কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ
[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]
১৪
এক শাহনশাহ নে বনওয়া কে হসিঁ তাজমহল
সারি দুনিয়া কো মুহব্বত কী নিশানি দি হ্যাঁয়
ইসকে সায়েঁ মে সদা পিয়ার কে চর্চে হোঙ্গে
খতম জো হো না সকেগি উয়ো কহানী দি হ্যাঁয়
এক শাহনশাহ নে বনওয়া কে হসিঁ তাজমহল
সারি দুনিয়া কো মুহব্বত কী নিশানি দি হ্যাঁয়
যমুনা নদীর পারে চমৎকার মাছের বাজার। সারি সারি নৌকো। বাবার সেই বি এস এ সাইকেল। পানাগড় থেকে কলকাতা হয়ে মথুরা তারপরে এই সাইকেল আগ্রা শহরে। এরপরে আরও কত শহরে এই সাইকেলের চাকা গড়াবে তা জানিনা। তবে আমরা এটি জেনে গেছি আমরা যেখানেই যাব, এই সাইকেলটি আমাদের সাথেই গড়িয়ে যাবে। এ আমাদের সৌভাগ্য না কি সাইকেলের সৌভাগ্য, জানিনা। গভীর শ্যাওলা রঙয়ের। যন্ত্রপাতিরও আস্তে আস্তে বয়স বেড়ে যায়। কিন্তু এই সাইকেলের শক্তি ও গতির বয়স বাড়েনা। আমাদের পরিবারের যাযাবরবৃত্তির সাথে সাইকেলটিও শরিক। পিছনে লোহার কেরিয়ার। আমি বসতাম পিছনে লোহার কেরিয়ারে, বাবার সাইকেলের হ্যান্ডেলে বাজারের থলে ঝোলানো। বাবা প্রায়ই বলতেন, বেশি নড়বে না কিন্তু। মথুরা শহরে যেমন মাছ মাংস পিঁয়াজ খুব গোপনে লুকিয়ে খেতে হত। আগ্রায় সে সব ঝামেলা নেই। আগ্রায় এসে জানতে পেরেছিলাম, মথুরা শহর থেকে সংখ্যায় বাঙ্গালিরা এখানে অনেক বেশি থাকে। কোয়ার্টারের পাশেই বেঙ্গলি হোটেল রমরমা। বাঙালি পর্যটকদের সমাগমে গম গম করছে।
বাগানে লনে, হোটেলের ঘরগুলিতে আলোর রোশনাই। আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে সময় কাটিয়ে দিতাম। বেঙ্গলি হোটেলের পাশেই সিভিলিয়ানদের বসবাসের চমৎকার জায়গা। সেখানেই অনেক বাঙালি পরিবার থাকে। কয়েকটি বাঙালি পরিবারের সাথে মায়ের আলাপ হয়েছিল। ভারতবর্ষ জুড়ে কত বাঙালি পরিবার কত শহরে নিজেদের স্থায়ী আস্তনা খুঁজে নিয়েছে।
বাবা আর আমি মাছের বাজারে ঘুরে ঘুরে মাছ দেখছিলাম। নৌকার মাঝিরাই এখানে মাছ বিক্রি করেন। পাশাপাশি নৌকা রেখে নৌকার মধ্যেই মাছের বাজার পেতে বসেছে। আমি বাবার পিছনে পিছনে ব্যাগ হাতে। বাবার একটি প্রথাগত অভ্যাস ছিল, প্রথমে বাজারে প্রবেশ করে গোটা বাজারটি ঘুরে ঘুরে একটানে দেখে নিতেন। মুখস্ত করে নিতেন, কার কাছে কি আছে? তারপরে মনে মনে টুকে রাখা বিক্রেতাদের কাছে গিয়ে দরদাম করে জিনিস নিয়ে নিতেন। নদীর ওপারে কাঠের পাটাতনে বসে মাঝিরা মাছ বিক্রি করছেন। যমুনা নদীর মাছ। বাবা খুব ভালো মাছ চিনতেন। কত ধরণের মাছ। ছোটো বড় মাঝারি বিভিন্ন সাইজের। কলকাতায় যেমন বড় বড় বটি দিয়ে মাছ কাটা হয়, এখানে কাটারি দিয়ে মাছ কাটা হয়। কোন মাছটি ছেড়ে কোন মাছ নেবেন স্থির করতে পারছিলেন না। অধিকাংশ মাছ বিক্রেতাই মুসলমান। খুব একটা দরদাম করতে হয়না।
যে দাম বাবা বলছিলেন, কোনো টানামানি চলছিল না।
বাবাকে এত মাছ নিতে দেখে বললাম,- এত মাছ নিচ্ছ পচে যাবে তো? মা রাগারাগি করবে।
বাবা আমাকে আলতো ধমক দিয়ে বললেন,- সে তোমাকে ভাবতে হবে না। ব্যাগ ভারি হয়ে গেলে বলবে, আমি সাইকেলের কেরিয়ারে তুলে নেব।
মাছের বাজারে গেলে মাছির মতো খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালি বাবুদের। স্থানীয় বাঙালি। বাঙলা ভাষা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলেন। বহুবছর ধরে আগ্রা শহরেই বসবাস করেন। স্থানীয় বাঙ্গালিরা এখানে নানান পেশায় যুক্ত।
নদীর ওপারেই হাত বাড়ালেই তাজমহল।
এপাশে পূর্বদিকের খুব কাছেই লাল পাথরের আগ্রা ফোর্টকে দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন নদী থেকে যে মাছ ওঠে, তাই বিক্রি করে ফেলতে হয়। বরফের ব্যবস্থা নেই। তাই শেষ বাজারে গেলে খুবই সস্তায় মাছ পাওয়া যায়। বাবা ব্যাগ ভর্তি করে মাছ কিনলেন। বাবা জানতেন মা মাছ দেখলেই খুশিতে ভরে ওঠে, আর বারে বারে বলতেন, মাছ খেতে খেতেই যেন চলে যেতে পারি। বাবা হাসতে হাসতে বলতেন, আমার অবর্তমানে, তুমি মাছ খাবে। সেই অনুমতি তোমাকে আগে থেকেই দিয়ে গেলাম। মাছ খাবে না কেন? আমি শাস্ত্রের নিয়ম কানুন মানি না। যেটা না খেলে শরীর চলবে না, তা খেতে হবেই।
তুমি আর কি অনুমতি দেবে? তোমরা পুরুষরা সবসময় অনুমতিই দিয়ে যাবে আর আমরা সেই অনুমতি বা আদেশ পালন করে যাব? আমি আমার মতো বাঁচব, নিজের খুশি মতো খাওয়া দাওয়া করব। অনুমতি আবার কিসের শুনি? লোকের কথায় কি যায় আসে। দেখে নিও তোমার ওই অনৈতিক অনুমতির জন্য আমি অপেক্ষা করব না। আমি মাছ ছাড়া খেতে পারিনা। তোমার আগেই আমি চলে যাব।
কোথায় যাবে?
কথা যখন বোঝো না, প্রশ্ন করো কেন?
আমি তো শুধু কোথায় যাওয়ার কথাই বললাম।
অথছ নিয়তির কি পরিহাস, মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা মাছ মাংস ও মুসুরির ডাল স্পর্শ পর্যন্ত করেন নি।
প্রথমবার বাবা আর আমি আগ্রার মাছের বাজারে, তাই বাবা মনের খুশিতে যা পারলেন, ব্যাগ ভরে নিলেন। বাবা সহজে সাইকেলে উঠছিলেন না। সম্ভবত আগ্রা ফোর্টের দিকে তাকিয়ে, শহরের আরেকটু গভীরে মতি মসজিদের দিকে তাকিয়ে বাবা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন কবে কোথায় সব ঘুরে দেখে নেবেন।
অফিসের সহকর্মীদের কাছে জেনে নিয়েছেন, আগ্রা ফোর্ট একদিনে দেখা হয়ে ওঠে না। ভালো করে ইতিহাস বুঝে নিয়ে দেখতে হলে তিন চারদিন লেগে যায়। গাইড আছেন। চমৎকার হিন্দি উর্দু ও ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাঙলা বলতে পারেন। বাঙলা বলার কারণ, প্রতিদিন পর্যটকদের মধ্যেই অধিকাংশই বাঙালি। ইতিহাস বলে যাওয়াই এদের পেশা।
নদীর পার থেকে উঠে এলাম আমরা। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম সারি সারি নৌকা যমুনার জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। নানা স্থান থেকে পণ্য নিয়ে এসেছে। গ্রীষ্মকালেও নদীতে ভরা জল। আর সান্ধ্য জোয়ারে নদীর এপার ওপার থৈ থৈ। এই গভীর জনপদের স্থানীয় নাম আমিনাবাগ। দুইধারে দোকান। বড় বড় কাঁচের বয়ামে ডালমুঠ, চালকুমড়োর পেঠা আর বিশুদ্ধ ঘিয়ের লাড্ডু। আগ্রার চালকুমড়োর পেঠা ভারতবর্ষে খুবই বিখ্যাত। আর খাদির পোশাক ও কাপড়। বড় বড় খাদির কাপড়ের শোরুম। বাবা পেঠা ও ডালমুঠ কিনলেন। এই পেঠাকেই আমরা মোরব্বা বলি। কিন্তু আমরা যে মোরব্বা এতদিন খেয়েছি তার স্বাদ ও আগ্রার পেঠার স্বাদের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
গৃহস্ত বাড়িতে সন্ধ্যেবেলায় মাছ এলে গৃহিনীর নানা রকম অসুবিধে। কিন্তু মা মছের বহর দেখে, এতই আনন্দিত হলেন, নিজে থেকেই বলে উঠলেন একেবারে তাজা মাছ যে। আগ্রাতেও যে গলসে পাওয়া যায়, ব্যাগের নিচে আড় আছে যে দেখছি। ট্যাংরাও এনেছ যে। এত মাছ আজকে রান্না করতে করতে রাত বারোটা বেজে যাবে?
যতটা পারবে, করো। বাকিটা হলুদ নুন মাখিয়ে রেখে দাও।
বাবাও মায়ের সাথে হাত লাগালেন। লোহার কড়াইয়ে সর্ষের তেল টুপ টুপ, ঝাঁঝে ঘর জ্বলে যাচ্ছে। আমাদের বইয়ের পাতা মাছের স্বাদে ও গন্ধে ভরে উঠছে। মাছ ভাজা হচ্ছে। একবার দেখে নিলাম, বাবা মায়ের অবস্থান। পা টিপে বাইরে এসে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। একটু দূরে গাছের মাথার দিকে তাকালাম। ছোটো ভাইকে বললাম, ওই দেখ মাছের গন্ধে গাছের ডালে পেত্নী পা ঝুলিয়ে বসে আছে।
ছোটো ভাই, কোথায় বলতে বলতে, গাছের ডালে খুঁজে যাচ্ছিল। বলল,- আগ্রার পেত্নীরা মাছ খায় না।
আমি বললাম,- সব পেত্নীই মাছ খায়।
আমার কথা শুনে, সে ছুটে পালিয়ে গেল ঘরের ভিতরে।
শুক্লপক্ষ। কাল বাদে পরশুদিন বুদ্ধপূর্ণিমা। দূরে জ্যোৎস্নার আলোতে তাজমহলের দৃশ্য আকাশের সমস্ত শুভ্রতাকে পরাস্ত করেছে। মহাজাগতিক বা পৃথিবীর সেরা দৃশ্যগুলি দেখতে দেখতে মানুষ খুব একা হয়ে যায়। আকাশে ভাসছে তাজমহল। আগ্রা শহরের যে যেখানেই থাকুক, বহুদূর পর্যন্ত তাজমহলের দৃশ্য ভেসে যাচ্ছে। বাতাসের হু হু শব্দ গভীর রাগে সেতার বাজিয়ে চলেছে। কখন যে বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতে পারিনি।
আমি আর বাবা চুপ করে দেখছিলাম – ধবধবে দুধসাদা স্থির তাজমহল।
বাবা বললেন,- মানুষ সৃষ্টি করেছে এই আশ্চর্য !!! ভাবলে অবাক লাগে।
বাবা সমস্ত কিছুই জেনে রেখেছিলেন। সৈনিক পরিবারদের জন্য তাজমহলের ডানদিকে নির্দিষ্ট একটি জায়গা থাকে। অফিস থেকেই পরিবার পিছু পাস দেওয়া হয়। বাবা সারারাত থাকবেন সেইরকমই অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন। বুদ্ধপূর্ণিমা, লক্ষ্মীপূর্ণিমা, গুরুপূর্ণিমা বা রাশপূর্ণিমা রাখিপূর্ণিমা বা অন্যান্য পূর্ণিমার রাত্রে তাজমহলের উদ্যানে তিল ধারণের স্থান থাকেনা। কত মানুষ, কিন্তু তাজমহলের সৌন্দর্যে নীরব থাকে। চাঁদ যত তার কোণ পরিবর্তন করে, শ্বেতপাথরের রঙয়ের মধ্যে আসে বহুমাত্রিক রঙয়ের সমাহার। মা বেতের একটি ঝুড়ির পাশে বসেছিলেন। আর তার মুখ থেকে জর্দাপানের সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছে।
চাঁদ উঠে এল, বিকেল থেকেই আমরা বসেছিলাম। চাঁদের অবস্থান যখন তাজমহলের খুব কাছে, তাজমহলের মাথা ও শরীর জুড়ে হাজার হাজার নানা রঙয়ের টুনি বাল্বের আলো যেন ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল হাজার হাজার টুনি বাল্ব দিয়ে তাজমহলকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। নানা রঙয়ের ছোটো ছোটো পাথরের ওপরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে, পাথরগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙয়ের বিন্দু বিন্দু আলো। আলোগুলি জ্বলছে নিভে যাচ্ছে, বহুদূরের নক্ষত্রের মতো, পাথরের ওপরে চাঁদের আলোগুলি টিপ টিপ করছে। আমরা পরস্পর কোনো কথাই বলছিলাম না, মহাজাগতিক এই সৌন্দর্য দেখে যাচ্ছিলাম। অবাক এই সৌন্দর্যের সামনে মানুষের কথা মানায় না।
বাবা সেই কথাই আবার বললেন,- মানুষ এই সৃষ্টি করেছে, ভাবলে অবাক লাগে। দেখ সবাই ভালো করে দেখ, আমরা সবাই পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্যয়ের সাক্ষী হয়ে থাকছি।
পাশে কেউ ছিলেন, জানি নাম তাঁর নাদিম আঙ্কল বাবার সহকর্মী, তিনি বললেন, বেগমজান মমতাজ পছন্দ করেন না, পূর্ণিমার এই আলোতে একটিও মানুষ যেন না থাকে তাজের উদ্যানে। এত মানুষের সমাগম হোক সে তাঁর ভারি অপছন্দ। তিনি চান এই মহাসৌন্দর্যকে একাই উপলব্ধি করবেন, তাঁর সম্রাটের পাশে থেকে থেকে, হেঁটে চলে বেড়িয়ে সম্পূর্ণ প্রাঙ্গণ।
প্রেমের সমাধি।
প্রেম এক অহংকারের নাম। মিথ্যার সমাধি।
এই কথা কেন বলছেন? সম্রাট শাহজাহানের ও মুমতাজ বেগমের প্রেমের উপলব্ধি পৃথিবীর যে কোনো সাগরের থেকেও গভীর। তা হলে আপনি আজকের পূর্ণিমার রাত্রে, কেন এসেছেন সাক্ষী হতে?
আমি মিথ্যার সৌন্দর্য দেখতে এসেছি। মানুষের প্রেম ভাবনা হল মস্তিস্ক থেকে এক বিশেষ রাসায়নিক রসের ক্ষরণ। ইতিহাস যে প্রেমের অনুভূতিকে জীবন্ত রাখে সে চায় না অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতি। এটিই তাজমহলের সৌন্দর্য।
ঠিক তাই, সাগরের ওপরে চাঁদের আলো সে নিজেকে খুব খুব একা একা চায়।
মা মোটেই ওদের কথা শুনছিলেন না। হয়তো প্রেম, মিথ্যা, সৌন্দর্য, মায়ের এমন তর্ক বিতর্ক ভালো লাগছিল না। আমিও শুনছিলাম, উদ্যানের বেশ কিছুটা দূরে।
কেউ একজন মাহামান্য মিউজিশিয়ান এ্যাকোর্ডিয়ান বাজিয়ে চলেছেন। মা তাজমহলের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে এ্যাকোর্ডিয়ানের মিহি শব্দ শুনে যাচ্ছিলেন।
আগ্রা ফোর্টের ভিতরেই গাইড জাহাঙ্গীর আমাদের খুবই পরিচিত হয়ে উঠেছিল। আমাদের যাওয়ার জন্য তিনি নিজেই টাঙ্গার ব্যবস্থা করে রাখতেন। আমরা যতবার গেছি, তিনি আমাদের সাপোর্ট দিয়েছিলেন। আর চমৎকার ইতিহাস বলে যেতেন, আমিই তাঁকে একদিন হঠাৎ করে একটি প্রশ্ন করেছিলাম, ঔরঙ্গজেব কি মাছ খেতেন?
বাবা আমার প্রশ্নটি শুনে যেন খুবই খুশি হলেন। বললেন,- বলুন, বলুন জাহাঙ্গীর ভাই ও যে প্রশ্নটি করল তার উত্তর দিন?
এ বড়ই ইতিহাসের বাইরের প্রশ্ন। কিন্তু তুমি হঠাৎ এই প্রশ্নটিই বা করলে কেন?
আমি বললাম, আমি এখান থেকে দাঁড়িয়ে যমুনা নদীর মাছের বাজারে সারি সারি নৌকা দেখতে পারছি বলেই প্রশ্নটি করতে ইচ্ছে হল।
জাহাঙ্গীর উত্তর দিলেন,- এই মাছের বাজার বাঙালিবাবুদের জন্যই গড়ে উঠেছে। তবে এতটুকু বলতে পারি ঔরঙ্গজেব ফল খেতে খুব বেশি ভালোবাসতেন।
বাবা বললেন,- ইতিহাসে তার কি প্রমাণ আছে?
জাহাঙ্গীর আঙ্গুল তুলে দেখালেন ফোর্টের ওই জায়গা জুড়ে ঔরঙ্গজেব আপেলের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। এখন দেখুন ঘন জঙ্গল।
আগ্রা খুব উষ্ণ অঞ্চল।
আজ থেকে চারশো বছর আগে তা কেমন ছিল? আমরা কেউ জানিনা।
হয় তো আপেল ফলানোর উপযুক্ত ছিল কি না আমরা জানিনা। মুখের কথা আর ইতিহাসের মধ্যে অনেক পার্থক্য, মুখের কথার মধ্যে অনেক গল্প থাকে, ইতিহাসের বাস্তবতা মুখের কথা থেকেও অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আখরোট সম্রাটদের খুব প্রিয়। চলুন আমরা একটু এগিয়ে যাই। প্রতিদিন এখানে কোনো না কোনো সিনেমার সুটিং হয়। আজ আপনাদের ভাগ্য ভালো যে কোনোরকম সুটিংয়ের কাজ হচ্ছে না। ময়ূর সিংহাসনের ওই দিকে যাওয়াই যায় না। ক্যামেরা আলো লোকজন ভর্তি থাকে। ফোর্টের ওই জায়গাটি খুবই আকর্ষণীয়। বিখ্যাত অভিনেতা প্রদীপ কুমার আগ্রা ফোর্টে বহুবার এসছেন। আমি ঠিক এখানেই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি বীণা রায়কে দেখেছি। অসামান্য সুন্দরী। তাঁর উপস্থিতিতে ফোর্ট আলো হয়ে গেছিল।
একবার নয়, যতদিন আমরা আগ্রায় ছিলাম, তাজমহলে যাওয়ার থেকেও বেশিবার আগ্রা ফোর্টে গেছি। কি বিশাল ক্ষেত্র। জাহাঙ্গীর যখন বলতেন, তখন তাঁর কথায় সবকিছুই জীবন্ত হয়ে উঠত। সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার স্থানটি বড়ই মনোরম। আমরা সবাই একটি শ্বেতপাথরের ওপরে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ। জাহাঙ্গীর বলে যেতেন এক এক করে রাজা বীরবল, মিয়াঁ তানসেন, আবুল ফজল, ফৈজি, রাজা মান সিং, রাজা তোদর মল, মোল্লাহ দো পিয়াজা, ফকির অজিও দিন, আব্দুল রহিম খান- ই- খানা সমস্ত বিখ্যাত মানুষের ইতিহাস। আকবরের নবরত্নের সভায় রাজা বীরবল ও মিয়াঁ তানসেন ভারতীয় জনসমাজে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমাজে মিয়াঁ তানসেনকে নিয়ে আজও অনেক চর্চা বর্তমান। মানুষের সমাজে বিখ্যাত মানুষদের কাজকর্ম সমুদ্র তরঙ্গের মতো। বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে সেই সব কাজ নতুন নতুন মাত্রা সংযোজন করে।
মা আস্তে আস্তে হিন্দি কথা বুঝতে শিখলেন। কিন্তু বলতে পারার মধ্যে অদ্ভুত এক বাঙলা টান থেকেই যেত। বাবা হিন্দি ভালো বলতেন। আমি একেবারেই বলতে পারতাম না এমন নয়, বুঝতে পারতাম। আর জাহাঙ্গীর যখন বলতেন, উর্দু কথার প্রভাব খুব বেশি থাকত। ঘন ঘন পান খেতেন বলে, তার কণ্ঠের মধ্যে সুন্দর মোলায়েম অবস্থান করত। জাহাঙ্গীরের পানের সে এক বাদশাহী গন্ধ। মা একদিন মজা করে তাঁকে বলেছিলেন, আপনি পান খেলে, একেবারে বাদশাহী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর সেই কথা শুনে আমাদের সবাইকে বসিয়ে রেখে ছুটে চলে গেলেন কোথায় বুঝতে পারিনি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন আমরা, তাঁর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে উঠছি। জাহাঙ্গীর এলেন। মায়ের হাতে দুইটি পান তুলে দিয়ে বললেন,- ভাবিজি দেওয়ান-ই-খাস। আগ্রা স্পেশাল।
মা অবাক হয়ে গেলেন। রসিকতা করে বললেন, যদি বলি মমতাজ বেগমের পোশাক খুব সুন্দর, আপনি আমাকে এনে দেবেন?
না ভাবিজি। আগ্রার দেওয়ান-ই-খাস পানের স্বাদ না নিয়ে এখান থেকে যাবেন না। আপনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, আগ্রার মানুষ হয়ে আপনার ইচ্ছা পূরণ না করলে, এই বাদশাহী শহরের মনের ভিতরে কাঁচের দাগ বসে যাবে। কাঁচের দাগ, মানুষের মন খারাপের পক্ষে যথেষ্ট। আপনি পানের গন্ধের কথা বলেছেন, আমি তাতেই বুঝে গেছি।
পাথরের দেওয়াল ঘেঁষে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, আগ্রা ফোর্টের পিছনে টুকরো মতো বনভূমি থেকে ময়ূরের ডাক ভেসে আসছিল। আমরা দেওয়ালের শেষে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, যেন একটি পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। দুর্গের উচ্চতা থেকে দেখলাম, যমুনা নদী সুতোর মতো পড়ে আছে। তাজমহলকে পাশে রেখে চলে গেছে, কোথায়?
জানি না।
[চলবে…]
Posted in: PROSE, September 2021 - Serial