আফগানিস্তান ফ্যান্টাসি – সংহতির ব্যাকরণ ও নিপাতন : তাহমিদাল জামি

কাবুলিওয়ালার দুর্গা – সংহতির আত্মগত প্রণয়ন

রবীন্দ্রনাথের “কাবুলিওয়ালা” গল্পে মিনির যে বাপ, তিনি একজন বাঙালি ভদ্রবিত্ত লেখক। কেমন লেখক? জানা যায়, তিনি প্রতাপসিংহকে নিয়ে উপন্যাস লেখেন। এই প্রতাপসিংহ বাংলার ভূঁইয়া প্রতাপাদিত্য নন। বরং এই প্রতাপসিংহ সম্ভবত খোদ মেবারের রাজা রানা প্রতাপ। কেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের কথকটি রানা প্রতাপকে নিয়ে উপন্যাস লেখেন?

এই কাবুলিওয়ালা গল্পটা লেখা হয়েছে ১৮৯২ সালে। ওই বছরেই বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা প্রকাশ্য মতান্তর হয়েছিল। সেই বছর কাউন্সিল এ্যাক্ট পাশ হয়, যাতে ইংরেজরা ভারতবাসীর প্রতি ঔপনিবেশিক বৈষম্য অটুট রাখে। এর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করেছিলেন। এই সভায় রবি ইংরেজদের সাথে মুসলমান শাসকদের তুলনা করে, আকবর বাদশাকে অনেক বেশি উদার ও মহান বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর এই বক্তৃতার প্রতিবাদে এর পরপরই সভাপতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আকবর বাদশার প্রতি ঘোর বিষোদ্গার করেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের এই ঐতিহাসিক বিতর্কে আকবর বাদশা, আলফ্রেড টেনিসন ও আবুল ফজল কেমন জড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারে আমি অন্যত্র লিখেছি। এই কাহিনীটা উল্লেখ করছি এই কারণে যে কাবুলিওয়ালা গল্পের লেখক যে রানা প্রতাপকে নিয়ে উপন্যাস লিখছেন, তার পশ্চাদভূমি হিসাবে হাজির ছিল সেই সময়ে বঙ্কিমের দেখানো পথে জেগে ওঠা পুনরুত্থানী জাতীয়তাবাদ। কাবুলিওয়ালার মিনির বাপ তারই এক ধামাধরা লেখক।

রানা প্রতাপ কে? মেবারের রাজপুত রাজা, যার বিরুদ্ধে আকবর বাদশা যুদ্ধ করেছিলেন। যিনি রানা প্রতাপকে নায়ক বানাতে চান, তিনি নিশ্চিতই বঙ্কিমের আকবরবিদ্বেষের সমর্থক। অর্থাৎ কাবুলিওয়ালার মিনির বাবা যে রানা প্রতাপকে নিয়ে উপন্যাস লিখছেন, সেটা আপতিক কোন ঘটনা নয়। রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্ম সাহিত্যিক কূটনীতিতে এটি গূঢ়ার্থ ব্যঞ্জক।

কাবুলিওয়ালা গল্পটিকে বাঙ্গালির আফগানিয়ানার একটা আইকনিক আখ্যান বলা যেতে পারে, মানে এই গল্পের দাগ ভদ্রলোক বাঙ্গালির মনে রয়ে গেছে। কাবুলি বা আফগানদের নিয়ে কল্পনা করতে গেলে তার মনে এই গল্প জেগে ওঠে। এই গল্পটাকে আমরা একটা “সংহতি”র আখ্যান হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই। আমাদের আফগান, তালেবান, ইত্যাদি প্রসঙ্গও এই সংহতির ইতিহাস থেকে শুরু।

গল্পের আখ্যানভাগ এমন যে, একদা এক উপন্যাস লিখিয়ে রানা প্রতাপকে নিয়ে উপন্যাস লিখছেন। এমন সময় তার দুয়ারে এসে হাজির হয় রহমত নামের এক বিরাটদেহী কাবুলি বান্দা। লেখকের অর্বাচীন শিশুকন্যা মিনি, এই আফগান সওদাগরটির সঙ্গে একটি সহজ বন্ধুত্ব রচনা করে। উপন্যাস লেখকও রহমতের সঙ্গে গল্প করেন মাঝে মাঝে। গল্প করে সুদূর আফগানিস্তান সম্পর্কে নিজের কল্পনা তিনি তৃপ্ত করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:
“আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে। একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছুটিয়া যায়, তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী পর্বত অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরের দৃশ্য মনে উদয় হয়, এবং একটা উল্লাসপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাত্রার কথা কল্পনায় জাগিয়া উঠে।“
কিন্তু একদিন এক গুরুতর ঘটনা ঘটে যায়। দেশের ফেরার আগে টাকা তুলতে তুলতে এক দেনাদারের সাথে রহমতের বচসা হয়। মাথাগরম রহমত সেই দেনাদারকে ছুরি মেরে খুন করে ফেলে। তার জেল হয় আট বছর। আট বছর দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে লেখক ও মিনি দুইজনই ভুলে যায় রহমতকে।

এরপর শারদীয় দুর্গাপূজার একদিন, মিনির আজ বিয়ে। “কৈলাসবাসিনীর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরের আনন্দময়ী পিতৃভবন অন্ধকার করিয়া পতিগৃহে যাত্রা করিবে।” এমনসময় দুয়ারে এসে দাঁড়ায় সেই কাবুলিওয়ালা। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে সে, এসেছে শিশুবন্ধুটির সঙ্গে ফির মোলাকাত করতে। কিন্তু হায়, বিয়ের কনেসাজের উদ্ভিন্নতরুণী মিনির সঙ্গে তার সেই আগের ভাবটি আর জমল না। রহমতের বিষাদে সান্ত্বনা জানাতে গিয়ে উপন্যাস লেখক আবিষ্কার করলেন যে কাবুলিওয়ালা তার বুকে সুদূর আফগানিস্তানে থাকা তার কন্যার হাতের একটি ছাপ রক্ষা করে। সেই শিশুকন্যাটির ছায়াই দেখে রহমত মিনির ভেতর। এই পিতৃহৃদয়ের সঙ্গে অনায়াসে সংহতি বোধ করতে পারলেন প্রতাপসিংহের লেখক। লেখকের ভাষায়, “তাহার পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন আমারই মিনিকে স্মরণ করাইয়া দিল।”

তাইলে রবি এই গল্পে কি করলেন? তিনি এই বঙ্কিমি লেখক, যে পুনরুত্থানবাদী হিন্দু বাঙালি, তাকে দিয়ে উপলব্ধি করালেন যে রহমতের মতো দূরের অসংস্কৃত কাবুলবাসী আফগানের ঘরেও দুর্গা আছে। মিনিকে যেমন ভালবাসা যায়, তেমনি রহমতের অদেখা কন্যাটিকেও স্নেহ করা যায়, আর বাপের হৃদয়ে হৃদয়ে যে অভিন্ন বাৎসল্য, তার জোরে রহমতের রুক্ষ প্রাণটিকেও সহমর্মিতা দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। আরও আছে। বঙ্কিম তাঁর “আকবর বাদশার খোশরোজ” থেকে শুরু করে নানা লেখায় মুসলমান পুরুষের সাথে হিন্দু নারীর সম্পর্ককে যে কামাত্মক নাফরমানি বা ট্রান্সগ্রেশন দিয়ে দাগিয়ে দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ পিতা-কন্যাসমার মধুর বাৎসল্য সম্পর্কের আখ্যান রচনা করে সেই দাগ মুছতে চেষ্টা করেছেন একটু।

আমি এইটাকেই বলছি ঠাকুরের সূক্ষ্ম কূটনীতি বা ডিপ্লোম্যাসি। আর এই কূটনীতির একটা পশ্চাৎপটও আছে। মুজতবা আলী রবীন্দ্রনাথের পরিচয় লিখেছেন এভাবে: “এ কবির পিতা সূফী সাধক ছিলেন এবং অতি উত্তম ফারসি জানতেন। কবি বাল্য বয়সে পিতার কোলে বসে বিস্তর ফার্সি গজল-কসীদা শুনেছেন”। কাজেই রবি হলেন সেই সময়ের সমাজের সবচেয়ে বড় লিবারেল।

অবশ্য রবির এই কূটনীতি অবশ্যম্ভাবী রূপেই সীমাবদ্ধ। বাঙালি ভদ্রলোক আজও কাবুলিওয়ালার জন্য দরদ বোধ করে, আরও বেশি দরদ বোধ করে কাবুলিওয়ালার ঘরের দুর্গাদের জন্য। কিন্তু তা রবির বেঁধে দেওয়া সীমাবদ্ধতার সূত্র মেনে। তাতে ঘোর স্বজাতি কেন্দ্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক নানা অনুমান নিহিত থাকে। সংক্ষেপে, রবীন্দ্রনাথের এই গল্পটিতে সংহতির ব্যাকরণের আত্মকেন্দ্রিক দিকটি দারুণভাবে ধরা পড়েছে। বলা বাহুল্য, রবিকে রবির সময়ে রেখেই প্রথমে বোঝা দরকার।

ভারতবর্ষের মুসলমানের আফগানদেশকল্প

ওরিয়েন্টালিজম ও কলোনিয়াল জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে আমরা যখন সূক্ষ্মভাবে চিন্তাভাবনা করতে শিখেছি, তখন আমাদের মধ্যে একটা ধারণার প্রচলন হয়েছে যে বুঝিবা ঔপনিবেশিক অপরায়নই অপরায়নের মূল ধরন। এর বাইরে অপরায়নের অন্য কোন গুরুতর ধরন বুঝি বা নাই। অথচ, সকল নিজই তো অনেক রকম অপরায়ন করে করে নির্মিত হয়। বাঙালি সমাজে যে ছোটলোক, চামার, চোয়াড়, চুতিয়া, হেড়েগলা, মগের মুল্লুক, খোট্টা, চিঙ্কু, ইত্যাদি জাতি ও জাতগত গালাগাল বহুল প্রচলিত তা তো আর এমনি এমনি নয়। অপরকে নির্মাণ করার ধরন নিয়ে সচেতন হওয়া এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তান ও আফগানদের নিয়েও দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশে নানা ধারণার নির্মাণ ও প্রতিনির্মাণের একটি লম্বা ইতিহাস আছে। আফগানিস্তান ও তার মানুষ এই অঞ্চলের সমাজের নানা অংশের চিন্তায় ও জ্ঞানে ধরা পড়েছে এক প্রায়-পরিচিত অপর হিসাবে। কাবুলিওয়ালা গল্পে আমরা তার একটা নমুনা দিয়েছি। এই অপর-নির্মাণের সঙ্গে সংহতির প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে আফগানদের সঙ্গে সেই সংহতি কোন কোন অনুমানে নির্মিত, সেইটা সন্ধান করা লাগে।

মধ্যযুগে পাঠানরা বাংলা শাসন করেছেন, এদেশের রাজাদের অধীনে চাকরি ও সেপাইগিরি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। আফগানিস্তানের সাথে বাংলার মানুষের সম্পর্ক যুগযুগান্তর ধরে। কিন্তু প্রতিটি পরিচয়ই নতুন ধরনের অপরিচয়, অপ-পরিচয় ও অপর-পরিচয় নির্মাণ করে। আফগানিস্তানের সাথে বাংলা ও ভারতের নানা পরিচয় এরকম নানা অপরিচয়ে ঘেরা। আফগানিস্তান সম্পর্কে যে আমরা কি জানি না, তাও আমরা জানি না। আপাতত ভারতের মুসলমান সমাজের কথাই বলি।

ভারতের মুসলমানদের কাছে আফগানিস্তান একটা আজিব ও গারিব কল্পভূমি হিসাবে প্রায় তিনশ বছর ধরে বিরাজ করছে।

নাদির শাহের মোগল বিজয়ের পরে যখন মোগল শাসন ফক্কা হয়ে গেল, তখন ১৭৫৭ সালে ভারতের প্রধান মুসলমান বুদ্ধিজীবী শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব মারাঠা, শিখ, ইত্যাদি “কাফির” জাতির অভ্যুত্থানের বিপরীতে মুসলমান সার্বভৌমত্ব বা সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠার জন্য আফগান আহমদ শাহ আবদালীর ভারত বিজয়ে বেহদ্দ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু আফগান বাদশাহ আবদালী সাহেব, শাহ ওয়ালিউল্লাহদের ধর্মরাজ্য-ইউটোপিয়া নিয়ে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। তিনি আফগান বাহিনী নিয়ে ভারত বিজয় করে প্রভূত সম্পদ লুণ্ঠন-পণ্ঠন করে বিদায় হন। অপাঙ্গে বলা যায়, ওই লুণ্ঠিত সম্পদের মধ্যে খুঁজলে বাংলার চাষিদের হাড়ভাঙ্গা শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্যের দুই আনা পাওয়া যেত।

ওয়ালিউল্লাহর উত্তরসূরি শাহ আবদুল আজিজের শিষ্য ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভী। তখন এদেশে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়েছে, দিল্লির বাদশাহ একেবারে নামকাওয়াস্তে গদিতে আছেন। ওয়ালিউল্লাহর রুহানী নাতি সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিষ্যসামন্ত সংগ্রহ করে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানদের অঞ্চলে হিজরত করেন। শত্রুভূম বা দারুল হারব থেকে উত্তরপশ্চিম সীমান্তের আফগানভূমে হিজরতের মধ্য দিয়ে একটা স্বতন্ত্র বেইজ তৈরি করে তারপর “বিধর্মী”দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে হবে, এই ছিল তাঁর বোঝাপড়া। আফগানদের মধ্যে গিয়ে তিনি খলিফা সাহেব হয়ে বসলেন। সেখান থেকে পাঞ্জাবের “কাফির”-অভিহিত শিখ রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শানাতে লাগলেন। একই সঙ্গে গোষ্ঠীবাদী নমুস-শাসিত আফগান গোষ্ঠীগুলোকে সাচ্চা শরিয়ত পছন্দ মুসলমান বানাতেও তিনি বিয়েশাদি-চলাফেরা-জীবনযাপনের উপর নানা নিয়মকানুন-বিধিনিষেধ আরোপ করলেন। খালি গায়ে গোসল করা নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে নারীদের চলাফেরার উপর কট্টর শাস্তি কায়েম করা হল। কিন্তু বিধি বাম! আফগানিস্তানে বেরেলভী সাহেবের খিলাফত সুবিধার হয় নাই। বড় বড় সর্দারদের মধ্য থেকে তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু হল। আফগান সর্দারদের দেওয়া তথ্য মতেই শিখ বাহিনী সৈয়দ আহমদের বাহিনীকে বালাকোটের যুদ্ধে পরাস্ত করল।

দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তানে উত্তরকালে যেমন ইংরেজ-রুশ-মার্কিন টিকতে পারে নাই, আগের আমলের খলীফা সাহেবও তেমন টিকতে পারেন নাই।

বালাকোটের পরেও ওহাবি আন্দোলনের নামে ইনায়াত আলীরা সীমান্তে গিয়ে জিহাদ করার প্রচেষ্টা করেছেন। ইংরেজরাও ক্রমবিস্তারমান রুশ সাম্রাজ্যকে ঠেকাতে আফগানিস্তানে বারবার হামলা করে বিশেষ সুবিধা করতে পারে নাই। আফগানিস্তানের ব্যাপারে ইংরেজ ও রুশ সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রহ ছিল মূলত ভূরাজনৈতিক। অন্যদিকে ভারতের মুসলমান নেতারা এদেশকে দারুল হারব যা শত্রুযুদ্ধের ভূমি মনে করায় তাঁরা এদেশ থেকে ভিনদেশে হিজরতের মত প্রচার করতেন। আফগানভূমি নিয়ে তাঁদের আগ্রহ ছিল ব্রিটিশ-অধিকৃত ভারতের অব্যবহিত বাইরে এক মুসলমান শাসিত রাজ্য হিসাবে।

এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হবে উনিশ শতকে হাজী শরিয়তউল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলনের অনুসারীদের কথা। উনারা এদেশে “আল-মিসর আল-জামি” (বা আল-মিসরুল জামি) নাই, অর্থাৎ “নগর পরিসরে মুসলমান সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশাসন” নাই বলে মনে করতেন। এই বিবেচনা থেকেই উনারা এইদেশে জুমার নামাজের জামাত অনাবশ্যক বিবেচনা করলেন। জুমার নামাজের সাথে রাষ্ট্রসংগঠনের একটা সম্পর্ক ছিল পুরানা মুসলমান সভ্যতায়। “আল-মিসরুল জামি”র ধারণাটির উদয় হানাফী আইনে। আমরা যে জামে মসজিদ কথাটা বলি, এই জামে মসজিদ নামক শব্দবন্ধের উদয়েরও আগে এই মিসরুল জামি অর্থাৎ একটি সামগ্রিক শহরের ধারণার উদয় হয় গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক ইরাকি সভ্যতায়। মিসরুল জামির কথা তুলছি ইংরেজ আমলে বাংলার মুসলমানদের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত ধ্যানধারণা বোঝাতে। এইদেশে মুসলমানি সার্বভৌমত্ব নাই বলে বিশ্বাস করার কারণেই এদেশ ছেড়ে আফগান সীমান্তে গিয়ে জিহাদ করার ধারণা চালু হয়েছিল।

আরবের মুসলমানেরা ইরাক বিজয়ের পরে তাতে বসরা, বাগদাদ (সংস্কৃত ভাষায় “ভগদত্ত”) ইত্যাদি নগরের পত্তন করে। ইরাক ইরান ইত্যাদি অঞ্চলের এইসব নতুন নগরে মুসলমানদের কেন্দ্র ছিল, অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে তখনও অমুসলমান মানুষ ছিল বেশি। এই বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে নবোদিত মুসলমানি সভ্যতায় নগর সম্পর্কে অভিনব ধ্যানধারণা গড়ে ওঠে। আল-মিসরুল জামি তেমনি একটি ধারণা। এই পরিভাষাটির দ্বারা বোঝাত সবধরনের বৃত্তি ও শিল্পসমন্বিত এমন শহর যা একই সঙ্গে মুফতী ও কাজীর দ্বারা ধর্মশাসিত। হানাফীদের মধ্যে এই মতের চল ছিল যে এহেন মিসরুল জামিতেই জুমার নামাজ পড়ার নিয়ম।

অর্থাৎ এই মিসরুল জামি ধারণার মধ্যে যুগপৎ ইসলামি সভ্যতার নগরকেন্দ্রিকতা, সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং কৃষির উদ্বৃত্ত মূল্যের সঙ্গে নগরকেন্দ্রিক উদ্বৃত্তভোগী “সভ্যতা”র শোষণমূলক সম্পর্ক একবিন্দুতে বিধৃত আছে।
ওসমানী সাম্রাজ্যে বড় বড় গ্রামাঞ্চলীয় কেন্দ্রগুলিকেও মিসরুল জামি বলা যাবে বলে বিধান দেওয়া হয়, যদি সেসব গ্রামে কাজী-মুফতী থাকে। হয়তো মোগল বাংলাতেও এরকম ধারণার চল ছিল।

কিন্তু উনিশ শতকে এসে দেশে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়েছে। যেহেতু ইংরেজ শাসিত বঙ্গে এই রকম মুফতী-কাজী শাসিত ব্যবস্থা নাই, ফলে ফরায়েজিরা এখানে মিসরুল জামি নাই বলে জুমার নামাজ বন্ধ করল। বলা বাহুল্য মিসরুল জামির ধারণা মুসলমান পণ্ডিতদের সবাই কোন সময়েই গ্রহণ করে নাই। ফরায়েজিদের এই নিয়মও সেকালের বাংলার মোল্লা ও পণ্ডিতদের সকলে গ্রাহ্য করে নাই। উনিশ শতক জুড়েই তরিকায়ে মুহম্মদীয়া, কারামাত আলী, ফরায়েজি প্রমুখের মধ্যে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে নানা মতবাদিক তর্কবিতর্ক চলতে থাকে যার ভেতরে ওই সার্বভৌমত্বের পুরাতন প্রশ্নটা ব্যাকগ্রাউন্ড বা ভিত্তি হিসাবে ছিল। অর্থাৎ সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা ইংরেজবাহুপাশাবদ্ধা বাংলার কৃষি সভ্যতার মধ্যে এই যে বিতর্ক, তাতে “ইসলামি সভ্যতার নগরকেন্দ্রিকতা, সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং কৃষির উদ্বৃত্ত মূল্যের সঙ্গে নগরকেন্দ্রিক উদ্বৃত্তভোগী “সভ্যতা”র সম্পর্ক” নিয়ে ধারণার স্পষ্টতা অর্জন ছিল একটা চ্যালেঞ্জ, যেই চ্যালেঞ্জ এই এলাকার মোল্লা সমাজ কখনোই মোকাবেলা করতে সমর্থ হন নাই।

বিশ শতকের শুরুতেও মুসলমানদের আন্দোলনে এই আঠার-উনিশ শতকের আলোচনার রেশ ছিল জোরাল। তখনও ভারতের উপনিবেশী শাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিম সীমান্তে হিজরত করার ধারণা চালু আছে। ব্রিটিশরা সেই হিজরতে বাধা প্রদান করত। একবার হিজরতে বাধা দিতে গিয়ে ব্রিটিশের সেপাই বেশ কয়েকজন মোহাজেরকে হত্যা করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কাজী নজরুল ইসলাম মুহাজিরিন হত্যার জন্য ব্রিটিশ শাসকের নিষ্ঠুরতাকে দায়ী করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন,
“তোমাদের অত্যাচারে, জুলুমে নিপীড়িত হইয়া, মানবাত্মা – মনুষ্যত্বের এত পাশবিক অবমাননা সহ্য করিতে না পারিয়া মানুষের মতো যাহারা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতে পারিল যে, এখানে আর ধর্ম কর্ম চলিবে না, এবং চিরদিনের মতো তোমাদের সংশ্রব ছাড়িয়া তোমাকে সালাম করিয়া বিদায় লইল, – সেই বিদায়ের দিনেও তাহাদের উপর সামান্য পশুর মতো ব্যবহার করিতে তোমাদের লজ্জা হইল না, দ্বিধা হইল না! সামান্য খুঁটিনাটি ধরিয়া, ছল করিয়া গায়ে পড়িয়া তাহাদের সাথে গোলমাল বাধাইলে, হত্যা করিলে! আবার হত্যা করিলে আমাদেরই ভারতীয় সৈন্য দ্বারা!”

নজরুল সীমান্তে হিজরতকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিবাদে লেখাটি লিখেছিলেন। সেটি ছিল অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের আমল। লক্ষ্য করুন, যখন এই অঞ্চলের মুসলমানেরা একধরনের ইউটোপিয়ান বাহিরানার টানে হিজরত করে পাঠান অঞ্চলে যাচ্ছে, সেই একই জমানায় পাঠানদের রাজা আমানুল্লাহ সেদেশে একধরনের আধুনিকতাবাদী, বিশ্বজনীন সংস্কৃতি চালু করার চেষ্টা করছেন। পাঠান ভূমির বাহিরানা তাই কল্পনার সোনার হরিণ।

১৯১৯ সালে আফগান বাদশাহ আমানুল্লাহ খান যখন তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন, তখন নজরুল লিখেছিলেন,
“খোশ্ আম্দেদ আফগান-শের! অশ্রু-রুদ্ধ কণ্ঠে আজ–
সালাম জানায় মুসলিম-হিন্দু শরমে নোয়ায়ে শির বে-তাজ!
বান্দা যাহারা বন্দেগী ছাড়া কি দিবে তাহারা, শাহানশাহ!
নাই সে ভারত মানুষের দেশ! এ শুধু পশুর কতল্-গাহ!
দস্তে তোমার দস্ত্ রাখিয়া নাই অধিকার মিলাতে হাত,
রুপার বদলে দু’পায়ে ভূর হাত বাঁধা রেখে খায় এ জাত!
পরের পায়ের পয়জার বয়ে হেঁট হ’ল যার উচ্চ শির,
কি হবে তাদের দু’টো টুটো বাণী দু’-ফোঁটা অশ্রু নিয়ে, আমির!…
‘আমানুল্লা’রে করি বন্দনা, কাবুল-রাজার গাহি না গান,
মোরা জানি ঐ রাজার আসন মানব জাতির অসম্মান!
ঐ বাদশাহী তখতের নীচে দীন্-ই-ইসলাম শরমে, হায়,
এজিদ হইতে শুরু ক’রে আজো কাঁদে আর শুধু মুখ লুকায়!
বুকের খুশীর বাদশাহ তুমি,– শ্রদ্ধা তোমার সিংহাসন,
সিংহাসন ছাড়ি’ মাটিতে নামিতে দ্বিধা নাই– তাই করি বরণ।
তোমার রাজ্যে হিন্দুরা আজো বেরাদর-ই-হিন্দ্, নয় কাফের,
প্রতিমা তাদের ভাঙ্গোনি, ভাঙ্গোনি একখানি ইট মন্দিরের।
‘কাবুলী’রে মোরা দেখিয়াছি শুধু, দেখিনি কাবুল পামীর-চূড়,
দেখিছি কঠিন গিরি মরুভূমি– পিই নাই পানি সে মরুভূর!’

মানবতাবাদে আস্থাবান নজরুল সেই সময়ে আফগানদের বাদশাহের শাসনে ন্যায়নীতি ও স্বাধীনতা নীতির প্রতিফলন দেখে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তুরস্কের আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক, একনায়ক কামাল আতাতুর্ককে নিয়েও নজরুলের বিস্তর উচ্ছ্বাস ছিল। আফগান সমাজ কিংবা ভারতের মুসলমান সমাজ নানা পুরাতন ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী হলেও নজরুল মহাপ্রাণ শাসকের হাতে এইসকল জাতির উন্নতি সম্ভব বলে আশাবাদী ছিলেন। আফগানদের প্রতি নজরুলের সংহতি নিছক ইসলামরাজ্য কিংবা মিসরুল জামি খোঁজার মামলা ছিল না। জিহাদ কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচনা ভূমিও নয় তা নিছকই। নজরুল এতে একটি আফগানিস্তান বা তুরস্কে একটি প্যারাডাইম বা দৃষ্টান্ত খুঁজেছিলেন, যা ভারতবাসী ও বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজের নজর পথে আসলে বিশেষ উপকার বলে তিনি কল্পনা করেছিলেন।

নারী ও কোরবানি

ষাটের দশকে আফগানিস্তানের কিছু ছবি পাওয়া যায় যেখানে আফগান নারীরা আধুনিক পোশাক পরে লেখাপড়া করছেন, জনপরিসরে বিচরণ করছেন। এই চিত্রমালা নিয়ে নানা রকমের জবানি পাওয়া যায়। অনেকে হায়-হুতাশ করেন যে আফগানিস্তানে একদা কি দারুণ আধুনিকতা ছিল! এর বিপরীতে আরেকদল বলেন যে এই আধুনিকতা সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের এক অতি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে। দেশের বিরাট গোত্র সমাজের নারীরা এই স্বাধীনতার ভাগীদারিণী ছিলেন না। পুনরায় কথা ওঠে যে ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেও যদি এইরকম স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত থাকে, তা সমাজের সকল নারীর জন্যই সম্ভাবনা আকারে হাজির হয় না? তার জবাবে প্রশ্ন ওঠে যে স্বাধীনতা মাপার উপায় কি? সমাজে যদি গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, নাগরিকতা ইত্যাদির বিকাশ ঘটে তাহলেই না হয় স্বাধীনতা বাড়ে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা কি লোকে নিজে অর্জন করবে নাকি রাজা বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাকা ফলের মতো লাভ করবে? এরকম আরও সুবিস্তার কূটতর্ক এই সামান্য কয়টি ছবিকে কেন্দ্র করে শাখায়িত হয়ে চলেছে। কিন্তু আমরা এই বিতর্ক ছেড়ে একটু এগিয়ে যাই।

আফগান নারীর বাসনার স্বরূপ কি, তা নিয়ে দুনিয়ায় জল্পনার শেষ নাই। কিসে তাঁদের মুক্তি, তা নিয়েও নানা প্রকল্প। এই প্রসঙ্গে সংক্ষেপে সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম উপন্যাসটির কথা পাড়তে চাই। উপন্যাস না বলে এটিকে একটি সুদীর্ঘ লিরিকাল গদ্য আখ্যান বলা যায়। উপন্যাসের মাপে মাপলে অত্যন্ত দুর্বল হলেও আখ্যান হিসাবে এতে দারুণ কিছু উপাদান আছে। অবাক নয় যে আমার পরিচিত বহু যুবকের প্রিয় আখ্যান এটি। তার কারণ, এই উপন্যাসে মুসলমানি রোমান্টিকতাকে আফগানিস্তানের সুদূর প্রান্তরে চরিয়েছেন লেখক। এর মধ্যে দুইটি দিক।

প্রথমত আফগান অপরকে অপরা অর্থাৎ ফেমিনাইজ করার ব্যাপার আছে এই উপন্যাসে। আফগানিস্তানের আখ্যানের খোলসে মূলত ফার্সিয়ানা মুসলমানি সভ্যতার আইডিয়াকে নিজের দয়িতারূপে পাবার শখ আছে এই লেখায়। ছত্রে ছত্রে কবিতা ফলাতে গিয়ে গদ্যময় বাস্তবতা এতে প্রায় অনুপস্থিত, নেহাত মুজতবা আলীর রসপ্রচেষ্টার কারণে কিছু বেখাপ্পা শব্দ এসে কাব্যিক আবেশ ভেঙ্গেছে মাঝেমাঝে।

দ্বিতীয়ত, মুসলমানি রোমান্টিকতাকে একটি স্পষ্ট রূপ দান করার কোশেশ আছে এই আখ্যানে। রোজা রেখে স্বপ্নে প্রিয়ার সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাদেশ খোঁজা কিংবা দয়িতের জন্য নামাজ পড়তে পড়তে শোক করা – এমন নানা বর্ণনাঙ্গে নায়ক-নায়িকার প্রেমের মুসলমানি সাংস্কৃতিক রূপকে স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। তবে এই মুসলমানি আধুনিক, অর্থাৎ তা অমোল্লা মুসলমানি। বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত প্রেমের সূচনা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে। বঙ্কিমের প্রেমকাহিনীগুলিতেও কোর্টশিপ বা প্রেম প্রার্থনার বাস্তবসম্মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে নানা দূর কল্পিত স্থানকাল পাত্রের অবতারণা করা হয়েছে। বাঙালি মুসলমান রচিত সাহিত্যে বিশুদ্ধ প্রেমের আখ্যানের ইতিহাসে শবনমের স্থানটি বিশিষ্ট এবং এখানে নিটোল প্রেম প্রার্থনার খোঁজে সুদূর কাবুল-পাগমানে রপ্তানি হতে হয়েছে লেখকের কল্পনাকে। ভাগ্যে মুজতবা আলী বহুদর্শী বহুব্রজ ব্যক্তি ছিলেন, এবং আদতেই আফগান ফেরত আধ-মোহাজির লেখক ছিলেন।

শবনম শব্দের মানে রাতের শিশির। প্যারিসে জন্মানো আফগান মোহাজের অভিজাত পরিবারের উনিশ-কুড়ি বছরের এই মেয়েটি বাংলা সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা রাখতেন না। তাঁর জানা মতে বাঙ্গালা মুলুকে পৃথিবীর শেষ। একেবারেই আজিব ও গারিব। তবু প্রথম দেখাতেই তিনি বাঙালি নায়ক মজনুনের প্রেমে পড়ে যান। শবনমের রূপটি শিশিরের মতই, তাঁর মুখচন্দ্রটি “পাগমান পাহাড়ের বরফের মতো ধবধবে সাদা… নির্জলা দুধের মতো (সাদা)”। তিনি মাংস খান এবং তাঁর ওজন কম নয়। তিনি বেশ লাফাতে ও নাচতেও জানেন। অর্থাৎ তিনি ভোরের শিশির হলেও তাঁর একটি সজীব গতিময় মাংসল দেহী উপস্থিতি রয়েছে। তাঁর প্রেম স্রেফ পূজা নয়, নিবেদন নয়, বরং কায়মন জুড়ে উপলব্ধি, আনন্দ ও সক্রিয় ইচ্ছার ধরাছোঁয়া প্রকাশ। সেই উপস্থিতি ও সেই ইচ্ছা বারবার তাঁর আফগাননারীরূপী লিঙ্গ পরিচয় ও যাপনের সমাজ-আরোপিত শর্তে ধাক্কা খায়, ধাক্কা খেতে খেতে আবার এগোয়। অর্থাৎ এই প্রেমাখ্যানে সকল প্রেমের আয়োজনের ভেতর আফগান মুসলমান সমাজে লিঙ্গ নির্দেশিত যাপনের জটিলতা শিরায়-শিরায় মিশে আছে। লেখক একান্তে শবনমের সাথে যেমন গল্প করতে পারেন, আফগান ড্রাইভারের সামনে তা পারেন না, কারণ আফগানেরা কিরকম গোঁড়া তা তাঁর ভালই জানা আছে। দুম করে বোরকা নিয়ে একটি ছোট আলাপ হয়ে যায় দুইজনের মধ্যে:
“আমি … বললুম, ‘তুমি ওই তাম্বু, মানে বোরকা পর কেন?’
‘স্বচ্ছন্দে যেখানে খুশী আসা-যাওয়া করা যায় বলে। আহাম্মুক ইউরোপিয়ানরা ভাবে, ওটা পুরুষের সৃষ্টি, মেয়েদের লুকিয়ে রাখবার জন্য। আসলে ওটা মেয়েদেরই আবিষ্কার – আপন সুবিধের জন্য। আমি কিন্তু মাঝে মাঝে পরি, এ-দেশের পুরুষ এখনও মেয়েদের দিকে তাকাতে শেখে নি বলে – হ্যাটের সামনে পর্দায় আর কতটুকু ঢাকা পড়ে?’

এই সংলাপ-বিনিময় চিত্তাকর্ষক: এতে বিশের দশকের আফগানিস্তানে একজন অভিজাত আধুনিক মুসলমান নারী কিভাবে সামাজিক পরিসরে আত্মযাপনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এবং বোরকাকে একটি স্বাধীন কিন্তু সমাজ সাপেক্ষ লেবাস হিসাবে ধারণ করছে অথচ অনিবার্য বাধ্যগত ভাবছে না, সেই খবর আছে। শবনম এমন নারী, “যেকোন পুরুষকে যে ছাড়িয়ে যায়”।

বলা বাহুল্য, শবনম রাজকন্যা তথা সর্দার কন্যা বলেই আফগান সমাজে এই স্বাধীনতা চর্চা তার দ্বারা সম্ভব হয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি, আমাদের কালেও বাঙালি ভদ্রবিত্ত ঘরের মেয়েদের যে নিজেদের রাজকন্যা ভাবার মানসিকতা দেখা যায়, তার পেছনে মূলত কন্যা শিশুকে গৃহশ্রম ও পারিবারিক অধীনতা থেকে মুক্ত করে শিক্ষিত ও স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে গঠন করার তাগিদই কাজ করে। সামন্ত মূল্যবোধ থেকে বুর্জোয়া ব্যক্তিতন্ত্রে উত্তরণে রাজকন্যা-রূপক এক বিচিত্র কূটাভাসী সিঁড়ি হিসাবে আমাদের অঞ্চলে হাজির, যে কারণে ব্যক্তির মুক্তি নাগরিক চেতনার পথে না গিয়ে শ্রেণিভেদের চেতনায় ঘুরপাক খায়।

তা যাই হোক, রাজকন্যা শবনম এক স্বতন্তরা নারী। ফলে, এই উপন্যাসে আফগান অপরাকে ফেমিনাইজ করা হয়েছে বলে যদি বা অভিযোগ করা চলে, সেই অপরা এইখানে সক্রিয়, বরং হিন্দুস্তানি প্রেমিক পুরুষটিই অক্রিয়, প্রায় অপদার্থ। প্রেমের প্রতিটি অগ্রসরণ ঘটে শবনমের হাতে, মজনুন তাতে সাড়া দিয়েছে মাত্র। ফলে, বাচ্চা সাকাও কাবুল আক্রমণ করলে শবনম নিজেই বাড়ি বয়ে এসে মজনুনকে বিয়ে করে ফেলে। তবে বাচ্চার কাবুল দখলের পরে রাস্তায় মেয়েদের চলাফেরাই বন্ধ হয়ে গেল। নারীর বেশবাস আর মেয়েদের “আপন সুবিধে”র ব্যাপার রইল না।

“দেউড়িতে দাঁড়িয়ে দেখি, রাস্তা থেকে মেয়েরা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গিয়েছে। বে-বোরকার তো কথাই হচ্ছে না, ফ্যাশনেবল বোরকাও দূরে থাক, দাদী-মা নানী-মার তাম্বুপানা বেঢপ বোরকার ছায়া পর্যন্ত নেই। শবনম আসবে কি করে? দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই মারাত্মক শীতে দেউড়িতে দাঁড়িয়ে চোখ ফাটিয়ে ফেলেছি – কখন প্রথম বোরকা বেরুবে, কখন প্রথম বোরকা দেখতে পাব?”

কিন্তু এই বিরহে রহিত থাকা শবনমের ধাত নয়। ধোপানীর বোরকার ক্যামোফ্লাজ পরে তিনি হাজির হলেন মজনুনের বাড়ি, সঙ্গে একটি বিরাট রিভলভার — কেউ প্রিয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে খুলি উড়িয়ে দেবে বলে। পরে যখন পরিবারের সম্মতিতে মজনুন ও শবনমের বিয়ে হল, তখনও “শবনম বানুর প্রসন্ন, অতিশয় সুপ্রসন্ন সম্মতি নিয়েই” তা সম্পন্ন হল। কিন্তু শবনমের এই অসাধ্যসাধনেরও সীমা আছে। বিবাহবাসরের পরের দিনই শবনমকে ধরে নিয়ে গেল বাচ্চার সেনাপতি জাফর খানের বাহিনী। শবনমের উপর ধর্ষকামী জাফর যখন চড়াও হতে যাচ্ছে, তখন বন্দিনী সেই অত্যাচারীকে গুলি করে মারল। তারপর কোথায় উধাও হয়ে গেল শবনম! উপন্যাসের বাকি দীর্ঘ বয়ান কেবলই মজনুনের বিরহ-হতাশ্বাসের প্রলম্বন — ক্রমশ শবনমের স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে, ধ্যান হয়ে ক্রমে ক্রমে নিরাকার এক ব্রাহ্মভাব হয়ে দাঁড়াল। বাঙালি বাবু আর আফগান স্বাধীনচেতা রাজকন্যার প্রেমের কাহিনীটি এক স্বপ্নের ভেতর মিলিয়ে গেল।

তাইলে শবনমের স্বাধীনতার স্বরূপটা কেমন? শবনমের প্রিয় গুরু জানেমন জল্পনা করেন যে জাফর খানের কবলে শবনম যদি আর একটু সময় অক্রিয় থাকত, তাইলে হয়তো সে বাচ্চা সাকাওয়ের কাছ থেকে আপসে ছাড়া পেয়ে যেত। দুর্দান্ত রূপক! এবং ভয়ঙ্কর কথা! একটা বিশেষ সমাজে ব্যক্তির – বিশেষ নারী ব্যক্তির – সক্রিয়তা কিভাবে অক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল হতে পারে, তা এই কথায় বোঝা যায়। তাইলে আমরা ঘুরেফিরে সেই আগের এপোরিয়ায় এসে ঠেকেছি — স্বাধীনতার মধ্যে সক্রিয়তা ও অক্রিয়তার সম্পর্ক কিভাবে হদিস করা যায়?
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আদি গদ্যলেখক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের রাজাবলী গ্রন্থে একটা বাক্য এরকম:
“বিক্রমাদিত্য আপনি দিল্লীতে সম্রাট হইয়া পৃথিবীস্থ যাবত রাজবর্গকে স্বাধীন করিয়া যুধিষ্ঠির দেবের ন্যায় ধর্মেতে পৃথিবী পালন করিতে লাগিলেন”।

এখানে স্বাধীন (স্ব-অধীন) মানে কিন্তু মুক্ত নয়, বরং অপর স্বাধীনকারীর অধীন হওয়া তথা পরাধীন হওয়া। স্বাধীন করা = পরাধীন হওয়া। স্বাধীন শব্দের ভেতর এই দ্বান্দ্বিকতাটা লক্ষণীয়। কেউ কাউকে স্বাধীন করতে গেলে তাকে প্রায়ই স্ব-এর অধীন করে নেয়। শবনমের স্বাধীনতা শবনম নিজেই রচনা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সর্বনাশী পরিস্থিতি তাঁর এই স্বাধীনতাচেষ্টাকে আত্মলুপ্তিতে বা কোরবানিতে নিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিকে আমরা আধুনিক সাবজেক্টের ট্রাজেডি বলে অভিহিত করতে পারি।

সংহতির পরিণামভোগ

রুশের যুদ্ধের পরে কিছুদিন তালিবান শাসনে থেকেছে আফগানিস্তান। এরপর বুশের ওয়ার অন টেররের ফলে আফগানিস্তান আরও বিশ বছর যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। মার্কিন দখলদারির সমাপন হতে না হতেই তালিবান বাহিনী কাবুলের দখল নিয়েছে। দ্রুত রূপান্তরশীল পরিস্থিতিতে আফগান সমাজের নানা অংশের সঙ্গে বাইরের মানুষ নানা প্রকারে সংহতি প্রকাশ করছেন। ইসলামপন্থীরা তালিবানদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীদের একটি অংশ মার্কিন প্রস্থানে আনন্দিত। কেউ কেউ তালিবানদের বীর হিসাবে অভিনন্দিত করছে। লিবারেলদের অনেকে মার্কিন প্রস্থানে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। উপমহাদেশের তিন দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষের কাছে আফগানিস্তান কাণ্ডের গুরুত্ব বিরাট। এই তিন দেশের জাতীয় রাজনীতির নানা সরগরম এজেন্ডা এবং জ্ঞানক্ষমতাগত প্রতর্কে আফগানিস্তান প্রশ্নটি একটি মোক্ষম ঘুঁটির মতো খেলিত হচ্ছে। উপমহাদেশকে আমরা একটি ইন্টারপলিটিকাল স্পেস বা আন্তঃরাজ্য পরিসর বলে অভিহিত করতে পারি, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের সাথে অপর রাষ্ট্রের সম্পর্ক এমন নিবিড় যে খণ্ড খণ্ড রাজনৈতিক সমাজগুলি গভীরভাবে পরস্পরের সাথে লিপ্ত হয়ে একটি উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক সমাজ পরিগঠনের আলামত ফুটিয়ে তোলে সুদূর ভবিষ্যতের দিকচক্রবালে। কিন্তু এই মুহূর্তে আফগান যুদ্ধে আগ বাড়িয়ে সংহতি-বিসংহতি জানানো প্রায়ই গভীরভাবে সমস্যাজনক, কারণ জোর করে নিজের মনগড়া আদর্শায়িত অনুভূতি আরোপ করে আফগান সমাজের বহুত্বকে সংহতির মেশিনে পিষ্ট করে নিজের রাজনীতির বয়ান আফগানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এক গভীর অন্ধতা — যা নানা পক্ষই করে। আমরা এখানে চারটা পক্ষের কথা উল্লেখ করব।

সাম্রাজ্যবাদের ধামাধারী পক্ষ: সাম্রাজ্যবাদের আরোপ করা দীর্ঘ যুদ্ধ আফগানিস্তানে অপরিমেয় নিষ্ঠুরতার চিহ্ন রেখে গেছে, যাচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে আফগানিস্তান যুদ্ধে প্রায় ৮৫,০০০ শিশু মারা গেছে। অসংখ্য নারী নিহত হয়েছেন। আধুনিক আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র কর্তৃক বোমা ফেলে, ড্রোন দিয়ে দেদারসে মানুষ হত্যা খুব কারিগরি ও নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। অতঃপর মিডিয়ায় তার নৈর্ব্যক্তিক, সংখ্যা সর্বস্ব উপস্থাপন রক্তের গন্ধকে ফিনাইল দিয়ে মুছে দিতে চায়। নৈর্ব্যক্তিকভাবে উপস্থাপিত গাঠনিক সন্ত্রাসে যদি আমরা নির্বিকার থাকি আর রগরগেভাবে উপস্থাপিত বিগাঠনিক সন্ত্রাসে বিচলিত হই, তাহলে আমাদের মানবিক প্রতিক্রিয়া নিছকই নরহত্যাযজ্ঞের মিডিয়া নির্মিত ইস্থেটিক্সের লীলায় পর্যবসিত হয়।

ইসলামপন্থী পক্ষ: অন্যদিকে এই সাম্রাজ্যবাদী অমানবিক যুদ্ধতন্ত্রের উল্টাপক্ষটা কেমন? উপমহাদেশের ইসলামপন্থীদের আলাপটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আলাপেরই প্রতিবিম্ব। রুশ সাম্রাজ্য ও বুশ সাম্রাজ্য যেরকম আফগানিস্তান দখল করে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা করেছিল, ইসলামপন্থীরাও তালিবানবিরোধী সব আফগানদের মার্কিন দালাল ও দমনযোগ্য বলে ঘোষণা দেয়। মানে দমন আপনাকে সইতেই হবে, হয় রুশ কিংবা বুশের হাতে আর নয়তো তালিবানের হাতে। এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে আমরা বলতে পারি বদলা-সাম্রাজ্যবাদ, ঠিক যেমন অনেক ফ্যাসিবাদ বিরোধী আসলে বদলা-ফ্যাসিবাদী। পক্ষ ও প্রতিপক্ষ যতক্ষণ একে অন্যের সহিংসতার অভিন্ন যুক্তি পুনরুৎপাদন করতে থাকে ততক্ষণ তারা পরস্পরের প্রতিবিম্ব হয়ে থাকে, ফলে অন্তহীন শত্রুমিত্রতা থেকে উত্তরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ আফগানই না মোল্লা না মার্কিন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী এবং মোল্লাতান্ত্রিক উভয় চোখে এই মানুষেরা গুরুত্বহীন ও দমনীয়।

হিন্দুত্ববাদী পক্ষ: আফগানিস্তান প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদীদের অবস্থানটিও অত্যন্ত লক্ষণীয়। তারা যে বিলাপের পেটরা খুলে বসেছে, সেই বিলাপ তাদের নিজঘরের অপর মজলুমের জন্য উন্মুক্ত হয় না কোনদিন, বরং অপরের জুলুমেই তাদের সম্মতি মেলে হরদম। উপমহাদেশে মোদিবাদী যে রাজনীতি, তার শর্তের ভেতর থেকে আফগানিস্তান নিয়ে হিন্দুত্ববাদী বয়ান নির্মিত, যার ভেতর মিশে গেছে নাগরিকত্ব আইনের বায়োপলিটিক্স ।

ভুয়া সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পক্ষ: সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জায়গা থেকে মার্কিন দখলদারির বিরোধিতা করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু তাকে তালিবান শাহির উদগ্র ও নিঃশর্ত সমর্থনে পর্যবসিত করেছেন অনেকে। কেউ কিউবার পরম অনুরাগী হলে তার কিউবাকশালি ব্যবস্থায় থাকার সংকল্প থাকা উচিত, যেমন কেউ আফগানিস্তানে তালিবান শাসনকে মহৎ মনে করলে তার সন্তানের জীবনে সেই শাসন কায়েমকে কাম্য বলে ভাবার কথা তার। খেলাফত আন্দোলনের কালে একটিভিস্ট মোহাজেররা সংহতি জানাতে আফগানিস্তানেই যেতেন, নিজেরা পশ্চিমে হিজরত করে আফগানবিজয়গাথা গাইতেন না। অর্থাৎ তাদের ব্যাপারটা ঠিক “সংহতি” ছিল না, বরং ছিল গায়ে গতরে উপস্থিতি ও যাপন। এইটাকে আপনি “কোরবানি” বলতে পারেন, কিংবা নাগরিকতা বা আধুনিক সাবজেক্টিভিটিও বলতে পারেন।

আধুনিক সাবজেক্টিভিটির সাথে কোরবানির সুবাদটা কেমন? সেই যে খ্রিস্ট জন্মের বারশ বছর আগে গ্রিকরা ট্রয় নগরী দখল করতে গেল, সেই যুদ্ধযাত্রার সময়ে, কোন এক কারণে দেবী আরতেমিস গ্রিক রাজা আগামেননের উপর খেপে গিয়েছিলেন। আরতেমিসের অভিশাপে গ্রিক রণতরী থমকে গেল। যুদ্ধযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ল। তখন আগামেনন জানতে পারলেন যে যদি তিনি নিজের কন্যা ইফিজেনিয়াকে কোরবান করেন তবেই আরতেমিস ক্ষমা করবেন। আগামেনন নিজের কন্যাকে ডেকে পাঠালেন। ইফিজেনিয়া যখন জানলেন বাপ তাকে কোরবান করবেন, তখন তিনি স্তম্ভিত। কিন্তু শুধু বাপ নন, সকল গ্রিক পুরুষই যুদ্ধের উন্মাদনায় ইফিজেনিয়ার কোরবানিতে সোৎসাহে সায় দিচ্ছিল। অগত্যা ইফিজেনিয়া বেদিতে উঠলেন। এরপর তিনি কোরবানি হলেন কিনা কে জানে! তবে কিছু কাহিনী অনুসারে কোরবানি হওয়ার আগেই দেবী তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে একটি হরিণ বাচ্চাকে সেই জায়গায় উৎসর্গের জন্য রাখলেন।

আগের দিনে রাজা বা আমির প্রজার জন্য যে বিধান বেঁধে দিতেন তার নিজেকে সেই বিধান মানতে হত না। কিন্তু আগামেননের পরিস্থিতিটি ছিল এমন যে নিজের আত্মার ধনকে কোরবানি দিয়েই রাজাগিরি প্রতিষ্ঠা করতে হত তাঁকে। এই পরিস্থিতিটি একটি নিখিল বা সামান্য পরিস্থিতি।

আধুনিক রাষ্ট্রে বিধানদাতা বা আমির হল নাগরিক নিজেই, এবং সে নিজেই সেই বিধানের অধীন। ইমানুয়েল কান্টের ভাষা ধার করলে, আপনি যে বিধানের অধীনতা বরণ করতে পারবেন সেটাই আপনি অন্যের জন্য বিধান হিসাবে দিতে পারবেন। আপনি নিজে যা মেনে নিতে প্রস্তুত অন্যকে সেটাই মেনে নিতে বলতে পারেন। কিন্তু যা মানতে বলছেন, তার ফলে কাকে কোরবান হতে হচ্ছে, সেটাও ভাবুন।

কিন্তু এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে বিদেশি হস্তক্ষেপের আহবান জানানো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে প্রলম্বিত করারই নামান্তর। তালিবান জেনেশুনেই গণতন্ত্রের বিরোধী এবং রাজনীতি বা রাজনৈতিক পরিসরেরও বিরোধী। ফলে নারী, বিরুদ্ধমতাবলম্বী সহ সমাজের নানা অংশের উপর তারা বিভিন্ন দমনমূলক ব্যবস্থা আরোপ করেছে। বিদ্যমান আমিরাত বা শাহির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আফগানিস্তানের সমাজের নানা অংশ করবেই, আজ বা কাল। এই সংগ্রামের পরিণামভোগীও হবে তারাই। যে সংহতির পরিণামের দায় আপনি নিজে নিতে অপারগ, সে সংহতির বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে না দেওয়াই ভাল। আফগান জনগণের স্বাধীনতা-বাসনার প্রতি সংহতি জানানো চলে কেবলমাত্র আফগান জনগণের শর্তেই।

তথ্যসূত্র:-
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “কাবুলিওয়ালা”, https://www.tagoreweb.in/Stories/galpoguchchho-84/kabuliwala-254
২। আবদুল করিম, “বাদশাহ আমানুল্লাহ খানের বিপ্লব”, সর্বজন, মে ২০১৩, https://tinyurl.com/3f75w6vh
৩। সৈয়দ মুজতবা আলী, শবনম, কলকাতাঃ বিশ্ববাণী প্রকাশনী, ২০০০ ইং।
৪। Tahmidal Zami, “Bankim’s Mughals and Ours: Nationalism and The Dialectic of Appropriation of Pre-colonial History”, New Age, 2018.

[লেখক – লেখক-গবেষক এবং বেঙ্গল হিস্টরি কালেক্টিভের সমন্বয়ক, ঢাকা, বাংলাদেশ।]

Facebook Comments

Leave a Reply