কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ

[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]

১৫

চকচকে রাংতার মতো কাগজ, আমি বলতাম ঝিরি ঝিরি কাগজ। এই কাগজগুলিকে দেখলে আমার বৃষ্টির দানার কথা খুব মনে হত। বাতাস লাগলে ঝিরিঝিরি, দেখতে ভারি সুখময়। এই “সুখময়” শব্দটি কেন? সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। ঝিরি ঝিরি সবুজ রঙয়ের কাগজ দিয়ে, খেলনা গাছ বানানো হত। তার গঠন হত অনেকটা বরের টোপরের মতো। সেই খেলনা গাছের ওপরে মার্বেল পেপারের ছোটো ছোটো সবুজ নানা রঙয়ের উজ্জ্বল তারা বিস্ময় সৃষ্টি করত। তারাগুলি একেবারে ফিনফিনে সুতোর বাঁধনে চক্রাকারে ঘুরে যেত।
সেইরকমই একটি রাংতার কাগজের গাছ, নিজের চেষ্টায় বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। তক্তপোষের নিচে পারিবারিক চোখের নজরের বাইরে। গোপনে।
আমি সেই খেলনা গাছটিকে বের করে ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে, সাজিয়ে নিলাম।
মা দেখে বিস্ময়ে বললেন, – কোথায় পেলি?
একজন অভিজ্ঞ সংগ্রাহকের মতো, গম্ভীরভাবে বললাম,- চৌকির নিচে।
মায়ের আলতার শিশির ভিতরে, মাকে না জানিয়েই তুলি আলতার তুলি নিয়ে, মেঝের ওপরে আলতা দিয়ে রেখা টেনে এক একটি গ্রাম বা লোকালয় এক টানে দাগ দিয়ে এঁকে,- জনপদের পাশে চুপ করে বসে থাকতাম। আর কল্পনায় ক্রুশবিদ্ধ ভগবানের বুকের ওপরে পেরেক ইংরেজিতে যাকে এককথায় বলে, – ক্রুসিফায়েড।
নিজের মনে নিজেই বললাম – ব্যথা।
অনেকটাই মায়ের মতো দেখতে, বালতি ভরে দুধ নিয়ে আসতেন নানিজি। আমার কর্ম দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে গালে হাত দিয়ে বললেন, হায় দাইয়া !!!
আমি বললাম ওসব ছাড়ো নানিজি, চার পোয়া দুধ বেশি দিয়েছ তো?
মা রান্নাঘর থেকে কড়াইয়ে ফোড়ন ছেড়ে চিল্লিয়ে উঠলেন, – একদম না… একদম না… হাঁড়ি ভর্তি দুধ রয়ে গেছে। এত দুধ রাখব কোথায়? নষ্ট হয়ে যাবে, সব যে ফেলে দিতে হবে যে?
আমি প্রতিবাদ করলাম,- প্রভু যিশু খাবেন। তুমি কি জানোনা আজ বড়দিন?
কি করে জানব?
বাবা আজকে কেন অফিসে যায়নি?
আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম, সেই স্মৃতি আজ ফিরে এল উড়ানের মতো, বাবা যেন বসেছিলেন সেইদিন ইোয়সে ডিসোউজা সারামাগোর কোনো একটি বিশেষ উপন্যাসের আখ্যানের মতো।
হ্যাঁ। বাবা ও মাকে অনেকসময় আমাদের সবারই মনে হয় বিশেষ কোনো উপন্যাসের আখ্যানের মতোই। তাঁরা বেঁচে থেকে ধরে ধরে, কোনো এক মহৎ লেখকের মতো নিবিড়ভাবে উৎসবহীন বুনে চলেন কাহিনি, স্নেহময় আখ্যানের মাদুর। নিজেদের প্রেম ও কামনাকে নিভৃতে রেখে, একদিন জীবনের সমস্ত যন্ত্রণাকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে যান সন্তানদের অনাথ করে।
বাবা বলেছিলেন,- আমরা হয় তো মুখে বলি না, কিন্তু আমাদের সবার প্রিয় হল, শ্মশান। পুড়তে পুড়তে জীবনের এক সময় তো আগুনের শিখা বাধাহীন স্থির দেহের ওপরে উঠে আসে। আমাদের সবার শেষ পরিচয় “শব”।
বাবা যেন হঠাৎ করেই নিজের চুপ করে বসে থাকার আখ্যান ভেঙ্গে তক্তপোষ থেকে নেমে আমাকে খুব মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,- দুধ কেন? একটু পরে বাজারে গিয়ে তোমাদের সবার জন্য কেক নিয়ে আসছি। ভালো কেক যদি না পাই, তাহলে পেঠা (চালকুমড়ো দিয়ে তৈরি) ও ডালমুঠ এনে দিচ্ছি।
মা বললেন,- বড়দিন তো, একটু বাজারে ঘুরে দেখ, কেক পেতে পারো।
ভাগ্যিস ব্রিটিশরা আমাদের দেশে এসেছিল।
মা বললেন,- তাতে কি হল?
সে তুমি বুঝবে না।
যা কিছু বুঝবে তুমি, আর আমি কিছুই বুঝবনা। তাই তো?
আহা। তুমি সব কথাতেই খুব গোল করো।
তুমি যাও, আমি ঘরে যা দুধ আছে, পায়েস করে দিচ্ছি।
আমি লোকালয় ও গ্রাম, জনপদের পাশে ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে বসলাম। সফট এইচ বি পেনসিল। বাবা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন, ছবি আঁকার উৎসাহের জন্য। আমি যখন খুব মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকার কাজ করতাম, বাবা গুন গুন করে খুবই টোকা দেওয়া শব্দের মতো গাইতেন,- “এই করেছ ভালো নিঠুর হে… নিঠুর হে”…… হ্যাঁ, বাবা মাঝে মাঝে চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন… কখনো কখনো তিনি গেয়ে উঠতেন বিশ্ব ভরা প্রাণ……
লোক পরলোক নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবতেন না। পরের দিকে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে নিজেই পুজো আচারে মেতে উঠলেন। উপনিষদ, দুই মহাকাব্য ও বেদান্ত দর্শন অধ্যয়নে গভীর ভাবে ডুবে গেলেন। অবসরকালীন সময়ে লিখতেন। নিয়ম করে স্নান খাওয়া দাওয়া করে, সামনে একটি জলচৌকির ওপরে খাতা রেখে লিখে যেতেন। তিন চার বছরের মধ্যে লিখে ফেললেন তিন চারটি গ্রন্থ। যেমন সাংখ্য দর্শনের ওপরে আলোচনামূলক একটি গ্রন্থ, বেদান্ত দর্শনের ওপরে একটি গ্রন্ত। দুই মহাকব্যের ওপরে আলোচনা “মহাকাব্য দর্শন”। একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন হিন্দি ভাষায়, “মন্দির মসজিদ”। ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন, “দি হোলি মেসেজ”। বাবার অধিকাংশ বইয়ের প্রকাশক ছিলেন হরফ প্রকাশনী। আমি দুইটি বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলাম। তখন আমি ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজে ছবি আঁকার ওপরে অধ্যয়ন করছি। নিজের খেয়াল খুশি মতো বাঙলা হরফের নক্সা আঁকতাম। আমার প্রিয় ক্যালিওগ্রাফার ছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর পূর্ণেন্দু পত্রী। ওনার লেটারিঙয়ের কাজ আমাকে মুগ্ধ করে দিত। বইগুলি এখন পাওয়া যায় কি না জানিনা। নিয়ম করে প্রতি বুধবার যুগান্তর দৈনিক পত্রিকার ধর্মকর্ম পাতায় নিবন্ধ লিখতেন বাবা। লেখায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করার পরে, যখন তিনি লিখে উঠতেন, তখন দেখতাম তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকতেন। কারোর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না। কোনো সময় তাঁর বন্ধুবান্ধব এলে, নিজের লেখা পড়িয়ে শোনাতেন। খুবই নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে তিনি থাকতেন। যখন চাকরি করতেন, চা খেতেন। পরের দিকে সেই অভ্যাসও পরিত্যাগ করেছিলেন।
যাক সে কথা, ২৫শে ডিসেম্বর মানে, আগ্রা শহরে ভয়ানক ঠাণ্ডা। ব্যবহারের জলও গরম করে রাখা হত। প্রতিদিন স্নান করা প্রায় দুঃসম্ভব ছিল। উত্তরপ্রদেশের শীতকাল খুব যে সুখদায়ক ছিল তা নয়। ঠাণ্ডা সামলানোতেই সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকত। ঘরের মধ্যে যেমন ফায়ারপ্লেস ছিল। তেমনি ঘরের বাইরে ও রাস্তার পাশে বা বাজারে জটলার পাশে আগুনের ধিকি ধিকি কুণ্ড পথচারীদের পক্ষে বেশ আরামদায়ক ছিল। বাবা কিন্তু কোনোদিন ফায়ারপ্লেসে আগুন উসকোতেন না। বলতেন, ঘরের ভিতরে আগুন জ্বালালে শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট হবে। লেপ কম্বলকে উত্তরপ্রদেশের ঠাণ্ডা খুব সহজেই পরাস্ত করে দিত। কিন্তু অনেক ফৌজি পরিবারের মতোই একপ্রকার মোটা কালো কম্বল আমাদেরও শীতের অবলম্বন ছিল। প্রবল ঠাণ্ডাকে ফৌজি কম্বল তুড়ি মেরে পরাস্ত করে দিত।

যাই হোক, নিজেকে যতটা পারলাম মাফলার সোয়েটার ও চাদর দিয়ে ঢেকে, চললাম নানিজিকে ডেকে আনতে। সকালে তিনি দুধের কথা শুনে দুঃখ পেয়েছিলেন। মা দুধ রাখলেন না বলে, তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন,- বহু, আমি কি তোমাকে দুধের দামের কথা বলেছি?
মা বলেছিলেন,- তা কেন? দুধের দাম নেবে না কেন?
নানিজি বললেন,- আমার বাড়িতে দুধ গড়িয়ে যায়। একমাত্র তোমাদের বাড়িতেই দুধ দিয়ে যাই। বাকি দুধ আমরা বিক্রি করিনা। অতিরিক্ত দুধ থাকে বলেই দিয়ে যাই। বেচারা তোমার বেটা চাইল, দিতে পারলাম না বলে, খুব দুঃখ হচ্ছে। তুমি না করলে তাই।
মা বললেন,- আমি কি বুঝতে পারছিনা?
নানিজির কুটির একটু চিনে নিতে সামান্য বেগ পেতে হচ্ছিল। হ্যাঁ, পিছনের তাজমহলের মাথাটিকে দক্ষিণের কোণে রেখে, তারপরে পশ্চিমে পায়ে হেঁটে গেলে, একটি পরিত্যক্ত বড় কুয়োর চাতাল, জংলাগাছের লতাপাতার সমাহার। সাপের মতো বেশ কিছু ডগা লকলকিয়ে দিগবিদিগ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কোনো কোনো জংলি ডগার আগায় ছোটো ছোটো বাহারি জংলি ফুলের টুসকি। ফুলগুলি প্রবল বরফিলি বাতাসে দুলছে। বাতাসের মধ্যে একপ্রকার গভীর উত্তরের আহ্বান ছিল। সেই বাতাসের মধ্যে ইনজেকশনের সুঁই ফোটানোর তীক্ষ্ণতা। ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। চারপাশে পচিশের বড়দিনের কোনো উচ্ছ্বাসের দোল… দে দোল নেই। কেমন এক জমাট স্তব্ধতা। এখানে এসে জেনেছি, বিশেষ করে বড়দিন ও পয়লা জানুয়ারি তাজমহলের প্রাঙ্গণে তিলধারণের কোনো স্থান থাকেনা। সবাই এসে তাজমহলের সৌন্দর্যের মুগ্ধতা পান করে।
তবে আমরা, বিকেলের দিকে পূর্ণিমার দিনে যেতাম। দিনের বেলায় গেলেও আমার প্রিয় স্থান ছিল, তাজমহলের পিছনের দিকে যেখানে দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর সমাধি সৌধ ও ও যমুনার প্রবাহ দেখতে দেখতে মাকে প্রচলিত একটি গানের কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিত। মা গুন গুন করে উচ্চারণের শব্দ ভেজে নিতেন,- নদী নারে না যাও শ্যাম পইয়া পরুঁ…………
এ দিকটায় অনেক ফাঁকা বলে, আমি সেই কুয়োর গভীরে উঁকি দিয়ে অনেকবার দেখেছি, – কি গভীর অন্ধকার। পৃথিবীর তলদেশ ভেদ করে কুয়োর গভীরতা অন্য এক শূন্যতার কাছে পৌঁছে গেছে। কল্পনায় ভাবতাম সেই তলদেশের গভীরে ছড়িয়ে আছে আরেকটি পৃথিবী, যেখানে জল বাতাস শহর গ্রাম সব পৃথিবীর মতোই।
কুয়োর গভীরে অন্ধকারের মধ্যে আদিম হুম হুম শব্দ। খালি মনে হত, যদি কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, অন্ধকার ও তার গভীরতা গিলে খেয়ে নেবে। আর অনন্তকাল ধরে, আমার শূন্যতার গভীরে পতন হতেই থাকব। আসলে পতনের কোনো সীমা নেই… পতন ক্রমান্বয়ে ক্রমশ… পতনের পর অনন্ত পতন। এখন বুঝি পতন ও উত্থান, এ সবের বৃত্তেই মানব জীবনের জীবনচক্র।
নানিজি আমাকে বারে বারে নিষেধ করেছেন, কুয়োর আশেপাশে যেন ভুল করে না যাই। কিন্তু কুয়োর ভিতরের অন্ধকার ও হুম হুম শূন্যতা বারে বারে আমাকে আকর্ষণ করত। নানিজি অনেকবার বলেছেন,- ওই কুয়োর ভিতরে অনেক মানুষকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কত বছর ধরে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে কেউ জানেনা। আসলে এই কুয়োটি মানুষকে হত্যা করার জন্যই যেন খনন করা হয়েছিল। কুয়ো তো মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য, কিন্তু মানুষ মানুষকে হত্যা করে, এও একরকম তৃষ্ণা।
আমি পা বাড়াচ্ছিলাম, কুয়োর দিকে যাব বলে, কেউ যেন আমাকে সাবধানে করে দিল।
পিছন থেকে না’ করে বলল, উধর মত যায়োঁ বেটা।
আমি পিছনে দেখলাম একটি মানুষ মানে রুঁই (তুলো) দিয়ে মোড়ানো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত লেপ দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছে। বললেন আমাকে আবার,- থানেদার এসেছিল, কয়েকদিন আগে একজনকে কুয়োর ভিতরে ফেলে দিয়ে গুম করে দেওয়া হয়েছে। অজিব গুম, কুয়ো কোনো প্রমাণ রাখেনি। এই কুয়োর ভিতরে কেউ তলিয়ে গেলে পৃথিবীর পিছন দিক দিয়ে একেবারে হারিয়ে যায়।
আমার কথাটি কেমন বিস্ময়কর মনে হল, পৃথিবীর পিছন দিক, পৃথিবীর পিছন দিক আছে… সবকিছুর পিঠ পিছন যেমন আছে তেমনি পৃথবীরও আছে। পৃথিবীর এই পিছন ও পিঠ জানে সমস্ত কুয়ো।
আমি পিছনের দিকে উল্টো পদক্ষেপ নিলাম, সরে এলাম রাস্তার দাগের ওপরে, দাগ গেছে নানিজির কুটিরের দিকে। নানিজির কুটিরের দিকে যাওয়ার সময় একটি বকরিখানার সীমানার চারপাশে খাটো আকারের কাঠের বাধা পাওয়া যায়। সেই কাঠের সীমানার কাছে গেলেই কেমন এক চিমসে লোমশ গন্ধ পাওয়া যায়। ছাগলের দুধের মধ্যে এই লোমশ গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা উত্তরপ্রদেশে যতদিন ছিলাম শীতকালে বাবা ছাগলের দুধের চায়ে চুমুক দিয়ে খুশিতে বলে উঠতেন, রঘুপতি রাঘব রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম……… আজ এই সময়ে যখন এই স্মৃতিমালা সামান্য অক্ষরের মাধ্যমে গ্রথিত করছি, তখন দেশকালের পরিস্থিতি সীতারামের দাম্পত্যকে আহত করছে, অপমান করেছে। সেই প্রচীনকাল থেকে ভারতীয় সংস্কৃতি রামের আগে সীতাকে উচ্চারণ করে, সীতাকে পাতালে নিক্ষেপ করার মহাকাব্যিক রাজনীতিকে উপহাস করেছে। কারণ, নারীর গর্ভেই পুরুষের জন্ম হয়।
যাই হোক, বাবার চায়ে চুমুক দিয়ে গুন গুন করে আপ্লুত পতিত পাবন সীতারাম কেন ??? আসলে তিনি যে ছিলেন গান্ধজির ভক্ত।
আমি নানিজির কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে, দুইবার ডাকলাম নানিজি…নানিজি…
অসহ্য তীক্ষ্ণ অভ্রভেদী হিম কামড় শরীরের সমস্ত উলের পোশাককে পরাস্ত করছে। একটু পরেই হয় তো, বরফের পতন হবে। এই প্রকার ঠাণ্ডাকে কোনো ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়না। বড় রাস্তায় কুয়াসার মতো পাতলা চাদর ভেদ করে কয়েকটি টাঙ্গা চলে যাচ্ছে তাজ রোডের দিকে। টাঙ্গার ঘোড়াগুলিকে নির্জীব মনে হচ্ছিল। আকাশে পাখি উড়ছে, কিন্তু প্রবল শীতে পাখির উড়ান কেমন ভিজে নেতিয়ে গেছে। পালকের ওজন ভারি মনে হচ্ছে। ডানার ওঠানামা মন্থর।
নানিজির উঠোনের ওপরে ধূসর সাদা রঙয়ের মরা ছাই পড়ে আছে। কুটিরের দরজা চাপানো। মরা ফ্যাকাসে আলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের গভীরে কয়েকটি ছেঁড়া ছবি কান্না করছিল, যে ছবিগুলি একসময়ে আমি এঁকেছিলাম ক্যামেল পোস্টার কালার দিয়ে। প্রবল সবুজের ওপরে দূরে বাদামি রঙয়ের কুটির, পাশে ইংরেজি অক্ষরের মতো বাদামি কাঠের বেড়ার ওপারে দুইটি ভেড়া তৃণ কুটি কুটি করছে। এই একই ছবি আমি বহুবার রচনা করেছি, কিন্তু মন ভরেনি। ছবিগুলিকে কুটি কুটি করেছি বারে বারে নিজের ব্যর্থতার জন্য। আসলে অনেক পরে আর্ট কলেজে শিক্ষা নেওয়ার সময় পল গগ্যাঁ ও ভিনসেন্ট ভ্যান গগের রচনাগুলিকে পাগলের মতো দেখে চলেছি তখন সেই সব ছবিগুলির মধ্যে অনেক শব্দ আবিষ্কার করেছিলাম। এক একটি রঙয়ের মিশ্রণের মধ্যে জগত সংসারের অনেক শব্দ থাকে। ছবির রঙ বড়ই শব্দ সচেতন হয়। রঙ শব্দের সরণি ধরে ভাঙচুর করে চলে জীবনের অমূল্য বোধকে। কেন জানি মনে হয়েছিল, জীবনের সবচাইতে বড় স্পন্দন থাকে, মৃত্যুর মধ্যে। মৃত্যু মানুষের অন্যত্র উড়ে যাওয়ার এক অভূতপূর্ব অস্থিরতা যা মোটেই স্থির নয়।
আমি নানিজিকে অনেকবার ডাকলাম। কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না ভেবে, অস্থির হয়ে উঠছিলাম। কত কি ভাবছিলাম। এই তো সকালে নানি বাড়িতে দুধ দিয়ে গেলেন।
কেউ কোথাও নেই। ছাইরঙা উঠোনের মধ্যে আমি একা ঠক ঠক করে কাঁপছি। বারে বারে দরজার দিকে তাকাচ্ছিলাম। দরজার পাল্লা নড়ে কি না?
কিন্তু কাউ কোথাও তো কেউ নেই। কেন জানিনা, কাউকে ডেকে ডেকে না পাওয়া গেলে, সে যদি না আসে তখন মনের গভীরে অনেক কথাই উচ্চারিত হয়…… রহস্যজনকভাবে হাহাকারের মধ্যে যা হয়, কোথায় গেলেন নানিজি।
বেটা…বেটা…বেটা… কখন এলে বেটা…
তুমি কোথায় গেছিলে? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি জানো?
কি করে জানব? তোমার মা তো বলেই দিল দুধ নেবেনা।
আমি সেই কথা তোমাকে বলতে আসিনি।
তাহলে কি বলতে এসেছ?
মা তোমাকে ডেকেছে। বলেছে নানিজিকে একবার ডেকে আনতে।
এখন আমি যাব কি করে? গায় ছাগল বেচারিদের চারা বিচালি দিতে হবে। তার আগে যাব ময়দানের দিকে, ঘাসকুটো কেটে কুড়িয়ে আনতে। এই শীতকালে ঘাস কি তাজা পাওয়া যায়? এই ঠাণ্ডায় সব ঘাস শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে।
তাহলে ঠিক আছে, চলো আমিও তোমার সাথে ঘাস কেটে কুড়িয়ে আনি।
ছিঃ। তুমি যাবে কেন? লিখাই পড়াইয়ের বেটা। ঘাস কাটবে কেন? গায় চারা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য অন্য সমাজ আছে। ফৌজি অফিসারের বেটা তুমি। তোমার মাইজি জানতে পারলে, আমাকে বলবে তোমাকে আর দুধ দিতে হবেনা। বেটা আমি কি তোমাদের শুধুই দুধ দিতে যাই। তোমাদের দেখতে যাই। তোমাদের প্রতিদিন না দেখতে পেলে আমার গাই ছাগল পালন পোষণের কাজ বৃথা হয়ে যাবে বেটা। চাইনা আমার দুধের দাম। দুধের বদলে তোমাদের মুখগুলি আমাকে আনন্দ দেয়।
ময়দান কোন দিকে?
ওই তাজ রোডের পাশে গুলাব বাগিচার পাশে।
চলো আমিও তোমার সাথে যাব।
নানিজি বসে পড়ে বলল,- বলো এবার তোমার কি কথা আছে? তোমার মা কি বলে পাঠিয়েছে?
শুধু তোমাকে বলেছে, একবার যেতে। আর কিছু বলেনি তো?
অনেক কাম কাজ পরে আছে বেটা। সেই কাজ সেরে তোমাদের বাড়িতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বিকেল ফুরিয়ে এলে ভীষণ ঠাণ্ডা পরে যায়। তখন আর বাড়ির বাইরে থাকা যায়না। তোমার নানাজি এখন সন্ধ্যায় ফিরে আসে। শীতকালে বিকেলের পরে আর কেউ বাজার মাণ্ডিতে কাউ থাকেনা। সে গেছে আমিনাবাগে।
আমি ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম রঙ্গিন কাগজের পাখি ফুল তারা কছুয়া বানিয়ে রেখেছে নানাজি। সেইগুলি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে নানাজি। আর নানিজি গায় বাছুরের পালন পোষণ করে। মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে দুধ দেয়। কাগজের পুতুল ও গরুর দুধের কারবারি নানাজি ও নানিজি এই ছায়রঙা উঠোন ও কুটিরের মালিক ও মালকিন।
নানিজি আমাকে স্পষ্ট করে কোনো কথা দিলেন না। সে কখন তিনি যেতে পারবেন।
আমি ফিরে গেলাম। মাকে গিয়ে বললাম, নানিজি বলতে পারলনা কখন আসতে পারবে। নাও আসতে পারে। বিকেল হলে খুব ঠাণ্ডা পড়ে বলে কুটিরের বাইরে বের হয়না।
মা বললেন,- বুঝতে পেরেছি, সকালে অমনভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। তুমি যখন বললে, এক সের দুধ রেখে নিতেই পারতাম।

মা দুপুরে উনুনে আঁচ তুলে বড়দিনের পায়েস রান্না করতে বসলেন। দুধ ও গোবিন্দভোগের চাল দুধের সঙ্গে ফুটছিল। এলাচি ও তেজপাতার গন্ধে ঘর যেন দুধের সুগন্ধি পাপড়ি হয়ে গেল। বাবা কেক নিয়ে এসেছিলেন সদর বাজার থেকে। আমার বড়দিনের গাছের ওপরে তারাগুলি সুতোর বাঁধনে চক্রাকারে ঘুরে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ ঘুমে ঢুলছিলাম, কিন্তু পায়েসের গন্ধে আমার মিজাজকে জিংগল বেল……জিংগল বেল…… করে তুলল। মনের গভীরে গির্জার ঘণ্টা, সহস্র মোমবাতির আলো জ্বেলে দিয়েছিল। বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে প্রভু যীশুর কাহিনি বলতে থাকলেন। বাবা যাই বলুন না কেন, সেই বলার মধ্যে গল্পের ও কাহিনির অভিনব টান থাকে। মা উনুনের সামনে বসে আগুনের তাপের আরাম নিচ্ছিলেন। আর উলের কাটা ঠোকাঠুকি করে, নিজেরই জন্য গোলাপি রঙয়ের কার্ডিগান বুনে চলেছেন। আমি বাবার গল্পের কাছ থেকে সরে গিয়ে মায়ের পায়েসের হাঁড়ির কাছে গিয়ে মাকে বললাম,- মা তুমি আমাকে বলোনি, নানিজিকে কেন ডেকে পাঠিয়েছিলে?
সকালে অমনভাবে বললাম, তাই খুব খারাপ লাগছিল।
যখন আর আসবেই না তখন আর ভেবে কি হবে?
মনের দিক থেকে হালকা হওয়া যেত।
কাল সকালে আসবে দুধ দিতে। তখন না হয়?
তুমি ভালো করে বলে এসেছ তো?
সে তুমি ভাববে না। বলেই তো এসেছি।
দেখি আসতেও পারে, কিন্তু মন বলছে না আসবে।
বড়দিনে সবাই কেক খায়। আমরা বড়দিনে কেক ও পায়েস খাই।
এই প্রথা তোমার বাবা চালু করেছে।
একটা বড়দিন যে সময়ের পরিধিতে এত ছোটো হয়, দেখতে দেখতে দুপুর ঢলে গেল। শীতের দুপুরের আলো, দ্রুত পড়ে আসছিল। আলো পড়ে এলেই স্থানীয় সভ্যতা পুরানো পাণ্ডুলিপির মতো হয়ে যায়। পরের দিন সেই পাণ্ডুলিপির খসরা ধরে পুনরায় লিখে চলে মানুষ বড়দিনের প্রবল শীতের আখ্যান।

বিকেল পড়ে আসছিল বলে, দ্রুত এগিয়ে আসছিল আমাদের কোয়ার্টারের গেটের দিকেই। কাছে আসতেই আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না। নানিজি আসছে। আমি দরজা আঁকড়ে ধরে, মাকে উচ্চস্বরে বললাম, নানিজি আসছে,… নানিজি আসছে।
মা বললেন, – আমার মন কেন জানি বলছিল, নানিজি আসবে। তোমাকে দুপুরে বলেছিলাম।
নানিজি একটি বড় রেকাবির মধ্যে, ক্রুস কাঠির সুতোয় বোনা ঝলেরের নিচে কিছু যেন ঢেকে নিয়ে এসেছেন। মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,- তোমার বেটার জন্য।
মা ঝালর উঠিয়ে দেখলেন, তারপরে বললেন,- সে কি !!!
সামান্য ক্ষীর। বেটা, বাবু ও তুমি একটু চেখে দেখে নিও। নানাজি আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছে আমিনাবাগ থেকে। ওদের জন্য পেঠা এনেছে। আমি ক্ষীর করলাম। সকালে এমনভাবে বললে, তোমার বেটা ক্ষীর খেতে চাইল। তাই করে আনলাম।
মা বললেন,- আমিও তো ক্ষীর (পায়েস) করেছি।
বুঝতে পারলাম, মায়ের হাতের পায়েস আর উত্তরপ্রদেশের ক্ষীরের মধ্যে বেশ ঠোকাঠুকি হল।
মুখে দিয়ে বুঝতে পারলাম মায়ের হাতের পায়েস আর নানিজির ক্ষীরের স্বাদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও নানিজির ক্ষীরের স্বাদ কিন্ত মুখের ভিতরে লেগে থাকল। কাজু পেস্তার ঝুরো মুখের ভিতরে, আগ্রা শহরের হৃদয়ের অনুভবকে বড়দিনের শীতের বিকেলকে খোলতাই করে দিল।

[চলবে…]

Facebook Comments

Leave a Reply