ছন্দ ও কবিতা : চিত্তরঞ্জন হীরা

ছন্দ নিয়ে সাহিত্যে পাতার পর পাতা খরচ হয়ে গেছে। তেমনি কবিতার কী ও কেন নিয়েও হাজার প্রশ্ন আর হাজার হাজার ব্যাখ্যা। এখন আমরাও প্রশ্ন করতে পারি যে – আচ্ছা, ছন্দ ছাড়া কি কবিতা হয় ! সে অর্থে ছন্দ ছাড়া জীবনও অচল। তবু ছন্দ নিয়ে কথা হয়, কবিতা নিয়েও আমরা আড্ডায় মেতে উঠি। সত্যিই তো কবিতা আসলে কী ! এ প্রসঙ্গে এমনটা মনে হয়, কিছু শব্দ মিলে একটা অনুভূতির প্রকাশ ঘটলো, একটা টেক্সট উঠে এলো আমাদের সামনে। তাকে পাঠের সময় যখন মনে হবে বিষয়টি মুখের কথার প্রকাশ থেকে কোথাও না কোথাও আলাদা। এই আলাদা হয়ে ওঠাটাই সাহিত্যের অঙ্গ। আর তার মধ্যে এমন কিছু এলিমেন্ট থাকে যা ঠিক মৌখিক নয়, একমাত্রিক নয়, যার ধ্বনির মধ্যে এমন এক অনুরণন থাকে যা কখনও কখনও ভেতরে ভেতরে বাজে। এই বেজে ওঠাটাই অন্তর্গত ধ্বনির ব্যঞ্জনা। আসে একটা তাল বা ছন্দ থেকে। আসলে কবিতার অনুভূতি প্রাত্যহিক জীবনের সংযোগের ভাষা থেকে একটু আলাদাই। কারও কারও কথা বলার ধরণে আশ্চর্য এক ছন্দ থাকে, শব্দ ব্যবহারের মাধুর্য থাকে‌। কিন্তু তা ঠিক কবিতা নয়। কবিতা এর সঙ্গে আরও কিছু দাবি করে।
তবে ছন্দ বলতে এতদিন পাঠক যা বুঝলেন সেটা হলো প্রথাবদ্ধ, নিরূপিত। যা ব্যাকরণে সিদ্ধ । যা মূলত তিনটি – অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত, কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত। ছান্দসিকরা আবার এদের আরও অনেকরকম নামকরণ করেছেন। আমরা ততটা বিস্তৃতে যেতে চাইছি না। তবু বলবো বিষয়টা তাত্ত্বিক। আর এই তত্ত্ব ও কবিতার পাঠবৈচিত্র্য থেকে পরবর্তীতে আরেকটি ছন্দের কথা গবেষকরা বললেন, গদ্যছন্দ ,ভাবের ছন্দ বা ভাবছন্দ। ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেও এর বাইরে বোধহয় বাংলা কবিতায় আর কোনও ছন্দের উদ্ভব হয়নি।
এখন কথা হলো ছন্দ আর অন্ত্যমিল যে এক নয় এ নিয়ে সাধারণ পাঠকের মনে একটা সংস্কার রয়ে গেছে, যা অনেকটা অন্ধসংস্কারের মতো। যেমন মুসলমান আর বাঙালি। যাহোক বাংলা ছন্দের আবির্ভাব বোধকরি ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্য থেকে। মিলের ব্যাপারটায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেখানেও তেমন অন্ত্যমিল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। যে চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার যাত্রাকে ধরা হয় সেখানে সবাই সেভাবে নিরূপিত ছন্দ ব্যবহার করেননি। আদ্য মধ্য অন্ত্যমিলের ব্যবহার, সহজস্বরের বিন্যাস সম্ভবত প্রথম এলো জয়দেব-এর কবিতায়।
যেটা হয়েছে, যেখানেই অন্ত্যমিলের ব্যবহার প্রাধান্য পেয়েছে সেখানেই কবিতা হয়ে উঠেছে গীতিধর্মী। অর্থাৎ শব্দের ভেতর সুরের ঝংকার। শুরু থেকেই কবিতা গান করে প্রচার করা হতো। পাঠক সেখানে প্রধানত শ্রোতা। যেমন চর্যাপদ আসলে চর্যাগান। তখন দ্বাদশ শতক। এই পর্বের শেষভাগে এসেছিলেন জয়দেব। গীতিময়তার অনন্য প্রকাশ হলো ‘গীতগোবিন্দ’। সেই প্রভাব এতো দীর্ঘ হলো যে বৈষ্ণব কবিতার সহজিয়া পথ পেরিয়ে চলতে চলতে একেবারে বিশ শতকে বিহারীলাল, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র-অনুসারিদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করলো। তবে সত্যি কথা বলতে এখনও ছন্দ মাত্রা অন্ত্যমিলে সাজিয়ে কবিতা লেখা হয়। কিন্তু যার পূর্বসূরি আসলে রবীন্দ্রনাথ নন, কবি জয়দেবই। কারণ তিনিই প্রথম সংস্কৃত কাব্যের অন্তর্গত ছন্দকে পেরিয়ে বাংলা কবিতায় অন্ত্যমিল ও মধ্যমিলের যাত্রার পথ সৃষ্টি করেছিলেন।
পদাবলী কাব্যের পর প্রায় পাঁচশো বছর ধরে চলেছে মঙ্গলকাব্যে পয়ারের অবাধ চলাচল। পয়ার বা অক্ষরবৃত্ত। কেউ বলেছেন লাছাড়ি ছন্দ। এ সমস্ত ক্ষেত্রে বিষয়ই প্রধান ছিল। ছন্দ নিয়ে ভাঙচুর বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। কারণটা বোধহয় সমাজের মানুষকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা। একটা চলমানতা, লোকপ্রিয়তা। সুর করেই কবিতাকে জনমানসে পৌঁছে দেওয়া। পরের দুশো বছর আমাদের সামনে প্রবাহিত হয়েছে অনুবাদ কাব্যের স্রোত। বিশেষত বলতে হবে রামায়ন, মহাভারত-এর কথা। যেখানে পয়ারের ব্যবহার খুবই লক্ষ্যণীয়। তারপর এলো কবিগানের যুগ। বিশেষত আবহমান গ্রামবাংলার উৎস থেকে উঠে আসা বাউলগান,লোকগীতি, সারিগান, আবার অন্যদিকে নাগরিক সমাজের বিলাসব্যসনের অনুষঙ্গে আখড়াই, হাফ-আখড়াই খেউড়, পাঁচালি ইত্যাদি। যেখানে ছড়াছন্দ অনেকটা ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া পয়ার তো রয়েছেই।
এরপর মধ্যযুগ জুড়ে বিরাজ করেছেন কবি ভারতচন্দ্র। বলা হয় বাংলাভাষার প্রথম ছন্দসচেতন কবি হলেন তিনিই। বিদগ্ধ কবি। ছন্দ নিয়ে তাঁর ভাঙচুর, তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাংলা কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে অনেক সাহস জুগিয়েছে। তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ছন্দকে বাংলা ছন্দের সঙ্গে মিশিয়ে, বাংলা ছন্দকে প্রথম একটা শক্ত নির্ভরযোগ্য ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’-এর কথা তাই বারবার ওঠে। কত পংক্তি প্রবাদ হয়ে গেছে ! যদিও মঙ্গলকাব্যের যুগ তখন শেষই বলা যায়। তবুও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে রয়েছে তিনটি ভাগ। প্রথম ভাগে শিবায়ন বা দেবীমঙ্গল, দ্বিতীয় ভাগে কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি। তৃতীয় ভাগে রয়েছে মানসিংহ-প্রতাপাদিত্য-ভবানন্দের কাহিনি। দেবীমঙ্গল এবং কালিকামঙ্গল বাংলায় প্রচারিত ছিল। অনেকেই লিখেছেন। বিশেষ করে বিদ্যা ও সুন্দরের প্রেমকাহিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে তিন চার শতাব্দী আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রধানত বিহ্লনের ‘চৌরপঞ্চাশিকা’ উপাখ্যানকে আশ্রয় করে বিদ্যাসুন্দরের কাহিনিকাব্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় লেখা হয়। অনেকেই লেখেন। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে রাজসভার কবি হিসাবে ভারতচন্দ্রকে ‘অন্নদামঙ্গল’ লিখতে হয়েছিল। এখানে তৃতীয় ভাগটি তাঁর মৌলিক রচনা। এক অন্নদা ছাড়া কাব্যের ভাগ তিনটির মধ্যে আর কোনও যোগ নেই। এক্ষেত্রে আরও লক্ষ্য করার বিষয় হলো নামে মঙ্গলকাব্য হলেও পুরোনো মঙ্গলকাব্য থেকে এই কাব্যের চলন অনেক আলাদা। একে বলা হয়েছে নতুন মঙ্গলগান। বিষয় উপস্থাপনের এ কাব্যের অনন্যতা রয়েছে। সেই কারণেই প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন এই কাব্য থেকেই আমাদের সাহিত্যে ‘secular spirit’-এর জন্ম।
যাহোক বাংলা কবিতায় ছন্দ নিয়ে কথা বলতে গেলে এরপর ঈশ্বর গুপ্তর কথা আসবেই। বলা হয় খাঁটি বাঙালি কবি। ছন্দে ছন্দে বাঙালির কথায়, ভাষায়, মনের ভাব প্রকাশে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তাঁর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা কবিতাকে বলা হয়েছে ‘গানের যুগ’। এই গানের পর্ব নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। আমরা সেবিষয়ে বিস্তৃত না গিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি, ১৭৭৮ সালে বাংলায় যখন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলো, তার প্রভাব বাংলা কবিতায় পড়তে শুরু করলো। কবিতার শব্দ সুরের নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে শুরু করলো। কবিতা ক্রমশ গাধ ছেড়ে পাঠবস্তু হয়ে উঠতে লাগলো। সে প্রয়াস ভারতচন্দ্রের কবিতাতেই প্রথম দেখা যায়। যেখানে ছন্দের তালে তালে কন্ঠস্বরের ভঙ্গিমা ফুটে উঠছে।
ভারতচন্দ্র জন্মেছিলেন ১৭১২ সালে, মৃত্যু ১৭৬০-এ। তাঁর একশ বছর পর ঈশ্বর গুপ্তর আবির্ভাব। ( ১৮১২- ১৮৫৯ )। তাঁর পরবর্তী কালে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছিলেন তাঁরা বাংলা কবিতায় একটা বড় বাঁক আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার প্রধান কারণ হলো ঔপনিবেশিকতা। এই সময়ে তাঁরা ইউরোপীয় কাব্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এখান থেকেই বাংলা কবিতার ভাব ও শৈলীর বিবর্তন হতে শুরু করে। এরপর বাংলা সাহিত্য পেলো মধুসূদনকে। উচ্চারণভিত্তিক যতির আবির্ভাব তিনিই ঘটালেন। পয়ারের আচ্ছন্নতা ভেঙে যতির স্থান বদলে তিনি অমিত্রাক্ষরের মাধ্যমে আরেক যুগান্তর সৃষ্টি করলেন। এই প্রথম অন্ত্যমিল না রেখে কবিতাকে আমরা পেলাম পদ্যের আকারে।
পরবর্তী ধারা হিসাবে গদ্যকবিতার আবির্ভাব অবশ্য ঘটেছিল মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশের বছরেই। অর্থাৎ ১৮৬১ সালেই কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার-এর হাতে। এরপর ১৮৭৬ সালে চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়-এর ‘উদভ্রান্ত প্রেম’ ছিল আরও একটি গদ্য কবিতার প্রয়াস। বঙ্কিমচন্দ্রও শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। টানা গদ্যে তিনটি সফল কবিতা তাঁর প্রথম ‘গদ্যপদ্য বা কবিতা পুস্তক’গ্রন্থে রয়েছে।
মধুসূদনের পর বাংলা কবিতায় এলো রবীন্দ্রনাথের কাল। তাঁকে বলা হয়েছিল ছন্দোগুরু। তাঁর হাতের স্পর্শে উচ্চারণনির্ভর ধ্বনির প্রাধান্যে বাংলা কবিতার পরিসর বেড়ে গেলো। উচ্চারণের মধ্যে ধ্বনিকে উপলব্ধি করা, সেই নিরিখে ধ্বনিমাধুর্য কীভাবে বিস্তার ঘটাতে পারে তিনিই প্রথম আমাদের দেখালেন। রবীন্দ্রনাথ অক্ষরবৃত্তকে যেমন উপলব্ধি করেছেন যথাযথভাবে, তেমনি কলাবৃত্তকে সঙ্গে নিয়েই বাংলা বাকরীতি অনুসারে দলবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করলেন। তাঁর সৃষ্টির মাহাত্ম এখানে। মনে রাখতে হবে মধুসূদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিশ্রবৃত্তকে প্রয়োগ করেছিলেন শুধুই অক্ষর গুণে গুণে। রবীন্দ্রনাথ ধ্বনিকে কানে নিলেন। প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ জানতেন ছন্দশাস্ত্র দর্শনশাস্ত্র নয়। এটি আসলে একটি শ্রৌতশাস্ত্র। তাই মিশ্রবৃত্তকে তিনি দৃশ্যমান অক্ষর সংখ্যার সংকীর্ণ খাঁচা থেকে কানে শোনা ধ্বনির আকাশে মুক্তি দিতে পেরেছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দ নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তিনি ছন্দশিল্পী, ছন্দের জাদুকর। কিন্তু কবি হিসাবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা কমই হয়। রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যান অনেকেই। রবীন্দ্রনাথ গদ্যকবিতার ক্ষেত্রেও যেভাবে বিচরণ করেছেন তা ছান্দসিকদের ভীষণ মুগ্ধ করেছে। গদ্যকবিতায় মূলত যা প্রধান, তার অন্তর্গত ধ্বনি বা ছন্দ। তার উপর নির্ভর করে বাংলা কবিতা পরে আরও মুক্ত বা স্বাধীন হতে পেরেছে। তাঁর ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় তিনি নিজেই লিখেছেন –”গদ্যকাব্যে অতিনিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সসজ্জ সলজ্জ অবগুন্ঠন প্রথা আছে তাও দূর করলে গদ্যের স্বাধীনক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের আবিষ্কারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।”
এজন্যই বারবার বলা হয়, কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস, টেকনিকবদলের ইতিহাস, আঙ্গিকের দিক থেকে তা ক্রমান্বয়ে ছন্দোমুক্তির ইতিহাস। যেমন মধুসূদন, যেমন রবীন্দ্রনাথ। আমরা দেখলাম গদ্যছন্দের উদ্ভাবনায় বাংলা কবিতার পরিসর বাড়লো, কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এসে কবিদের কেউ কেউ কিছুটা সংকোচেও পড়লেন যে, শাসন ভাঙলে না কাঠামোটাই ভেঙে যায় ! তাই অনেকেই ছন্দোমুক্তির সঙ্গে ছন্দশাসনের সমন্বয়ও খুঁজেছেন। এর বাইরে ছন্দোমুক্তির জন্যে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো চলছেই।
ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই নিরূপিত ছন্দে লেখা বর্জিত হয়ে চলেছে। টানা গদ্যে বা কবিতার মতো পংক্তি সাজানো গদ্যে এখন লেখার চলন সিদ্ধ হয়েছে। কোথাও কোথাও এই পংক্তি বিভাজন দৃশ্যত হয়ে উঠছে কখনও চিত্রকরের তুলিতে এঁকে তোলা বিমূর্ত ছবির মতো, কখনও জ্যামিতিক। কিন্তু নিবিড় ব্যঞ্জনাধর্মী। এখন আর সেভাবে সহজ সরল একমাত্রিক কবিতা লেখার মধ্যে অগ্রমনা কবিদের তেমন স্ফূর্তি নেই। কারণ তাঁরা এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন। জীবনভাষাও তো হয়ে উঠেছে অনেক জটিল। আপাত সরল শব্দ বা শব্দগুচ্ছের মধ্যেও কবিদের রহস্যপ্রসাধন কাজ করে যায়। এটাই কবিতার আড়ালমাধুর্য।
তবে ভাষার বিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, ছন্দের মুক্তি খুঁজতে খুঁজতে ছন্দশাসন না মেনেও আমরা কবিতায় ছন্দ নিয়ে কাজ প্রত্যাশা করতেই পারি। সেখানে হয়তো নিরূপিত অর্থাৎ মিশ্র, কলা, দলবৃত্তের আলাদা কোনও চিহ্নায়ন থাকবে না। মিলে মিশে যা পাঠক ও শ্রোতার একই সঙ্গে দৃশ্য এবং শ্রুতির নিরাময় ঘটবে। উপলব্ধির দরজায় সেই বেজে ওঠা। বুদ্ধদেব বসু একসময় বলেছিলেন – “কবিতার নবজন্ম তখনই সম্ভব হয় যখন কবিরা ভাষাকে দেন নতুন প্রাণ ও ধ্বনিস্পন্দন।” আমরা তার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। বাংলা কবিতার এই ছন্দোমুক্তির পথেও নতুন এক ছন্দে জেগে উঠুক আরেকটা নতুন সকাল।




হারানো আশ্বিন




ভোর লিখে ফেলে ঝরাপাতার সন্নাটা।
মেঘ ছুঁই ছুঁই আকাশবাড়ির ছাদে
বিভোর জমছে। কুয়াশার পাখিপড়া
ভাব ছাড়তে চায়না। তবু দেখো পড়ে
যেতে যেতে সেতো একটুও ঝরলো না।
বৃষ্টিগন্ধে মেখে নিলো সকাল হাঁটায়।

একটা পথ চলেছে। বাজানো হয়নি
অনেকদিন তাকে। আড্ডার দিনগুলো
এঁকেবেঁকে। উড়োকথাদের ছোঁয়া থেকে
দূরত্ব মাপে। হারাতে হারাতে চোখের
আদর নামিয়ে রাখছে রেটিনার পা।
পায়ে পায়ে জ্বলতে জ্বলতে নিভু আঁচে।

একঘর ঘাঘরা বাতাস আলপথে
ফিরতে শিরোনামহীন অক্ষরে বাজে।



মাত্রাছুটের খেলায়




ছুটির ঘণ্টা নামতা পড়াচ্ছে
একটা জীবন নিরুদ্দেশে
একটু বেঁকে
ঢেউ ফেলে যায় একটা আদর
জ্যোৎস্না আড়াল একটা পরত
খুলতে খুলতে প্রহর শেষের
                 ঘণ্টা বাজছে কানে।

চাঁদ কি তখন ঝলসে ওঠা নদী !
সন্ধ্যা নামের বিমূর্ত সব মূর্তিগুলো
যদি মুক্তবন্ধ হতো
যদি শব্দখোলস ছাড়তে ছাড়তে
একলা জাগার ব্রত
ফেলতো শিহরণের পাতায় !
তাহলে কি সেই অন্ধরাতের তারা
চিত্রকল্প মাথায় হাজির হতো
ফেরিওয়ালার বেশে
নাকি হাজার বছর কাটিয়ে দিতো
                          মাত্রাছুটের ঘাটে !

Facebook Comments

Leave a Reply