লৌকিক – অলৌকিক – অলীক মানুষ : উমাপদ কর

[কবি ও গদ্যকার উমাপদ কর বছর আটেক আগে গল্প ও উপন্যাসকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনন্য উপন্যাস “অলীক মানুষ” নিয়ে চরিত্রভিত্তিক একটি দীর্ঘ আলোচনা তথা গদ্য লেখেন, যা প্রকাশ পায় “বিনির্মাণ” পত্রিকায়। সম্প্রতি অপরজন পত্রিকার তরফে সেই গদ্যটি প্রকাশ করতে চাইলে তিনি পূর্বোক্ত গদ্যটিকে সংযোজন-বিযোজন-বিবর্ধন ইত্যাদির মাধ্যমে পুনর্লিখিত করেন। গদ্যটি দীর্ঘ। লেখকের সম্মতিক্রমে আমরা বেশ কয়েকটি কিস্তিতে (৬-৭) আলোচনাটি প্রকাশ করব ধারাক্রমে প্রতিমাসে। এই সংখ্যায় তার সপ্তম তথা অন্তিম পর্ব।]

চরিত্রকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার মধ্যে উঠে আসা উপন্যাসের গতিবিধি

এভাবে এই উপন্যাসে ছোট-বড়ো লৌকিক-অলৌকিক, বাস্তবোচিত-অবাস্তবের ছোঁয়ালাগা অনেক চরিত্র আছে। কিছু আছে কয়েকপৃষ্ঠাব্যাপী ঘটমানতায় সম্পৃক্ত চরিত্র। যেমন ফরিদুজ্জামান, ছোটগাজি, দরিয়াবানু, নুরাজ্জামান, দিল আফরোজ বেগম, রবি, বিড্ডু, আয়মণি, গোবিন্দরাম সিংহ, মুন্সি আবদুর রহিম, হাজারীলাল প্রমুখ। আবার আসমা, মেহরু, আলি বখ্‌শ, দুখু শেখ, অসিমুদ্দিন, জালালুদ্দিন, পান্না পেশোয়ারি, আবু মীর, জরি বেগম, যামিনী মজুমদার, কাল্লু পাঠান, আবদুল, কামারুন্নিসা, ফজু, ফকিরুজ্জামান ও জুলেখা ইত্যাদি ইত্যাদি চরিত্র যা উপন্যাসকারের দু-চারটে আঁচড়ে, তুলির টানে, জীবন্ত-প্রাণময়-খেয়ালি-হেঁয়ালিভরা-একগুঁয়ে-ধান্দাবাজ-অত্যাচারী-অত্যাচারিত-হোমোসেক্সুয়াল-দার্শনিক-আবেগপ্রবণ-কঠোর-বিকৃতকাম-অবাস্তবচিত-প্রতিহিংসাপরায়ন-প্রেমিক-ধর্মপ্রাণ-বিবেকবান, ইত্যাদি।
এমন যথেষ্ট বেগ-পাওয়া জটিল সব চরিত্রের সম্মিলনে তৈরি বেশ জটিল এক উপন্যাস ‘অলীক মানুষ’। কেন এমন এক উপন্যাসে গমন করলাম, কেন পরিশ্রমসাধ্য বেশ কিছু পৃষ্ঠা লিখেও ফেললাম তার একটা কৈফিয়ত জারি করে লেখাটা শেষ করব। সেখানেই পাঠক এই উপন্যাসের জটিলতার সঙ্গে সঙ্গে মহত্বতার পরিচয়ও পাবেন আশা করি।

ক) প্রায় একশ বছরের ব্যাপ্তিতে এক উপন্যাস। ভুল বললাম। ইতিহাস। শুধু ইতিহাসই বা কোথায়, ভূগোলসুদ্ধো। ইতিহাস আবার প্রথাগত শুধু রাজা-রাজরার ইতিহাস নয়। রাজা-রাজরা থেকে জমিদার হয়ে সাধারণ মানুষ, গরীব-গুর্বো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ-নাস্তিক, অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, ভারত তথা বাঙলার মূল কয়েকটি ধর্মের আভ্যন্তরিন ধারা, রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহর সবার ও সবকিছুর এক প্রাণবন্ত প্রকৃত ইতিহাস সম্বলিত এক মহাকাহিনি, যা কয়েকটি যুগধর্মের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

খ) অসাধারণ সব চরিত্রায়ন, যা আগে অনেকটাই প্রতিফলিত, এবং যা লৌকিকতার বেড়া ডিঙিয়ে অলৌকিক এবং অনির্দিষ্টে মিশতে পারে। বাস্তবের কঠিন-কঠোর অবস্থান যেমন আছে, তেমনি ভাববাদী অবস্থানও বিদ্যমান, আবার অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত অবস্থানেরও দেখা মেলে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এই চরিত্র নির্মাণে যে বাস্তবতার রসদ গ্রহণ, যে সময় ও পরিসরের উপযুক্ত ব্যবহার তাতে তারা প্রাণময় আর আর্থসামাজিক পরিকাঠামো থেকে উঠে আসা। চরিত্রচিত্রণে বৈপরীত্যকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তেমনি একত্বের মধ্যেও ভিন্নতার চিহ্ন আছে। যেমন বদিউজ্জামান আর শফিউজ্জামান একদম বিপরীতধর্মী চরিত্র। আবার বারি চৌধুরী ও বড়োগাজির চরিত্রে চিন্তাভাবনা বিশ্বাসে অনেক মিল থাকলেও প্রকৃতিগত দিক থেকে অনেক পার্থক্যও আছে। যেমন স্বাধীনবালা ও রত্নময়ীর চরিত্রে লক্ষ্যগত অবস্থান এক, কিন্তু তাদের ভাবনা ও তার রূপায়নে একজনকে বাজি ধরেও ভিন্ন পন্থাতে রূপায়নে আগ্রহী। একজন স্বদেশীয়ানা ও কঠোর নারীত্বকে ঢাল করেছেন, অন্যদিকে আরেকজন জমিদার তনয়া, রোগগ্রস্তা, ও নরম নারীত্বকে ঢাল করেছেন। সাইদা বেগম আর ইকরাতন যেন দুই দ্বীপের বাসিন্দা। অনন্ত নারায়ণ জমিদার, তার পুত্র হরিনারায়ণ একই পরিবারের হয়েও, তাদের মধ্যে একই বংশের রক্তধারা বইলেও সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ তাদের আচার-আচরণে কর্মসম্পাদনে। আবার এক জমিদার পরিবারভুক্ত মানুষ দেবনারায়ণ এদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মননে-চিন্তনে। তাকে তুলে আনা হয়েছে সুন্দর ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে। রোজি-রুকু যমজ বোন, কিন্তু চরিত্রের নিরিখে উভয়ে যেন ভিন্ন মেরুর। শফিউজ্জামান ও নুরাজ্জামান সহোদর, একই পিতা-মাতার ও বংশের এক প্রজন্ম, কিন্তু তাদের চরিত্রে আসমান-জমিন ফারাক। অবাঙালী চরিত্রগুলোর চলনবলন আচরণের সঙ্গে স্পষ্ট পার্থক্য বোঝা যায় বাঙালী চরিত্রগুলোর। আবার হিন্দু-বাঙালী ও মুসলিম বাঙালীদের মধ্যে ভাষা এক হলেও পারিবারিক পরিবেশ ও ধর্মীয় আচার-আচরণ ভিন্ন হওয়ায় তার ছাপ পড়েছে তাদের চরিত্র চিত্রণে। একটি উদাহরণ তুলে আনা যেতে পারে। শফি যেদিন প্রথম হিন্দুবাড়িতে (প্রফুল্ল সিঙ্গি) রাতে ভাত খায়, সেদিনই দুপুরে সে বড়োগাজির বাড়িতে খেয়েছিল বিরিয়ানি আর হালুয়া। কিন্তু রাতের ডাল-ভাত-শাকসবজির স্বাদ তার অনন্য লেগেছিল। এক সুন্দর আস্বাদ। উভয়ের ভাষাতেও খানিকটা পার্থক্য রয়েছে। যা বারি চৌধুরীর মতে ‘কালচারাল ডিফারেন্স’। শফির মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে দুই পরিবারের পারিবারিক পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়ন ইত্যাদির পার্থক্য। পরে অবশ্য শফি উভয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্যক পরিচয় লাভ করে। স্বল্প পরিসরে ঔপন্যাসিক জমিদার অনন্ত নারায়ণের নায়েব গোবিন্দরামের যে চরিত্রটি দারুণভাবে এঁকেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। শফির এক প্রিয় মানুষ এই গোবিন্দরাম সিংহ। তাকে প্রণাম করতে মন চায়, এমন শ্রদ্ধা করে সে।প্রায় একইভাবে সৃষ্টি করেছেন গিয়াসুদ্দিন-এর চরিত্রটি। কিশোর রবির চরিত্রও তুলে এনেছেন সামাজিক যত অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে, খুব সামান্য হলেও যার প্রভাব কিছু পড়েছিল কিশোর শফির ওপর।

শফির এক প্রিয় মানুষ জমিদার অনন্ত নারায়ণের কর্মচারী বা নায়েবমশাই গোবিন্দরাম সিংহ। তাকে প্রণাম করতে মন চায়, এমন শ্রদ্ধা করে সে।

গ) সেই সময়কালের বাংলার মানুষের ধর্মীয় বোধ ও আচরণ, সমাজ-রাজ-অর্থনীতি কোনো এক আশ্চর্য ছোঁয়ায় যেন একাকার। শুধু সামগ্রিকভাবে নয়, বিশ্লিষ্টভাবেও সমান মনযোগ আকর্ষণ করে। হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্ম, খ্রিষ্টান সব ধর্মের ধার্মিক মনোভাব থেকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নির্যাস উঠে আসে। বিভেদের মধ্যেও পারস্পরিক এক সম্ভ্রমবোধও লক্ষ করা যায়।

ঘ) পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তিতুমিরের বিদ্রোহ এবং সর্বোপরী স্বদেশী আন্দোলন সব মিলেমিশে রাজ-এর বিরুদ্ধে একটা বার্তা বহন করে। এর ফলে সামাজিক বাতাবরণেও একটা অনন্যতা দেখা যায়। ব্যক্তি-আনন্দস্বরূপতা যেমন এনেছেন, তেমনি ব্যক্তি-নৈরাজ্যও উঠে এসেছে। একদিকে ধর্ম-সম্প্রদায়-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক গঠনে যখন সাম্যের বার্তা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েপড়াদের জন্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আয়োজন; একই সঙ্গে ধর্ম না-মানা, রাজ না-মানা, রাষ্ট্র না-মানা দ্রোহী ও অন্তে হত্যায়-খুনে প্ররোচিত, অভ্যস্ত।

ঙ) মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে লালবাগ থেকে ভগবানগোল থেকে কৃষ্ণপুর থেকে লালগোলা— তার পদ্মা ও গঙ্গাতীরবর্তী হয়ে ব্রাহ্মণী নদীতীরবর্তী বীরভূমের গ্রাম মফস্বল ও শহরের মানুষের লোকজ জীবনযাপন ও সংস্কৃতির পরিচয় হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্ম নির্বিশেষে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। এই রোড-ম্যাপের মধ্যবর্তী নিসর্গ ও তার ঋতুকালীন বিবিধ রূপ এবং তারই মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাসের জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থানভেদে যাপন, সংগ্রাম, ব্যথা-বেদনা-যন্ত্রণা, ব্রিটিশরাজের অত্যাচার, নবাবী জমানার অবক্ষয়, জমিদারদের প্রতাপ, আর গোপনে স্বদেশী লড়াই সবই একসঙ্গে উপজীব্যতাসহ উপন্যাসের রঙে রসে মিশেছে।

চ) ভাষার ক্ষেত্রে, মানুষের মুখের ভাষা ডায়লেক্টসহ উঠে এসেছে। আবার সংস্কৃত-বাংলা-ইংরেজি-ফারসি-আরবি-উর্দু সব একঠাঁয়ে নিজের অবস্থানে দীপ্যমান। তবু বাংলার প্রতি অমোঘ টান ধরা পড়েই। খোট্টাদের ভাষা যেমন এসেছে, তেমনি তার প্রতি অনাগ্রহও বর্ষিত হয়েছে। শফির রোজনামচা বাংলাভাষার তৎকালীন রূপ। আর বদিউজ্জামানের কেতাবের ভাষা বাংলা হলেও স্বাভাবিকভাবেই উর্দু-আরবী শব্দে ভরা।

ছ) তৎকালীন বাঙলায় প্রচলিত প্রায় সব ধর্মের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন, সময়ের নিরিখে তার বিচার, রাজ-সমাজনীতির সঙ্গে তার যোগাযোগ, মানুষের মধ্যে তার প্রতিফলন ও প্রভাব এবং ঘটমান জীবনের বহমানতার চড়াই-উৎরাইসহ অনির্দিষ্ট রূপরেখা, অনেকসময় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠিহীন বল্গা চরৈবেতি আর সব কিছুর মধ্যে একটা সমন্বের প্রয়াস উপন্যাসটিকে একটা বিশেষ মাত্রায় তুলে ধরতে সক্ষম।

জ) এই উপন্যাস এক আশ্চর্য বয়নশিল্পের উদাহরণ। ইতিহাস— সে পত্র-পত্রিকার সূত্রে তথ্য হিসেবেই আসুক বা আসুক অবধারিত ঘটনাক্রম হিসেবে, কিংবা আসুক রোজনামচা কিংবা আত্মচরিতের হাত ধরে বা আসুক ঐশী বিধির নিদান হিসেবে; ভূগোল— সে প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিমণ্ডল ধরেই আসুক বা আসুক পথ চলার তরিকা হিসেবে, অথবা আসুক মানচিত্রে একটা রোডম্যাপ অনুসারে; সময়কাল— সে তিন-চারটে প্রজন্মের যাপনের মাধ্যমেই আসুক বা আসুক একটা কালখণ্ডের দলিল হিসেবে, এমনকি কখনো কখনো আসুক সময়কাল নিরপেক্ষে, যাকে কালাতীত বা সর্বকালের বলা যায়; সমাজ— সে উচ্চ-নীচ-জাতপাত-ধর্মীবিধর্মী-রাজাপ্রজা-জমিদারভূমিহীন ভেদেই উঠে আসুক বা আসুক সংস্কৃতির ধারা বেয়ে; রাজনীতি— সে খর বিদ্রোহের রূপেই আসুক, বা আসুক তোয়াজে ভর করে, অথবা আসুক কোনো রফাসূত্রের মাধ্যমে; ধর্ম— সে মোহাবিষ্টই করুক বিভূতিতে, বা গরম লাভা ছড়াক বিভেদের, অথবা উদয় হোক সমন্বয়ের সুরে; অর্থনীতি— সে ইংরেজের আগ্রাসী রূপ ধরেই প্রতীয়মান হোক বা গ্রামবাংলার গরীব-গুর্বোর কষ্টের মধ্যেই চিত্রিত হোক, অথবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যমায় অবস্থানের ভিত্তিতে হোক; বিজ্ঞান— সে গ্রামীন অপবিজ্ঞানের মাধ্যমেই প্রতিভাত হোক, বা অলৌকিকতার স্বপক্ষে বা বিরুদ্ধ ব্যাখ্যা নিয়েই হাজির হোক, অথবা নাস্তিকতার কথা শোনাক বা শোনাক প্রকৃতির উদার দান, বা মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তোলার অবকাশ; সবই ঔপন্যাসিক মিলিয়েছেন সূক্ষ্ম এক মালিকায়, যার প্রতিটি ফুলকে আবার চিহ্নিত করা যায়, আলাদা করা যায়। একেই অসাধারণ বয়নশিল্পের নমুনা বলছি।

ঝ) ছোটো থেকে বড়ো যে-সমস্ত চরিত্রায়ন উপন্যাসে আছে, তাদের মানসিক জটিলতা, হেঁয়ালি, ব্যক্ততা-অব্যক্ততা, যন্ত্রণা-আনন্দ, লোকজ-অলৌকিকতা, বাস্তবতা-কারণশূন্যতা সব তিনি সপ্তসুরের মধ্যে বেঁধেছেন অসম্ভব বিচিত্রতায়, মিলিয়েছেন অনন্য পারদর্শিতায়। একদিকে বদুপির যেন সামাজিক বহমানতার এক প্রতীক, অন্যদিকে শফি যেন সেইসময় ও পরিবেশ-পরিসরের এক প্রোডাক্ট, যাকে তৈরি করতে হয় না, ঘটনা পরম্পরায় তৈরি হয়, অনেকটা ব্যাখ্যাতীতের বাইরে গিয়ে। এছাড়াও বাকি সব চরিত্রই তাদের ওঠা-পড়া, বৈশিষ্ট্যসহ জীবন্ত, মাটি থেকে উঠে আসা, যা অসধারণ মাত্রা যোগ করে উপন্যাসে।

ঞ) উপস্থাপনায় সময়কালকে ভেঙেচুরে একাকার করেছেন। অথছ ছিঁড়ে মুছে যায়নি তাদের অস্তিত্ব, হারায়নি পরম্পরার সূত্র, যা শুধু অবাক করে দেবার মতো প্রয়াস নয়, উপন্যাসকে এক মহাকাব্যিক রূপ দেয়। কোন অবস্থান থেকে কোন অবস্থানে চলে যাওয়া, বা কোনো সময়কাল থেকে জাম্পকাট করে ভিন্ন সময়কালে চলে যাওয়া যেন অবলীলায় সেরেছেন; অথচ উপন্যাসের স্বাভাবিক গতিবিধি ও গতিময়তা ব্যহত হয়নি। হয়তো অমীমাংসিত রয়েছে কোনো কোনো জায়গার গতিবিধি বা ঘটনাক্রম, যা পাঠকমনে প্রশ্ন তুলতে পারে; কিন্তু তা যেন স্বতপ্রণোদিতভাবেই রাখা, যা মূল উপন্যাসের ঘনত্বকে হালকা করতে চায়নি, আর একটা কৌতূহল বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে।

ট) গমনের বক্রতা, সাদাসিধে সরলযাপনেও মানসিক জটিলতা, পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব, আশার মধ্যে নিরাশা, প্রেম-অপ্রেমের জটিল রসায়ন, যৌনতা-শরীর, জটিল নানা তত্ত্ব ও প্রশ্ন উঠে পড়া, অবদমন-আত্মপীড়ন, দ্রোহ-ক্রোধ-আনন্দানুভব, ইত্যাদিসহ যে জীবন প্রত্যেকের প্রায় আলাদা, তাই আবার সমাজের ক্ষেত্রে এক যোগসূত্র তৈরি করে যাপন ও স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। কেউ আবার এই সামাজিক অবস্থানে আইসোলেটেড হয়ে পড়ে, কেউ জীবনভর খুঁজতেই থাকে আনন্দ, কেউ জীবনভর উচ্চ মানসিক অবস্থান থেকে নিচে নেমে আসতে চেয়ে বারবার ব্যর্থ হয়, কেউ প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যায়, আবার কেউ শরীরে আশ্রয় খুঁজে মরতেও চায়— এসবই অভিনব এবং আশ্চর্য সুন্দরভাবে প্রতীয়মান।

ঠ) সময়কাল ও পরিসরের প্রেক্ষিতে অলৌকিকতার জটিলতায় একরৈখিক হয়ে যেতে পারত যে উপন্যাস, তা ঔপন্যাসিকের অদ্ভুত তৎপরতায়, দক্ষতা আর মুনশিয়ানায় অনেক সম্ভাব্যতা ও বহুরৈখিকতার দরজা খুলতে খুলতে অগ্রসর হয়েছে। আগাগোড়া একটা টান রাখতে সক্ষম হয়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠককে ঠেলে দিয়েছে আগামীর দিকে। কৌতূহল ও রহস্যকে আলগা হতে দেননি। যে উপন্যাসে অলৌকিকত্বের পাঠ একটা বড়ো জায়গা দখল করে আছে, সেখানে রহস্য বজায় না-রাখতে পারলে পানসে হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকত। আবার অলৌকিকত্বের কাউন্টারও আছে বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে, সেখানে কৌতূহল বা খোঁজ একটা বড়ো বিষয়। এই বিবিধ কাউন্টার না-থাকলে তা অলীক মানুষের বিভূতি প্রচারের আখ্যান হয়ে যেত। তা না-করে সেখান থেকেই সম্ভাব্যতার ক্ষেত্রগুলি সামনে এনেছেন দক্ষতার সঙ্গে।

ড) দেশি-বিদেশি বহু মনীষীর (দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক, সঙ্গীতকার, চিন্তাবিদ, ধর্মগুরু) ছোটোখাটো অনেক উদ্ধৃতি এবং তার সঙ্গে উপন্যাসের মূলসুর ও সূত্রের যোগ একে ভিন্ন একটি মাত্রায় তুলে ধরেছে। পাঠক নিজেও এই মণীষীদের আলোয় তাঁর মনে উঠে পড়া কিছু প্রশ্নের উত্তর যেমন পেতে পারেন, আবার নিজ ভাবনার সঙ্গে সেই ভাবনাকে সমলয়ে রাখতে পারেন।

এমন একটি উপন্যাসে গমন করতে অনেক কষ্ট করা যায়। এমন একটি উপন্যাস আত্মস্থ করতে অনেক পথ হাঁটা যায়, আবিষ্কারের নেশায়। আর হাঁটতে হাঁটতে, হাঁটতে হাঁটতে মাথার টুপি খুলে রেখে আসা যায় উপন্যাসকারের পায়ের কাছে। অনেক অনেকদিন ধরে এর রেশ বয়ে বেড়ানো যায়, আগ্রহের সঙ্গে।

Facebook Comments

Leave a Reply