‘ছন্দে লেখা’ বনাম ‘ছন্দ লেখা’: শোভন ভট্টাচার্য
‘কথা’ থেকে কোনো বাক্যের ‘কবিতা’ হয়ে ওঠার রহস্যময় প্রক্রিয়ামধ্যে ছন্দ একটি অত্যাবশ্যকীয়, ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান, যার ব্যবহার কবিকে জানতেই হয়, অথচ যার হাতে কবিতাকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করা চলে না। অর্থাৎ কবিতা ছন্দবদ্ধ বাক্যে লিখিত হতেই পারে, কিন্তু ছন্দবদ্ধ বাক্য মাত্রই কবিতা নয়। এখানেই কবির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ছন্দ। যখন আমরা প্রথম ছন্দ শিখতে শুরু করি, তখন তাকে প্রাথমিকভাবে অঙ্কের হিসেব বলেই মনে হয়। মন তখন থেকে থেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পয়ারের ৮/৬ চাল শিখতে শিখতে প্রথম প্রথম মনে হয় ‘ধুর, নিকুচি করেছে ৬ মাত্রার… মাথায় আসছে ৫ মাত্রা, লিখতে হবে ৬… এও কি হয়?’ কিন্তু, মন দিয়ে কিছুদিন এই ৮/৬ চালের সঙ্গে বসবাস করতে থাকলে আমাদের মন একদিন পয়ারকে অতিচেনা পাঁচালির ছন্দ বলে চিনতে শেখে। সেই চলন যখন একবার বুকের ভেতর বসে যায়, তখন আর ৬ মাত্রার জায়গায় কখনো কোনো ৫ মাত্রার জুড়ে বসার জো নেই। তখন মনে হয় বাক্য যেন ৮/৬ হয়েই আসছে। এমনকী সেই ৫ মাত্রার শব্দটা কখন যে ৩+৫ হয়ে ৮ মাত্রার পর্বে ঢুকে পড়ে, দেখে, কবিও চমকে ওঠেন আচমকা। কেউ কেউ আবার একে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিয়ে ছন্দের প্রাথমিক শৃঙ্খলাকেই শিকল হিসেবে প্রতিপন্ন করতে পারলে খুশি হন। কেননা ওই পরীক্ষাটুকু দেবার ধৈর্য রাখতেই তাঁরা নারাজ। তাঁদের কে বোঝাবে যে সারেগামা না শিখলে যেমন গান হয় না, বড়জোর রিয়েলিটি শো হয়, কবিতার ক্ষেত্রেও তেমনই। তার কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা না শিখেই শিকল-ভাঙার-গান লিখতে গেলে লোকে লোকাল কবির চোখেই দেখবে। সে তুমি যতই সাহিত্যের রিয়েলিটি শো-এ ফার্স্ট হও না কেন।
বেয়াড়া বেল্লিক বলে ছন্দে লিখো নাকো;
মণীন্দ্র গুপ্তের ধ্রুব লুঙ্গি ধরে থাকো।
ওদিকে বামন-কাব্য ছদ্মছন্দগিরি;
প্রথমটা বেকুব আর পরেরটা বিচ্ছিরি।
হাসতে হাসতে যেকোনো সময়, যেকোনো বিষয় নিয়ে দু’কলম ছন্দ লেখা এমনই সহজ। (মনে রাখতে হবে যে মিশ্রকলাবৃত্তে একটি অক্ষর মাত্রই একমাত্রা নয়। যতই তাকে কেউ কেউ ‘অক্ষরবৃত্ত’ নামে ডাকুক না কেন। এই ছন্দে শব্দের অন্তরস্থ রুদ্ধদলসমূহ পায় একমাত্রা করে আর বহিরস্থ রুদ্ধদলটি পায় দু’মাত্রা। যেমন উপরের পদ্যটির শেষ লাইনে ‘প্রথমটা’ এবং ‘পরেরটা’ এই দুই শব্দে অক্ষর সংখ্যা ৪ হলেও এরা আসলে তিন মাত্রা। যেমন ‘প্রথমটা’ ভাঙলে দেখা যায় প্র ১+থম ১+টা ১=৩ আবার ‘পরেরটা’ ভাঙলে তেমনই হয় প ১+রের ১+টা=৩ । এক্ষেত্রে ‘থম’ ও ‘রের’ অন্তরস্থ রুদ্ধদল, তাই তারা একমাত্রা করে পাচ্ছে।) প্রকৃত ছন্দরসিক বাতাসের আসা-যাওয়ার মতোই সহজে ছন্দের আসা-যাওয়া টের পায়। ছন্দের হিসেব শিখতে শিখতে একসময় সে বুঝতে পারে, আমাদের বাকরীতির ভেতর অজান্তেই লুকিয়ে ছিল বিভিন্ন রকমের ছন্দ, আমরা শুধু তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে এতদিন অবহিতই ছিলাম না ঠিকঠাক। ছন্দের প্রাথমিক হিসেব, আমাদের বাকরীতির সেই অলক্ষ চলনকে স্পষ্ট, বৈজ্ঞানিক যুক্তি পরম্পরায় চিনতে শিখিয়েছে মাত্র।
যখন আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি, স্থানীয় দু’একজন অগ্রজ লিখিয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সদ্য। তাদের কাছে শুনেছি- ‘আধুনিক কবিতা এখন আর ছন্দে লেখা হয় না, এখন সব গদ্যকবিতা, আজকালকার দিনে ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখা সেকেলে, হাস্যকর ব্যাপার’ ইত্যাদি। ভেবে দেখুন, ‘ছন্দ মিলিয়ে’ কথাটা বলছে মানে তারা নিজেরাই ‘মিল’ এবং ‘ছন্দ’-র তফাৎ জানে না। তারা মনে করে, ছন্দে লেখা মানেই ‘বাড়ি’-র সঙ্গে ‘গাড়ি’, ‘জামা’-র সঙ্গে ‘মামা’ এইজাতীয় মিল দেয়া। সুতরাং তারা মিলকে নাকচ করতে গিয়ে ছন্দকেই নাকচ করে বসে। আবার কলেজের বা পাড়ার অন্যান্য বন্ধুরা বলত ‘ধুর, এখনকার কবিতা কিছু বোঝাই যায় না, ছন্দ মেলে না, দুর্বোধ্য’ ইত্যাদি। সুতরাং তখন আমার কাঁচা মনের অবস্থা যে ঠিক কতটা দোদুল্যমান ছিল সহজেই অনুমান করা চলে। কিন্তু ক্রমশ দেশি-বিদেশি শ্রেষ্ঠ কবিদের লেখা পড়তে পড়তেই আমি বুঝতে পারি বিশ্বব্যাপী কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাসের একটি আদিম উপকরণ হলো ছন্দ, যা সমস্ত যুগে, সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবির লেখাতেই প্রতিফলিত। ক্লাসিক, রোম্যান্টিক কবিদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, এই আধুনিক কবিতার যুগে যাকে বলা হয়েছে প্রথম দ্রষ্টা, সেই উড়নচণ্ডী শার্ল বোদলেয়ারও ছিলেন নিবিড়ভাবে ছন্দনিষ্ঠ। সনেটের প্রতি তাঁর নিবিষ্ট অনুরাগের কথা আজ কারই বা অজানা। অদম্য ঝড়ের মতোই জীবন যে কবির, তাঁরও নিখুঁত ছন্দজ্ঞান দেখে মনে আমার বিশেষ প্রত্যয় জেগেছিল ছন্দে লেখা বিষয়ে। আবার সেই সময়ই বিখ্যাত বাণিজ্যিক পত্রিকায় পাতার পর পাতা জুড়ে কবিতার নামে অশ্লীল ছন্দচর্চার যেসব নমুনা চোখে পড়ত, তা ছন্দ ব্যাপারে একধরনের বিবমিষারও জন্ম দিত মনে আমার।
অথচ মহাকাব্য থেকে শুরু করে, আধুনিক, উত্তরাধুনিক সমসময় পর্যন্ত যাদেরই লেখা আমার ভালো লেগেছে, তাঁদের মধ্যে এক-আধজন ছাড়া প্রায় সকলেই ছন্দে কবিতা লেখায় বিশ্বাসী থেকেছেন আজীবন। বাল্মীকি থেকে ব্লেক, কৃত্তিবাস থেকে কীটস, হোমার থেকে হিমেনেথ, রায়গুণাকর থেকে রিলকে, কেউই এর ব্যতিক্রম নন। মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা, ভাগবত গীতার অনুষ্টুপ, সর্বত্রই ছন্দের উপস্থিতির কারণে এক মন্ত্রশক্তির উদ্বোধন ঘটছে বলে আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছে ক্রমশ। স্বাভাবিকভাবেই আমার মন ক্রমশ ছন্দের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব কিছুদূর পার করেই বুঝতে পেরেছি, একেকটা কবিতা যেন ছন্দ নিয়েই আসে। লাইনের পর লাইন অনায়াসেই উৎসারিত হয় সেই ছন্দময় বাক্ধারা। আমাকে আর মোটেই কষ্ট করে ছন্দ লিখতে হচ্ছে না। কোনো কবিতার পঙক্তিমালা ৫+৫+৫+২ হয়ে আসছে, আবার অন্য কোনো কবিতার পঙক্তিসমূহ রূপ নিচ্ছে ৭+৭+৭+৫ বিন্যাসে। শুধু কবিতার বক্তব্য নিয়ে ভাবাই যেন আমার একমাত্র কাজ, বাকিটা যেন কেউ ম্যাজিকের মতো করে দিচ্ছে আমার হয়ে। তখন থেকেই আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে ছন্দ প্রকৃতির এমন একটি তরঙ্গবিশেষ, যার ধ্যানে খানিক সিদ্ধি লাভ করতে পারলে প্রকৃতিই কবির হাত ধরে নেন যথাসময়ে।
ছন্দের প্রাথমিক অনুশাসন পর্ব সফলভাবে পার হতে পারলে এও বোঝা যায় যে, গদ্যলেখাও ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। এই যে গদ্যের মধ্যে একটা খোলা প্রান্তর, তার ভেতর অবাধে খেলে বেড়ানো তাদের পক্ষেই সহজতর হয় যারা কঠিন অনুশাসন পর্বের ভেতরে থাকাকালীন ‘সীমার মাঝে অসীম’-এর আভাষ পেয়েছে। আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে কেবলমাত্র দু’জনের নাম বলতে পারি যাঁরা কখনো ছন্দে লেখেননি। একজন হুইটম্যান, একজন কহলিল জিব্রান। অথচ এই দুজনের গদ্যই যে মূলত কবিতা তা নিয়ে কোনো সংশয়ই আমার মনে জন্মায়নি কোনোদিন। আমি একথা আদৌ মনে করি না যে তথাকথিত ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। কিন্তু ছন্দ কবিতাকে যে বিচিত্র বিপুল মাত্রা দিতে পারে তা গদ্যকবিতার পক্ষে অসম্ভব। আবার আমি নানারকমের ছন্দ শিখেছি বলেই যখনতখন দশটা লাইন লিখে দিয়ে বলতে পারি না যে ‘একটা কবিতা লিখলাম’। এই যে লোক-ঠকানোর কল, এই কলে কবিই কাটা পড়েন সবার অলক্ষে, সবার আগে। যেহেতু তিনি দু’চারকলম ছন্দ জানেন, সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি কিছু চমকপ্রদ লাইন লিখে ফেলে দুনিয়া মাত করে দিতে চান। কিন্তু তিনিও জানেন না, তাঁর ‘সগুণ’ই তাকে ‘বিগুণ’ করছে দিনে দিনে।
ছন্দবিহীন কবিতা বিষয়ে আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত সেই উক্তিটাই স্মরণ করতে চাই পরিশেষে, যেখানে তিনি বলেছেন ‘Writing free verse is like playing tennis with the net down.’ পাশাপাশি এও মনে করিয়ে দিতে চাই যে ‘ছন্দে লেখা’ যতটা কাম্য, ‘ছন্দ-লেখা’ ঠিক তেমনই যত্নে বর্জনীয়। সেটা কবিজীবনের এক অন্যতম কঠিন পরীক্ষা।
বি.দ্র.– ‘পয়ার’ তথা মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের ১৪ মাত্রার চলন বোঝানোর জন্য উপরের গদ্যে একটি মন-গড়া পদ্যের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অন্য ছন্দে লেখা কবিতার নমুনা হিসেবে এখানে আমার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘জংলা মনের স্বর্গ’ থেকে দু’টি কবিতা সংযোজন করা হলো। ‘শারদ প্রাতে’ লেখাটা মাত্রাবৃত্তের ৫+৫+২ চালে, এবং ‘অগণতান্ত্রিক’ লেখাটা ৭+৭ চালে বহমান।
শারদ প্রাতে
ভোর হচ্ছে গন্ধলেবুতল
সবুজ আলো, স্ফটিক-উজ্জ্বল
পোকার দেশ, পাখির ঘরবাড়ি
পথ দেখায় কাশবনের সারি
পথ দেখায় আকাশপথে ডানা
এমন ভোরে চোখে চাদর টানা
কী অশ্লীল, সে বুঝবে না, যার
ভার্চুয়াল সুখের সংসার
ঘুমোচ্ছে সে পাশ ফিরে বেঘোর
মুছে আসছে মহালয়ার ভোর
ধরে আসছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের
কন্ঠস্বর, সে পাচ্ছে না টের—
কত জন্ম অপেক্ষার আলো
কার হৃদয়ে কী সোনা চমকালো
অ-গণতান্ত্রিক
একই সমতলে যেহেতু হাঁটে-চলে
ভেবো না সকলেরই জীবন সমতল।
একই ছন্দে তো সবাই কথা বলে
কারোর উত্তল, কারো বা অবতল।
কারোর চলাচল নেহাতই কর-গোনা।
পেরিয়ে যায় কেউ আলোর গতিবেগ…
ত্রিকাল জুড়ে তার জীবন অর্চনা…
কুয়াশা নেই সমকালের, নেই মেঘ।
কারোর আয়ু জুড়ে দেশভাগের স্মৃতি
মূলোৎপাটনের স্থানিক হাহাকার।
কারোর কাছে গোটা বিশ্বপ্রকৃতি
একটা দেশ, এক জ্যান্ত পাঠাগার।
যেখানে সমতলে সবাই হাঁটে-চলে…
তবু কি সকলের জীবন সমতল?
একই ছন্দে তো সবাই কথা বলে
কারই বা উত্তল, কারই বা অবতল?
Posted in: October 2021 - Cover Story, POETRY