সম্পাদকীয়
ছান্দসিক আর ছন্দ রসিকের মধ্যে পার্থক্য আছে।প্রথমজনের কাজ মাপজোখের, জরিপের—কবিতাকে চেপে ধ’রে মাত্রার হিসেব-নিকেশ তার কাজ।দ্বিতীয়জনের তা নয়, তার ভ্রমণ ভিতরের… কবিতায় ধ্বনিপথের অলিগলি দিয়ে।রবীন্দ্রনাথ দিলীপ কুমার রায়কে এক চিঠিতে লিখছেন— “আজ তুমি ভাগবিভাগ করে ছন্দ যাচাই করছ, প্রাণের পরীক্ষা চলছে দেহব্যবচ্ছেদ করে। যারা ছান্দসিক তাদের উপর এই কাটাছেঁড়ার ভার দাও, তুমি যদি ছন্দরসিক হও তবে ছুরিকাঁচি ফেলে দিয়ে কানের পথ খোলসা রাখ যেখান দিয়ে বাঁশি মরমে প্রবেশ করে”।
এই পথ কবির। কবিতায় ধ্বনি থেকে ধ্বনিতে যে প্রবাহ, যে সচলতা, তাই তার একমাত্র প্রাণ… তা বাদে কবিতা লিখিত স্থবির কিছু চিহ্ন মাত্র যার আবেদন বোধের কাছে, মনের কাছে নয়। ফলে কবিকে এই পথ দিয়ে চলতেই হয় নিজের মধ্যে—নিজেকে, নিজের ছন্দকে, এই অসীম বিশ্বের ধ্বনি-সচলতাকে আবিষ্কার করতে করতে।
কবিতায় ধ্বনি সঞ্চার ছন্দের কথা মনে করায়–তাকে রিদম বা মিটার যেভাবেই দেখা যাক। ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ বিন্যাস এক ছন্দোময়তাকে সূচীত করে। সেটা হয়ত প্রথাগত ছন্দের পরিধিতে আটকে থাকে না। এমন কি গদ্যবিন্যাসেও এক ছন্দোময়তা টের পাওয়া যায়। সেকারণে ছন্দের সাথে কবিতার স্বভাবত, স্বকীয় যোগাযোগ থেকে গেছে। সেই যোগাযোগ ব্যকরণের নয়, বন্ধনের নয়, নিতান্তই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক যোগাযোগকে নিয়মতন্ত্রের বেড়াজালে বাঁধার চেষ্টাই অস্বাভাবিক। যেমন অস্বাভাবিক ছন্দের নিরিখে কবিতার বিচার।
কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে ছন্দের লেখা কবিতা যেমন লিপিত হয়েছে তেমনই নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছন্দ অস্বীকারের কবিতাও লিপিত হয়েছে। কিন্তু অনস্বীকার্য থেকে গেছে কবিতা হয়ে ওঠা না হওয়ার প্রাথমিকতা, ধ্বনি বিন্যাসের অন্তর্নিহিত ছন্দময়তা।
অপরজনের এই সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি, ‘ছন্দের কবিতা’, ছন্দ এবং কবিতার সেই সামগ্রিক পথচলাকে ছোঁয়ার প্রয়াসে। আমরা এই সময়ের কবিদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম ছন্দ ও কবিতা সম্পর্কে তাঁদের বোঝাপড়া নিয়ে একটি গদ্য এবং কবিতা দেওয়ার জন্য। এই প্রয়াসটুকু অপরজনের, বাকিটা পাঠক আপনাদের ও বন্ধু লেখকদের, যাঁরা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিলেন।
অক্টোবর, ২০২১
Posted in: EDITORIAL, October 2021