ভাষাংবুরুর হেমন্ত : অমিতাভ প্রহরাজ

মনের মতো ঘরের কথা এখানে কেউ ভাবে না। কারণ ঘরের মতো মন কি আর মানুষের হয়? ওই এক জায়গায় স্থির থেকে অবিরল স্থান আর ত্রাণ ঢেলে চলেছে, সে কি কোনো এক মানুষের কাজ? তাই বলে যেন ভেবো না সবাই এখানে থেমে যায়। এই ভাষাংবুরুর দেশে সব লোক বড়ো হয়ে দরজা হতে চায়। মনের ভেতরে পাল্লা গজায়। বাইরের পাল্লা নয়, ভেতরের পাল্লা গজানোর কাজ করে। তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে নিজের ভেতরে। দেখে মনের কীর্তিকলাপ। সে বড়ো আমোদের ব্যাপার। এক আঙুলি মন, কি যেন ভীষণ বীর এই ভাবে পাল্লার সাথে পাল্লা দেবে বলে আরেক পাল্লা তৈরি করে, চুপচাপ এদিক ওদিক দেখে নেয় কেউ দেখছে কিনা। ভাষাংবুরুর লোকের দারুণ মজা নিয়ে দেখে তার গোপন কীর্তিকলাপ। নিজের ভেতরে তাকিয়ে থাকে একমনে, মুখে মিচিক দুষ্টুমি। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে মাথার মধ্যে একটা ফিসফিস চালিয়ে দেয়। আর মন তৎক্ষণাৎ ছেনি বাটালি র্যাঁ দা ইত্যাদি লুকিয়ে ভদ্র সভ্য হয়ে “এঁজ্ঞে, গাঁওবুড়ারে মনে করছিলেন বুঝি, এঁজ্ঞে”। আর ভাষাংবুরুর লোকেরা হেসে কুটিপাটি।

এই গাঁওবুড়া মন, দরজা হওয়া বড়ো হয়ে। এসব কিন্তু এমনি এমনি নয়। খুব বেশী চাঁদ আগের কথা নয়, যখন গাঁওখেকো হুমো হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিলো। সেই হুমো না খেত মানুষ, না খেত কুঁকড়া, না খেত ছাগল, শুধু গাঁওগুলা গপাগপ খেয়ে নিতো। কেউ দেখতে পেত না আর গাঁওদের। এক দুজন বলতো তারা নাকি দেখেছে অমুক কুচুড়ের পারে মাধুভুখারের গাঁও এক মস্ত বাবু মানুষ হয়ে বাড়ি বানিয়েছে বটেক। তা গাঁও এ লোকে ঘর করে, গাঁও নিজে ঘর করে এমন কেউ কখনো দেখেছে না শুনেছে? তবে সময় তো ছিলো বড়ো খারাপ। তাই ভাষাংবুরুর লোকেরা সবাই করলো কি নিজেরা একটা করে গাঁও ঢুকিয়ে নিলো নিজের ভেতর। ভাষাংবুরুর যতো লোক, সবার ভেতরে একটা করে গাঁও। বাইরে থেকে দেখবে তুমি লোক। তা বুদ্ধিটা দিয়েছিলো সেই কালিয়া সর্দার, যে কিনা গাঁওখেকো হুমোর খেয়ে নেওয়া গাঁওকে দেখেছিলো কুচুড়ের ধারে নিজের মস্তো বাবু হয়ে বসে থাকতে। সে বললে গাঁও যদি বাবুমশাই হয়ে ঘর হাঁকিয়ে লোক হতে পারে, তবে আমাদের লোকগুলাই বা কেন গাঁও হতে পারবে না? ভারি ভালো বুদ্ধি। সবাই নিজের ভেতরে এক একটা গাঁও ঢুকিয়ে আর একটা গাঁও বিছিয়ে তাতে রাত্রে ঘুমোলো। রাত্রে এসে হুমো গাঁওখেকো সেই গাঁও খেয়ে চলে গেল, ভাষাংবুরুর লোকেরা সেই খেয়ে যাওয়া গাঁও এর ফাঁকায় আলো বাতাসের মতো ভেসে ভেসে শুরু করলো তাদের নতুন জীবন। সবার ভেতরে তো একটা গাঁও রয়েছে। এক একদিন এক এক জায়গায় এক একজনের গাঁও খুলে বিছিয়ে পাতা হয়, তাতে সব লোকেরা বসে, কুঁকড়া লড়াই করে, হিসাম হিসাম হুমসি হুমসি নাচ নাচে, হাঁড়িয়া খায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এই যে লোকের ভেতরে থাকা গাঁও তাকে খুলে তার ভেতরে ঘর বাড়ি বিছিয়ে থাকা কি সহজ কথা রে ভাই। তখনই তো বোঝে সব ভাষাংবুরুর লোক যে তাদের বড়ো হয়ে দরজা হতে হবে। দারুণ দু পাল্লা দরজা কাঁঠাল থেকে সেগুন করতে হবে নিজের ভেতর। আর মানুষ যখন পুরোটাই দরজা হয়ে যায়, তখন সেই দরজা নিজের আগুপিছু আশপাশ বাড়িয়ে বাড়িয়ে একটা ঘর হয়ে যায়। ভাষাংবুরুর লোকেরা জানে মানুষ থেকে ঘর হওয়া যায় না, আপাদমস্তক দরজা হতে হয় প্রথমে। তা এবার গাঁও গুলো ভেতরে রেখে ভাষাংবুরুর লোকেরা যখন ভাসছিলো, তখন একজন নিজের ভেতরে তাকিয়ে দেখে মনের কাণ্ডকারখানা। ভেতরে একটা গাঁও জলজ্যান্ত, সেখানে মনের কি ভারিক্কী ভরকম। গম্ভীর মুখে হাঁটে, উনুই তালাও দের কাছে গিয়ে “ভালো আছিস তো জল, কিছু লাগলে বলবি” যেন কতো ক্ষমতা তার। যেন ওই মনই গাঁওর গাঁওবুড়া। সেই থেকে মনকে গাঁওবুড়া বলে ডাকা হয়। ভারি লজ্জা পায় মন, খুব খুশীও হয়। যেন গাঁওবুড়া হলে তার কতো ওজন হবে। ভাষাংবুরুর দেশে যা কিছু পাল্লা হয়, সব ভেতরে। মাঝে মাঝে শোনা যায় কেউ হয়তো হুঙ্কার দিয়ে বলে “সব কটাকে কাটি ফেলবো আজ। শালা হারামজাদা”। যে দিয়েছে সে তো বটেই, বাকিরা হই হই করে দৌড়ে আসে, “আরে দুখুয়ার ভেতরে গাঁওবুড়া রঙ্গ শুরু করছে”, দুখুয়া তো বটেই, সবাই তার ভেতরে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে ওই এক আঙুলি মনের কি আস্ফালন ভেতর গাঁও এর কুঁকড়া দের ওপর। ওরা চুপ দেখে আর হাসি চেপে চেপে মরে যায়।

এই এক ভাষাংবুরুর দেশ। কখনো কখনো গাঁওবুড়ার রস চাপে। লোকগুলো কিচ্ছু না বলে চুপটি উঁকি মারে ভেতরে। দেখে গাঁওবুড়া মন কেমন বাবুখানি সেজে হলুদঝোরা ফুলের গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পার্ট বলছে যেন।

Facebook Comments

Leave a Reply