লুক্কায়িত পাঠক্রম : শতানীক রায় ও শানু চৌধুরী

[ It is not good for man to keep reminding himself, that he is man. — E.M. Cioran
খুব বড়ো একটা পৃথিবীতে বসবাস করি। প্রতিদিন অনেক কিছু বদলায়। ভাঙে গড়ে। আমরা নিজেই ভেঙে আবার গড়ে উঠি। আমরা ভাবি। আমাদের এই নিগূঢ় অস্তিত্ব যাপনের পদ্ধতির মধ্যে এসে পড়ে অন্বেষণ। জানি না কক্ষনো। জানতে পারি না। গানটা কেন এভাবে হচ্ছে কেন এভাবে হেঁটে চলেছি আর শেষপর্যন্ত ভাবতে বাধ্য হই কেন বেঁচে আছি। এই অন্বেষণের একটা বড়ো অংশ হল বই। আর পৃথিবীর নানা ভাষার বই থেকে আমরা কিছু বই বেছে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, একটি বই কিন্তু আবার জীবনও। মানুষ অদ্ভুতভাবে সেখানে লুক্কায়িত আছে। তারই পাঠ করতে করতে আমরা গড়ে উঠি। শব্দ। বাক্য। বাক্যের মধ্যে মধ্যে লুপ্ত শব্দ। শূন্যতা আর কীভাবে যে নিজেদের সংশয়কে এসে যেতে দেখি। নিজেদের অস্তিত্বচিন্তা চেপে বসে। এঁটে যায়। এই ধারাবাহিক সেরকমই কিছু বই। সেরকম জীবনের সন্ধান যার কোনো-না-কোনো অণুর ভেতর আমিও আছি। আর চাইছি সেই বিচ্ছুরণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাক। এই ধারাবাহিকে শতানীক রায় সে-সব বই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবেন। আর শানু চৌধুরী সে-বইয়ের কিছু অংশ অনুবাদ করবেন। আসলে কোনো পাঠই সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ-না আপনি সে-পাঠের অংশ হয়ে উঠছেন।]

পর্ব ৩

দি আনওম্যানলি ফেস অব ওয়ার
স্বেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ্

যুদ্ধের থেকে মানুষ মহৎ
[A HUMAN BEING IS GREATER THAN WAR]
ভাষান্তর: শানু চৌধুরী

প্রথম সাক্ষাতের পর…

বিস্ময়কর: এই মেয়েদের সামরিক বাহিনীতে অনেকরকম দায়িত্ব ছিল— মেডিকাল অ্যাসিসট্যান্ট, স্নাইপার, মেশিন গানার, যুদ্ধ বিমানের কমান্ডার, কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ার— তাঁরা বেশিরভাগই এখন অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ল্যাবে সহায়ককর্মী, মিউজিয়াম গাইড, শিক্ষক… তাঁদের তখনকার আর এখনকার পেশায় বিস্তর অমিল। তাঁদের স্মৃতিগুলো যেন তাঁদের সম্পর্কে নয়, যেন অন্য মেয়েদের। তাঁরা এখন নিজেদের নিয়ে অবাকই হন। আমার চোখের সামনে ইতিহাস নিজেকে “মানবায়িত” করে, নিত্যদিনের জীবনের মতো হয়ে ওঠে। অন্যভাবে উদ্ভাসিত হয়।

আমি অতুলনীয় সব গল্প-বলিয়েদের সঙ্গে যাপন করেছি। তাঁদের জীবনের এমন অনেক পৃষ্ঠা আছে যা ক্লাসিকের সেরা পৃষ্ঠাগুলোকেও টেক্কা দিতে পারে। সেই মানুষেরা নিজেদের এত পরিষ্কারভাবে উপর থেকে দেখে— স্বর্গ থেকে, আর নিচ থেকে— পৃথিবী থেকে। তাঁদের সামনে সমগ্র পথ— ওপর থেকে নীচে, দেবদূত থেকে দানব অবধি। স্মৃতিরোমন্থন শুধুমাত্র অতীত ঘটনার আবেগ-উদ্‌যাপন বা আবেগহীন পুনরুত্থাপন নয়, বরং একে অতীতের নতুন জন্ম বলা চলে, যেখানে সময় বিপরীত দিকে বয়। এবং সর্বোপরি এটা সৃষ্টিশীলতা। যেভাবে তাঁরা বর্ণনা করেন, তাঁরা সৃজন করেন, তাঁরা “লেখেন” নিজেদের জীবন। কখনো তাঁরা “লিখে ওঠেন” বা “পুনর্লিখন” করেন। এই জায়গা থেকে আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। নজরবন্দিতে রাখতে হবে। এবং একইসঙ্গে যন্ত্রণা মিশে গিয়ে ধ্বংস করে সমস্ত রকম মিথ্যাচারকে। প্রখর উত্তাপ! সহজ মানুষেরা— নার্স, রাঁধুনি, ধোপা— এঁরা ভীষণ অকৃত্রিমভাবে মেশে, আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম ওঁদের ওপর… ওঁরা… কীভাবে আমি ওঁদেরকে মথিত করব, ওঁদের থেকে কীভাবে আমি কথা বের করব, যা কোনোভাবেই ওঁদের সংবাদপত্র বা বই পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে আসবে না বা অন্য কারো কাছে শোনা। তা উঠে আসবে শুধুমাত্র তাঁদের ব্যথা ও অভিজ্ঞতাকে ভেদ করে। শিক্ষিত মানুষের অনুভূতি ও ভাষা, অদ্ভুত হলেও, অনেকসময়ই সেটা সময়ের গতির ওপর নির্ভরশীল থাকে। সে-সব বাইরের জ্ঞানের দ্বারা আক্রান্ত থাকে। মিথ দ্বারা প্রভাবিত থাকে। প্রায়শই আমাকে অনেকটা সময় হাঁটতে হয়, অনেক ঘুরপথে, “মেয়েদের” যুদ্ধের কথা শুনতে তবে পুরুষদের নয়, পিছিয়ে আসা নয়, যেভাবে আমরা অগ্রসর হয়েছি, যুদ্ধের কোন সীমানায়… এ একবার সাক্ষাতে সম্ভব হয় না, অনেকবার সাক্ষাৎ প্রয়োজন হয়। একজন চিত্রশিল্পীর মতো যিনি অটলভাবে দিনের পর দিন একটা ছবি নিয়েই যাপন করেন।

আমি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করি, কখনো সারাদিন, একটি অজানা আস্তানায়। আমরা চা পান করি, সদ্য কেনা পোশাক পরে দেখি, হেয়ার স্টাইল ও বিভিন্ন রান্না নিয়ে আলোচনা করি। তাঁদের নাতি-নাতনিদের একান্নবর্তী ছবি দেখা দরকার। তারপর… একটা সময় পর, বুঝতে পারতাম না, হঠাৎ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন মানুষটা নিত্যদিনের কংক্রিটের জঞ্জাল সরিয়ে, আমাদের স্থপতি যেমন— নিজের ভেতরে প্রবেশ করে। নিজের ভেতর। তখন যুদ্ধকে ভুলে তিনি মনে করতে শুরু করেন তাঁর শৈশবকে। তাঁর জীবনের একটা টুকরো… আর আমাকে ঠিক এই মুহূর্তটাকেই ধরে রাখতে হবে। কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না! কিন্তু কখনো কখনো, দীর্ঘ একটা দিন কাটানোর পর— শব্দ, ঘটনা, চোখের জল সত্ত্বেও একটিমাত্র বাক্য আমার স্মৃতিতে গেঁথে থাকে (তবে কী বিস্ময়কর সেইসব বাক্য!): আমার তখন খুব অল্পবয়স যে-সময় যুদ্ধের জন্য আমি অগ্রসর হয়েছি, আমি বেড়েই উঠেছি যুদ্ধের সময়।” আমার টেপরেকর্ডারে দীর্ঘ দীর্ঘ টেপ থাকতেও এইসব আমি নোটবুকে লিখে রাখি।

আমাকে কী সাহায্য করে? যে, আমরা একসঙ্গে বসবাস করি। আমরা কমিউনাল। আমরা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ, অনেক সম্প্রদায় মিলে মিশে একত্রে থাকি। আমাদের সবকিছু একরকম— সে সুখ হোক বা দুঃখ। আমরা যন্ত্রণা বুঝি আর সেই যন্ত্রণাকে ব্যক্তও করতে পারি। যন্ত্রণাই আমাদের কঠিন ও এলোমেলো জীবনকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করে। ব্যথা আমাদের কাছে শিল্প। আমাকে স্বীকার করতেই হবে, মেয়েরাই এই পথে অগ্রসর হয়েছেন…

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

Leave a Reply