“ল্যান্ডমার্ক” শব্দের, না, সময়ের? — সঞ্জয় সাহা
“কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছে” — কবি শক্তি এরকম লিখেছিলেন। কিন্তু “তরবারির দিন শেষ হইয়াছে”। রাজা মহারাজাদের আগ্রাসনের, সাম্রাজ্যবাদের অভিমুখ, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সবই বদলেছে। এখন যুগটা চশমার। যুগটা দেখার। যুগটা বীক্ষণের। যুগটা শুধুই দর্শক হয়ে থাকার। এই কথাটাই কি বিভিন্ন আঙ্গিকে, ছোট্টো ছোট্টো ঘটনায়, আভাসে, অন্তরালে মনে করিয়ে দিতে চান বিতান চক্রবর্তী তাঁর “ল্যান্ডমার্ক” বইটিতে? আর, পেশাদার প্রাবন্ধিকের মতো তিনি তার প্রথম গল্পেই যেন তা স্পষ্ট করেন। আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় একটা কৃত্রিম, ফিট-না-হওয়া চশমা পরে থাকি। দেখাগুলো পালটে যায়। যা দেখার ছিল, দেখি না। যা দেখার আছে, তাও দেখা হয় না।
তবে কি বিতানের গল্প শুধুই এক মিস-ফিটের চোখে দেখা পৃথিবীর বারোমাস্যা? এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার সমান সমান এ স্কোয়ার প্লাস টু এবি প্লাস বি স্কোয়ার? এক ধরনের গোল গল্প? নটে শাকটি মোড়ানো বা দে লিভ হ্যাপিলি দেয়ার আফটার? না,পাঠক, সম্পূর্ণ উলটো। গোল বা চৌকো নয়। আয়তাকার বা সামন্তরিকও নয়। বরং অ্যামিবয়েড। অনিয়তাকার। আর, পৃষ্ঠদেশ খসখসে। কোথাও টু এবি নেই, কোথাও বি স্কোয়ার নেই, কোথাও-বা এ স্কোয়ারও নেই। আছে, তবে তা পাঠকের বিনির্মাণে। সেই নিরুক্তিগুলোকে, সেই গ্যাপগুলিকে ভরাতে হবে পাঠককে নিজেই। কেননা গ্যাপগুলো ভরে দিলে তা হয়ে যেত বিতান’স ম্যানিফেস্টো। আর ম্যানিফেস্টো লেখা গল্পকারের কাজ নয়। যদিও শব্দ, অক্ষর, বর্ণ, বাক্য এখানে মিছিলে হাঁটছে। হাঁটছে রেললাইন ধরে ফিরতি শ্রমিকের পায়ে পায়ে। হাঁটছে বিধর্মীদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার অশুভ ইচ্ছার কিরিচে। একই সাথে ব্যক্তির ও সমষ্টির গল্প এই সব। এই চরিত্রদের পাশ দিয়ে আপনি হাঁটতে পারবেন, আবার সাথে নিয়েও। আবার কখনো কখনো মনে হবে আপনি নিজেই বুঝি এই সব চরিত্র। লেখক নিজস্ব শ্রেণি অবস্থান ভুলে গিয়ে একই সমান্তরালে কী করে যে একটা কর্পোরেট এলিট ক্যারেক্টর তৈরি করেন, আবার কখনো ‘গেঞ্জির কারখানায় মাল ভাঁজ করা ঠিকা শ্রমিক’! বিতানের বর্ণনা চরিত্রগুলোকে প্রাণবন্ত ও বিশ্বস্ত করে তোলে। এই নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি আছে বলেই কি বিতানের গল্প এত জীবনের কাছাকাছি?
বিতান আনখশীর একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কোনো দলীয় রাজনীতিতে বিতান যুক্ত নয় বলেই জানি। কিন্তু ওর শব্দ, বর্ণ, যতি সব যেন এক আবহমানের অসাম্যের প্রতি তীব্র শ্লেষ ছুড়ে দেয়। আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করায়। আমরা আমাদের মুখ লুকোবার চেষ্টা করি। এক তীব্র অস্বস্তিতে পড়তে হয় পাঠককে। মনে হয়, বিতান আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখেনি তো! আমরা যারা নন্দন চত্বরে যাই, কবিতা পড়ি, একাডেমিতে নাটক দেখি প্রতিবাদের, প্রতিরোধের এক কাল্পনিক সাম্য শান্তি ঐক্যের পৃথিবীর অথচ আমরা এই প্রসেনিয়ামের বাইরে এসে পরে ফেলি রংবেরঙের মুখোশ! একে তাকে মিথ্যে বলি, এমনকী নিকটতম প্রতিবেশীকেও মিথ্যে বলে মেতে উঠি নিজস্ব ভোগবিলাসে। আর রাষ্ট্র? সে তো “বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ”। কোথায় পালাব আমরা? কোথায় একটু শান্তিতে থাকবে অহন আর মেঘা? আমাদের প্রাইভেট স্পেসে ঢুকে পড়বে নীতি পুলিশরা। এবং তা মোটেই কোনো নীতির জন্য নয়।
“লিভ ইন করবে? ইউপির লোকেদের জানো তো, পিটিয়ে পাড়া ছাড়া করে দেবে” (প্রতিচ্ছবি)। রাষ্ট্রের তদারকিতে ও তত্ত্বাবধানে ভেঙে যায় সনাতন জীবনের ছন্দ। “তখনও গ্রামখানা এত ফাঁকা হয়নি, তবে সকলেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাতবিরেতে জমির দখল নিতে গুলি চলে। সুবলদের বাড়ির পেছনের দেওয়াল ঝাঁঝরা হয়ে গেছে গুলিতে” (মাটি)। সিপিএম কংগ্রেস বিজেপি তৃণমূল না বললেও আমরা বুঝতে পারি এ-গল্প সুবলের বা উপেনের বা আরও অনেকের। সেই “রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি”-র আবহমানের গল্প।
আমরা স্বীকার করি আর না-ই করি, এই নানা মত নানা জাতি নানা পরিধান-এর দেশে কোথায় যেন এক অসহিষ্ণুতা ঢুকে পড়েছে। হয়তো ছিলই, কিন্তু এখন যেন আরও প্রকট। এবং তা রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে। কিন্তু দিনের শেষে এসে মানুষ নিজের দিকে তাকায়, সে আয়নার দিকে তাকায়। এই তাকাতে গিয়েই বিতানের সঙ্গে, অহনের সঙ্গে আমরা হয়তো নিজেকেই দেখে ফেলি। বিহার ইউপি-র লোকরা রিজার্ভড সিটের প্যাসেঞ্জারদের উঠিয়ে নিজেরা বসে পড়ে — এই অত্যাচারের সম্মুখীন আমরা অনেকেই হয়েছি। কিন্তু আমরাও যে একই প্রতিহিংসা বয়ে বেড়াই তা এত স্পষ্ট করে বিতানের আগে কেইবা দেখিয়েছে? (অন্তত আমার পাঠ পরিসরে) আসলে, সময় সুযোগ বুঝে আমরা সবাই কম-বেশি রেসিস্ট, কম-বেশি প্রতিক্রিয়াশীল।
আখ্যানের দিন বিগতপ্রায়। বিতানও আখ্যানবিলাসী নয়। তবুও আখ্যান এসে পড়ে ইশারা-ইঙ্গিতে। এবং কব্জি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আউটসুইং, ইনসুইং, রিভার্স… সবটাই খেলে বিতান। মূলত ভঙ্গিমার জন্যই আখ্যান সাবলীল থেকে সাবলীলতর, সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে ওঠে। প্রথম লাইনগুলোই যেন চাবুকের মতো। একরাশ সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয় — “এরপর রাস্তা এখানেই শেষ” (চশমা)। অবশ্যই পাঠককে কৌতুহলী করবে। গল্পের শুরুতেই শেষের কথা তবে কি রেট্রোস্পেকটিভ? স্মৃতি তর্পণ? আবার “স্খলন” গল্পে যখন বিতান শুরু করে এভাবে —“এইখানে এসে দাঁড়াতে নলিনাক্ষের পয়তাল্লিশ বছর লেগে গেল।” — মনে হয় না কোন চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে নায়ক? এবং পাঠকও মনে মনে তৈরি হতে থাকেন যেকোনো ভাঙনের; যে ভাঙন এক অর্থে পুনর্নির্মাণও। বইয়ের মুখবন্ধে নবেন্দুবাবুর (নবেন্দু সেন, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়) দু-একটি তুলির টান যেন সমালোচকের পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা। ভাষার “সাম্প্রতিকতা” বিষয়ে যা বলেছেন তিনি, তা সর্বাংশে সত্য। এই সাম্প্রতিকতা গল্পকারকে সবিশেষ করেছে। ভাষা ঝকঝকে কিন্তু হৃদয়গ্রাহী। কেননা শুধু কবিতা নয়, গল্পও আলটিমেটলি শব্দ দিয়েই লেখা হয়। বরং সংলাপধর্মিতা থাকায় গল্পে শব্দের ব্যবহার অধিক যত্ন আশা করে। তবে বিতানের গল্পে সংলাপ বেশিরভাগই আত্মকথন। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা। হয়তো লেখকও পাঠকের সঙ্গে এভাবেই কথা বলে নেন। এলিটের সঙ্গে এলিটের ভাষায়, সাব-অল্টার্নের সঙ্গে সাব-অল্টার্নের।
মাত্র সাতটি গল্প। কিন্তু সপ্তরথীর মার বড়ো মারাত্মক। বড়ো আক্রমণাত্মক। বড়ো প্রশ্নময়। বড়ো রাজনৈতিকও। বইটি শুধু নামকরণেই নয়, আক্ষরিক অর্থেই একটি ল্যান্ডমার্ক। কঠিন, কর্কশ ও জীবাণুময় জীবনে এক ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক। প্রচ্ছদে রোচিষ্ণু সান্যালের একটি লাল আঁচড় যেন এই দুঃসময়ে এক সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতির মতো। যা হয়তো সমস্ত গল্পজুড়ে বিতানই বলতে চেয়েছে।
ল্যান্ডমার্ক (হার্ডকভার)
বিতান চক্রবর্তী
প্রকাশক — শাম্ভবী
দাম — ২০০ টাকা
[লেখক – সম্পাদক, তিতির, মাথাভাঙ্গা, কোচবিহার।]
Posted in: BOOK-REVIEW, October 2021