জগবন্ধুর একদিন অথবা জগন্নাথের অষ্টপ্রহর : অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

(১)

– অ্যাই জগু, এদিকে তাকা। জগু?
– নর্দমার জল কেমন বিনবিনিয়ে ঘুলাচ্ছে না?
– অ্যাই জগু, তাকা না!
– তুমি যাবে না ডাক্তারস্যারের বাড়ি?
– তুই তাকাবি?
– ঘুম পাচ্ছে। কাল পাঁউরুটি আসবে তো?
– অ্যাই, একটা চুমু খেতে দিবি?
– নাঃ।
– দে না রে! সেদিন দিবি বললি যে!
– নর্দমাটা কেমন রং পাল্টাচ্ছে, না? ভেপসে যাবে, একটু পর ভেপসে যাবে।
– আচ্ছা, ঠোঁটে খাবো না। গালে খাই?
– হাতটা ছাড়ো। এঁটো করে দিলে।
– ধুয়ে নে। জল দিচ্ছি।
– কাল পাউরুটি না পেলে কিন্তু হরিণ’দা বিস্তর ঝামেলা করবে।
– অ্যাই জগু, কি সুন্দর লাগছে রে তোকে দেখতে! একটা চুমু খেতে দে না?
– নাঃ।
– কেনো?
– আমার নাম জগু না।
– ন্যাকামো করিস না।
– নর্দমাটায় ফিনাইল দিতে পারো তো!
– একটা চুমু খাই? একটা চুমু খাই, জগন্নাথ?
– আমার নাম জগন্নাথ না।

জগবন্ধু যে বিশেষ সুবিধের লোক নয়, সে ছাড়া আর কেউ জানে না। কনুইয়ের গুঁতো, পাঁজরের ঠিক নীচে মোক্ষম কনুইয়ের গুঁতো খাওয়ার পর লোকটাকে চোখে চোখে রেখেছিল সে। আর আট সেকেন্ড পর পর জানলার সিটটা নজরে মাপছিল। মেয়েটা বড়ো বাবার মন্দিরের সামনে উঠবে। নামবে সারথি মেডিক্যালের সামনে। রোজই বড়ো বাবার মন্দিরে সামনে উঠে, দুটো লোকের পা মাড়িয়ে, কন্ডাক্টরকে ভাড়া না দিয়ে সারথি মেডিক্যালের পাশের গলি দিয়ে মেয়েটা চলে যায়। সোম বুধ শুক্র হলুদ সালোয়ার পড়ে, মঙ্গল বৃহস্পতি শণি গোলাপি সালোয়ার পড়ে। হয়তো মেয়েটা কন্ডাক্টরের প্রেমিকা, বা বোন, বা টিকিট সে জগবন্ধুকে না দেখিয়েই কেটে নেয় রোজ। জানলার ধারে সড়াৎ করে বসতে বসতে হলদে অথবা গোলাপি অপসৃয়মান শরীরটাকে দেখে নেয় জগবন্ধু। পরক্ষণেই ভুলে যায় মেয়েটার মুখ। আজ বাসটা ঝাঁকি দিতেই সে সজাগ হল।

দু-তিন বছরের পুরোনো একটা চপ্পল পড়েছে লোকটা। তবে দু-তিন মাসের পুরোনোও হতে পারে। অতিরিক্ত ব্যবহারে হয়তো ক্ষয়ে গেছে। হাটুরে লোকেদের চপ্পল বেশ গোলমেলে হয়। বাসটা আরেকবার ঝাঁকি দিতেই জগবন্ধু সটান পা বাড়িয়ে দিল। লোকটা বুড়ো বাবার মন্দিরেই নামবে। কয়েক পা এগিয়ে গেছে সে। জগবন্ধুর পা’টা শূণ্যে ভেসে বাসের মেঝেতে থপ্‌ করে পড়ল। জগবন্ধু পরিস্কার শুনতে পেল, তার ডান পা’টা চপ্পলসমেত থপ্‌ করে পড়ল মেঝেতে। আর কেউ শুনতে পেল না। সে সিটের দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা ইতিমধ্যে উঠে পড়ে ওড়না গোছাচ্ছে, আর অন্যমনস্কতাবশতঃ দখলদারির স্বত্ব ছেড়ে দেওয়ায়, গড়িয়া মোড় থেকে ওঠা প্যাঁকাটি বুড়োটা সেই সিটে বসে আয়েশ করে রুমালে ঘাড় মুছছে। বুড়োটা বোধহয় বুঝে নিয়েছিল সিটটা জগবন্ধুরই প্রাপ্য। বুড়োটা জগবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল। জগবন্ধুর আজ অপসৃয়মান গোলাপি শরীর দেখা হল না। আর গোটা বাস ভর্তি প্যাসেঞ্জার জানতেই পারল না, আসলে জগবন্ধু বিশেষ সুবিধের লোক নয়।

জগবন্ধু শিপ্রার ব্রণভর্তি মুখটার দিকে তাকাল। কনুইয়ে ছ্যাতলা পড়েছে, তাকাল। লম্বা নরম আঙুল, নখে চিকন সবুজ ময়লা, জগবন্ধু শিপ্রার বেঞ্চের উপর আলগোছে রাখা আঙুলের দিকে তাকাল। শিপ্রা এখন তার দিকে তাকিয়ে নেই। বলটু ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিতে চা ছাঁকছে। শিপ্রা বলটুর মেটে রঙের ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এখনি বলে বসবে, এ দাদা, তোর গেঞ্জি ছেঁড়া, ন্যাংটো মাথা ন্যাড়া। ছেঁড়া আর ন্যাড়া, যথাযথ অন্ত্যমিল হয়তো শতকরা আশি ভাগ, তবু সে বলবে বা হয়তো কখনো বলতো, যখন দুই বিনুনিতে লাল ফিতে ঝুলিয়ে ইস্কুল যেত সে। বলটু পাড়া দাপিয়ে ফুটবল খেলে ফিরে পায়ে গরম চুন হলুদ লাগাতে বসত। তাদের বাবা তাদের মা’কে লুকিয়ে দু’ঢোঁক তুফান সাবড়ে দিতেন। জগবন্ধু তখন কোথায়? জগবন্ধু তখন কোথায়! জগবন্ধু তখন পঁচাশি (আসলে তিরাশি, কিন্তু সে দু’কিলোমিটার বাড়িয়ে বলে) কিলোমিটার দূরের এক অজ পাড়াগাঁয়ে বসে ছক কষছে কিভাবে সাবিরের চাচার দোকান থেকে একটা রবারের বল হাতানো যায়; আর রাতে যখন মা, দাদু, দিদা আর বড়োপিসি সাদাকালো টিভিতে শিবের সিরিয়াল দেখছে, ভাবছে সে বোধহয় আগের জন্মে শিব ছিল অথবা পরের জন্মে কার্তিক হবে।

– জল দিলে না হাত ধোবার?
– শিপ্রা জল ঢালে।
– দূরে ঢালো। পা ভিজে যাচ্ছে তো!
– শিপ্রা হাই তোলে।
– কাল দু’পাউন্ড পাঁউরুটি আনিয়ে রেখো। এক পাউন্ড আজকের, এক পাউন্ড কালকের।
– শিপ্রা বেঞ্চে টোকা মারে।
– আর কত বাকি আছে হিসেবটা দেখো তো। হরিণ’দা জানতে চেয়েছে।
– এ দাদা, জগা কি বলে দ্যাখ্‌!
– বলেছি না জগা বলবে না!
– বেশ করেছি। তোর বাপের খাই না কি রে! জগা, এ জগা, এই জগগু-উ-উ-উ!
– পাঁচশো তেরো টাকা বাকি আছে। কবে দেবে হরিণ?
– দিয়ে দেবে।
– কবে?
– আমি কি জানি! আমায় শুধু জেনে যেতে বলেছে।
– ছাড় দাদা। এই জগ্‌না দেবে টাকার হদিস! এই জগ্‌না ফোট্‌। কাল টাকা আনবি, তবে মাল পাবি।
– আমি কিন্তু হরিণ’দাকে বলে দেবো।
– বল্‌ গে যা। দাদা এমন লাথ ঝাড়বে না। বল্‌ দাদা, বন্নির মাঠে হরিণ’দাকে কেমন পাছায় ঝেড়েছিলি। বল পেছনে নিয়ে গোলে ঢুকে গেছিল।
– কাল তিনশো টাকা সঙ্গে নিয়ে আসবি। দু’পাউন্ড পাঁউরুটি তুলে রাখবো।

জগবন্ধু ঘাড় নাড়ায়। শিপ্রা ঠা ঠা করে হাসতে থাকে। বলটু চা’য়ে ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জি আবার ভিজোয়। জগবন্ধু ঝুম রোদের মধ্যে হরিণের ইঁটভাঁটার দিকে পা বাড়ায়। ঝুম রোদ ঠা ঠা করে হাসতে থাকে।

হরিণের দপ্তরি নাম হিরণ্যকশিপু। এ নিয়ে তার পরিবারে কম জলঘোলা হয় নি। জনশ্রুতি আছে হিরণ্যকশিপু নাম রাখার এক মাসের মধ্যে তার ঠাকুমা মারা যান। তারও দশ বছর পর চলতি ভাষায় সে হরিণ নামে পরিচিত হয়। জগবন্ধু তাকে হিরণ্যকশিপু নামের মানে জিজ্ঞেস করে একবার বিস্তর নাকাল হয়েছিল। ক্লাবের আরো তিন জনের সামনে হরিণ তার জামা প্যান্ট খোলায়। তারপর স্রেফ জাঙিয়া পরা অবস্থায় নগেন্দ্রনাথ প্রাইমারি স্কুলের মাঠে দশ পাক দৌড় করায়। জগবন্ধু কেন জিজ্ঞেস করেছিল? তার পেটেও বোধহয় ছিটেফোঁটা মদ পড়েছিল সেদিন। সে হয়তো মুচকি হেসেছিল হিরণ্যকশিপু উচ্চারণ করার সময়। অথবা হরিণের চোখের ভুলও হতে পারে সেটা। হয়তো। পরদিন হরিণের ডায়াবিটিস ধরা পড়ে। জগবন্ধু জানে সে বিশেষ সুবিধের লোক নয়।

রাস্তায় লোকচলাচল কমের দিকে। যারা হাঁটছে, মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে নিয়েছে। দু’একজন মাস্কের মধ্যেই আঙুল চালিয়ে চুলকে নিচ্ছে দাড়ি। এ বড়ো কঠিন সময়! জগবন্ধু নিজের মাস্কটা দেখল মন দিয়ে। নাকের দু’পাশে ঘামের কালো আস্তরণ পড়েছে। আরো কয়েক জায়গায় হলদেটে ছোপ। কাচতে হবে। কেচে কেচে পাতলা হয়ে গেছে মাস্কটার কাপড়। আজকাল আর ক্লাবের থেকে মাস্ক বিলি করে না। আর বোধহয় করবেও না। জগবন্ধু নিজের সাদা অথবা ছোপলাগা মাস্কটা মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিল। কানে গলানোর ফিতে দুটো উঁচু হয়ে বেরিয়ে রয়েছে। জগবন্ধু হৃৎপিন্ডের উপর হাত রেখে কবেকার মাস্কটার নিচে রাখা দশ টাকার নোট দুটো, যাদের একটি এখনও অদ্ভুত সতেজ, অনুভব করল।

ঝুম ঝুম রোদ একটু পরেই গনগন করবে। তখন ছাতা মাথায় দেবে শৌখিন ও বিচক্ষণ লোকেরা । বাকিরা, মাথায় জল দেবে বাড়ি পৌঁছবার পর। তিন ঘটি জল মাথায় ঢেলেও লাভ নেই বুঝে গেলে, বাকি চার ঘটি ঢেলে নেবে শরীরে। আর জল নেই। আর জল থাকে না। কোনো দিনই থাকে না। বৃষ্টির দিনগুলোয় ঝুম ঝুম রোদ গনগন করে না। তাই চার ঘটি জল শরীরে ঢালার পর, গামছা নিংড়ে ঘটিটা আরেকবার মাথায় উপুড় করে বাকিরা। দু’ফোঁটা, কখনও তিন ফোঁটা জল, চুঁইয়ে পড়ে। বোঝা যায় না। শৌখিন ও বিচক্ষণ লোকেরা এসময় ফ্যানের রেগুলেটর বাড়াতে চায়। দেখে তা আগে থেকেই সর্বোচ্চ গতিতে ঘুরছে। তারা বিগত তেরো বছরের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ভাবে এয়ারকন্ডিশনারের কথা। তারপর খরচার কথা। তারপর কাঁচা আমের চাটনি ভেবে, তাদের সমস্ত রাগ জল হয়ে যায়।

জগবন্ধু সেই তিরাশি অথবা পঁচাশি কিলোমিটার দূরের অজ পাড়াগাঁয়ের কথা ভাবে। সেখানে টাবুর টুবুর বৃষ্টি পড়ত টিনের চালে। টাবুড় টুবুড়, সবুড় সবুড়! বাবা বলত। বাবা কখনো টাবুর টুবুর, সবুর সবুর বলতো না। টাবুড় টুবুড়, সবুড় সবুড়। অথচ কুকুরকে কুকুর বলতো, কাপুরকে কাপুর। বাবা শশী কাপুরকে পছন্দ করত খুব। কাপুর না কপুর? কে জানে! পাড়ার আর সব অমিতাভ বচ্চনের ফ্যানেরা, বাবাকে টিটকিরি দিত সময়ে অসময়ে। বাবা মনের দুঃখ চেপে, মায়ের দিকে তাকিয়ে, পরদেসিঁও সে না আঁখিয়া মিলা না, গাইত। বাবা বোধহয় শশী কাপুরের অথবা শশী কপুরের প্রথম বা দ্বিতীয় সারির ভক্তদের মধ্যে পড়ত না, জগবন্ধু পরে ভেবে দেখেছে। নইলে সবসময় হিট গানগুলোই গাইত কেন? হরিণ’দা অজয় দেবগণের ফ্যান। তার কাছে অজয় দেবগণের কত অজানা গান শুনেছে জগবন্ধু!
হাঁটতে হবে রে জগবন্ধু! হাঁটা ছাড়া গতি নেই।

– গাড়িটা কিনলে যে!
– মা চড়ুক। বাবা চড়ুক।
– তারপর?
– দক্ষিণেশ্বরটা ঘুরে আসবে।
– আচ্ছা।
– তাজপুরেও যেতে পারে।
– সেই ভালো।
– সামনের মাসে ড্রাইভিংটা শিখে নিস। এত টাকা দিয়ে ড্রাইভার রাখা পোষায় না।
– শেখাবে?
– গণেশকে বলিস। ব্যাটার গাড়ি ধোয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
– তেলও মারে বোধহয়।
– মারবে না! আমিও মারতাম। ডাক্তারস্যারের।
– স্পার্টস্‌?
– তাও বেচেছি।
– ভালো লাভ, না?
– তাতে তোর কি রে জগবন্ধু? তুই পারবি না।
– চেষ্টা করে দেখতে পারি।
– তাও পারবি না। তোর মধ্যে ওই ব্যাপারটাই নেই।
– একটা টুপি কিনে দেবে হরিণ’দা? পরে গাড়ি চালাবো।
– গণেশ টুপি পরে?
– নাঃ।
– তোকেও পরতে হবে না। টাক পড়ে যাবে।
– আমার টাক পড়বে না।
– জানিস?
– হ্যাঁ!
– কেনো?
– বাবা হাত দেখতে জানতো। বলেছিল।
– টাকাটা ফেরত দে।
– একটা নোট খরচা হয়ে গেছে। আরেকটা আছে। নাও।
– তোকে দিয়ে হবে না রে জগবন্ধু!
– কেনো হরিণ’দা?
– একটা নোট প্যান্টের পকেটে সরিয়ে রাখবি তো! আমি এখানে বসেই নোট দুটো দেখতে পাচ্ছি।
– এ বাবা, ভুল হয়ে গেছে।
– ভুল হয় নি। আসলে তোর মধ্যে ওই জিনিসটাই নেই।
– তাই হবে।
– ছাড়। শিপ্রা কিছু বলল?
– হ্যাঁ।
– কি?
– ফুটে যেতে।

ইনোভার সামনের সিটে বসেছিল জগবন্ধু। গণেশের পাশে। হিরণ্যকশিপুর বাবা অভ্যাসবশতঃ তাকে বলছিলেন হাত জানলার ভিতরে রাখার কথা। গাড়ির জানলার বাইরে হাত বা কনুই ঝুলিয়ে রাখলে, যে কোনো সময় উদ্দাম ট্রাক বা লরি বা অন্য কোনো বেখেয়ালী চার চাক্কা এসে হাত বা কনুই কেটে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কেটে নেওয়া হাত নিয়ে ট্রাক বা লরি বা বেখেয়ালী চার চাক্কা চলে যাবে না। কেটে নেওয়া হাতটা হাইওয়েতে পড়ে থেকে থেকে ধুকপুক ধুকপুক করবে। তারপর একরাশ কুকুর ঘেউ ঘেউ করবে মালিকানা নিয়ে। তারপর এক দল কাক এসে হাড়গোড়, মাংসের ছিটেফোঁটা নিয়ে বাসা চলে যাবে। তাদেরও তো ছানা আছে! তাদেরও তো খিদে পায়! তারপর রোদ কড়া হলে, ছোপ ছোপ রক্ত শুকিয়ে বাস্প হবে। দাগ থেকে যাবে। আপামর পথিকেরা ভেবে নেবে, বছর চোদ্দ’র খালাসি, বোতলের ঘোলা জলে কুলকুচি করে, পিচিক ফেলেছে। সবুজ বোতল। খয়েরি পানের পিক ছিটকে লেগেছে গায়ে। সবুজ বোতল, কোনো মুদির দোকানে কেনা কোল্ড ড্রিঙ্কসের। অথবা বৃষ্টি হলে ধুয়ে মুছে যাবে। জগবন্ধুর ছিটেফোঁটা রক্ত ধুয়ে যাবে হাইড্রেনে। কুলকুচি করে ফেলা থুতু মাখা জল, নিম্নচাপেতে ঝরা ঝিরঝিরে পানি, শিরায় শিরায় বওয়া জগবন্ধুর পিতৃপুরুষের রক্ত, একাকার হয়ে যাবে। মিশে গিয়ে, চেনা যাবে না।

সে ডান দিক চেপে বসেছিল তাই। গণেশের বাঁ হাত, প্রতিবার গিয়ার বদলানোর সময়, তার ডান উরুতে ঘষে যাচ্ছিল। বাঁ হাত বা বাঁ কনুই কেটে যাওয়ার থেকে ডান উরুর ছাল উঠে যাওয়া ঢের ভালো। ডাক্তারস্যারের কাছে গেলেই ওষুধ দিয়ে দেবেন। মেজাজ ভালো থাকলে প্রেশারটাও মেপে দিতে পারেন একবার। ডাক্তারস্যারের ছেলে লাল মোটরবাইকটা ধুতে ধুতে প্রেম করে ফোনে। জগবন্ধু কোনোদিন ডাক্তারস্যারের ছেলেকে মোটরবাইক চালাতে দেখে নি। বিগবাজারের সামনে অন্তত তিন থেকে চারবার আলাদা আলাদা মেয়ের সাথে চিকেন রোল খেতে দেখেছে। কিন্তু প্রতিবারই ডাক্তারস্যারের ছেলে অটোতে গেছে, অটোতে ফিরেছে। নইম জগবন্ধুর দোস্ত আদমি। নইম বলেছে। নইম পুরোনো বাজার টু বিগবাজার রুটে অটো চালায়। মনমেজাজ ফুরফুরে থাকলে ডাক্তারস্যার হাতে পট্টি জড়িয়ে প্রেশার মেপে দেন জগবন্ধুর। কোনোদিনই ১২৫/৮৪-র উপরে ওঠে না।

তবে এসব আগের কথা! সামনের মাসে ড্রাইভিংটা শিখে গেলে, বলটুর দোকানে ফটাক্‌সে গাড়ি নিয়ে যাবে। পাঁউরুটি কিনে ব্রুম ব্রুম করে স্টার্ট দেবে ইঞ্জিন। শিপ্রা ফুটে যেতে বললে, সাঁ করে পিচ রাস্তায় তুলে দেবে গাড়ি। তারপর ফটাক্‌সে তিনটা খালি লরিকে ওভারটেক করে হরিণ’দার ইঁটভাঁটায় ফিরে আসবে। ভেবেই হাসি পেয়ে গেল জগবন্ধুর। হাসলে তাকে খুব সুন্দর দেখায়। মা বলতো। বলতো, আয় তো, একটা টিপ পরিয়ে দিই কাজলের। কে জানে কোন রাক্ষুসী আবার কেড়ে নিয়ে যাবে! বড়োপিসি বলতো, কে আবার কাড়বে তোমার ধন! নিজেই পালাবে। ওর পায়ের পাতা বারমুখি দেখছো না! জগবন্ধুর মা জগবন্ধুকে টিপ পরাতে পরাতে ঠোঁট বেঁকাত। সে রাতে বড়োপিসির পাতে মাছ পড়ত না। তাকে নাকি হাসলে সুন্দর দেখায়! ভেবেই হেসে ফেলল জগবন্ধু। মা’টা এক্কেবারে হাঁদা ছিল! নইলে নিজের পেটের ছেলে যে বিশেষ সুবিধের লোক নয়, তা একবারও বুঝল না?
চাউমিনটায় কি ঝাল দিয়েছো গো!

– কি লেখা আছে পড়্‌।
– কোথায়?
– সাইনবোর্ডে।
– ফিস তন্দুরি।
– তার পাশে।
– ফায়েড রাইস।
– ডান পাশে না। বাঁ পাশে।
– চিলি চাওমিন।
– চিলি মানে জানিস?
– তাই বলে এভাবে লঙ্কা ডলে দেবে!
– ঝাল না খেলে খিদে মিটবে কি করে! ঝাল না খেলে কাজ করতে পারবি না।
– তুমি মাইরি ভাত সেদ্ধ করলেও লঙ্কা দাও!
– কাল গড়িয়া যাবি তো?
– হ্যাঁ।
– একটা ওষুধ খোঁজ করিস।
– কি ওষুধ?
– লেখা আছে। দিয়ে দেবো কাগজটা।
– এখানে পাচ্ছো না?
– পেলে কি তোকে বলতাম গাধা! সত্যিই তোর দ্বারা কিস্‌সু হবে না।
– সামনের মাস থেকে হরিণ’দার গাড়ি চালাবো আমি।
– হরিণটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
– হতে পারে। জেঠুও বলছিলেন।
– কোন জেঠু?
– হরিণ’দার বাবা।
– কি বলছিলেন রসাকাকা?
– হরিণ’দার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পর পর দু’বার বিয়ে চটকে গেল না!
– ওই রাক্ষসটাকে কে বিয়ে করবে!
– শিপ্রা করবে না?
– বলেছে করবে?
– না। বলে নি।
– তবে? এসব ফালতু কথা রটাস না।
– দক্ষিনেশ্বরের জ্যোতিষ নাকি বলেছে।
– কি বলেছে?
– হরিণ’দার বউকে নাকি হরিণ’দা ছোটোবেলা থেকে চিনবে। আর সে হরিণ’দার চেয়ে আট বছরের ছোটো হবে।
– শিপ্রা হরিণের চেয়ে ছ’বছরের ছোটো।
– আমাকে যে বলল ছাব্বিশ!
– ওর মা দু’বছর কমিয়ে রেখেছে। আমার বাবা ছিল জন্মের সময়। ডাক্তারকে বলার সময় বাবাই তো বলেছিল।
– শিপ্রার বয়েস আটাশ?
– নয় তো কি! তোর কত?
– সামনের মাসে ছাব্বিশ হবে।
– ওই হরিণটা একটা রাক্ষস, আর শিপ্রাটা রাক্ষুসী। ওদের জন্মান্তরের ভাই-বোনের রিলেশন। তুই আবার ফাঁসিস না ওখানে।

মা তাহলে ভুল বলতো? রাক্ষুসী নয়, সে রাক্ষসের পাল্লায় পড়েছে? হিরণ্যকশিপু ছিলেন রাক্ষসরাজ। এই কচি’দার দোকানে বসেই সে ইতিহাস জেনেছে জগবন্ধু। সেদিন যদিও বিকেলটা ছিল চড়া। ইঁটভাঁটার চোখজ্বালানো ধোঁয়াকে ম্লান করে দিয়ে, বৈকালিক আলো শরীরের প্রত্যেকটা কুঠরিতে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। ইঁটভাঁটার গনগনানো চুল্লী দিয়ে নিয়ম করে বেরিয়ে আসছিল অজস্র আর্তনাদ। কচি’দা বলছিল হিরণ্যকশিপুর কথা। নরসিংহের কথা। ভক্ত প্রহ্লাদের কথা। কিভাবে নরসিংহ থাম ফাটিয়ে বেরিয়ে এল! কিভাবে নরসিংহ হিরণ্যকশিপুর বুক ফেড়ে রক্ত খেল! বুক ফাড়লে কষ্ট হয়? কাঠ চেরার মতো ফ্যাড় ফ্যাড় ফ্যাড় ফ্যাড় করে বুক ফাড়ে। মরে গেলে কষ্ট হয় না। ওই নখ বসানো থেকে মরে যাওয়ার সময়টুকু, কি কষ্ট কি কষ্ট! রিমলি’দির মুখ দেখেছিল জগবন্ধু। কষ্টে, ভ্যাটকে পড়ে ছিল। রিমলি’দির বুক চিরে ফালা ফালা করে নি নরসিংহ। গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তবে বুকের দু’পাশে নখের দাগ ছিল অনেক। দাঁতেরও। কোমর, পিঠ, পাছা, নাভি, উরু; সব জায়গায়। এসব কথা বাবা, মা’কে লুকিয়ে বলেছিল। নরসিংহ বুক চিরতে না পেরে গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিয়েছিল ওভাবে।

ভক্ত প্রহ্লাদের কথা শুনে ভরসা হয় জগবন্ধুর। ছেলে হয়ে বাপের বিরুদ্ধাচরণ করেও তাহলে সুখ্যাতি পাওয়া যায়! ইতিহাসে আছে প্রহ্লাদের নাম। সহজ ব্যাপার নয় সেটা। তার নাম জগবন্ধু না হয়ে প্রহ্লাদ হলে কেমন হতো? ভক্ত উপাধি নিত সে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, নাম প্রহ্লাদ ভক্ত। নিবাস ঢেনকানিতলা। বাবার নাম সুবাস মিস্ত্রি। নিবাস ঢেনকানিতলা। মায়ের নাম কল্পনা মিস্ত্রি। নিবাস ঢেনকানিতলা। তিনবার ঢেনকানিতলার নাম শুনে প্রশ্নকর্তা রেগে গেলে, সে মুচকি হেসে জানাত, আসলে তার বাবার নাম সুভাষ। লোকে আলপটকা ডেকে ডেকে সুবাস করে তুলেছে। কিন্তু তার নাম প্রহ্লাদ ভক্ত নয়। সে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায় না। জলসা হলে তার স্থান হয় জনতার ভিড়ে, যে পাশে ছেলেদের গুলতানি, তার পরিধিরেখায়। ওপাশে মেয়েদের জমায়েত। মাঝে দড়ি। স্টেজে ডিজে রাতুল খেলা দেখাচ্ছে। ডিজে রাতুল এ অঞ্চলের জলসা মাতানো আইটেম। ডিজে রাতুল হরিণ’দার বন্ধু মানুষ। তবু জলসা হলে, জগন্নাথ ছেলেদের ভিড়ে আরেকটা ছেলে হয়ে মিশে থাকে।

ওপাশে মেয়েদের জমায়েত। মাঝে লম্বা নারকোল দড়ি। নাচো, কোঁদো, লাফাও, ঝাপাও, দড়ি পেরিও না। জগবন্ধু দড়ি পেরোয় নি। শিপ্রাও দড়ি পেরোয় নি। হুড়োহুড়িতে জগবন্ধুর কনুই (হিরণ্যকশিপু’র বাবার সাবধানবাণীতে যা আজও অক্ষত) গোত্তা খেয়েছিল শিপ্রার পিঠে। শিপ্রা, শুধু শিপ্রা কেন, তুতুল বা ঝিলমিল হলেও, মাথা গরম হওয়াটাই ন্যায্য, শিপ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, অ্যাই সালা জগন্নাথ! এক ঝাপড়ে কোমর নাচানো বের করে দেবো। জগবন্ধু প্রথমে বুঝতে পারে নি। তার নাম জগন্নাথ নয়। তার নাম প্রহ্লাদ নয়। তার নাম জগবন্ধু মিস্ত্রি। জন্ম ঢেনকানিতলা। নিবাস সূর্যপুর ফ্রেন্ডস ক্লাব। সে হিরণ্যকশিপু রায়ের খাস আদমি। হিরণ্যকশিপু রায়ের এ অঞ্চলে দুটো ইঁটভাঁটা রয়েছে। তাই জগবন্ধু প্রথমে বুঝতে পারে নি। তাই জগবন্ধু প্রথমে গায়েও মাখে নি কিছু। পরে সাবান ঘষতে ঘষতে ভেবেছে, তার নাম জগন্নাথ হলে কি খুব অসুবিধে হত? প্রহ্লাদ বা জগন্নাথ, অথবা জগবন্ধু, সুভাষ মিস্ত্রি আর কল্পনা মিস্ত্রির বড়ো আদরের একমাত্র ছেলের কি জন্ম থেকেই পা বারমুখী ছিল না? রাক্ষস অথবা রাক্ষুসীর হাতে পড়ার জন্যই কি জন্ম হয় নি তার? বরং জগন্নাথ নামের একটা মাহাত্ম্য আছে। জগতের ঈশ্বর। সংসার জুড়ে মন্দির আছে কত্তগুলো! জগতের বন্ধু হয়েই বরং বিশেষ লাভ নেই। সবাই হ্যাটা করে। জগবন্ধু ঠিক করে, সামনের মাসে ড্রাইভিংটা শিখে নিয়ে, হরিণ’দাকে বলে, নাম পালটে জগন্নাথ করে নেবে। জগন্নাথ মিস্ত্রি। পেশায় ড্রাইভার। ফটাক্‌সে গাড়ি চালিয়ে হিরণ্যকশিপু’র বাবা আর হিরণ্যকশিপু’র মা’কে দক্ষিনেশ্বরে পৌঁছে দেবে।

– সন্ধেটা কেমন থম মেরে আচে দেখচিস্‌!
– ঢালবে?
– আজ নয়। কাল।
– কিভাবে বুঝলে?
– ওয়েদার রিপোট বলচে। এই দ্যাক্‌।
– মোবাইলটা কত দিয়ে কিনেছো গো?
– বলা যাবে না।
– গুহ্য কথা?
– ভীষণ।
– গেল মাসে সাদা বাড়িটায় একটা বড়ো চুরি হয়ে গেল না?
– কোন সাদা বাড়িতে?
– ওই যে গো, বিরাট কালো গেট। গেটটার উপর বেগনি ফুল ঝুলে থাকে হরদম।
– মনে পড়চে না!
– ওই বাড়ির মেয়েটার সঙ্গে নাকি হরিণ’দার বিয়ের কথা হয়েছিল।
– মোবাইলটা ছ’হাজারে কিনেচি রে! সেকেন্ড হ্যান্ড মাল।
– কোথা থেকে কিনলে?
– খিদিরপুর। বন্ধু আচে। ও-ই এনে দিয়েচে।
– বিয়েটা ভেঙে গেল কেন গো?
– কে জানে বাবা! কত কারণে ভাঙে!
– মেয়েটার শ্বশুরবাড়ি নাকি কালীঘাটে।
– তুই কিভাবে জানলি?
– বলটু’দা বলেছে।
– শিপ্রার দাদা?
– হ্যাঁ।
– ওর কথা বাদ দে। দিনরাত গাঁজা টানে আর গুল দেয়।

জগবন্ধুর মনে হয়, রাত বাড়লেই জ্বর জ্বর লাগে মাথাটা। তখন পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। এদিকে পুকুর বিশেষ নেই। সবই ডোবা। সাঁতার কাটলেই গায়ে চুলকুনি উঠবে। অথচ রাত বাড়লেই সাঁতরে পার হয়ে যাবার ইচ্ছেটা থেকে থেকে খোঁচা মারে। সে ফ্যান নিভিয়ে বসে থাকে। সারা গা দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম গড়ায়। জগবন্ধু জানে ঘাম হলে জ্বর ছেড়ে যায়। তখন ফ্যান চালিয়ে বাকি রাতটা কাবার করে দিতে পারলেই নিশ্চিন্তি! আর ঘাম হয় কচি’দার ডিমের ঝোলে। ভিতর পর্যন্ত ঘেমে যায়। লাল, কড়া করে ভাজা মুরগীর ডিম। ততোধিক লাল ঝোল। মাঝে দু’পিস আলু, ডুমো ডুমো করে কাটা দু’পিস আলু, নির্বিবাদে ভেসে থাকে। জগবন্ধু এক ফালি পেঁয়াজ নেয় সঙ্গে। এক খাবলা নুন। সাপটে উঠে যায় এক থালা ভাত। শিসোতে শিসোতে নরম, ঠান্ডা জলে কুলকুচি করে সে। বাসি নীল জলের জগ থেকে পেট ভরে জল খায়। শ্বাসনালী বেয়ে পাকস্থলী অবধি ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে থাকে।

এসব সময়ে চাল্লুকে মনে পড়ে তার। চাল্লুর বাড়ি ঝাড়খন্ডের সিংভূম অঞ্চলে। সে বাড়িতে অশ্বত্থ গাছ আছে একটা। আজব আজব কথা বলত চাল্লু। বলত, এই ইঁটভাঁটার তলায় যদি সুড়ঙ্গ খোঁড়া যায়, তবে নাকি পৃথিবীর একদম কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া যাবে। পৃথিবীর সব ইঁটভাঁটার আগুন নাকি সেখানেই জমা থাকে। বলত, রাতে যখন আকাশ পাতাল বেবাক ঠান্ডা আর একদম সুনসান, তার বোন নাকি পাতাল থেকে উঠে এসে, পাশে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। ঘুমোতে দেয় না। চাল্লুটা ভাগ্যিস হিন্দু ছিল! ওকে আর আলাদা করে শ্মশানে নিয়ে যেতে হয় নি। ইঁটভাঁটাতে পা হড়কে পড়ে, সিধে ওই কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। বোনের কাছে। পাতালে। অত রাতে কি করতে ইঁটভাঁটায় গিয়েছিল চাল্লু, তা নিয়ে অবশ্য কানাকানি হয়েছিল কিছু। কে নাকি হরিণ’দা আর গণেশ’কে টর্চ নিয়ে যেতে দেখেছিল ওদিকে। কিন্তু পুলিশ ক্লিন চিট দিয়ে দিয়েছে। জগন্নাথ চাল্লুর বোনের কথা বলেছিল হরিণ’দাকে। হরিণ’দা বোধহয় ইন্সপেক্টর স্যারকে বলে থাকবে। চাল্লুটা যে আসলে পাগল ছিল, সেটা ইন্সপেক্টর স্যারের বুঝতে মিনিট তিনেকের বেশী লাগে নি। দু’দিন ইঁটভাঁটা বন্ধ রেখে, আবার পৃথিবীর পেটে আগুন দেওয়া শুরু হয়ে গেল। শুধু, হরিন’দার বিয়েটা দ্বিতীয়বারের জন্যেও ভেস্তে গেল, এটাই যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

হরিন’দার ধারণা শিপ্রার সাথেই বিয়ে হবে তার। ছোটোবেলার চেনা। আট বছরের ছোটো। কচি’দাটাই হিসেব গুলিয়ে দিল আজ। শিপ্রা বয়েস ভাঁড়িয়েছে। বয়েস ভাঁড়িয়ে বিয়ে করলে কি তারা সুখী দম্পতি হতে পারবে? হরিণ’দা রাক্ষস, শিপ্রা রাক্ষুসী। ওদের হয়তো অসুখের বিয়ে হবে। ততদিনে জগবন্ধু জগন্নাথ হয়ে যাবে। ইনোভা গাড়িটাকে কালীঘাট থেকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে আনবে সে আর গণেশ। হরিণ’দা পেছনের সিটে ধুতি আর টোপর সামলে বসবে আর থেকে থেকে ছবি উঠবে খচাখচ্‌। শিপ্রার বাড়ির দোরগোড়ায় গাড়ি থামলেই উলু দিয়ে উঠবে সবাই। বলটু সতর্কভাবে ছেঁড়া গেঞ্জিটা লুকিয়ে রাখবে সেদিন। ততদিনে জগন্নাথ হয়ে যাবে জগবন্ধু।

– অ্যাই সালা, জগ্‌না! আবার চাল্লুটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিস?
– চাল্লু ভালো নেই গো! ওর বোনটাকে খুঁজে পাচ্ছে না এক মাস হল।
– তাতে আমার কি! তুই আমাকে চুমু খাবি না তা’লে?
– তুমি বয়েস লুকিয়েছো কেন?
– তাতে তোর কি?
– লোক ঠকানো পাপ।
– লোক ঠেকানো?
– মজবুরি।
– খাবি? একটা চুমু। আমাকে।
– কি হবে খেলে?
– ভালো থাকবো।
– না খেলে?
– আমাকেও খুঁজে পাবি না।

জগবন্ধু লজ্জা পায়। নাকি জগন্নাথ লজ্জা পেলো? জগবন্ধু অথবা জগন্নাথ চোখে চোখ রাখতে না পেরে মাটিতে নক্সা কাটে। এইসময় নীল হলুদ বাসটা ঝাঁকি দেয় একবার। সে সারথি মেডিক্যালের পাশ দিয়ে অপসৃয়মান শিপ্রার শরীরটা দেখতে পায়। শিপ্রার মেটে রঙের সালোয়ার শেষপর্যন্ত, গলির শেষ মুখ পর্যন্ত ভেসে থাকে। জানলার পাশের সিটে ঝুম ঝুম রোদ তার বাদামী ত্বককে কালো করে দেয়। সে বুঝতে পারে, জগবন্ধু অথবা জগন্নাথ যে খুব একটা সুবিধের লোক নয়, সে ছাড়া আর কেউ জানে না। শিপ্রাও না।

Facebook Comments

Leave a Reply