বাঙ্গিকৃষি : রোমেল রহমান
দিলু একজন বাঙ্গি চাষি! সফল বাঙ্গি চাষি হিসেবে মেডেল পাওয়ায় গতবছর তার ক্ষেত এবং তাকে সরকারী টেলিভিশনের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছিল! তারপর থেকে এলাকায় তার নামডাক বদলে গেলো! স্টার চাষা হয়ে উঠলো সে, কেনোনা টেলিভিশনের সেই অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছিল, দেশের আশু বাঙ্গি বিপ্লবের প্রধান সৈনিক দুলু! বিদেশি এক এঞ্জিও এসেছিল এদেশের জনপ্রিয় সব ফলের উপর একটা ডকুমেন্টারি বানাতে, যেখানে দিলুর সুযোগ হল বাঙ্গি বিষয়ক কথা বলার। ফলে গ্রামের টকিজ দেখা দুষ্ট ছেলেপেলেরা দিলুর নাম দিয়ে ফেললো, বাঙ্গিম্যান! দিলু অবশ্য এইসব নিয়ে ভাবনা থাকে না, সে স্বপ্ন দেখে জীবনটা বাঙ্গিময়, দুনিয়াটা বাঙ্গির ক্ষেত! আর তার ক্ষেতের বাঙ্গি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে! সমগ্র দুনিয়ার প্রধান ফলের নাম হয়ে উঠবে একদিন বাঙ্গি! কিংবা তার গ্রাম বা দেশের নাম হবে বাঙ্গিস্তান! স্বপ্নের তো মা বাপ নেই তাই এইসব ভাবনা বউয়ের সঙ্গে আলাপ করতেও খারাপ লাগে না যদি গেন্দুলির মতন বউ পাওয়া যায়! কেননা এইসব বিশ্বাস আর স্বপ্নের পর তার বউ গেন্দুলি বলে, লোকটা একটু আউলা হলি কি হবে দাদা মানুষটা একেবারে বাঙ্গির মতন খাঁটি! গেন্দুলি বাঙ্গির তরকারী রান্নাবান্নার বিভিন্ন কলাকৌশল আয়ত্ব করে রেখেছে! যেহেতু শহর থেকে সাহেবরা আসে বাঙ্গি চাষবাস বিষয়ে নাড়াচাড়া করতে, তখন চান্স পেলেই গেন্দুলি জানিয়ে দেয় বাঙ্গি শুধু ফল হিসেবে নয় সব্জি হিসেবেও খাওয়া যায়! গেলো বছর দিলু যখন বিখ্যাত হয়ে উঠলো, তখন ডিসি সাহেবকে একদিন বাঙ্গির কয়েকটা পদ রান্না করে খাওয়ানর সৌভাগ্য হয়েছিল গেন্দুলির! সেই ছবি এখনো তাদের ঘরে বাঁধানো! এবার দ্বিগুণ চমক দিতে দিলু টাকা লোণ নিয়েছিলো এবং নিজের ক্ষেতের পাশের কয়েকটা ক্ষেত লিজ নিয়েছিলো নিজে হাতে বাঙ্গি ফলাবে বলে! কৃষি অধিদফতর থেকে কর্মকর্তারা এসে কয়েকদফা খোঁজ নিয়ে গেছে! এবারও তার ক্ষেতকে মডেল হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে, একটা সাইনবোর্ড পুতে গেছে! কিন্তু আচমকা মহামারী এসে পড়ায় সবকিছু উলটপালট হয়ে গেছে আচমকা! দিলু টের পেয়ে গেলো ফলন ভালো হলেও বাজার পাওয়া যাবে না! মানুষ ভাত খেতে পাচ্ছে না যেখানে সেখানে বাঙ্গি খাবে কোন দুঃখে? তার মধ্যে একদিনি গেন্দুলি জানালো, গত বছরের সাফল্যের উত্তেজনায় সেও ফলবতী! দিলু হিসেব কষে দেখল, সিজন শেষে বাঙ্গি বিক্রির পর হাতে নগদ টাকা থাকতো আর সেই গরম হাতের মধ্যে বাচ্চাটা জন্মাত! কিন্তু এখন কি হবে তার? আকালের মধ্যে বাচ্চাটা ট্যাঁ ট্যাঁ করবে?
ক্ষেতের যত্ন নেয়া ছেড়ে দিলো দিলু! টাকার অভাবে ক্ষেতের যত্ন নিতে পারছে না এই বলে যদি কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যায় কৃষি অধিদপ্তর থেকে কিংবা কোন সাহায্য সংস্থা থেকে! কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না! কারোর দেখাই পাওয়া যাচ্ছিলো না! ফোন দিলে সবাই বিরক্তি নিয়ে জানাত, তুমি কি নির্বোধ এই অভাবের দিনে বাঙ্গি চাষ নিয়ে আছো? সে যদি বলতো, স্যার আমি মেডেল পাওয়া চাষি! এবার ফসল নষ্ট হয়ে গেলি মাঠে মারা যাবো! তখন ফোনের ওপাশ থেকে শোনা যেত, মেডেল ধুয়ে পানি খাও! ফলে দিলুর বুঝতে দেরি হয় না বাজার ব্যবস্থা একজন কৃষককে কেন মেডেল দেয় এবং কেন তার মৃত্যুতে ‘আহারে’ বলে উঠে একমিনিট নীরবতা যাপন করে!
গেন্দুলির পেট ফুলে উঠতে থাকে যতো দিলুর মানুষিক চাপ বাড়তে থাকে ততো! লিজ নেয়া ক্ষেত গুলোয় যত্ন নেয়া ছেড়ে দিলেও ভালো ফলন হয়! দিলুন মনে সামান্য আলোর ইশারা জাগে! হয়তো অর্ধেক দাম পাওয়া যাবে! কিন্তু ফড়িয়ারেরা যখন আসে বাঙ্গি কিনতে, মহামারীর ওজুহাতে একেবারে নামমাত্র মূল্য দিতে চায় বাঙ্গির! দিলু টের পায়, এই টাকায় বাঙ্গি বিক্রি করে দেয়া আর মাঠ পরিষ্কার করা এক কথা! তারচেয়ে মাঠের ফসল মাঠে পচুক! লোকে বলে, তুই বাঙ্গি বেচতিছিস না ক্যান দিলু? দিলু বলে, দাদনের টাকা তো শোধ দিতি পারবো নানে! তারচাইয়ে বাঙ্গি গুলো পইচে সার হোক, কাজে দেবেনে আগামী বচ্ছর!
একদিন বিকেলে গেন্দুলির চেঁচামেচিতে আশপাশের লোকেরা তাদের বাড়িতে এসে দেখে, দিলুর মুখ দিয়ে গেজলা বেরোচ্ছে! এই দৃশ্য তাদের চেনা! দিলু কীটনাশক খেয়েছে! মৃত্যুকে কণ্ঠনালী দিয়ে পাচার করে দিয়েছে সে মহামারী কিংবা ঋণের টাকা অথবা প্রতিভার মিথ্যা মূল্যায়নে মেডেল নামক ভুজুংভাজুং হজম করতে না পেরে! কিন্তু কেউ তাকে হাসপাতেলে নিতে এগিয়ে আসে না! সবাই বলে, হাঁসপাতাল যাবে কিডা? ভাইরাসে গিজগিজ করতিছে হাঁসপাতাল! একজন কেউ বলে, দিলু কাকা কি এন্ডিন খাইচে নাকি করোনা ভাইরাস? ফলে সাবাই দ্রুত সটকে পরে ভাইরাসে কথা শুনে! সেদিন সন্ধ্যায় গেন্দুলি যখন ঠোঁটে জল দিচ্ছিল হরিনাম ডাকতে ডাকতে! তখন একবার শুধু দিলু বলে ওঠে, আমি মরলি চিতে দিস নে, মাটিও না; ক্ষেতে দিস, পইচে সার হবো!
ফলে,
গেন্দুলির মতন বউ যার থাকে, তার আত্মহত্যা করেও শান্তি হয়! কেননা পরদিন দেখা যায় দিলুর বাঙ্গি ক্ষেতের ঠিক মাঝখানে একদল শকুন এসে ভিড় করে! লকডাউনের এই সময়ে শকুনেরা নির্ভয়ে খেতে থাকে একজন মেডেল পাওয়া বাঙ্গি চাষির শরীর! তারপর থেকে শোনা যাবে বাঙ্গি ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া দেয়া লাগে না কেনোনা, বাঙ্গি ক্ষেতে দিলুর ভূত পাহারা দেয়! আর গেন্দুলি মনে মনে ঠিক করে ফেলে তার ছেলে সন্তান হলে নাম রাখবে, বাঙ্গি আর মেয়ে হলে নাম রাখবে, ফুটি! পরের বছর ঐ এলাকায় বাঙ্গির ফলন তুমুল হয়! সবাই বলে, দিলু যে সার দিয়ে গেছিলো এইটে তার কেরামতি! কিন্তু দিলুর মৃত্যু রহস্যের কোন কিনারা হয় না! মহামারীতে নিরন্নতার অভিশাপে সে মারা গেলো, ঋণ শোধের আতঙ্কে নাকি পুরোটাই রাষ্ট্রির ব্যবস্থার ব্যর্থতায়? এর উত্তর খোঁজার উপায় থাকে না, কেননা, গেন্দুলিকে কৃষি অধিদপ্তর সোনার মেডেল দেয় শ্রেষ্ঠ বাঙ্গিচাষি হিসেবে! গেন্দুলি ভেবে পায় না মেডেল তাকে কেন দেয়া হল? সে বাঙ্গি বা ফুটি নামের সন্তান প্রসব করেছে বলে? তাহলে কি আগামী বছর সেও মেডেল পাওয়ার অভিশাপে আত্মহত্যা করবে তার স্বামীর মতন?
Posted in: October 2021, STORY