শেষ মেট্রো : তৃষ্ণা বসাক
[এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ও কথাকার তৃষ্ণা বসাক।
তৃষ্ণার মুক্তগদ্যের ধারাবাহিক, ‘শেষ মেট্রো’, ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]
পেজমার্ক
পেজমার্ক। আমরা যারা পাঠ্য বইয়ের আড়ালে অপাঠ্য বই পড়ার নিষিদ্ধ আনন্দ পেতে পেতে বড় হয়েছি, বুকের ওপর বই রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি অনেক অলস মধ্যাহ্নে, বিকেলের শেষ আলোয় আবছা হয়ে আসা অক্ষরগুলো মরিয়ার মতো আঁকড়ে পৌঁছতে চেয়েছি চৈতন্যের অনাবিষ্কৃত পারে, তাদের বড় কাছের শব্দ এই পেজমার্ক। হাতের কাছে কিছু না জুটলে ট্রেনের টিকিট, চিরুনি, দেশলাই কাঠি, চুলের ক্লিপ—কত অদ্ভুত জিনিস বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখে মানুষ।
পড়া আর না-পড়া অংশের মাঝখানের ওই বিভাজিকাটি তখন শুধু পেজমার্ক নয়, এক টুকরো জীবন, যাতে লেগে থাকে গেরস্থালীর তেল হলুদের ছোপছাপ। না, সে সব নয়, একটি কেতাদুরস্ত সুদৃশ্য যথার্থ পেজমার্কের কথাই বলছি, বইয়ের সঙ্গে যেগুলো পেতে ভালো লাগে। পুজো সংখ্যার সঙ্গেও আসে পেজমার্ক। দাঁতের মাজন, মাথার তেল, কিংবা ননস্টিকি বাসন ফুঁড়ে জেগে থাকে আমাদের প্রিয় পুজো বার্ষিকীগুলোর মেরুদণ্ড পরের পুজো আসা পর্যন্ত।
বই বা পুজো সংখ্যার ফাঁকে ফাঁকে রেশমি সুতোয় বাঁধা পেজমার্ক—এতে তো কোন চেতনাগত ধাক্কা নেই। এই বই তো এমনভাবেই পড়তে হয়। কিন্তু অন্য বই? যে সব বইয়ের আগেও একটা হ্রস্ব ই জুড়ে গেছে, সেই ই-বইয়ের কথাই বলছি। একটু ধোপদুরস্ত ভাষায় বৈদ্যুতিন বই। সেইসব বই ও সাময়িকী যারা তৈরি করেন, তাঁরা যখন প্রীতি উপহার হিসেবে হাতে ধরিয়ে দেন একটা সুদৃশ্য পেজমার্ক তখন এই স্ব-বিরোধিতার অভিঘাত আমাদের কেমন বিমূঢ় করে দ্যায়।
পেজমার্ক ধরে রাখার মতো স্পাইন বা মেরুদণ্ড যে ই-বইয়ের নেই। তবু এই কৌতুককর ঘটনাটি ঘটেছিল এক বইমেলায়। বই নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার শেষ নেই। দৃশ্যশ্রাব্য থেকে বৈদ্যুতিন মাধ্যম—কোন না কোন প্রতিপক্ষ খাড়া করে, ‘বই থাকবে তো?’—এই আতঙ্ক চারিয়ে যায় পরিপার্শ্বে। এর বিস্ফোরণ ঘটে ফি বছর বইমেলায়। ‘বইয়ের দিন কি শেষ?’ জাতীয় উদ্বেগ, আশংকা একেবারে গণ হিস্টিরিয়ার রূপ নেয়। যদিও পণ্ডিতেরা বলেন এই আশংকা অমূলক।যুগটা যে কনভার্জেন্সের। ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির মতোই মিলে যাচ্ছে নতুন ও পুরনো মাধ্যম কোথাও, কোন না কোন বিন্দুতে।কোথাও বা স্বকীয়তায় উজ্জ্বল থেকে তারা সহাবস্থান করছে পরস্পরের সমান্তরালে।
প্রতিটি মাধ্যমকেই নিজের নিহিত শক্তি চিনে নিয়ে ঠিক করতে হবে নিজস্ব ক্ষেত্র। যেখানে সে অপরিহার্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারবে। তথ্য বণ্টনের তো আলাদা আলাদা মুখ আছে। এক এক মুখের এক এক স্বর, ‘ফর লাস্ট ইয়ার্স ওয়ার্ডস বিলং টু লাস্ট ইয়ার্স ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যান্ড নেক্সট ইয়ার্স ওয়ার্ডস অ্যাওয়েট অ্যানাদার ভয়েস’। তথ্য প্রযুক্তির বিস্ফোরক উন্নতি যখন আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু থেকে বেছে নেবার স্বাধীনতা, একান্ত ব্যক্তিনিবিষ্ট পরিষেবা, তখন সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক যাপনে আলাদা কণ্ঠস্বরের দাবী উঠতেই পারে, তার জন্যে পুরনো স্বরগুলি হারিয়ে যাবে কেন?
প্রচলিত প্রকাশনের ডেলিভারি সিস্টেমে পদে পদে নানা বাধা। পাঠকের কাছে পৌঁছতে গেলে পেরোতে হয় সম্পাদনা, অক্ষরবিন্যাস, প্রাক-মুদ্রণ স্ক্যানিং, ইমেজসেটিং, মুদ্রণ, বাঁধাই, ডিস্ট্রিবিউটর নানান ধাপ। এর ফলে অনেক সময় নষ্ট হয়, দাম যায় বেড়ে। বৈদ্যুতিন প্রকাশনে থাকবে না এইসব ফ্রিকশন অব ডিস্ট্রিবিউশন, তথ্য পাওয়া যাবে অনেক সস্তায়, লেখকদের হাতে আসবে অধিকতর শক্তি—এমনটা দাবি বিল গেটসের। ‘দা ইনফরমেশন হাইওয়ে উইল বই লার্জলি ফ্রিকশন ফ্রি, ইট উইল এম্পাওয়ার মোর অথরস, বিকজ ভেরি লিটল অফ দা কাস্টমার্স ডলার্স উইল বি ইউজড টু পে ফর ডিস্ট্রিবিউশন।’
যে সব লেখক জুতোর সুকতলা খুইয়ে প্রকাশকের দরজা থেকে শুকনো মুখে ফেরেন প্রাপ্য রয়্যালটি না পেয়ে, তাঁরা আশান্বিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে এবার থেকে নিজের মূল্য সরাসরি যাচাই করে নিতে পারবেন পাঠকের মুখোমুখি বসে, শুধু মাউসের একটা ক্লিক, ব্যস। এই মুক্ত মাধ্যমে নেই চিরাচরিত প্রকাশকের মিথ্যে অজুহাত, অরণ্য পোড়ান কাগজে বই ছাপার অপরাধবোধ, কাগজ-কালির ক্রম বর্ধমান দাম, গুদামজাত হয়ে জলে, পোকায় নষ্ট হবার ভয়। দ্বিমুখী, ইন্টার অ্যাক্টিভ এই প্রকাশনে পাঠক হাইপার টেক্সটে ক্লিক করে পেতে পারেন বাড়তি অনেক তথ্য, অর্থাৎ এখানে বদলে যাচ্ছে পাঠের অভিজ্ঞতাই।
রক্ষণশীল পাঠক তবুও খুশি ছিলেন এই ভেবে যে বৈদ্যুতিন মাধ্যম তো শুধু শুকনো তথ্য খোঁজাখুঁজির জন্য। অর্থাৎ নেহাতই দায়ে দরকারে ব্যবহার্য। কিন্তু যখন স্টিফেন কিং, মেরি হিগিন্স ক্লার্ক, ওয়াল্টার মোজেলের মতো বাঘা বাঘা লেখক তাঁদের নতুন বই বৈদ্যুতিন মাধ্যমেই প্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখন বুক কেঁপে উঠল। এবার কি তবে পাঠের আনন্দেও ভাগ বসাবে বৈদ্যুতিন প্রকাশন? ই-বুক কোনদিন বইয়ের মতো হতে পারবে? কম্পিউটার পর্দা থেকে কিছু পড়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রচুর, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে, ঘড় টনটন করে। সবচেয়ে বড় কথা, ছাপার হরফের রেজোলিউশন বৈদ্যুতিন হরফের চেয়ে ঢের বেশি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, গাড়িতে যেতে যেতে ইচ্ছেমত বই পড়া যায়।এরকম ঘনিষ্ঠতা কি ই-বইয়ের সঙ্গে সম্ভব? যতই আধুনিক ই-বইয়ে পাতা উলটনোর শব্দ থাকুক।
বই পড়তে লাগে না কোন বিদ্যুৎ সংযোগ, মডেম কিংবা টেলিফোন লাইন। আর পাঠের গভীরতা? যথার্থই বলেছেন বিখ্যাত শিল্প বিশেষজ্ঞ হাইনজ বার্গহান্স ‘ফরচুনেটলি ফর দা গ্রাফিক কমিউনিকেশন ইন্ডাস্ট্রি, পিপল এভরিহোয়ার স্টিল ওয়ান্ট টু সি অ্যান্ড কিপ দা প্রিন্টেড ওয়ার্ড অ্যান্ড পেজ। দে হ্যাভ গেনড গ্রেটার ভ্যালু অ্যান্ড সেট টু রিটন অ্যান্ড এভার ইনক্রিজ দিজ ভ্যালুজ ইন দা ইয়ার্স টু কাম। আ রিয়েলাইজেশন হ্যাজ কাম দ্যাট ইলেক্ট্রনিক ওয়ার্ডস সিম টু ল্যাক সাবস্ট্যান্স। ডিজিটাল ডেটা ক্যাননট গিভ দা পারমানেন্ট ইম্প্যাক্ট অফ দা প্রিন্টেড ওয়ার্ড’
এই পারমানেন্ট ইম্প্যাক্ট—এই শব্দ জোড়ার মধ্যেই নিহিত আছে বইয়ের চরিত্র বিশিষ্ট।একটি বইয়ের দু মলাটের মধ্যে লেখকের রচনা পায় স্থায়িত্ব, নিশ্চয়তা ও গৌরব। হাত দিয়ে ছোঁয়া, পাতা ওলটানো, বইয়ের পাতায় লুকনো গোলাপ—বই হয়ে ওঠে নানা ব্যক্তিগত মুহূর্তের সঙ্গী। এমনটা কি কোনদিন হয়ে উঠতে পারবে ই-বই?
একদিকে যখন পেরে ভিসান্স শোনাচ্ছেন মার্কিন মুলুকে মোট বিক্রির ৯৭ শতাংশই মুদ্রিত বই, তখন বৈদ্যুতিন প্রকাশন সংস্থার স্টলে ভিড় করা দর্শকের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পেজমার্ক।
কী বলব এই কৌতুককর স্ব বিরোধিতাকে? কনভার্জেন্সের যুগে এমনটাই হয়? এটাকে কি ধরে নেব সাড়ে পাঁচশ বছরের প্রাচীন প্রযুক্তিকে পঞ্চাশ বছরের এক সদ্য যুবার কৃতজ্ঞ গুরুদক্ষিণা? নাকি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুন যেমন দ্রোণাচার্যের পায়ে তির পাঠিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এটা তেমনি কিছু? যুদ্ধটা কি তাহলে সত্যি সত্যি শুরু হয়ে গেল?
Posted in: October 2021 - Serial, PROSE