মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। অপরজনের ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
১৪
পৃথিবীর কক্ষপথে এক নৃত্যরতা উর্বশী !
পৃথিবী ছেড়ে আমরা যেন সৌরমন্ডলে বেড়াতে বেরিয়েছি। শুরু করেছিলাম সূর্য থেকে। তারপরে ঘুরে ঘুরে দেখছি সব প্রতিবেশী গ্রহকে, আর তাদের চাঁদদেরও। আগের পর্বে বুধ আর শুক্রগ্রহের বিচিত্র সব খবর পেয়েছি আমরা। আলোচনা করেছি সেইসব। যেমন বুধগ্রহের একদিন (Solar Day) পূর্ণ হতে তার দু’বছর কেটে যায়। বুধের আকাশে সূর্যের চলনও বিচিত্র। পূব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিমে যেতে যেতে, হঠাৎ সে কিছুক্ষণ থেমে, বিশ্রাম নিয়ে, উল্টে আবার পূর্বদিকেই চলতে থাকে। অনেক পরে আবার দিক পরিবর্তন ক’রে চলতে থাকে পশ্চিমে!
শুক্রগ্রহও কিছু কম নয়। সেখানে গেলে আপনাকে- ‘একি! আজ পশ্চিমে সূর্য উঠেছে নাকি?’–বলতেই হবে। কারণ, নিজের অক্ষের ওপরে শুক্রগ্রহ ঘুরছে উলটো দিকে। তাই সেখানে সূর্যোদয় হয় পশ্চিমে, আর অস্ত যায় পূর্বদিকে। সৌরমন্ডলের মধ্যে সুন্দরী ভিনাস বা শুক্রগ্রহই সবচেয়ে তপ্ত ও ভয়াবহ এক নরক। অ্যাসিডের বিষবাস্পে প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে বাতাস, ইতস্ততঃ ভয়ংকর টর্নাডো ঝড় চলছে, আর ভূপৃষ্ঠ জুড়ে আছে হাজার হাজার মাইল গলিত ফুটন্ত লাভার নদী।
সৌরমন্ডলে একমাত্র আমাদের পৃথিবীই রয়েছে সূর্য থেকে এমন এক দূরত্বে, যেখানে জল রয়েছে তরল অবস্থায়। আছে সাগর-নদী-পাহাড়-বনস্থলী, আর বাতাসে আছে প্রাণদায়ী অক্সিজেন। সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র প্রাণজীবন। জলচর, সরীসৃপ, উদ্ভিদ, ছত্রাক, পশু, পাখি, মানবসংসার। যেকোনও নক্ষত্রকে ঘিরে এই সেই ‘গোল্ডিলক্স জোন’, যেখানে রয়েছে আমাদের এই পৃথিবী, এই বসুন্ধরা, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব। এমন গ্রহটি আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। অবশ্য, এমন গ্রহ (Exoplanet) হয়তো আরও আছে, অন্য কোনও গ্যালাক্সিতে, সূর্যের মতো অন্য কোনও নক্ষত্রের নিরাপদ বাসযোগ্য ‘গোল্ডিলক্স জোন’-এ। হয়তো কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে আছে তারা, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর মানুষ সেখানে একজীবনে পৌঁছবে কী করে?
*
আমাদের এই পৃথিবীর শীতলতম গ্রামের নাম ‘ওইমিয়াকন’ (Oymyakon)। উত্তরমেরু থেকে কয়েকশো কিলোমিটার নীচে, সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশে। এখানেই বিশ্বের শীতলতম মানব বসতি, জনসংখ্যা মাত্র ৫০০। একটা স্কুলও আছে ছোটদের। আছে একটা মাত্র চাল-ডাল শাকসব্জি জামাকাপড়ের দোকান, আর একটা মাত্র পেট্রল পাম্প। যখন ছ’মাস শীতকাল, এখানে তখন দিনের মধ্যে প্রায় ২১ ঘন্টাই রাত। আজ অব্দি সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস -৭১.২ ডিগ্রি। এটা একটা বিশ্ব রেকর্ড। (এর চেয়েও হিমশীতল জায়গা আছে বিশ্বে, কিন্তু সেখানে মানুষের বসতি নেই)।
নীচে ছবিতে, ওইমিয়াকন গ্রামের প্রবেশপথ। আর প্রচন্ড ঠান্ডায় ভোরবেলা স্কুলের পথে চলেছে এক ছোট্ট বালিকা, তার চোখের পাতায় বরফ জমে আছে।
ওইমিয়াকন গ্রামের পথে, সসপ্যানে ফুটন্ত জল নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে মুহূর্তে সেটা প্রবল ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে ঝরে পড়ে। গ্রামের কাছেই আছে একটা ‘গরম’ জলের নদী, তার তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি। শীতকালে যখন বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস-৩৫ হয়, তখন লোকে বলাবলি করে যে, কয়েকদিন ধরে বেশ গরম পড়েছে। এ-হেন শীতের দেশেও. মে-জুন-জুলাই মাসের গরমকালে তাপমাত্রা সাধারণত ১৬-১৭ ডিগ্রি হয়। তবে ২০১০ সালের ২৮ জুলাই বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়ে তাপমাত্রা রেকর্ড করেছিল ৩৪.৬ ডিগ্রি!
বোঝা যায় পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে, হিমশৈল ভাঙছে, বরফ গলছে, সমুদ্রে ক্রমশঃ বাড়ছে জলস্তর। এবছর, ২০২১ সালে, উত্তরমেরুর আর্কটিক সার্কেলে সবচেয়ে প্রাচীন যে বরফের স্তর, যাকে ‘লাস্ট আইস’ বলা হয়, সেখানেও ভাঙনের সংকেত পাওয়া গেছে!
আর মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই নাকি সারা পৃথিবীর সমুদ্র-উপকূলবর্তী অধিকাংশ শহর জলমগ্ন হয়ে পড়বে। এইসবই কি সভ্য মানুষের লোভ, অবিবেচনা, অসংযম ও অবিমৃশ্যকারিতার ফল? আমরা কি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেই বিপদকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবো? নাকি, আমাদের হাতে কোনও সুযোগ নেই আর, পৃথিবী এবার তার নিজের নিয়মেই কিছু বড়সড় দুর্যোগ ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সারিয়ে তুলবে নিজেকে? সেই মূল্য চোকাতে হবে আমাদেরই।
*
পৃথিবী ছাড়িয়ে এবার আমরা ডিজিটাল পর্যটনে যাব দূরের গ্রহগুলোর দিকে। মঙ্গলগ্রহে আমরা আগেই গিয়েছি। এই লেখার সপ্তম পর্বে আছে মঙ্গলগ্রহের কথা। তাহলে আমাদের পরবর্তী উড়ান হবে বৃহস্পতির দিকে। তবে ওদিকে যাওয়ার আগে, পৃথিবীর কক্ষপথে একটা ভারি সুন্দর ট্যাঙ্গো নাচের অনুষ্ঠান দেখে নেওয়া যাক। অনেক কবি ও শিল্পীরা এর খবর রাখেননা।
ইতালিয়ান চলচ্চিত্রকার বারনার্ডো বারতোলুচ্চির ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’ ছবিটার সেই নাচের দৃশ্যটা মনে পড়তে পারে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আরজেন্টিনায় এই ‘ট্যাঙ্গো’ নাচের উৎপত্তি হয়েছিল শোনা যায়। মাত্র দুজন পুরুষ ও নারী মিলে রচিত হয় এই আবেগঘন প্রেমের যুগলবন্দী। যে নাচ প্রেমের, বিচ্ছেদের, আনন্দের, একাকিত্বের, বিষাদের। এই নাচ দুরুহ, অনেক সাধনায় রপ্ত করতে হয় এর নানা জটিল মুভমেন্টস।
কিন্তু আজকের লেখা যে যুগলকে নিয়ে, তাদের ট্যাঙ্গো নাচের আঙিনা কোনও থিয়েটার বা বলরুম নয়। এতে বার্তোলুচ্চির যৌনতা নেই, আছে ধ্রুপদী সৌন্দর্য। এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে মহাজাগতিক এক বিশাল স্টেজে, সেটা আমাদের সৌরমন্ডল। ওই যুগলের একজন আমাদের পৃথিবী। আর তার আকর্ষণে আগে আগে মূল নাচটা নাচছে যে, সে একটা গ্রহাণু, যার ব্যাস মাত্র ৩০০ মিটার। তার নাম 2010TK7.
আমার বরং মনে পড়ছে দেবতা ইন্দ্রের সভায় অনেক অপ্সরাদের মধ্যে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা লাস্যময়ী নর্তকী উর্বশীর কথা। নাচছে সে দেবতাদের সভায়, কিন্তু তার ছন্দিত নৃত্য বুঝি সে সমর্পণ করেছে রাজা পুরুরবাকে, যাকে সভাগৃহে দেখামাত্রই তার রূপে সে মোহিত। সেই মোহাবেশে নাচের ছন্দভঙ্গ হলে, দেবতা ইন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের দুজনকেই স্বর্গ থেকে বহিস্কার ক’রে মর্ত্যলোকে নির্বাসিত করেন।
পৃথিবীর কক্ষপথে এই গ্রহাণুটিও যেন সেই স্বর্গভ্রষ্টা উর্বশীর মতো। পৃথিবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে, ঠিক হাত ধরাধরি করে নয়, পৃথিবীর সাথে প্রায় একই কক্ষপথ ধ’রে সে নেচে চলেছে। পৃথিবীর আগে আগে, লাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্ট L4 অঞ্চলে, বিচিত্র তার পদচারণা, তার তালজ্ঞান।
বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথেও এমন কয়েক হাজার নাচিয়ে আছে, যাদের Trojans বলা হয়, যারা নাচছে আগে আগে অথবা, পেছনে পেছনে। আছে মঙ্গল আর ইউরেনাসেরও। কিন্তু সে তো দল বেঁধে বেলেল্লাপনা। ট্যাঙ্গো নয়। ট্যাঙ্গো শুধুই দুজনের জুটির জন্য রক্ষিত। নায়কের জন্য একক নায়িকা। পৃথিবীর আছে সেই একক নর্তকী, 2010TK7, বিজ্ঞানীরা যার খোঁজ পেয়েছেন মাত্র এগারো বছর আগে। ওপরের ছবিতে সূর্য, পৃথিবী, আর সেই নর্তকী। সবুজ রঙে আঁকা হয়েছে তার মোহময় পদচারণা।
*
মঙ্গলগ্রহকে পেরিয়ে বৃহস্পতির দিকে যাওয়ার পথে আমরা পেরিয়ে এসেছি একটা বলয়ের মতো গোলাকার অঞ্চল। এই সেই ‘প্রধান গ্রহাণু বলয়’ বা, Main Asteroid Belt, যার কথা আগের একটি পর্বে লিখেছি। এর মাঝে রয়েছে কয়েক কোটি গ্রহাণু, বা অ্যাস্টরয়েড। তাদের মধ্যে যেগুলো আকারে কিছু বড়, তাদের ক্ষুদ্র গ্রহ বা, মাইনর প্ল্যানেট বলা হয়। নাসার ডেটাবেসে আজ অব্দি এরকম ৭,৯৪,৮৩২-টির সন্ধান লেখা আছে।
গ্রহাণুদের এই বিশাল অঞ্চলের মধ্যে এমনই একটিকে আবিষ্কার করা হয়েছিল ২০০৬ সালে, জানিয়েছে আমেরিকায় নাসার ‘জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরি’। এর চারপাশে কয়েকটা রিং অর্থাৎ, বলয় দেখা গেছে।
কক্ষপথে যখন সে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে, তখনও পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব প্রায় আঠাশ কোটি কিলোমিটার (1.8530 AU)। এর আগের একটি পর্বেই জানিয়েছি যে, ভারতীয় মার্গসঙ্গীতসাধক পদ্মবিভূষণ পন্ডিত যশরাজকে সম্মান জানিয়ে এর নাম রাখা হয়েছে ‘300128 Panditjasraj’. –এর প্রথম ৬-টি সংখ্যা আসলে পন্ডিত যশরাজের জন্মদিন ২৮-০১-‘৩০ কে উলটে লেখা। এর আগে মোৎজার্ট, পাভারোত্তি ও বিটোফেনের নামে গ্রহাণুর নাম রাখা হয়েছিল। তবে ভারতীয় সংগীতজ্ঞ এই প্রথম। মৃত্যুর স্বল্পকাল আগে এই সংবাদ পেয়ে পন্ডিতজি জানিয়েছিলেন, তিনি আপ্লুত। নাসা তাদের সাইটেশানে জানিয়েছেন, এই সঙ্গীতসাধকের কন্ঠস্বর প্রায় সাড়ে চারটে অক্টেভ জুড়ে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারে। [Data source: IAU’s Minor Planet Center]
এই একই অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে প্রথম Mionor Planet অর্থাৎ, প্রথম ক্ষুদ্র গ্রহটির আবিস্কার হয়েছিল ১৮০১ সালে। এটিই আজ অব্দি আবিস্কৃত সবচেয়ে বড় ‘মাইনর প্ল্যানেট’। এর নাম সিয়ারীজ (Ceres), ব্যাস প্রায় ৯৪৫ কিলোমিটার।
সৌরমন্ডলের সমস্ত গ্রহাণুদের চালচলন, গতি, কক্ষপথ, ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তাদের নানা পরিবারে বা, ফ্যামিলিতে ভাগ করা হয়েছে ; যেমন- Hilda, Schubert, Vesta, Eunomia, Koronis, Hector, এমন কি ‘007 James Bond’ ফ্যামিলিও আছে !
*
এই বিশাল গ্রহাণু-বলয় পার হয়ে গেলেই আমরা উপস্থিত হব বৃহস্পতির কক্ষপথে। সেই কক্ষপথে বৃহস্পতি একা নয়, তার আগেপিছে আছে লক্ষ লক্ষ গ্রহাণু। –আগের একটি পর্বে ‘লা গ্রাঞ্জ পয়েন্ট’ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, এমন প্রত্যেক গ্রহরই আছে পাঁচটা ‘লা গ্রাঞ্জ পয়েন্ট’। এর মধ্যে বৃহস্পতির ‘লা গ্রাঞ্জ পয়েন্ট- ৪ ও ৫’ নম্বর স্থানদুটোতে রয়েছে আনুমানিক ১০-লক্ষ গ্রহাণু, যারা আকারে ১-কিলোমিটারের চেয়েও বড়। এদের মধ্যে প্রায় ৯৮০০-টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গ্রহাণুদের মধ্যে একদল চলেছে বৃহস্পতির আগে আগে, L-4 পয়েন্টে ; এদের বলা হয় গ্রীক গোষ্ঠী। আর একদল চলেছে বৃহস্পতির পেছনে পেছনে, L-5 পয়েন্ট অঞ্চলে ; এই গ্রহাণুদের বলা হয় ট্রজান গোষ্ঠী (গ্রীক পুরাণে বর্ণিত ট্রয় যুদ্ধের সেনাদের স্মরণে)।
[ বৃহস্পতির কক্ষপথে লা গ্রাঞ্জ পয়েন্টে ‘ট্রজান’ গ্রহাণুরা ]
সৌরমন্ডলের সবচেয়ে বড় এই বৃহস্পতিগ্রহ বা, জুপিটার। ৩২০-টা পৃথিবীর ওজোনের সমান তার ওজোন।। সূর্য থেকে পৃথিবী আছে ১৫ কোটি কিমি দূরে, মঙ্গল আছে ২৩ কোটি কিমি দূরে, আর বৃহস্পতির দূরত্ব প্রায় ৭৮ কোটি কিমি। পৃথিবীর এক বছর হয় ৩৬৫.২ দিনে, মঙ্গলের হয় ৬৮৭ দিনে, আর বৃহস্পতির বছর পূর্ণ হতে সময় লাগে ৪৩৩১ দিন, অর্থাৎ আমাদের প্রায় ১২-বছর।
ওপরের সারণীতে দেখা যাচ্ছে, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্বকে বলা হয় ‘এক অ্যাস্ট্রোনোমিকাল ইউনিট’ অথবা, 1 AU ( AU = Astronomical Unit)। এই হিসেবে, সূর্য থেকে নেপচুনের দূরত্ব হচ্ছে 30 AU.
দেখা যাচ্ছে,
১। গ্রহদের মধ্যে সবচেয়ে তপ্ত শুক্রগ্রহ, এবং সবচেয়ে শীতল নেপচুন, কারণ সে সূর্যের থেকে সবচেয়ে দূরে।
২। সবচেয়ে বিশালাকার গ্রহ বৃহস্পতি।
৩। সূর্যকে ঘিরে কক্ষপথে সবচেয়ে তীব্র গতিতে চলেছে সূর্যের নিকটতম বুধগ্রহ। সূর্যের দূরতম কক্ষপথে নেপচুনের গতিবেগ তাই সবচেয়ে মন্থর।
৪। যেসব গ্রহের চারপাশে নিজস্ব বলয় বা, রিং আছে, তাদের নাম : বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন।
৫। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য : যেসব গ্রহের অভ্যন্তরে, মাটি ও পাথরের অনেক নীচে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে, বিপুল পরিমাণ গলিত লোহার ঘূর্ণায়মান ভান্ডার নেই, তাদের নিজস্ব চৌম্বক বল সৃষ্টি হয় না, যা মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে গ্রহকে আড়াল করে রাখতে পারে। যেমন, শুক্র এবং মঙ্গল। ভূচুম্বক বলের অভাবে ভয়ংকর মহাজগতিক বিকিরণ সবসময় বর্ষিত হচ্ছে এই দুটো গ্রহের ওপর। এখানে এখন তাই কোনও রকম প্রাণের সম্ভাবনা নেই।
আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের পৃথিবী রয়েছে সূর্য থেকে এমন দূরত্বে যা আরামদায়ক, যেখানে বিপুল পরিমাণ জল আছে তরল অবস্থায়, যেখানে খুব সহনীয় আবহমন্ডল আছে, বাতাসে আছে প্রাণদায়ী অক্সিজেন। আছে প্রয়োজনীয় মাধ্যাকর্ষণ বল, যা বায়ুমন্ডলকে পৃথিবীর সাথে যুক্ত রেখেছে, মঙ্গল গ্রহের মতো বায়ুহীন করেনি, এবং সর্বোপরি আছে নিজস্ব ভুচৌম্বক বল (ম্যাগনেটোস্ফিয়ার), যা সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা প্রবল শক্তিশালী ক্ষতিকর বিকিরণকে পৃথিবীতে পৌঁছতে দেয় না। তাদের আটকে রাখে উর্ধাকাশেই।
পৃথিবীকে এভাবে উর্ধাকাশে ঘিরে রেখেছে ভূচুম্বক বলের প্রভাবে আটকে যাওয়া ওইসব মহাজাগতিক বিকিরণ, আর সৌরঝড় থেকে আসা তেজপূর্ণ ‘চার্জড’ কণাদের দুটো স্তর। এদের বলা হয় ‘ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্ট’। পৃথিবীকে ঘিরে থাকা এই বেল্টের ওপরের দিকের স্তরটি ভূপৃষ্ঠের ১৩,০০০ কিমি ওপর থেকে ৬০,০০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। [ নীচে ছবি ]
[ছবি : ঊর্ধাকাশে পৃথিবীকে ঘিরে আছে ভয়ংকর শক্তিশালী সৌর প্লাজমা ও মহাজাগতিক বিকিরণে পূর্ণ
‘ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্ট’ ]
আর বেল্টের নীচের দিকের স্তরটি ভূপৃষ্ঠের ১০০০ কিমি ওপর থেকে ১২,০০০ কিমি অব্দি বিস্তৃত, যাতে আটকে আছে বিপুল পরিমাণ ‘চার্জড’ ইলেকট্রন ও প্রোটন কণারা। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে যখন তীব্র আন্দোলন সৃষ্টি হয় (জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম), তৈরী হয় সাময়িক কিছু দুর্বল ফাটল। যেমনটা ইদানিং হচ্ছে দক্ষিণ আটলান্টিক সমুদ্র অঞ্চলে। সেখানে রেডিয়েশান বেল্ট বা, বিকিরণ বলয়ের নীচের স্তর, পৃথিবীর মাটি থেকে মাত্র ২০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত নীচে নেমে আসে। এর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ওইসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান, বিশেষতঃ কৃত্রিম উপগ্রহগুলো।
মনে পড়ছে, এই তীব্র জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম বা, বিচিত্র জ্যামিতিক ও অদৃশ্য এই ভূচুম্বক ঝড়ের কথা বহুকাল আগে কৌরব পত্রিকায় (মে, ১৯৯১) একটি কবিতায় লিখেছিলাম আমি, যেটা পরে আমার ‘উত্তরমালা, বেরিয়ে এসো প্লীজ’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়।
“বহুদূরের ঠিকানায় আমাদের চাকরি ছিলো
আমাদের চিঠিগুলো চলে যেত মহানদী পেরিয়ে
চিনি কারখানার গভীরে আর কাগজের কলে।
একদিন মধ্যরাতে ডাক এসেছিলো,
যেন তীব্র এক জ্যামিতিক ঝড়—
আমরা কি বৃত্ত পরিধি, নাকি অসীমের দিকে ধাবমান
কোনও রেখা
সহসা একদিন রাতে
এইসব প্রশ্ন উঠেছিলো।”
যৌবনে যেদিন আমি একটা টেলিস্কোপ কিনি, সে প্রায় ৩০-বছর আগে। দিল্লি থেকে মেইল-অর্ডারে সেটা এসেছিল আমার জামশেদপুরের ফ্ল্যাটে। প্রথম দিন রাতের আকাশে বৃহস্পতি আর শনিগ্রহকে দেখে আমি চমকিত হয়েছিলাম। যাঁরা টেলিস্কোপে চোখ রেখে এই দুই গ্রহকে প্রথম দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন।
*
সেটা ছিল ২০২০ সালের মে মাস। ভারতের পশ্চিম উপকূলে সেই ঝড়ের নাম ‘নিসর্গ’। এত মধুর নাম, কিন্তু ধ্বংস ক্ষমতা ছিল পূর্ব উপকূলের ঝড় ‘আমফান’-এর মতো। তবে মুম্বাই অনেকটাই বেঁচে গেছিল। নিসর্গ ঝড় আরও দক্ষিণে, আলিবাগ এবং রত্নগিরি অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে, মহারাষ্ট্রে ঢুকেছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিদ্যুৎহীন, যোগাযোগহীন। ভারতবর্ষের দুই উপকূলে প্রকৃতির একই বিষোৎগার, মাত্র এক পক্ষকালের ব্যবধানে।
কলকাতায় আমফান ঝড়ের পরে টেলিযোগাযোগ ফিরে এলে, তরুণ কবিবন্ধু অরিত্র সান্যাল আমাকে জানিয়েছিল: “It was real scary. The uncanny wheezing near the window shields, the throbbing monstrosity in the loud darkness kept us on our toes. We luckily escaped a serious damage in our kitchen chimney prop.”
সেদিন ঝড়ের গতি ছিল ঘন্টায় ১৫০-১৭০ কিলোমিটার (কয়েক মিনিটের সর্বোচ্চ গতি ছিল ২৪০-২৭০ কিমি)। ক্রমশঃ জানা গেল, গ্রামকে গ্রাম চিহ্নহীন। রেল লাইন উপড়ে ফেলেছে। কত লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি স্বপ্ন সংসার নিমেষে তছনছ। মহাপ্লাবন। মৃত পশুর শব চারিদিকে। রাজপথে উপড়ে পড়ে আছে বয়স্ক গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, হাইটেনশান টাওয়ার।
ধরা যাক, সত্যিই এক মহাজাগতিক শয়তান আছে, যে নরকের রাজা, যার প্রচন্ড রাগ আছে আমাদের এই ভারতবর্ষ দেশটির ওপরে এবং সে আমাদের শাস্তি দিতে চায়। কী হতে পারে সেই শাস্তি? রাজা বললেন : প্রথমে, সারাদেশে মারণভাইরাস ছড়িয়ে নাস্তানাবুদ করে দাও। তারপর উত্তর সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বাজাক কেউ। আর পূর্ব ও পশ্চিম দুই উপকূল দিয়ে অতি ভয়ংকর সাইক্লোন এসে ষাঁড়াশি আক্রমণ করুক। আর তার মাঝে মাঝে রিখটার স্কেলে কয়েকটা ঝটকা। ব্যাস, ত্রাহি ত্রাহি রব উঠবে, সোনার সংসার তছনছ হয়ে যাবে।
এবার দেখা যাক, সত্যিই এমন সব হোল কিনা। হ্যাঁ, হয়েছেই তো। সমগ্র গ্রহ জুড়েই, নানাদিকে। অর্থাৎ, এটা তাহলে নিশ্চয়ই সন্দেহ করা যায় যে, বাস্তবিক কোথাও আছে এক খুংখার মহাজাগতিক শয়তান। নরকের রাজা।
এটা কুসংস্কার বা রূপকথা নয়। এটা একটা কঞ্জেকচার, বা প্রমাণসাপেক্ষ পূর্বানুমান। বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও অনেক কিছু শুরু করেন এভাবেই, একটা কঞ্জেকচার দিয়ে। তারপর বাস্তবে তার প্রমাণ খোঁজেন। এবং প্রমাণ পেলে দাবি করেন যে, প্রথম অনুমানটি তাহলে সত্য ছিল। আমরাও মেনে নিই। যতদিন না অন্য একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। তবে এখন ক্রমে বোঝা যাচ্ছে যে, এই শয়তান মানুষেরই সৃষ্টি। অথবা, মানুষের মধ্যেই বাস করছে সে, মানুষের অগোচরে। এই গ্রহেই।
তবে কি মহাজাগতিক কোনও বিপদই নেই, যা মনুষ্য সৃষ্ট নয়? –না, বিপদ ছড়ানো আছে সর্বত্র। সৌরমন্ডলে—কেন, কে জানে– শুধুমাত্র এই পৃথিবীকেই এত আদরে যত্নে সৃষ্টি করেছে কেউ, আগলে রেখেছে দশদিক থেকে, এতকাল ! প্রথম টেলিস্কোপে বৃহস্পতি গ্রহের দিকে চোখ রেখে এইসব মনে হয়েছিল আমার।
সৌরমন্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ সে। তার ব্যাস ১,৪৩,০০০ কিমি, পৃথিবীর চেয়েও যা ১১ গুণ বড় ! ওই বিশাল বপু নিয়েও এত তীব্রবেগে সে নিজের অক্ষের ওপরে প্রায় খাড়াভাবে (মাত্র ৩ ডিগ্রি বেঁকে) ঘুরছে যে, ১০-ঘন্টাতেই তার এক দিন সম্পূর্ণ হয়, আর আমাদের ১২-বছরে পূর্ণ হয় তার এক বছর।
নিজের কক্ষতলে প্রায় খাড়া হয়ে সে ঘুরছে বলে (পৃথিবী ঘুরছে ২৩.৪ ডিগ্রি বেঁকে), তার কোনও গ্রীষ্ম/শীত বা ঋতু পরিবর্তনও নেই। গ্রহটিকে ঘিরে আছে একটি বলয় ; খন্ড খন্ড জমাট বরফ নয়, শুধু মিহি ধুলোর স্তর। বলয়টি তাই খুবই ম্লান, শনির মতো উজ্জ্বল নয়।
আহা, আবার আমার পৃথিবীকে নিয়ে সোহাগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কে একে সৃষ্টি করেছিলেন, বিশ্বকর্মা নিজে, নাকি কোনও সাবকন্ট্রাক্ট, জানি না, কিন্তু পৃথিবীর চলন যদি অমন বাঁকা না হয়ে খাড়া হোত, তবে গ্রীষ্মের হুহু রাত, রিমঝিম বৃষ্টির দিন, হেমন্তের শিশির, আর শীতের কুয়াশামাখা ভোর, কিছুই পাওয়া হোত না আমাদের। পাওয়া হত না মৌসুমী ফুলের সম্ভার, ফসলের ঘ্রাণ, আর স্রোতস্বিনী নদীগুলো। এ ভবসংসারে, নদী নির্ঝরে !
বৃহস্পতিকে বিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘গ্যাস জায়ান্ট’। কারণ, তার ওই সুবিশাল আয়তনের প্রায় নব্বই ভাগই হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও অ্যামোনিয়ার গ্যাসবাস্পে ভরা, যেখানে সবসময় ঝড় বইছে। হিমশীতল উপরিভাগের নীচে রয়েছে প্রচন্ড চাপে সৃষ্ট তরল হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের বিপুল সমুদ্র। আরও অনেক অনেক নীচে, মাটি পাথর বরফ ও তপ্ত গলিত (৫০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) লোহা দিয়ে গঠিত ‘কোর’ বা কোরক অংশটি তুলনায় খুবই ছোট।
বিজ্ঞানীদের পাঠানো স্যাটেলাইট কখনোই বৃহস্পতিতে নামতে পারেনি, কারণ তার প্রায় সবটাই গ্যাসীয়। টেলিস্কোপে বৃহস্পতির গায়ে যে অনেকগুলো ব্যান্ড দেখা যায়, তা আসলে অ্যামোনিয়া, সালফার এবং ফসফরাসের ঘন মেঘ, প্রচন্ড বেগে ঘূর্ণনের জন্য ওইরকম অনেক রঙিন ব্যান্ডের মতো দেখায়। আর ওই তীব্র ঘূর্ণনের জন্য বৃহস্পতির আছে বিপুল চুম্বক ক্ষেত্র, যা পৃথিবীর ক্ষেত্রের চেয়েও প্রায় ১০-১২ গুণ বলশালী। বৃহস্পতির এই চুম্বক ক্ষেত্রের বিস্তার সূর্যের দিকে প্রায় ৩০ লক্ষ কিমি এবং বিপরীত দিকে, শংকু আকৃতি নিয়ে, প্রায় ১০০ কোটি কিমি পর্যন্ত।
বাই দি ওয়ে, মহাকাশে গ্রহরা যে বিপুল গতিতে নিজের অক্ষের ওপর ঘুরছে, সেটা বৃহস্পতি ছাড়া অন্য কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই, আমাদের চাঁদকে দেখে তো নয়ই, কারণ চাঁদ ঘুরছে অত্যন্ত ঢিমে গতিতে, তার শুধু একটা দিকই আমরা সবসময় দেখতে পাই, ফলতঃ বোঝা যায় না যে ঘুরছে। কিন্তু মাত্র ১০-ঘন্টায় অতবড় গ্রহ বৃহস্পতি একবার পুরোটা পাক খেয়ে নেয় ! সেটাই তার একদিন। তাই টেলিস্কোপে কিছুক্ষণ পরপর তাকে দেখলে, তার মেঘের প্যাটার্ন আর রক্তচক্ষুর অবস্থান দেখলে, পরিস্কার বোঝা যায় যে, গ্রহটি তো ঘুরছে।
[ ছবি : বৃহস্পতি গ্রহের গায়ে নানারকম মেঘের ব্যান্ড, এবং তার বিখ্যাত ঝড় ‘রেড আই’ ]
এবং আমরা যারা আয়লা, ফনি, বা আম্ফান ঝড়কে দেখেছি, তাদের একবার টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখা উচিত বৃহস্পতির ওই দুর্দান্ত ‘রেড আই’-কে। কত শতাব্দী ধরে বৃহস্পতির আকাশে এক ভয়ংকর উচ্চচাপের (anticyclonic) ওই ঘূর্ণীঝড় প্রায় ১৬,০০০ কিমি এলাকা জুড়ে বয়ে চলেছে, ঘন্টায় প্রায় ৪৫০ কিমি তার গতিবেগ। ওই ঝড়ের আয়তন আমাদের দুটো পৃথিবীর সমান, আর ঝড়ের গভীরতা প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ কিমি। অর্থাৎ প্রায় ৩৮-টা এভারেস্ট শৃঙ্গকে, একটার ওপরে আরেকটা করে বসালে যতটা উচ্চতা হয়।
টেলিস্কোপে দেখা যায় এই ঝড়কে, বৃহস্পতি গ্রহের বিষূবরেখার কিছুটা দক্ষিণে, একটা বড় উপবৃত্তাকার লাল রঙে। এই সেই বিখ্যাত ‘রেড আই’। [ নীচে ছবিতে ]
বৃহস্পতি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করছে নাসার পাঠানো স্যাটেলাইট- ‘জুনো’। সে লক্ষ রাখছে, এবং ছবি তুলছে ওই রক্তিম চোখের। সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে থাকা ওই ঘূর্ণী ঝড়ের আকার এবার ক্রমশঃ ভাঙছে, আয়তন হ্রাস পাচ্ছে। আগামী মাত্র ২০-২৫ বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাবে হয়তো। যাঁরা বঙ্গোপসাগরে আয়লা আর আমফানকে গড়ে উঠতে দেখে শিহরিত হয়েছেন, অথচ সৌরমন্ডলের সবচেয়ে তীব্র ও বিশাল এই ঝড়ের দৃশ্য এখনও দেখেননি, অবশ্যই একে দেখে রাখুন। পাশাপাশি দুটো পৃথিবীর চেয়েও আকারে অনেক বড় এই ঝড়।
তবে ঝড় ছাড়াও বৃহস্পতির অন্য যে জিনিসটা টেলিস্কোপে সুন্দর দেখা যায়, তা হোল দুপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এর চাঁদগুলো। বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে ছোট বড় নানা আকারের ৭৯-টা চাঁদ, যার মধ্যে ৫৩-টাকে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই মান্যতা দিয়েছেন, বাকিগুলোর চালচলন নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণ চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও প্রধান চারটে চাঁদের কথা স্বয়ং গ্যালিলিও ১৬১০ সালে টেলিস্কোপে দেখতে পেয়ে লিখে রেখেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে। এদের নাম– আয়ো (Io), ইউরোপা (Europa), গ্যানিমিড (Ganymede), এবং ক্যালিস্টো (Callisto)।
এই চাঁদগুলোকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের বিপুল আগ্রহ, কারণ এদের আকার, অবস্থান ও আবহাওয়ার কারণে এখানে তরল জলের সমুদ্র এবং প্রাণের সম্ভাবনা থাকতেও পারে। নাসার পাঠানো বিভিন্ন উপগ্রহ (পায়োনীয়ার -১০ এবং ১১, ভয়েজার-১ এবং ২, আর গ্যালিলিও স্পেসক্র্যাফট) বিভিন্ন সময়ে বৃহস্পতিগ্রহ ও তার প্রধান চাঁদদের খুব কাছ দিয়ে (২৫০ কিমি) উড়ে যেতে যেতে অনেক ছবি তুলে পাঠিয়েছে পৃথিবীতে।
আয়ো :
এর অভ্যন্তরে আমাদের পৃথিবীর মতোই নানা স্তর রয়েছে। একেবারে কেন্দ্রের কোর অঞ্চলে আছে গলিত ধাতু ও তরল পাথরের কুন্ড। তার ওপরে আছে নানা রঙের সালফার মিশ্রিত কঠিন পাথরের বিভিন্ন স্তর। বৃহস্পতির বিপুল মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে আয়ো-র কঠিন ভূমিও জোয়ারের জলের মতো প্রায় ৩০০ ফুট ফুলে ওঠে, যার প্রভাবে পাথর ফেটে অগ্ন্যুৎপাতের মতো বেরিয়ে আসে তপ্ত গলিত পাথরের স্রোত (hot silicate magma)। নীচের ছবিতে এমনই এক উদ্গীরণ দেখা যাচ্ছে।
ইউরোপা :
বৃহস্পতির এই চাঁদকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের দারুণ কৌতুহল। কারণ গ্যালিলিও মহাকাশযানের পাঠানো ছবি ও তথ্য থেকে মনে হচ্ছে, বরফে ঢাকা ওপরের স্তর কোথাও কোথাও ফেটে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে রঙিন জলধারা, পরে আবার তা জমেও গিয়েছে কিছুটা। এবং এই বরফের স্তরের নীচেই আছে বিশাল বরফ-গলা জলের হিম সমুদ্র, যার জলের পরিমাণ পৃথিবীর সমগ্র জলের প্রায় দ্বিগুণ !! এমন পরিবেশে নিশ্চয়ই প্রাণের সন্ধানও পাওয়া যেতে পারে। [ নীচে ছবিতে ইউরোপা ]
গ্যানিমিড :
বৃহস্পতির চাঁদদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই গ্যানিমিড। একেও ১৬১০ সালে প্রথম আবিস্কার করেছিলেন গ্যালিলিও। সৌরমন্ডলের সমস্ত চাঁদের মধ্যেও এ-ই সবচেয়ে বড়, এমনকি বুধগ্রহের চেয়েও। এর অভ্যন্তরে, বরফ, জল ও পাথরের অনেক নীচে আছে গলিত লোহার ম্যান্টল, যা সৃষ্টি করছে নিজস্ব চুম্বক ক্ষেত্র। বরফের নীচে আছে বিপুল সমুদ্র, যা এই পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের মিলিত জলের চেয়ে বেশি জল ধরে ! বৃহস্পতিকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিতে গ্যানিমিডের লাগে মাত্র ৭-দিন। এর তাপমাত্রা মাইনাস-১২০ থেকে মাইনাস-২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অর্থাৎ, পৃথিবী ছাড়িয়ে যতই দূরে যেতে থাকবো, ততই ক্রমশঃ ভয়ংকর শীতের অঞ্চল, কঠিন পাথরের মতো জমাট বরফ। গ্যানিমিডে বায়ুমন্ডলও খুবই ক্ষীণ, মঙ্গলের মতোই। তবে সামান্য অক্সিজেন আর ওযোন আছে। অর্থাৎ জল, অক্সিজেন এবং চুম্বক ক্ষেত্র—এই তিনটে প্রয়োজনীয় জিনিসই আছে গ্যানিমিডে, তাই একে নিয়ে বিজ্ঞানীদের এত উৎসাহ। কিন্তু ভয়ংকর শৈত্য, গড় তাপমাত্রা মাইনাস-১৬০ ডিগ্রি ! এবং তরল জল আছে বরফের অনেক নীচে, পাতাল-সমুদ্রের গভীরে। আগামী বছর ২০২২ সালে, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি একটা মহাকাশযান পাঠাবে গ্যানিমিডের দিকে।
মহাবিশ্বের এইসব গবেষণামূলক প্রকল্পের সাথে যুক্ত থাকেন যেসব বিজ্ঞানীরা, তাঁদের আছে বিপুল নিষ্ঠা ও ধৈর্য। কারণ তাঁরা ঘরের সুখ ছেড়ে আক্ষরিক অর্থেই তো আকাশের একেকটা রহস্যময়ী চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। একটা গোটা মানবজীবন কেটে যেতে পারে একটা চাঁদকে নিয়ে। তবুও সবটা জানা হয়ে ওঠে না।
[ বৃহস্পতির চাঁদ গ্যানিমিড : ভয়েজার-২ উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি ]
ক্যালিস্টো :
গ্যানিমিডের পরেই বৃহস্পতির দ্বিতীয় বৃহত্তম চাঁদ এই ক্যালিস্টো। পৃথিবীর থেকে প্রায় ৬৩ কোটি কিমি দুরত্বে, এর ব্যাস ৪৮০০ কিমি। গড় তাপমাত্রা মাইনাস-১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের ১৭ দিনে ক্যালিস্টোর এক দিন। এখানেও আছে খুব ক্ষীণ একটু বায়ুমন্ডল। সম্ভবতঃ বরফ-গলা জলও আছে পাতাল-সমুদ্রে।
[ ক্যালিস্টোর ছবি। সৌজন্য : নাসা / জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরি ]
বৃহস্পতি ও তার বিখ্যাত গ্যালিলিয়ান চাঁদদের দেখে নিয়ে এবার আমরা যাবো পরবর্তী গ্রহ শনির দিকে। দেখবো তার অপূর্ব ও বিচিত্র বলয়গুলো। এবং তার কয়েকটা বিখ্যাত চাঁদ, যেমন টাইটান, যাকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের অসীম আগ্রহ। সেসব কথা আগামী পর্বে।
[ ক্রমশঃ ]
Posted in: October 2021 - Serial, PROSE