার কমন স্পেস। অনেক উঁচুতে ঝোলানো কেচে রাখা জামাকাপড়। কে যে ওই উঁচু দড়িতে হাত পায় কে জানে। দড়িতে ঝোলানো জামাকাপড়ের মত ফেড হয়ে আসছে আকাশের রঙ। এসব বাড়িতে যে এত লোক থাকে, কিন্তু বাইরে থেকে তাদের আওয়াজ নেই । সময়ের মতই যেন সবাই নিস্তেজ হয়ে ঘড়িতে ক্রমাগত দম দিচ্ছে। শুধু হকারের চিৎকার আর দূর থেকে আসা হর্ন শোনা যায়।
নিন্দুকেরা বলে সাউথ কোলকাতায় নাকি গাছ নেই। খুব ইচ্ছা করে তাদের একবার এই সব রাস্তা ধরে হাঁটায়। এত গাছ ফুটপাথের ওপর, সমস্ত লাল বাড়িগুলোকে আঁকড়ে আছে শেকড় দিয়ে। এই কন্ট্রাস্টটা ভারি মজার। আকাশ ধুসর, গাছ ধুসর, পিচের রাস্তার ওপর এতগুলো লাল বাড়ি। যেন এখন থেকেই জানিয়ে দিচ্ছে আর কয়েকমাস পরে সবকিছু কেমন রঙিন হয়ে উঠবে। অবশ্য এই রাস্তাটা পেরিয়ে গেলেই ফ্যাকাসে। তখন মানুষ। তখন উনুনে কয়লা দেওয়া হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পর গন্ধ বেরবে রুটির। শুধু ই গন্ধটুকুর জন্যই আরও দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা যায় অনায়াসে।
লাইব্রেরির পাশের রাস্তাটা এড়িয়ে যায় গৌরির মেয়ে। রাস্তাটা পছন্দের। ওই কোনায় ম্যাথিউসদের বাড়ি। আর কদিন পর থেকেই বারান্দায় একটা স্টার ঝুলবে আর আলো জ্বলবে। ওদিকে গেলেই কেমন জন্মদিন জন্মদিন লাগে। সে যীশুরই হোক বা নিজের। একটার গায়ে ওপর অন্যটা। কনভেন্টে পরার জন্য পুরো সময়টাই ফেস্টিভ। আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে না। সময়টা এসে গেলেই তো পারে। ছুটির মত মজা আর কিছুই হতে পারে না। যেমন আজও ছুটি। তাই অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হচ্ছে। ওখানে কোচিং ক্লাস। ওখানে গেলেই দেখে ফেলবে । বাড়িতে জানানো যাবে না এই অ্যাডভেঞ্চারের কথা।। গুলি খেলাটা তো বন্ধই করে দিয়েছে। স্কুলেও কেউ খেলতে নেয় না। তাঁর চেয়ে নিজেকে ছুটি দিয়ে ঘুরে বেড়ানোই ভালো। একটু সাবধানে। পাড়ার মাসি, পিসি, পুতুল দিদি, রিক্সা দাদু সবাই মুখিয়ে আছে। দেখতে পেলেই শাসন করবে। পার্কের মধ্যে দিয়ে শর্ট কাট করা যায়। ভর্তি বাঁশ। টপকে টপকে যেতে হবে। একটা দুটো আবার ব্যালেন্স নেই। পায়ের তলায় নড়ে যায়। এই পার্কে দুর্গা পুজো হয়না। জগধাত্রি পুজো। পরশু ভাসান হয়ে গেছে। গৌরির মেয়ের বহুদিনের ইচ্ছা ভাসান দেখবে। ওই ওরা তো লড়ি করে যায়, কিন্তু ওকে তো বাড়ি থেকে ছাড়ে না।
বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে একটু সচেতন হতে হয়। রিক্সা দাদুর বাড়ির। ঠাকুমার রিক্সাওয়ালা। ওকেই মাঝে মাঝে পাঠায় দাদুকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন রিক্সাটা নেই বাড়ির সামনে। তাহলে ভয়ও নেই। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখে একটা কিছু গোলমাল হচ্ছে। বাড়ির গায়ে মন্দির। এত লোকজন জড়ো হয়ে কান্নাকাটি করছে। ওই যে, পার্বতী। বন্ধু হয়। এক সময় হিংসা হত। সবাই বলত পার্বতী ভালো মেয়ে, পাড়ায় ঘোরে না, পড়াশুনো করে, বাবা মায়ের কথা শোনে। রাগ হত খুব। এখন আর হয়না। এখন বন্ধু হয়।
ভাসানে গেছিল পার্বতীর কাকা। তারপর আর ফেরেনি। সবাই অপেক্ষা করছিল। পুতুল দিদির মা বলেছে পার্বতীর কাকা নাকি মদ খেয়ে লড়িতে উঠে ঠাকুরের কাপড় ছিঁড়ে পাগড়ি বানিয়েছিল, চুল ছিঁড়ে গোঁফ করেছিল। তাই সে আর ফেরেনি। পার্বতীর ঠাকুমা মন্দিরে প্রদীপ দিয়েছিল। প্রদীপটা নিভে গেছে মনে হয়। তাই এত কান্নাকাটি।
বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই সন্ধে । এই তো বাইরে যখন ছিল, ছাদের কার্নিশে রোদ তখন। উঠোন অবধি আসতে আসতেই অন্ধকার। সবকিছুই হুড়মুড় করে হয়ে যায় । হালকা হালকা ঠাণ্ডা লাগে। গায়ে চাদর দেবো কি দেবো না ঠিক করার আগেই জাঁকিয়ে শীত পরে যায়। একটা ছুটির দিন শেষ হতে হতেই আবার একটা ছুটি। লম্বা, স্যাঁতস্যাঁতে, একঘেয়ে।
Posted in: November 2021 - Cover Story, PROSE