বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
অষ্টম পর্ব
এই প্রথম অঙ্কে তাটকার যে বর্ণনা লক্ষ্মণ দিয়েছেন সে বর্ণনার সঙ্গে ভাস রচিত বলে প্রখ্যাত ‘মধ্যমব্যায়োগ’-এর রাক্ষস বর্ণনার সাদৃশ্য কিন্তু নেই। তাটকা এখানে অতি দীর্ঘাকৃতি, গলায় নাড়ীর তন্ত্রীতে বাঁধা বড়ো বড়ো মাথার খুলি এবং নলাকার হাড়। অজস্র অলঙ্কার শরীরে। পীতোদ্গীর্ণ রক্ত আর পাঁক শরীরের সামনের দিকে মাখানো।
অর্থাৎ তাঁর বর্ণনা আমাদের ছোটবেলার রাক্ষস সংক্রান্ত রূপকথা-উপকথার সঙ্গে মিলে যায়। হয়তো ভেবে দেখারও অবকাশ আছে যে ভবভূতিদের বর্ণনাই আমাদের রূপকথা-উপকথাতে জুড়ে গেছে কী না! অন্যদিকে মধ্যমব্যায়োগ-এর নাটককার যিনি, তিনি ভাস হোন বা অন্য কেউ, তিনি যে ভয় এবং কুদৃশ্য বিবর্জিত বর্ণনা দিয়েছেন তা আমাদের ভাবনাধারায় এলো না কেন তাও ভেবে দেখা যেতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে মধ্যমব্যায়োগের বর্ণনাটিও আমরা পাশাপাশি রেখে দেখে নিতে পারি। মধ্যমব্যায়োগের নাটককার রাক্ষসের কুলোর মত কান, মুলোর মত দাঁত – এই জাতীয় ধারণাকে ভাঙছেন। যে কারণে ঘটোৎকচের বর্ণনাতেও তা আনছেন। গায়ের রঙ কালো। কটা চোখের মণি। বিশাল বলশালী শরীর। দাঁত সামান্য উঁচু এবং সাদা।
ব্রাহ্মণী ও তার সন্তানদের উপমাতে বারেবারে ঘুরিয়ে আনছেন, ঘটোৎকচকে দেখতে প্রলয়কালীন মহাদেব বা শিবের মতন। শুধু তাই নয়, সে যে উপবীত ধারণ করে, যা শূদ্র ও নারী ব্যতীত ত্রিবর্ণ ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ রাক্ষসেরও সংস্কার আছে যা তথাকথিত আর্য সংস্কারের সঙ্গে মেলে। রাক্ষস সংক্রান্ত ভয়ের কথা মধ্যমবায়্যোগেও আছে। কিন্তু ভবভূতির মতন শুরু থেকেই রাক্ষসকে ভয়ের অলঙ্কারেই সাজাচ্ছেন না। আরো দেখার বিষয় ভবভূতির তাটকার বর্ণনায় অলঙ্কারাদি এবং রাক্ষস কর্মের চিহ্নের বর্ণনা আছে, শরীর সংক্রান্ত বর্ণনায় শুধুমাত্র আছে দীর্ঘ ঝুলে পড়া স্তনের প্রসঙ্গ। আর কিছু নেই। বর্ণ থেকে শরীরের বর্ণনা নেই।
কেন নেই সে প্রসঙ্গে যাবার আগে আমরা যেনে নিই তাটকা বধের প্রসঙ্গ। বিশ্বামিত্র রামকে আদেশ দিলেন তাটকা বধের। রামের চরিত্রে এখানে ভবভূতি দ্বন্দ্ব এনেছেন। রাম বলছেন রাক্ষসী হলেও, ইনি তো স্ত্রীলোক। তাঁর বধ্য ইনি কেমন করে হবেন এই প্রশ্ন উহ্য রাখলেও এই যে মূল প্রশ্ন তা বোঝা যাচ্ছে। রামের এই ভাবনায় মুগ্ধ সীতা, উর্মিলা এবং রাজা কুশধ্বজও। বিশ্বামিত্র, স্ত্রীলোক বধ সঙ্গত কী না সে প্রশ্নে যাচ্ছেনই না। বরং রামকে লক্ষ্য করতে বলছেন তাটকার হাতে সম্মুখে একসঙ্গে বহু ব্রাহ্মণের মৃত্যুর কথা। এই সম্ভাবনাকে নিষ্ক্রিয় করতে বধ করতে হবে।
রামও চললেন বধ করতে। তাঁর কাছে বিশ্বামিত্রের আদেশ বেদতুল্য এবং পাপপূণ্যের প্রমাণস্বরূপ। এর আগেও বেদের মাহাত্ম্যের প্রসঙ্গ এসেছে বারংবার। এবারেও এল। শুধু তাই নয়, বেদে যা শ্রুতিবদ্ধ তা গুরু দ্বারা যে ব্যাখ্যাত হয় সে প্রসঙ্গও কিন্তু আমরা পরোক্ষে বুঝতে পারছি। বিশ্বামিত্রের আদেশ সে কারণেই বেদতুল্য।
আরেকটি কারণও আছে। তা হল ভবভূতির আত্মপরিচয়। ভাসের ক্ষেত্রে যেমন কিছুই জানা যায় না, ভবভূতির ক্ষেত্রে একেবারেই উলটো। নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন গর্ব সহকারে।
সম্ভবতঃ বাণভট্টের পরে ভবভূতিই দ্বিতীয় কবি যিনি আপন কীর্তিতে আত্মপরিচয় দিয়ে গেছেন। সাধারণতঃ সংস্কৃত থেকে পুরাণের কবিরা পর্যন্ত আত্মপরিচয় সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন। আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে মহাবীরচরিত নাটকে তিনি লিখেছেন –
‘অস্তি দক্ষিণাপথে পদ্মপুরং নাম নগরম্। তত্র কেচিত্তৈত্তিরীয়িনঃ কাশ্যপাশ্চরণগুরবঃ পংক্তিপাবনাঃ পঞ্চাগ্নয়াে ধৃতব্রতাঃ সােমপীথিন উদুম্বরনামানাে ব্রহ্মবাদিনঃ প্রতিবসন্তি। তদামুষ্যায়ণস্য তত্রভবতাে বাজপেয়যাজিনাে মহাকবেঃ পঞ্চমঃ সুগৃহীতনাম্নো ভট্টগােপালস্য পৌত্রঃ পবিত্রকীর্তেনীলকণ্ঠস্য আত্মসম্ভবঃ শ্রীকণ্ঠস্য পদলাঞ্ছনঃ পদবাক্যপ্রমাণজ্ঞো ভবভূতিনাম জাতুকর্ণীপুত্রঃ কবির্মিত্রধেয়মস্মাকমিত্যত্রভবন্তো বিদাঙ্কুবন্তু। (সং. সা. স. ১৩শ খন্ড, পৃ. ১৩২)’
শ্রেষ্ঠঃ পরমহংসানাং মহর্ষীণাং যথাঙ্গিরাঃ।
যথার্থ নামা ভগবান্ যস্য জ্ঞাননিধিগুরুঃ।” (ম. চ. ১/৫)
দক্ষিণাপথের পদ্মপুর তাঁর পূর্বপুরুষের বাসস্থান। সেখানে কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখাধ্যায়ী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণেরা থাকতেন। এই ব্রাহ্মণ পরিবারের গােত্র নাম কাশ্যপ ও বংশনাম উদুম্বর। তাঁরা বেদশান্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁরা যে বিশেষ একটি বৈদিক শাখার বিদ্যালয় পরিচালনা কিংবা অধ্যাপনা করতেন ‘চরণগুরবঃ’ বিশেষণটি তারই প্রমাণ। ধর্মব্রত এই পরিবার পঞ্চযজ্ঞাগ্নি রক্ষণ, সােমযাগ ইত্যাদি ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন।
বৈদিকশিক্ষা ও ধর্মানুরাগে তাঁরা উচ্চসম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন সেজন্য তাঁদেরকে পংক্তিপাবন বলা হত। এই বংশে মহাকবি নামে একজন জন্মগ্রহণ করেন, তিনি বাজপেয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। খ্যাতনামা এই পুরুষের পঞ্চম উত্তরসূরী কবি ভবভূতি। পিতামহ ভট্টগােপাল, পিতা নীলকণ্ঠ এবং মাতা জাতুকর্ণী। শাস্ত্রজ্ঞ যথার্থনামা জ্ঞাননিধির শিষ্য ছিলেন ভবভূতি। তিনি তাঁর পান্ডিত্যের জন্য শ্ৰীকণ্ঠ উপাধি লাভ করেছিলেন।
ব্যাকরণ, মীমাংসা এবং তর্কশাস্ত্রে তিনি পান্ডিত্যের কথা বলেছেন। প্রসঙ্গত জানিয়েও দিয়েছেন বেদের সঙ্গে তাঁদের বংশগত সম্পর্ক কত গভীর। অঙ্গিরার উল্লেখে, সোমযাগের উল্লেখে বোঝা যায় ভার্গবাঙ্গিরসদের কট্টর ধারার সঙ্গেই তাঁদের বা তাঁর সম্পর্ক।
মালতীমাধবে ভবভূতির পূর্বপুরুষের গৌরব প্রসঙ্গে অধিক বিবরণ পাওয়া যায়। ‘তাঁরা তত্ত্বনিশ্চয়ের জন্য নিত্য জ্ঞানের অর্থাৎ পরাবিদ্যার অনুশীলন করতেন, ইষ্ট ও পূর্তকর্মে অর্থ বিনিয়ােগ করতেন, সন্তান কামনায় দার পরিগ্রহ করতেন এবং তপস্যার জন্য পরমায়ু কামনা করতেন।’ এই সকল আত্মপরিচয় একত্র করলে স্পষ্ট বোঝা যায় বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদি-রীতিনীতি এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট অহংকার ছিল। তাঁর রচিত রূপকে স্বাভাবিক ভাবেই বেদ ও ব্রাহ্মণের বাক্যই যথেষ্ট তাই। রাম, যোদ্ধা স্ত্রী কেন বধ করবেন এই পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা ছেড়ে ব্রাহ্মণ্য ভাবনার অধীন হলেন। এরই সঙ্গে ভার্গবাঙ্গিরস ধারায় নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গী তারও স্থান হল এখানে।
বিশ্বামিত্রের আদেশের ফলে তাটকা বধ সম্পন্ন হল। সীতা ভয়ার্ত হয়েছিলেন কিছু মূহুর্তের জন্য। লক্ষ্মণকে দেখেছি উল্লাস করতে তাটকার মৃত্যুতে। রাজা কুশধ্বজও রাক্ষসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ধনুর্বাণ প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু রাম তাটকা বধ সম্পন্ন করলেন। সমগ্র ঘটনাটি দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলেন রাক্ষস সর্বমায়। যিনি বৃদ্ধ বলে আর সমরকুশল নয়। তাটকা, তাঁর স্বজাতি হলেও তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না এ যুদ্ধে তাটকার পক্ষে অংশগ্রহণ করা।
তিনি ঠিক কি দেখলেন? শুধু তাটকা বধ? না। তিনি দেখলেন লাউ জলে ডুবে যাচ্ছে, পাথর ভাসছের মত অলৌকিক ঘটনা যেন ঘটলো – এই তাটকা বধের মাধ্যমে। রাক্ষসরাজের পরাক্রমের অবসান শুরু হতে দেখলেন এক মানবশিশুর হাতে। আসলে দেখলেন রাক্ষস বিরোধী যুদ্ধে বৈদিক মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে মিথিলা ও ইক্ষ্বাকু ক্ষত্রিয়রা এক সারিতে এবারে দাঁড়ালেন। এই অঙ্কেই বিশ্বামিত্র স্বগতোক্তি করবেন, সমস্ত রাক্ষস ধ্বংস রূপ বেদের এটা তো সবে মাত্র ওঁকার। এবং নাটককার জানিয়েও দেবেন, বিশ্বামিত্রের এই সংলাপের মাধ্যমে, রামের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বেদ-বিরোধী সকল রাক্ষস নিধানের বিজয়োল্লাস রচনাও তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্য।
সর্বমায় আবার চেষ্টা করলেন রাবণের প্রস্তাব উত্থাপনের। কিন্তু বিশ্বামিত্র সীরধ্বজ রাজা অর্থাৎ জনকের কাছেই সে প্রস্তাব নিবেদন করতে হবে জানিয়ে দিলেন। তারপরেই সর্বমায়কে সামনে রেখে রামকে প্রদান করলেন তাঁর গুরু কৃশাশ্বের কাছ থেকে পাওয়া দিব্যাস্ত্রসমূহ। রাম সে সকল ভাগ করে নিলেন লক্ষ্মণের সঙ্গে। তাটকা বধের মাধ্যমে বিশ্বামিত্রের আদেশ পালন করে যে আনুগত্য রাম দেখিয়েছেন তারই ফলশ্রুতি এ সকল দিব্যাস্ত্র লাভ।
অর্থাৎ আগে পরীক্ষা, তারপরে ফল। এই ঘটনাসমূহে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যাচ্ছে রাক্ষসবধ স্বরূপ যে বেদের কথা বিশ্বামিত্ররা ভাবছেন সেই বেদে রামের ভূমিকা অনুগত সৈনিকের। দেবতারাও রামের পক্ষ নিতে শুরু করলেন নানা বাদ্যধ্বনি ইত্যাদির মাধ্যমে। এইখানে এল হরধনু ভঙ্গের পালা। রামের সঙ্গে সীতার বিবাহ জনকের সুকঠিন শর্তের জন্য অসম্ভব, এই নিয়ে কুশধ্বজের যে আক্ষেপ তাও মিটে গেল। বিশ্বামিত্রের স্মরণ মাত্র সে হরধনু তাঁর আশ্রমে উপস্থিত হল। রাম সে হরধনুতে জ্যা পরানো মাত্র হরধনু ভঙ্গ হল। এ ঘটনাও ঘটল রাক্ষস সর্বমায়ের সামনে।
অঙ্ক এখানে সমাপ্ত না হলেও আমাদের দেখে নিতে হবে বাল্মিকী রচিত বলে কথিত রামায়ণের প্রচলিত কাহিনীস্রোত থেকে ভবভূতি কতদূর গমন করেছেন নাটককারের স্বাধীনতায়। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রাম-লক্ষ্মণকে আনার কাহিনী আছে সেখানে। কিন্তু জনকের ভ্রাতার সীতা ও উর্মিলাকে নিয়ে আগমনের কোনো কাহিনীই নেই। অর্থাৎ কুশধ্বজের রামকে জামাতা রূপে পাবার আকাঙ্খা রামের বীর্যবত্তা ও চরিত্র দর্শনে, এমন কোনো সম্ভাবনা সেখানে ছিল না। ছিল না প্রথম দর্শনে রাম-সীতা বা লক্ষ্মণ-উর্মিলার প্রণয়ের সম্ভাবনা। সে কাহিনী-স্রোতের কৌতুহলদ্দীপক কিছু অংশের কথা বলে নেই এবারে।
প্রচলিত বাল্মিকী কথিত রামায়ণে বিশ্বামিত্রের আশ্রম থেকে রাক্ষস নিধন করে মিথিলার দিকে রাম-লক্ষ্মণ যাত্রা করেন। বিশ্বামিত্রই সে পথে নিয়ে চলেন তাঁদের। পথে অন্যান্য নানা কাণ্ডের সম্পর্কে তাঁরা জ্ঞাত হয়েছেন। তারপরে অহল্যা-উদ্ধার করেছেন। এইখানে আরেকবার আমাদের আসতে হবে অহল্যা প্রসঙ্গে। ভবভূতির কাহিনীর সঙ্গে অহল্যা-কাহিনীর বিরোধ এখানে আছে। গৌতম-পত্নী অহল্যা এখানে জানতেন যে সহস্রাক্ষ ইন্দ্র গৌতমের মূর্তি ধরে এলেও, আদপে তিনি ইন্দ্রই। তাঁর কৌতুহল হয় দেবতা-সম্ভোগ জানার। সেই কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই তিনি ইন্দ্রের সঙ্গে রমণ করেন। তারপরে ইন্দ্রকে শচীপতি জেনেই গৌতম আসার আগেই বিদায় নিতে বলেন, যাতে তাঁর এবং ইন্দ্রের মান অক্ষুণ্ণ থাকে। গোপনও থাকে এ কাজ।
কিন্তু আসল ঋষি গৌতম ইন্দ্রের বিদায়কালে দ্বারে উপস্থিত হ’ন। ইন্দ্রকে ছদ্ম-গৌতম বলে চিনতেও পারেন। ক্রোধে ইন্দ্রের অণ্ডদ্বয় খসে যাবার অভিশাপ দেবেন তিনি। আর অহল্যাকে অভিশাপে সকল প্রাণীর চোখে অদৃশ্য করে নিরাহারা অবস্থায় বহুযুগ পরে রামের আগমনে শাপমুক্ত হবার বিধান দেবেন। ইন্দ্রের অণ্ডকোষদ্বয় দেবতাদের অনুরোধে পিতৃগণ কর্তৃক মেষের অণ্ড দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, কাহিনী অনুসারে।
অহল্যা, বিশ্বামিত্রের সহযোগে রামের আগমনে শাপমুক্ত হলেন। অর্থাৎ এই মহাবীরচরিত-এর প্রথম অঙ্কে অহল্যার অন্ধতমিস্রারূপ নরকে গমন এবং অহল্যার পাষাণীরূপ লাভ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তার সঙ্গে উপরোক্ত কাহিনী মেলে না। ইন্দ্রকে সামান্য অহল্যার উপপতি বলে ব্যাঙ্গ বা তাচ্ছিল্য করা আর অণ্ডকোষ খসিয়ে দেওয়া দুয়ের মধ্যে ক্রোধের মাত্রার অনেকটাই পার্থক্য আছে। তাছাড়া অণ্ডকোষ খসিয়ে দেওয়া, ছিঁড়ে নেওয়া ইত্যাদি পদ্ধতিগুলি ইন্দো-ইরানিয়ান ইন্দো-ইউরোপিয়ানদের পুরাণগুলিতে আরো পাওয়া যায়। বীর্যের মাধ্যমেই পুরুষের বংশধারায় সম্পদ চালন, অণ্ডকোষ তার সেই ক্ষমতাকে এবং প্রকারান্তরে তার আধিপত্যকে ক্ষুণ্ণ করার পদ্ধতি।
পুরাণতত্ত্ববিদেরা অনুসন্ধান করতে পারেন দেব এবং মুনি-ঋষিদের সম্পর্কের বিবর্তনের বিষয়। সে ক্ষেত্রে এই সকল পুরাকাহিনী তাঁদের কাজেও লাগবে। রামায়ণের প্রচলিত কাহিনীতে দেবরাজকে পরসম্পদ লোলুপতার জন্য শাস্তি দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হবে সেক্ষেত্রে। ইন্দ্রপূজকদের প্রতিপত্তি কমারও নিদর্শন বলা চলে একে।
কিন্তু ভবভূতি যখন নাটকটি রচনা করছেন তখন কি অহল্যা কাহিনী এ ভাবে প্রচলিত ছিল না? থাকলে তিনি এর পরিবর্তন করলেন কেন? ইন্দ্রকে তাচ্ছিল্য করাটুকুই রাখলেন কেন? নাকি ভবভূতির সময়েও দেব ইন্দ্রের পূজারীরা বেশ সবলই ছিল, তাই অণ্ডকোষ খসার মাত্রায় পৌঁছতে পারা যায়নি? অথবা এও কি সম্ভব যে বাল্মিকীর নামে প্রচলিত যে রামায়ণ সেখানে এই অণ্ডকোষ খসার কাহিনী পরে যুক্ত হয়েছে, যখন ইন্দ্রপূজকদের প্রাধান্য ঐ সমাজে আর তেমন নেই?
বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র বিরোধও ভবভূতির কাহিনীতে গুরুত্ব পায়নি। বরং শুরু থেকেই এঁরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবান এবং আস্থাবান। তাহলে কি এমন সময় তিনি রচনা করছিলেন যখন এই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বিরোধ নিতান্তই দূরাগত অতীতের ছায়া? কিম্বা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়’র জোট বৈদিক ধর্ম রক্ষার্থে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল বলে পূর্ববর্তী সব বিরোধকে এড়িয়েই যাত্রা করা হচ্ছে?
সে প্রশ্নের পরোক্ষ উত্তর আছে এই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে। সে অঙ্ক আলোচনার সময় আমরা তা দেখব। ক্ষত্রিয় রাজা থেকে রাজর্ষি এবং সবশেষে ব্রহ্মর্ষি হয়েছিলেন বিশ্বামিত্র। লাভ করেছিলেন ব্রাহ্মণত্ব। অর্থাৎ রামায়ণের প্রচলিত কাহিনীও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ব্রাহ্মণত্ব লাভ সম্ভব এ কথা স্বীকার করেছিল। বর্ণপ্রথা, অচল অটল কিছু নয় এমন প্রমাণ রেখেছিল। আমাদের আলোচ্য নাটকে যদিও এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হরধনু ভঙ্গ, সে কারণে সেদিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু বাল্মিকী প্রণীত বলে প্রচলিত রামায়ণের ক্ষেত্রে শিব এবং বিশ্বামিত্র সম্পর্ক সম্বন্ধে এবং ইন্দ্র-বিষ্ণু সম্পর্কে কয়েকটা কথা লেখা নিতান্তই প্রয়োজন। তাহলে হরধনু ভঙ্গের তাৎপর্য আরো কিছুটা পরিস্কার হবে।
বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠের কাছ থেকে হোমধেনু কেড়ে নেবার চেষ্টায় বিফল হয়ে যখন তপস্যার শক্তি সম্পর্কে আস্থাশীল হলেন তখন তিনি তপস্যার দ্বারা শিবের কাছ থেকে বরপ্রাপ্ত হলেন। সেই বরের দ্বারাই তিনি দেব, গন্ধর্ব, মহর্ষি, যক্ষ, দানব, রাক্ষস সকলের অস্ত্র অধিগত হলেন। অর্থাৎ দিব্যাস্ত্র সকল প্রাপ্তি তাঁর মহাদেব শিবের আনুকূল্যে।
কিন্তু ভবভূতি তাঁর নাটকে দিব্যাস্ত্র সমূহ ভগবান কৃশাশ্বর থেকে প্রাপ্ত বলেছেন। এই কৃশাশ্ব অন্যত্র প্রজাপতি কৃশাশ্ব বলে কথিত। আবার ইক্ষ্বাকু বংশেও কৃশাশ্ব বলে এক রাজার সন্ধান পাওয়া যায় পুরানে। সে যা-ই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে মহাদেবের পরিবর্তে কৃশাশ্বের উল্লেখ কেন ভবভূতিতে? রামায়ণ গানের ভিন্ন ভিন্ন ধারা প্রচলিত থাকার কারণে এমন সম্ভব হতে পারে কি? যে কারণে বিংশ শতকের প্রথমে বিশ্বনাথ-চতুষ্পাঠীর প্রতিষ্ঠাতা এক বিশ্বনাথের কথা পাওয়া যাচ্ছে যিনি তৎকালে বাল্মিকী রামায়ণ বলে পরিচিত রামায়ণের আদি কাণ্ড অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদ বিশ্বনাথ রামায়ণ বলে পরিচিত। সে রামায়ণে আবার ভবভূতির মতই দিব্যাস্ত্র সমূহ বিশ্বামিত্র প্রজাপতি কৃশাশ্বের থেকে পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ।
এই অস্ত্র কার থেকে লাভ করেছেন এ কথা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? আসলে ইন্দ্রপূজকদের মতই এই ভূখণ্ডের এক বিপুল সংখ্যক অধিবাসী শিবপূজক। শিব বৈদিক দেবতা না। শিব, মহেশ্বর, পশুপতি, হর ইত্যাদি নানা লৌকিক দেবতা সম্মেলনেই সম্ভবত দেবাদিদেব মহেশ্বরের আবির্ভাব সংস্কৃত পুরাণ ও মহাকাব্যদ্বয়ে। অর্থাৎ এই ধারাটি যথেষ্ট শক্তিশালী ধারা।
কিন্তু ভবভূতির নাটকে এই ধারার শক্তি বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাঁর ধারাটি বৈদিক এবং বৈষ্ণব মতাশ্রয়ী। সেই মত প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি রামকে শুধু অবতারই প্রতিপন্ন করতে ইচ্ছুক এমন নয়, রামকে তিনি সর্বগুণাণ্বিত ঈশ্বরে প্রতিপন্ন করতে ইচ্ছুক। রামায়ণের প্রচলিত ধারার মতই তাঁর নাটকেও অহল্যা-মুক্তি, গৌতমাদির বন্দনা তাই অবিকৃত ভাবেই ঠাঁই পেয়েছে। দিব্যাস্ত্র সমূহ লাভ এবং তাটকা বধের পরেই রাম হরধনু ভঙ্গ করছেন।
ভবভূতির নাটকে না থাকলেও বাল্মিকীর রচনা বলে প্রচলিত রামায়ণে হরধনু জনক কেমন করে লাভ করলেন তার পরিস্কার বর্ণনা আছে। সে বর্ণনা আমাদের জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে কিছুটা বোঝা সম্ভব হরধনু আছে, অথচ তা জনক কেমন করে পেলেন সে কথা এখানে নেই কেন! সে কাহিনী বলছে নিমির বংশধর জনকের পূর্বজ রাজা দেবরাতের হাতে মহাদেবের এই ধনু কেমন করে এসেছিল।
দক্ষযজ্ঞে, প্রজাপতি দক্ষ শিবকে অপমান করার উদ্দেশ্যেই আমন্ত্রণ জানাননি। যদিও শিব তাঁর জামাতা স্থানীয়। সেই অপমানে সতীর প্রাণত্যাগ। এই ক্রোধে মহাদেব দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করলেন। তাঁর ক্রোধ থেকে দেবতারাও রেহাই পেলেন না। তিনি এই ধনু ধারণ করে দেবতাদের বললেন, হবির ভাগ তাঁর প্রাপ্য। সেই হবির্ভাগার্থী তিনি হওয়া সত্ত্বেও দেবতারা দক্ষকে সে ভাগ দিতে বলেননি বা নিজেরাও নির্দেশ করেননি। তাই তিনি তাঁদের মুণ্ডচ্ছেদন করবেন সেই ধনু দিয়ে।
দেবতারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলে তিনি অবশেষে সেই ধনু দেবতাদেরই দান করেন। এ কাহিনী জানাচ্ছে দেবসমাজ, ব্রহ্মা-বিষ্ণু থাকা সত্ত্বেও শিবের শ্রেষ্ঠত্ব মানে। এ শিব-মাহাত্ম্য প্রচারের শৈব কাহিনী। কালে কালে সে ধনু দেবতাদের থেকে দেবরাতের হাতে ন্যাস্ত হয়। তাঁর বংশধর মিথিলাপতি জনক সেই ধনুকে জ্যা পরানোর পণ রাখলেন লাঙলের ফলায় উত্থিতা সীতার জন্য। কন্যাকে তিনি বীর্যশুল্কা করলেন। অনেকানেক রাজা এলো, তারা সে পণে পরাজিত হল। অক্ষমতার ক্রোধে দল বেঁধে তারা মিথিলা আক্রমণ করে যেতে লাগলেন। এক সময় দেবতাদের সহায়তায় জনক তাঁদের পরাজিত করলেন। তারপরে বিশ্বামিত্র সহযোগে রাম এসে সে হরধনু ভঙ্গ করে সীতালাভ করবেন।
এই সকল ঘটনাকে ভবভূতি একেবারেই অন্য পন্থায় নিয়ে এসেছেন তাঁর নাটকের প্রথমাঙ্কে। হরধনু ভঙ্গ করতে রামকে যেতে হয়নি, বিশ্বামিত্রের স্মরণমাত্র সে হরধনু চলে এসেছে বিশ্বামিত্রের আশ্রমে। সর্বমায়ের সামনেই সে হরধনু ভঙ্গ করে সীতালাভ করলেন রাম। লক্ষ্মণের উর্মিলা লাভ হল। শুধু তাই নয়, কুশধ্বজের দুই কন্যাও ভরত এবং শত্রুঘ্নের জন্য চেয়ে নিয়েছেন বিশ্বামিত্র।
সর্বমায় তার মধ্যে তাঁদের মনে করিয়েছেন, রাবণকে অবহেলা করার ফলাফল ভাল হবে না। সীতাকে যেতেই হবে লঙ্কায়। অন্যভাবে, অর্থাৎ বন্দিনী হয়ে যেতে হবে। এ সব কথার মধ্যেই সুবাহু এবং মারীচ, তাটকার মৃত্যু সংবাদে সসৈন্য আক্রমণ করে বিশ্বামিত্রের আশ্রম। রাম-লক্ষ্মণ যৌথভাবে যুদ্ধে নির্গত হলেন তাদের বধার্থে। বিশ্বামিত্র আবার শ্লাঘার সঙ্গে বললেন, অথর্ববেদের ভয়ঙ্কর অভিচার ক্রিয়ার মতই রাম বেদবিরোধী সমস্ত ব্রাহ্মণশত্রুকে বিনাশ করবেন। অর্থাৎ ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণে যে যুদ্ধ বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠে ঘটেছিল, সে অতীতকালের বিষয়। সন্ধিই এখন মূল উৎসবের কারণ।
এর মধ্যেও একটি কৌতুহলজনক ভাবনা আমাদের জন্মায়। সেটি এই নাটক প্রসঙ্গেও বটে, আবার প্রচলিত রামায়ণ প্রসঙ্গেও বটে। জনক হরধনু ভঙ্গের পণ কেন রাখলেন? এই কথাটা খুব একটা স্পষ্ট হয় না বয়ানে। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে যেমন খুব ভাবনাচিন্তা করেই দ্রুপদ লক্ষ্যভেদের ব্যবস্থা করেছেন, সীতা-রামের কাহিনীতে তেমন ভাবনা কোথাও ছিল না? শুধু দেবরাতের হাতে ন্যাস্ত ধনুটি ছিল বলেই এমন হল?
রামায়ণ বা ভবভূতির নাটক সে বিষয় নীরব। অনুমান করা চলে কি? আমাদের ছোটবেলায় শোনা নানা গল্পের মধ্যে রাবণের হরধনু ভঙ্গ করতে আসার গল্পও শুনেছিলাম। কিন্তু বাল্মিকীর রামায়ণ বলে যা প্রচলিত তাতে এমন কিছু নেই। ভবভূতির নাটকে তো স্পষ্টই রাবণ কোনো পণের কথা তুলছেনই না। তিনি সোজাসুজি সীতাকে বিবাহ করতে চাইছেন। জনকের পণকে গুরুত্ব দেবার প্রসঙ্গই নেই রাবণের তরফে সর্বমায়ের বয়ানে। তাহলে?
আমরা মনে রাখি রাবণ শৈব। রাবণ এত বড় ভক্ত যে শিবও তাঁর প্রতি বিমুখ হতে পারেন না। সেই রাবণ হরধনু, অর্থাৎ তাঁর পূজ্যের ধনুর্ভঙ্গ করবেন, তা হয়? হরধনু রাবণ ভঙ্গ করবেন না, এই ভাবনাতেই জনক হরধনু ভঙ্গের পণ রাখেননি তো? অর্থাৎ শৈবের বিরুদ্ধে শৈব অস্ত্রকেই প্রয়োগ করেননি তো? এমন একটি ভাবনার ইঙ্গিত আছে ‘দেবীভাগবত পুরাণ’-এ। সেখানে রাবণ সীতাকে বলছেন, জনকের কাছে সীতাকে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু হরধনু স্পর্শ করার সাহস হয়নি বলে স্বয়ংবরে যাননি। ‘রুদ্রচাপভয়ান্নাহং সম্প্রাপ্তস্তু স্বয়ংবরে’।আবার হরধনু রাম ভঙ্গ করলে শৈব মাহাত্ম্য খণ্ডন করে বৈষ্ণব মাহাত্ম্যের সূচনা হবে, এমন সম্ভাবনা প্রচ্ছন্ন রেখেও প্রচলিত রামায়ণ এবং ভবভূতির নাটক, এ প্রসঙ্গ অবতারণা করেনি তো?
আমরা স্পষ্টত জানি না। শুধু কৌশল হিসেবে এ যে মন্দ নয় তা মাথায় রাখতে পারি। কেন না শিবের অস্ত্রের অসম্মানে শৈবের প্রত্যাঘাত আমরা পরবর্তী অঙ্কেই দেখতে পাব। তখন আমাদের মেলাতে সুবিধে হবে ভাবনাটি।
দ্বিতীয় অঙ্ক
দ্বিতীয় অঙ্কে আসবেন রাবণের প্রধান উপদেষ্টা মন্ত্রী মাল্যবান। তিনি প্রথম অঙ্কে ঘটে যাওয়া রামের যাবতীয় কাণ্ডকারখানা শুনেছেন সর্বমায়ের কাছ থেকে। মারীচ-সুবাহু এবং তাদের সৈন্যদের বধ্যে লক্ষ্মণের বীরত্বের কথাও জানেন। দেবতারা, রাম, জনক সব এখন রাবণের বিপক্ষে সমবেত হচ্ছে। তিনি চিন্তিত। এমন সময় প্রবেশ করবেন শূর্পণখা। রাম-সীতার বিবাহ সংবাদ নিয়ে আসেন তিনি। বিশ্বামিত্র ছাড়াও মুনি অগস্ত্যও যে রামকে মহেন্দ্রধনু দান করেছেন সে সংবাদও আনেন।
মাল্যবান এ সব সংবাদে আরো বিমর্ষ। ক্ষত্রিয়ের অস্ত্র আর ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ দুই-ই অব্যর্থ। আর ব্রাহ্মতেজ-ক্ষত্রতেজ মিলিত হওয়ায় তা দুর্ধর্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মাল্যবানের মন্তব্য। এই মন্তব্যের মাধ্যমে নাটককার আমাদের পূর্বের সংশয়েরও অবসান ঘটালেন। বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠ বিরোধ তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন এই কারণেই। তাঁর প্রকল্পে আছে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় যুক্তশক্তি যা কাজ করবে অবৈদিকদের বিরুদ্ধে। তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করবে।
সে ভীতিকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন শূর্পণখা। রাম সামান্য মানব। তাকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? তার উত্তরে মাল্যবান জগতে রামের বিশিষ্টতা প্রকাশ করেন। রাম দেবতাদের পূজণীয়, বেদচিহ্নিত ধর্মের রক্ষক ইত্যাদি ভাবনা প্রকাশ করেন। ব্রহ্মা, রাবণকে বর দেবার সময় যে মর্ত্যজীব থেকে বিপদের কথা বলেছিলেন সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
এ অংশে নিজেদের বংশগরিমার কথাও স্মরণ করেন। ব্রহ্মার সাত পুত্রের বংশধারার মধ্যে এক ধারা তাঁরা পুলস্ত্যবংশীয়রা। তাঁদের ধারা, জগতের এবং জনকের বন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও জনক, রাবণকে সীতার অযোগ্য মনে করলেন কেমন করে এ প্রশ্নও উত্থাপন করেন। এখানে নাটককারের খানিক দুর্বলতা বাড়তে থাকে। জনক কেন অযোগ্য মনে করলেন তার স্পষ্ট উত্তর নেই। আবার এখানে দাশরথি রামকে যে রাবণের অরি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার কারণও স্পষ্ট নয়। ইক্ষ্বাকু বংশের সঙ্গে বংশগত বিরোধ বলেই অরি? সীতাকে বিবাহ করে নেবার জন্য অরি? তা এখানে তত স্পষ্টও নয়। যা স্পষ্ট তা মাল্যবানের ভয়, সীতা না পাওয়ায় রাবণের বিষণ্ণতা এবং সীতা-বিষয় রাবণের সিদ্ধান্ত বলদৃপ্ত হবে সে সব সম্ভাবনা।
এর পরেই এই অঙ্কে ভবভূতি একটি চমৎকার কূট অংশের অবতারণা করেন। প্রচলিত রামায়ণে এ অংশও এভাবে উপস্থাপিত নয়। ভবভূতি, রাজ্যপরিচালনার কূটনীতি, ষড়যন্ত্রের নেপথ্যছায়া বুননকে মাল্যবানের পরিকল্পনার মাধ্যমে যেভাবে উপস্থিত করেছেন তা দর্শক বা পাঠককে অবশ্যই চমকিত করবে। তবে নাটকগত ভাবে ষড়যন্ত্রটি যতটা ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে এলে এই চমক আরো অভিনব হত তা হতে পারেনি। রাবণ, পরশুরাম, শিব এবং রাম – এই চমকপ্রদ অংশে কতগুলি পরস্পরবিরোধী সুতোয় আটকে যাচ্ছেন।
শূর্পণখার সঙ্গে কথা বলার সময়েই এক রাক্ষস প্রতিহারী পরশুরামের পত্র আনছেন মাল্যবানের কাছে। শূর্পণখার সামনেই মাল্যবান পাঠ করছেন সে পত্র। পরশুরাম, তাঁর পত্রে মাল্যবানের মাধ্যমে রাবণকে জানিয়েছেন, তিনি ক্ষুব্ধ। দণ্ডকারণ্যে যাঁরা উপাসনা করেন তাঁদের তিনিই অভয় দান করে থাকেন। তাঁর দ্বারা রক্ষিত তাঁরা সকলে। সেখানে বিরাধ, দনুকবন্ধ প্রভৃতি রাক্ষসেরা অত্যাচার করে চলেছে। তাদের বারণ করতে হবে। নতুবা, তাঁর এবং রাবণের মধ্যে শৈব হবার দরুন যে প্রীতি তা নষ্ট হবে। পরশুরাম দুঃখিত বা ক্রুদ্ধ হবেন।
মাল্যবান ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পত্রের। বলছেন, পরশুরাম তাঁদের প্রতি শৈব অনুরাগ পোষণ করেন। তাই তাঁদের মন্দ কাজের ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ হ’ন, কঠোরও হ’ন। পরশুরাম কঠোর হলে তা ভয়াবহ। রাবণকে পরাজিত করার পর থেকে কার্তবীর্জার্জুন উদ্ধত আচরণ শুরু করেছিল। পরশুরাম, সে আচরণসমূহের জন্য তাকে নিধন করে ক্ষত্রিয়বধ পালা শুরু করেন।
এই ব্যাখ্যা দিতে দিতেই মাল্যবানের পরিকল্পনা সেজে ওঠে। হরধনু ভঙ্গ করেছে রাম। এ যদি শম্ভূর ভক্ত পরশুরামের হৃদয়ে বেজে থাকে তাহলে পরশুরাম-রাম যুদ্ধ অনিবার্য। সে যুদ্ধে উভয়েই যদি হত হ’ন তাহলে পরমানন্দ। রাবণের রামের মত শত্রুও থাকলেন না, পরশুরামের মত দর্পী মিত্রও থাকলেন না যিনি শত্রু হতেও পারেন।
অন্যথায় রামকে হত্যাই করুন পরশুরাম। তাহলেও শত্রুবিনাশ হবে। পরশুরাম বনবাসী বলে আবার বনে চলে যাবেন। কিন্তু পরশুরাম যদি পরাজিত হ’ন তাহলে রাম তাঁকে হত্যা করবেন না। তিনি ব্রাহ্মণভক্ত আর পরশুরাম ব্রহ্মর্ষি। সেক্ষেত্রে বিপদ হল পরশুরাম লজ্জায় বনে চলে যাবেন অস্ত্রত্যাগ করে। রামের আশেপাশে দেবতারা জড়ো হবেন। রাবণের বিপদ আরো ঘনিয়ে আসবে। সেই বিপদ মাথায় নিয়েই মহেন্দ্রদ্বীপে শূর্পণখাকে নিয়ে পরশুরাম সকাশে গেছিলেন মাল্যবান।
এই ছোট্ট মিশ্রবিষ্কম্ভটি সমাপনের পরে আসে সেই অংশ যেখানে পরশুরাম স্বয়ং উপস্থিত হবেন বিদেহনগরীতে। মাল্যবান, শূর্পণখা তাঁকে রামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এসেই তিনি কে, সেই ঘোষণা সদর্পে করে জানাবেন রামের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েই তাঁর আগমন।
তাঁর এই ঘোষণায় শঙ্কিত সীতা লোকলজ্জা ত্যাগ করে রামকে আলিঙ্গণ করে রেখেছেন। যেতে দেবেন না পরশুরাম সকাশে। ওদিকে পরশুরাম দ্রুত অন্তঃপুরেই প্রবেশ করছেন। রাম তাঁর মুখোমুখি হবেন বলে সীতার বাহুবন্ধন মুক্ত হয়ে পদচারণা করছেন। চারিদিকে হায় হায় রব উঠছে। সীতা আবার তাঁকে আটকাচ্ছে। রাম সে বন্ধন একাধারে উপভোগও করছেন, অন্যদিকে পুনর্বার সীতার বন্ধন ছাড়িয়ে ক্ষাত্র কর্তব্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে পরশুরামের সম্মুখীন হতেও চললেন। পরশুরাম ওদিকে নিজেকেই জানাচ্ছেন, তাঁর শান্ত হবার পরিণাম ক্ষত্রিয়দের এই উত্থান। এমন সংঘাতময় অবস্থায় দুজনে মুখোমুখি হলেন।
প্রাথমিকভাবে পরশুরামের আকর্ষণ তৈরী হয় রামের প্রতি। রামের শিষ্টাচার, গাম্ভীর্য, বীরত্ব ইত্যাদির কারণে। নাটককার এখানেও রাম-মাহাত্ম্য প্রকাশে এত উদগ্রীব যে পরশুরামকে দিয়ে রামের একপ্রকার স্তব করিয়েও নিচ্ছেন। অর্থাৎ সাধারণ ক্ষত্রিয় নয় রাম, বিশেষ ক্ষত্রিয় সে কথা আবার স্মরণ করাচ্ছেন উপস্থিত সকলকে।
এই সব অতিরেক পার হয়েও দ্বন্দ্ব লাগে পরশুরাম এবং রামের। তার কারণ রামের পরশুরামের প্রতি সম্মান পূর্বক অবহেলা প্রদর্শন। রাম বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরশুরামের তিনি গুণগ্রাহী। পরশুরাম পূজনীয়। কিন্তু রাম তাতে ভীত এমনও নয়। জনক ও অঙ্গিরার পৌত্র তথা গৌতম পুত্র শতানন্দ, যিনি জনকের পুরোহিত – তাঁরা প্রবেশ করেন। ততক্ষণে রাম ক্রমাগত ব্যঙ্গ করে চলেছেন পরশুরামকে ধীর শান্ত থেকে। তাঁর প্রতি পরশুরামের করুণা প্রকাশকেও ব্যঙ্গ করছেন। অর্থাৎ রাম গুরুজনদের অনুমতির অপেক্ষায় শুধু, যুদ্ধারম্ভের জন্য।
ভার্গবাঙ্গিরস অনুসারী ভবভূতির গর্বের আরেকটি কারণ হল সীতার পিতা জনকের পুরোহিতও আঙ্গিরস গৌতম। এ গর্ব ছাড়াও ভবভূতির সীতা চরিত্র নির্মাণটিও দেখার। ভাসের মত সীতা নির্মাণ তিনি করছেন না। তাঁর সীতা প্রায় লবঙ্গলতিকা। অল্পেতেই ত্রস্তা। সারাক্ষণ তাঁকে রক্ষা না করে চললেই বিপদ। এমন ভঙ্গুর সীতা, ব্রাহ্মণ্যবাদী নারীচিন্তার সঙ্গে অবশ্য ভালই খাপ খায়। নারী যে অবলা, বুদ্ধিহীনা থেকে একা কিছুই করতে সক্ষম নয়, এ সব ভাবনাকে প্রকাশ করার জন্য এ জাতীয় চরিত্র অব্যর্থ।
এখানে নাটক আরো চরিত্রের আমদানি করে। সে সব চরিত্র পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে যায়। ভবভূতির উদ্দেশ্য-বিধেয় বোঝার জন্য এই চরিত্রদের পারস্পরিক কথোপকথন ও ঘটমানতার কথা জানা আমাদেরও প্রয়োজন। রাজা জনক, প্রথমেই জানেন পরশুরাম ব্রাহ্মণ হলেও আমন্ত্রণ নিতে নয়, শত্রুতা করতেই এসেছেন। অতএব তিনি প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য।
শতানন্দকে দেখে তাঁকে সম্ভাষণ করে সে কথাটাই আবার মনে করিয়ে দেন পরশুরাম। শতানন্দ তাঁকে অন্তঃপুরে আগমনের বিষয় নিয়ে কটাক্ষ করলে, পাল্টা কটাক্ষ করেন তিনি – বনবাসী বলে তিনি রাজগৃহের নিয়মাদি জানেন না বলেন। রাম স্বগতোক্তিতে পরশুরামের দাপটের কারণ চিহ্নিত করেন ব্যঙ্গের মাধ্যমে। একদা পরশুমার বিশ্ব নিঃক্ষত্রিয় করেছেন একুশবার। তারপরে সেই বিজীত ভূমি সকল দান করেছেন ঋষি কাশ্যপকে। সেই ভূখণ্ডে এখন যে ক্ষত্রিয়রা অধিপতি তাঁদের তিনি তাঁর অধীন সামন্তরাজ মনে করেন। তাই কন্যান্তপুরে প্রবেশ নিয়েও পরশুরামের কোনো অস্বস্তি নেই।
নাটকের এই অবস্থায় রামকে মঙ্গলসূত্র মোচনের জন্য অন্তঃপুর থেকে ডাক দেওয়া হয়। রাজা জনক এবং শতানন্দও তাঁকে অন্তঃপুরে যেতে বলেন। রাম প্রকারান্তরে পরশুরামের অনুমতি চাইলেন, পরশুরামও লোকাচারের মর্যাদা রেখে রামকে দ্রুত সে সব সেরে আসতে বললেন। তাঁদের দ্বন্দ্ব হবে, কিন্তু লোকাচার সম্পন্ন হবার পর। অর্থাৎ পরশুরাম ক্রুদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণ্য লোকাচার-রীতিনীতি মানতে ভুলছেন না। এখানেই সংবাদ আসবে বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র, মহারাজ দশরথের সঙ্গে আছেন। তাঁরা সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
Posted in: ARTICLE, October 2021 - Serial