জুয়েল মাজহার-এর কবিতা
বীতশোক ফিরে এসো
১.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক, চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে।
আমার ‘সামান্য ক্ষতি’? বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল!
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা! তরী ডোবে!
২.
পুরাতন বিষণ্ণতা, গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে,
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা।
৩.
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য-বেদনা ও ক্লেশে—হয়তো সে
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে;
যেন নীল প্রজাপতি এসে তার কাছে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে।
৪.
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোঁক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভি ভরেছে উদকে স্বার্থপর!!
‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিলো? এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?
৫.
হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে দূরে।
কত দূরে? কাউকে বলে নি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!
এই তবে গূঢ়লেখ? বৃথা তব নর্তকী ও মদ?
৬.
বীতশোক, তুমি আছো! অনন্ত পশ্চিমে নাকি পুবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!
অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?
৭.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে;—ঝরাপাতা-মুখর সরণি—
কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।
৮.
উপশম হলো ব্যথা? পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে;
অনন্ত গোধূলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে।
ঈর্ষার এঞ্জিন
[সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের জন্য]
ঈর্ষার এঞ্জিন গরজি ওঠে আজ; ঘুরছে মঞ্জুল মেঘাঙ্কুর;
ঘুম এক চিৎকার! আকাশে চুনিলাল সূর্য-ক্রন্দন ঝরায় খুন।
উন্মাদ চায় তার অধরে অনিবার স্বর্গবেশ্যার স্তনাগ্র।
কোন্ মন্কির কোন্ নকিরে লিখে মোর কোন সে-পাপ কোন অধর্ম?
অন্ধের তন্দ্রায় ক্রমশ খ’সে যায় রাত্রে বর্তুল ডালিমফল;
জন্মের-জঙ্ঘায় অঝোরে ঝরে মেঘ;—ফুটছে ফুল এক অলক্ষ্যে।
নিঃসীম কান্তার ঘুমে ও তৃণে পার। রজ্জুপথ—দূর—গভীর ডাক;
এক-ক্লোন-চণ্ডাল ঢুঁড়েছে পিপাসায় নফ্সে আম্মার—কী লান্নত!
বোর্রাক জন্মায় জেগেছে চিঁহি তার; শুনছে তন্ময় মদনটাক!
লোল্জিভ রাক্ষস আঁধারে খুঁজে যায় কূর্মপৃষ্ঠের আ-নীল মদ।
আর কার চরকায় কে এসে ঢালে তেল কার আপনজন কে কার পর?
রক্তিম জল্লাদ চেয়েছে রতি আজ বন্যরাত্রির আলিঙ্গন।
কোন মান্দাস্ কোন্ গরলে অচেতন ভাসছে ঘুম-নীল লখিন্দর?
কোন্ মৎসীর লেজ নিমেষে হয়ে সাপ বক্ষে বিষদাঁত ছোবল দেয়?
এক হিঙ্গুল মুখ ক্রমশ জোড়া চোখ ফুটছে ঘোরলাল এ-রাত্রে!
ঝঞ্ঝার মেঘ ধায় ছুটিয়ে ঘোড়া তার হানছে মৃত্যুর অপস্মার!
আজ তোর স্কন্ধের গরিমা খ’সে হায়! ছিন্নমস্তার তাথৈ নাচ!!
মনসুর হাল্লাজ জপেছে দমেদম্ মাংসে মজ্জায় আনাল হক্
ষণ্ডের তিন-শিং খুঁজেছে যোনিকূপ অন্ধ মুদ্গর আসন্ধ্যা
বল তোর উড্ডীন ডানাটা চাটে কোন ধূর্ত জম্বুক—মানিক মোর!
শিশ্নের উদগম! পেত যে উপশম জাগত হররোজ বালার্ক
ছম্ছম্ রাত্রির বেভোলা পথিকের রক্তে রম্ভার রতির স্রোত
চুপ-শ্যাম দাঁড়কাক দ্যাখে না কোনো চাঁদ উষ্ণ ফল্গুর সে-উদ্গার!
শয্যায় চুপচাপ দু’জনে দুটি লাশ ক্লান্ত, প্রেমহীন, নিরুত্তাপ!
স্পন্দন শেষ হায়! নদীতে ভেসে যায় কার গো কার লাশ মুখের ডৌল?
অস্থির খুর তার কাঁপিয়ে গিরিপথ রক্তে চঞ্চল ঘোটক ধায়।
হায় কোন্ খঞ্জর বাঁকানো খরশান চায় ঘুমন্তের লোহুর মদ?
দুগ্ধের নির্ঝর নোনা এ-শরাবের পাত্র উপচায় আ-সৎকার।
দিলখোশ পক্ষীর ঠোঁটে যে ধরা মাছ তারচে’ উজ্জ্বল কে ঝল্মল্?
স্পর্শের বিদ্যুৎ ছড়িয়ে কুহরণ রাত্রি বন্ধুর—উড়ালময়!
নিষ্ফল পুষ্পল কাননে মদালস জমছে হিম-নীল লিথির জল
বঙ্কিম চন্দ্রিমা হেরো হে, এ-আনন—একটি ফল্গুর একুশ মুখ!
সুমসাম প্রান্তর!—তবু কে কুহু গায় শূন্য মঞ্চের নেপথ্যে?
তবলায় তিনতাল বেজেছে অনিবার নৈশযুদ্ধের আমন্ত্রণ!
অদ্ভুত বর্ষার জঘনে ঝরে নুন লক্ষ তীবরীর তীরাস্ত্র।
ভঙ্গুর মুখ যার বোতলে ভরো তার তপ্ত নিশ্বাস ব্যথার ক্ষার।
পঙ্গুর ঈর্ষার কত না গুরুভার মৃত্যু-মুদ্রণ আকৈলাস!
অদ্ভুত পিঞ্জর পাখিরে ফিরে চায় স্বপ্ন-সম্ভব অলিন্দে;
মর্মের সংক্ষোভ বেদনা হাহাকার করছে মশগুল ভূমণ্ডল
ডুম্বুর পুষ্পের স্মরণে অনিবার মন্দ স্পন্দন এ-অঙ্গার!!
Posted in: October 2021 - Cover Story, POETRY