ভেসে যাওয়া এক খবরওয়ালা : দেবলীনা নাথ
১৭৮০ সাল। ভারতীয় সংস্কৃতির উষ্ণীষ সেদিন উজ্জ্বল হয়েছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’নামক এক সংবাদপত্রের আভায় আর এই পত্রের কর্ণধার ছিলেন আয়ারল্যান্ডের এক আইরিশ ভদ্রলোক ৷ নাম জেমস অগাস্টাস হিকি – দ্য পাপা অফ ইন্ডিয়ান প্রেস ৷ ১৭৭৩ এর ১লা ফেব্রুয়ারি ভাগ্যান্বেষী এই সাহেবের জাহাজ ভিড়ল বঙ্গদেশে ৷ শুরু হল জিজীবিষার তাগিদে অক্লান্ত পরিশ্রম কিন্তু সফলতা বারবার মরীচিকা হয়ে থেকে যায় ৷ প্রতারণা,লোকসান,অর্থসংকট এবং শেষে কারাদণ্ডে গিয়ে আত্মোপলদ্ধি ৷ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে অতীতের অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে শুরু হয় সৃষ্টির নতুন ঠিকানার সন্ধান ৷ ১৭৭৮ এ কলকাতার রাধাবাজারে স্থাপন করেন ভারতের প্রথম সংবাদপত্রের সূতিকাগৃহ ৷ এর ঠিক দুবছর পড়েই ভূমিষ্ঠ হয় ভারতের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ ৷ একদিকে পলাশীর উত্তপ্ত প্রান্তর আর অন্যদিকে দিল্লির মসনদের অস্থিরতা এমন মৌষলগ্নে দাঁড়িয়ে সম্পাদক হিকি সাহেব পত্রিকার মুখবন্ধে ঘোষণা করলেন যে, এটি একটি রাজনৈতিক ব্যবসায়ী পত্রিকা ৷ সকল দলের জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত, তবে এটি কারো দ্বারা প্রভাবিত নয় ৷ নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার এতটাই দৃঢ় ছিল যে অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার রুদ্রবীণা মুখরিত হয়ে ওঠে ৷
অষ্টাদশ শতকের কলকাতার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যাসংকুল জীবনের খতিয়ান দিতে শুরু করে ‘বেঙ্গল গেজেট’ ৷ ইস্ট ইন্ডিয়ার কর্তা ব্যক্তিদের কুকীর্তি ফাঁস করতেও দ্বিধান্বিত হয় নি ৷ তাই কখন যে ‘বেঙ্গল গেজেট’র জনপ্রিয়তার হাত ধরে রাজরোষ এসে দুয়ারে দাঁড়ালো তা বুঝতে উঠতে পারলেন না হিকি সাহেব ৷ ফলস্বরূপ তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস শুরু করলেন ক্ষমতার প্রদর্শন ৷ ‘Power exists only when it is put into action’ (The subject and Power : Michael Foucault) অর্থাৎ ক্ষমতার অস্তিত্ব কেবল তখনই থাকে যখন তা ব্যবহৃত হয় ৷ আর এই সত্য যেকোনো শাসকেরই অবগত ৷ হেস্টিংস আর কেনই বা এই তত্ত্বের ব্যতিক্রম হবেন ! হিকির কলকাতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ দিয়ে সূচনা হয় ক্ষমতার উদগ্রতার প্রদর্শন এবং যার সমাপ্তি হিকির কারাদণ্ডে ৷ কিন্তু সেখানে বসেও তিনি পরিবেশন করে গেছেন একের পর এক আক্রমণাত্মক রচনা তবু শেষরক্ষা হল না ৷ ১৭৮২র ৬ই এপ্রিল কোর্টের নির্দেশে হিকির মুদ্রণঘর সহ পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া হয় ৷ শেষ হয় সংবাদপত্রের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় ৷ এরপর অবশ্য দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সম্পাদকের জীবন ৷ আত্মীয়-বন্ধুহীন জীবনের ঘূর্ণিমায়ায় ঘুরতে-ঘুরতে আগুন আর আলোর পার্থক্য বুঝতে পেরেছিলেন ৷ কিন্তু হতোদ্যম হয়ে পড়েননি,সেকারণেই ১৮০২সালে বাঁচার আশায় আবার জাহাজে ভাসলেন ৷ কিন্তু দীর্ঘ পথের ক্লান্তি নিতে পারলো না মনের অবসাদে ক্লান্ত বয়স্ক শরীর ৷ তাই চেনা কূলে আর ফেরা হল না সম্পাদকের ৷ অতলের টানে ভেসে গেলো তাঁর নশ্বর শরীর ৷ কবি শঙ্খ ঘোষ ‘ত্রিতাল’ কবিতায় লিখেছিলেন:
“তোমার কোনো ধর্ম নেই,শুধু শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই,শুধু বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া’
উক্ত পংক্তিটি হিকি সাহেবের দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের ইতিহাসের নির্যাস বললে অতিকথন হবে না বোধহয় ৷
এমন নির্ভীক নিরপেক্ষতা আজ অবধি কোনো সংবাদমাধ্যম দেখাতে পারল না ৷ কেউ ভগবানকে ভয় পেলো, কেউ আবার এগিয়ে রাখলো পিছনের দিক থেকে; আর আমাদের প্রজন্ম শুধু বুঝে নিলো বেশিরভাগ পত্রিকার সম্পাদক মানে গোঁসাই ঠাকুরদের মত ‘আজ্ঞাবহ দাস’ ৷ এমন এক জরাজীর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে পৃথ্বী সেনগুপ্তের ‘হতভাগ্য এক সম্পাদকের কাহিনী’ আমাদের ইতিহাসের ছাইকে সরিয়ে হিকি সাহেবের মতন এক অবিক্রীত শিরদাঁড়ার সম্পাদককে নতুন করে চিনিয়ে দিল ৷ নিষ্ঠাবান সম্পাদক হওয়ার অপরাধে তিনি হয়েছিলেন একদিন হৃতসর্বস্ব ৷ অনেকটা যেন রিচার্ড এলডিংটনের ‘All Men’s are Enemies’ এর নায়ক অ্যান্টনি, আবার কখনো তাঁকে মনে হয়েছে ‘অমলকান্তি’ যে অন্ধকার ছাপাখানার কাজ করত সেখানকার এক দিকভ্রান্ত শ্রমিক যাঁকে ইতিহাস মনে রাখবে বুঝতে পেরে বর্তমান খুবলে খেয়েছে সুযোগ মতো ৷
পৃথ্বী সেনগুপ্তের কথা বলার ধরণ আলগোছা ৷ আপাত নিরীহ ৷ তথ্য নির্ভর ৷ বর্ণনামূলক পদ্ধতিতেই এগিয়েছে তিনি টুকরো টুকরো ঐতিহাসিক ঘটনাকে তিনি অতি সন্তর্পণে জুড়ে দিয়েছেন ৷ তবে কিছু কিছু জায়গায় নিজেও পাঠক হয়ে থমকে গেছেন,বিশেষ করে ‘কালো মেঘের ছায়া’ শীর্ষক অংশের শেষ প্রশ্নগুলো যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ৷ এছাড়াও গৌরচন্দ্রিকা অংশে লেখকের অকপট স্বীকারোক্তি: “আমার শিক্ষার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের হিকি নিয়ে পড়াশুনোর ফসল এই বইটি ৷ যেটি গবেষণাপত্র নয়,গবেষণার ফসল হিসেবে বিভিন্ন মোড়কে একটি উপস্থাপনা মাত্র ৷”
তিনি আরো জানান ‘Hicky’s Bengal gazette’ বা ‘Calcutta general advertiser’ এবং সেই সময়কার কিছু ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্যাবলি নির্ভর করে সমৃদ্ধ হয়েছে ‘হতভাগ্য এক সম্পাদকের কাহিনী’ ৷
দিগন্ত পাবলিশার্স থেকে ২০২০র নভেম্বর প্রকাশিত আশি পাতায় সম্পূর্ণ ‘হতভাগ্য এক সম্পাদকের কাহিনীর’র প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন শ্রী কুমার সেনগুপ্ত ও ঈশানী সেনগুপ্ত ৷ লেখক ভাগ্যা্ন্বেষী হিকি সাহেব থেকে হতভাগ্যবান হিকি সাহেবে পৌঁছেছেন ১৯টি শিরোনাম যুক্ত পর্বের মধ্যে দিয়ে ৷ প্রতিটি পর্ব পরিমিত ৷ একদম শেষে যুক্ত হয়েছে ‘চিত্রপঞ্জী’ ও ‘মুখ্য ও পার্শ্বচরিত্র’ শীর্ষক অংশ বইটিকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে ৷ আশা করা যায় এই অংশটির জন্য বইটি কেবল ইতিহাসের ছাত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না,ইতিহাস অনুরাগী সকল পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে ৷ তবে প্রথম পরিচ্ছেদ অর্থাৎ ‘অষ্টাদশ শতকের বাংলার বর্ষানুক্রিমক ইতিহাস এবং সমসাময়িক সমাজ জীবন’ শীর্ষক অংশে ঐতিহাসিক তথ্যের ভারকে নান্দনিকতার মলাটে দেখালে ভালো হতো,একঘেয়েমি আসতো না ৷ এছাড়াও যে বিষয়টি একদম অনালোচিত থেকে গেছে সেটি হল,একাধিক বহুমুখী পেশায় অভিজ্ঞ হিকির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ৷ শুধু সর্বস্ব নাশের অশ্লেষা সময় দাঁড়িয়ে এক হতভাগ্য সম্পাদকের আর্তনাদই ধ্বনিত হয়েছে ৷
[লেখক – রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। বাংলা ভাষায় স্নাতকোত্তর। বর্তমানে নাটক নিয়ে গবেষণা করছেন। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিজে বাংলা ভাষাবন্ধু হিসেবে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে কাঁচরাপাড়া কলেজে বাংলার শিক্ষক।]
Posted in: BOOK-REVIEW, October 2021