অপ্রকাশিত কবি

[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।

“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।

বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]

মহিউদ্দিন সাইফ

জন্ম: ২৪শে মে, ১৯৯৫

জন্মস্থান: দুর্লভপুর গ্রাম, বাঁকুড়া

কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়: আমার কবিতার ভাবনা খুবই সহজ। যা জীবনে দেখি, তাকে মর্মে আর মননে দেখার লোভ হয় নিরন্তর। এক একটি শব্দ শুনি আমার বাপ-দাদা, দাদি-চাচি, গাজু-গডো-দুগ্গাখুড়ো আর আবহমান বাংলা কাব্যের পিতৃ-পিতামহদের কাছে। যাবতীয় ঘটনা, আর আমার লোকায়ত আত্মজন, দেবী, দেব, দেয়াসী, মুর্শিদ আর অন্ধ কানাই ভেতরে ঘুরিয়ে দেয় অন্য জাহানের চাবি। ক্বচিৎ আমি বর্তে যাই। মিলিত হই চরাচরের সঙ্গে।

প্রথম প্রকাশ: আরশিনগর পত্রিকা, ২০১৮

লেখা শুরুর খুব বেশিদিন হয়নি এখনও মহিউদ্দিন সাইফের। এইটুকু সময়েই ওর লেখা এতখানি পরিণত। শব্দ ব্যবহারে নিজস্বতা। কী বলার বা বলার নেই, বা কীভাবে এসব উপস্থাপিত তাতেও নিজস্বতা। বিভিন্ন দেশজ শব্দের (যা পূর্বে বিশেষ ব্যবহৃত নয়) পাশাপাশি অদেশজ তৎসম ধরনের শব্দের নিপুণতা। যদিও গম্ভীর তৎসম শব্দগুলি কিঞ্চিৎ গুরুপাক ঘটাতে পারে কারোর কারোর। ইসলামিক বিবিধ প্রসঙ্গের এবং অঞ্চল বিশেষের না-বলা কথা-বার্তাও ঝলক দেয় কোনো কোনো লেখায়। এসব শব্দ-বাক্য-ভাষা-কল্পচিত্র-অনুভব-অনুভূতি ইত্যাদি ইত্যাদি মিলিয়ে-গুলিয়ে এবং ছাড়িয়ে কী দাঁড়ালো অবশেষে পাঠকের অবশ্য সেটুকুই উদ্দিষ্ট থাকে। সেই স্বাদের শরিক হওয়া যাক।

আপ্যায়ন

আহির গাঁয়ের মেয়েদের মতো মেঘ
আমাকে ফারাক বোঝাল দেবদারু বন আর জুলফি রোদের।
দোক্তাদাঁত উঁচা-নিচা অশোক টিলায় দেখাল ক্ষুব্ধ গিরগিটি
দীপ্র অজ ও মানুষের ছানা স্বাস্থ্যবান।

একটি কোঙা গাছের নীচে কতগুলি শিলা,
রাঢ়বঙ্গের সাদা ফোটা রোদ
ভাবগূঢ় ছায়ার সাথে মিশে রচনা করেছে আশ্চর্য কাংড়া সংসার।

এসবের তাৎপর্য বুঝতে গিয়ে
পরবশ হাতে আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি
কত জনজাতিক নিশান
ব্রতচ্যুত চর্যার পুরোডাঁশ।
আমার কানে কেউ অলীক থেকে পরিয়ে দিচ্ছে শব্দকুণ্ডল।

একটাই তো মৃগ

একটাই তো মৃগ।
বিভিন্ন মায়ায় ঘুরিয়ে মারে
রাম-শ্যাম-যদু-মধু-তোমাকে-আমাকে।
পতিত কুলের বনে আলোড়ন।
‘বস্তুর বিরাগ থেকে কী বা হতে পারে!’
এই মর্মে ঘুরে ফিরি প্রকৃত কুলের সন্ধানে।
হরেক উপায়ে খোলে লাল-সাদা-নীল কত ধারণার পথ।

ব্রীড়ানত ভঙ্গিমায় উঠে আসে হিরন্ময় ব্যোম,
আয়ত্ত করে নানা কসরত, রূপ-রস-ঊষা, মধুঋতু।
বুকের অন্বয় থেকে কালে কালে
সুলুক মেলে বিনীত গুহার।
নিজেরই আঁকা গন্ডারের ছবি দেখি
পৃথিবীর সংঘাতকালের কথা মনে পড়ে যায়।

একটি ঘরের কথা ভাবি

কতবার ভেবেছি, শেষবেলায় একটি ঘর হবে,
সাষ্টাঙ্গ মাটির।
বেহিসাব প্রত্যাহারের পর একটিই ঘর, গ্রহণ করব।

মায়ের মতো আঁচলপাতা দাওয়া, নতমুখী ছাঁচ
আয়ুষ্মান বর্ষা-শীত-গ্রীষ্ম ঘিরে ধরবে মৃন্ময়ী।
সন্ধ্যামণি বাতাসের পানে চেয়ে
খুলতে খুলতে চৈতন্যের বাঁধন
ঘোর ডিংলাফুলের লতায় জড়িয়ে যাব।

ভোরবেলা নবকল্পারম্ভে
আমি কোকিলের মতো সিদ্ধ
হতেও পারি আবার না-ও হতে পারি।

Facebook Comments

Leave a Reply