ছন্দের কবিতা : অমিতাভ প্রহরাজ

যে লিখছে তার কঙ্কালও লিখছে। শুধু মাত্র মেধা কিংবা হৃদি নয়। আমি শুধু দেখি তাকে আর নীরবে নীরবে মুখরিত হয়ে যাই। মানুষ মাত্রেই লেখার মানুষ। আর লেখার মানুষ দুরকমের থাকেন, একদল যাদের ছন্দজ্ঞান ছন্দবোধ আছ বা বলা যায় ছন্দ জানা মানুষ। আরেকদল অপছন্দ জানা মানুষ। আমি পারি না, সত্যিই পারিনা অপছন্দে লিখে উঠবো ঝমঝম করে যখনই প্রয়োজন। শব্দ বাজবেন, শব্দ আমাকে বাজাবেন, তারও বহু বহু আগে শব্দ আমাকে বাছবেন। আমি নগ্নে মগন মানুষ। নিকুঞ্জ লেগেছে দেখি গাছের ন্যাংটোতে। ভালো লাগলো গতকথা গুলো? একটি কঙ্কাল বাক্য বাজাচ্ছে প্রকৃত প্রস্তাবে। লেখার যেদিকেই তাকাই না কেন দেখি মানুষের ভেতর কঙ্কাল কলকল করছে। কোথাও তো দেখিনি তোরণ বা মিনার বা কোনো ভাস্কর্যশিল্প হাসছে মানুষের ভেতরে। এবার উদ্ভাসিত দেখছি, কেন তুমি কঙ্কাল ভয় পাও খুব। জগৎ অন্ধকার হলে কঙ্কালে ভিরমি খেয়ে যাও। নিজের ভেতরকে এত ভয় পাও? এত এত? তুমি কে জানিনা, সত্যিই জানিনা, যেই হও না কেন একটি কঙ্কালী লাবণ্যের মালিক, আমি এভাবেই দেখবো তোমাকে। অপছন্দে লিখতে পারিনা কখনো তাই লেখা অপছন্দ করতে পারিনা, পারিনি কখনোই। লিখে অপছন্দ করে করে তার ঘাটতি মেটাই।

তখন বড় ছন্দভক্ত, আমি ও ইন্দ্র দুজনেই.. ইন্দ্রর থেকে, দেবাদা নীলাদ্রিদার থেকে আমি কবিতার, ছন্দের অনেক কিছু শিখেছি.. এটার একটা সম্ভবতঃ এরকায় বেরিয়েছিলো..

১.

ওহে অঞ্জনা একি অঞ্জন
মনে মেঘে আজ মৃদুগঞ্জনা মধুগুঞ্জন
উড়ন্ত ফুল শয্যায়, ঘনলজ্জ্বায় আমি তো তোমার
কব্জায়, নড়ে উঠি, যেন দরজার মতো মানুষ করেছে মা
অবনত, মা উন্নত, মার মঞ্জরী এ উপদ্রবে দেখেছে ছবি তার
দেখেছি সন্ধ্যায় প্রতিমা পরানো ল্যাম্পপোস্টের নীচে, ওহে শুনছো কি
এ্যাসেক্সুয়ালি
বেড়েছে বেড়ে যায়
যতো সঞ্চিত খঞ্জনী মতো
কবিতা আমার…

২.

আমার অন্ধত্বের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়া
নালে এসে লাগলো আলো কুছ নেহি তো থোড়া
থোড়াসা রঙ্গিলি আলো ঘোড়ার পায়ে বাঁধা
অন্ধ অনুভবের পাশে আলোকময়ী রাধা

৩.

আরেকটার আর্ধেক মনে পড়ছে

চাঁদের কলোনীতে শাওনী জলবায়ু ঘরে ঘরে শুধু যক্ষ্মা
কথা খেয়েছিস মাদী রাক্ষুসী আজ তবে তুই চোখ খা
আমিও কথা বলি, খড়গ পথে চলি, জিভ ঠেকে যায় মূর্ধায়
গুরুজন যত দোভাষিনী রাখে যোগাযোগ হবে ক্ষুরধার

তারপর মনে পড়ছে না, শেষ লাইন ছিলো

কাহ্নরও হৃদমধ্যে যক্ষ্মা সমকামী হলো রাধিকা

আমি কানুরও হৃদমধ্যে লিখেছিলাম, দেবাদা বললে এক মাত্রা বেশী হচ্ছে.. কাহ্ন করে দিলে বেশী হবেনা, আমি প্রথম শিখলাম ছন্দ কারেকশান কাকে বলে

(১৯৯৮, আমি নামক বস্তুটির বয়স তখন ১৯.৫০)

আবার কবিতা ৩

মেঘের কথা ভেবে আমার দারুণ গড়ন হয়
উল্লসিত, উচ্চকিত। উদ্ভাসিত নয়

লুকিয়ে থাকি একার ভেতর অটুট আন্ধারে
মন ভরে যা! কীসব রসে তবুও বান্ধা রে

কষ্ট শ্বাসে, নষ্ট বাসে রাস্তা জোড়া মেলা
মুখোশ পরে হাঁটছি আমি, লোকের অবহেলা

এই পড়ছে জলের পরে সংখ্যাহীন জল…
নামছি আমি উঠছি শুধু অতল অবিরল

মাছবাজারে মন করেছি রাস্তা-কাদা ফেলে
গন্ধ আঁশে, ছিটকে আঁশে আমার বড় ছেলে

কন্টি নুই টাই-

সম্প্রসারণ হলো প্রাণধর্ম। যেকোনো বাক্যই অসীম অবধি সম্প্রসারণ সম্ভব। আমরা বাক্যের সেই কন্টিনুয়েশান থেকে না লেখা না বলা কথা খুঁজি। এতেই লেখা জন্মায়। আর এতে কোনো দোষ নেই। দোষ হচ্ছে যেভাবে কন্টিনিউ করি বা যেভাবে বাড়াই আমাদের দেখা। ধর আমি বললাম “কবিতা অংক নয়”। আর মস্তো বড়ো এক মানুষ এসে তাকে বাড়াতে বসলো, না লেখা, না বলা জায়গাগুলো বলতে বসলো আর লিখলো
“কবিতা অংক নয়। কারন অংকে মিল লাগে, অংকে মাপা যায়, কবিতা মাপা যায় না। অংকে ঠিক ভুল হয়, কবিতার ঠিক ভুল হয়না। কবিতা গণিত নয় কারন গণিতে নিয়ম থাকে, গণিত ধাপে ধাপে চলে আর কবিতা প্রাণের আনন্দে লাফায়……”

এইভাবে বাড়িয়ে বাড়িয়ে সেই মস্তো বড়ো মানুষ কি খুঁজে পায় বলতো? খুঁজে পায় কারণ। আর কারণের এমন নেশা, কারন খুঁজে পেয়েও আবার কারন খোঁজে, তারপর আবার কারণ খোঁজে, আর অসীম অবধি কারণই খুঁজে যায়। তার আর দু নয়ন ভরে অকারণ দেখা হয় না।

কিন্তু মস্তো বড়ো মানুষের বদলে একটা পুঁচকে বাচ্চা হাতে পেল “কবিতা অংক নয়”। আর তারপর তাকে বাড়ালো কিভাবে বলতো?

“কবিতা অংক নয়। কবিতা ছিলো কুঝিকঝিক রাজ্যের রাজকন্যে। আর অংক ছিলো তার পাশের এক রিমরিম করে ডেকে চলা ঘন জঙল। কবিতা তো অংক নয়, অংককে দেখেও নি কোনোদিন। অংকও কবিতা দেখেনি কোনোদিন। অথচ ওই কুঝিকঝিক রাজ্য আর তারপাশে রিমরিম করে ডাকা গম্ভীর জঙ্গল, সেখানেই থাকতো দুজনে। তারপর তো কতো যুদ্ধ, কতো রাক্ষস, কতো ভালোপরী বাজে পরী। তারপর কবিতা ও অংকের হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কবিতা দেখলো আরে সে তো অংক নয়। অংক দেখলো আরে সে তো কবিতা নয়। খুব বন্ধু হলো দুজন। তারা একে অপরকে ডাকতো নয়ংক আর নয়কবিতা বলে। এই দেখে গম্ভীর জঙ্গল আস্তে আস্তে গভীর হয়ে গেল……”

এইভাবেও কন্টিনুয়েশান হয় কিন্তু। এভাবেও দেখাকে বাড়ানো যায়। এই নালেখা না বলা কথাগুলোও রূপকথার মতোই চুপটি লুকিয়ে থাকে। থাকে ওই একটা বাক্যের বাড়ানো আভাসে। এই সেই অকারণময়তা যা কারণের নেশা, বিরোধের নেশায় হারিয়ে ফেলে মানুষ।

কবিতা অংক নয়। হয়তো কখনো কবিতা থেকে অংক হবে খুব। এমন ভাবতে বুঝি অসুবিধে খুব? কেন, অংকের একটা অর্থ কোল নয়? আর কবিতা যদি একটা শিশুর নাম হয়। সে থাকে কোলে কিন্তু সে তো কোল নয়। একদিন হয়তো তারও কোল হবে, অংক হবে। আর সেখানে মৃদুল মহুল বাতাসে দুলবে অন্য আরেক কবিতা। কোথাও বিরোধ নেই তার আতরে আভাসে।

Facebook Comments

1 thought on “ছন্দের কবিতা : অমিতাভ প্রহরাজ Leave a comment

  1. চাবুকের শপাং করার আগে যেমন ঢেউ খেলে তেমন…

Leave a Reply