বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
সপ্তম পর্ব
মহাবীরচরিত
এই নাটকটি সাত অঙ্কের নাটক। কিন্তু সাতটি অঙ্কই যে নাটককার ভবভূতির রচনা নয় তা আজ মোটের উপর প্রমাণিত। পঞ্চম অঙ্ক অবধি তাঁর রচনা। তার পরের অংশ যে নয় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কারণগুলি ভাষা, নাটক থেকে অন্যত্র উদ্ধৃতি, এক চরিত্রের কাজ অন্য চরিত্রের ঘাড়ে দিয়ে দেওয়া জাতীয় ভুল, প্রাকৃত ভাষার মধ্যেকার পার্থক্য এবং ছন্দের দুর্বলতা ইত্যাদি। কিন্তু যে পাঁচটি অঙ্ক ভবভূতির রচনা বলে মানা গিয়েছে সেই পাঁচ অঙ্ককে নিয়েই আমাদের আলোচনা চলুক। পরে তার সঙ্গে আরো দুই অঙ্ক প্রয়োজনে জুড়ে নেওয়া যাবে।
‘মহাবীরচরিত’ নামটির মধ্যেই একধরণের দ্বৈত অর্থ লুকিয়ে আছে বলে মনে হয়। এইখান থেকে আমাদের আলোচনা শুরু করা চলে। আমরা ‘মহাবীর’ শব্দটিকে দু’ভাবে জেনেছি। শব্দার্থ বলতে যিনি যুদ্ধ ইত্যাদিতে মহা বীরত্বের পরিচয় দিয়ে থাকেন তাঁকে মহাবীর বলা চলে। ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিক নানা চরিত্রের বিশেষণ রূপে এই শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আবার আমাদের প্রচলিত ইতিহাসে মহাবীর বলতেই মনে পড়ে মহাবীর জৈনের কথা। বর্ধমান যাঁর নাম ছিল বলে কথিত। তিনি অস্ত্র-শস্ত্র-হত্যা-লোকক্ষয়ের যুদ্ধের বীর না। বরং তিনি অহিংসার কথা প্রচার করেছেন, জীবনে যাপন করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ বীরত্বের পরিচিত চিহ্নগুলোর বিরুদ্ধেই তাঁর বীরত্ব। এই যে দ্বৈত অর্থ মহাবীর নামের মধ্যে আছে, তার ফলে নাটকটির নাম শুনলে প্রথমেই যেন মনে হয় মহাবীর জৈনের চরিত্র কেন্দ্রিক নাটক। এবং আরো কারণ আছে এমন ভাবার। ভবভূতির পূর্বকালের নাটককার অশ্বঘোষ। তাঁর প্রখ্যাত নাটক ‘বুদ্ধচরিত’ গৌতম বুদ্ধের জীবন নিয়ে রচিত। অর্থাৎ এমন চরিত লেখার পূর্ব দৃষ্টান্তও আছে। তাহলে ভবভূতি জানা সত্ত্বেও এমন নাম দিলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে যেতে গেলে সম্ভবত আমাদের সেকালের ধর্মীয় বিরোধের চরিত্রের দিকে নজর দিতে হবে। সে কাজ এখন নয়, পরের দিকে করা যাবে। আপাতত আমরা মূল নাটকটি এবং ভবভূতির প্রসঙ্গে থাকি।
প্রথম অঙ্ক
মহাবীরচরিতের প্রথম অঙ্ক শুরু হচ্ছে নাট্যশাস্ত্র মেনেই। নান্দী হল প্রথমে। তারপরে সূত্রধার জানাচ্ছেন ভগবান কালপ্রিয়নাথ-এর যাত্রা উৎসবে অভিনীত হবে মহাবীরচরিত রূপকটি। ভগবান কালপ্রিয়নাথ কে? বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেননি সে বিষয়। কেউ বলছেন উজ্জ্বয়িনীর মহাকালকেই কালপ্রিয়নাথ বলা হয়। কেউ বলছেন পদ্মাবতীতে অবস্থিত এক শিবমন্দির, যেখানে শিবের নাম কালপ্রিয়নাথ। মহাকাল-ও শিবেরই অপর নাম। কিন্তু কালপ্রিয়নাথ যদি শিবই হবেন তাহলে সেখানে তাঁর যাত্রা উৎসবে এমন রূপক অভিনীত হবে কেন যার ঘোষিত উদ্দেশ্যই হচ্ছে দৈত্যারি রামরূপী বিষ্ণুর অদ্ভূত মহিমা প্রকাশ? এবং সেই উদ্দেশ্যে শিবভক্ত পরশুরামের রামের হাতে পরাজয় অনুষ্ঠিত হওয়াও এই রূপকে বহু অংশ জুড়ে আছে। শৈব উৎসবে বৈষ্ণব অধিকার বিস্তার হতে দেওয়া খুব একটা যুক্তি সংগত বলে মনে হয় না। বিশেষ করে পুরাণে শিব ও বিষ্ণুর পারস্পরিক শ্রদ্ধার মত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কাহিনীও খুব কম নেই। অন্য একটি মত বলে কালপ্রিয়নাথ আসলে সৌর মন্দির। কালপ্রিয়নাথ সূর্য। তাঁর পূজার উৎসব ছিল। ইক্ষ্বাকু বংশ সূর্যের বংশ বা সৌরবংশী বলে প্রসিদ্ধ। সেই বংশের অন্যতম নায়ক রামকে নিয়ে সূর্য পূজা উৎসবে অভিনয় সম্ভব। সূর্যের সঙ্গে বিষ্ণুর সম্পর্ক স্থাপনও প্রাচীন বিষয় এক। সুতরাং সেদিক থেকে দেখলেও সূর্য উৎসবে রামচরিত নিয়ে রূপক অভিনয় সম্ভব।
এখানে আমরা ভি ভি মিরাশির কতগুলি যুক্তিকেও কালপ্রিয়নাথ কে তা বোঝার কাজে লাগাতে পারি। পুরাণে কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে নিয়ে যে কাহিনী আছে তার থেকে মিরাশি তাঁর সূত্র নিচ্ছেন। কৃষ্ণের বহু স্ত্রী শাম্বকে নিয়ে উদ্বেল ছিলেন প্রেমে। এমনটা একদা কৃষ্ণ বুঝতে পারেন। সে জন্য পুত্রকে যক্ষ্মাগ্রস্ত হবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। শাম্ব সে রোগমুক্ত হতে সূর্যপূজা শুরু করেন এবং সূর্যমন্দির স্থাপন করেন। ভবিষ্য এবং বরাহ এই দুই পুরাণ থেকে মিরাশি কয়েকটি শ্লোক তুলে দেখিয়েছিলেন শাম্ব প্রতিষ্ঠিত সূর্যমন্দিরের তালিকায় কালপ্রিয়ের উল্লেখ আছে। পূর্বে একটি মন্দির। মধ্যে যমুনার দক্ষিণ তটে কালপ্রিয়তে আরেকটি মন্দির। তৃতীয় মন্দির পশ্চিমঘাটের মূলস্থান-এ। পৌরাণিক শাম্ব কাহিনী এবং শাম্বর ঐতিহাসিকতাকে নিয়ে আমাদের আলোচনা নেই। কিন্তু কালপ্রিয় নামটি শ্লোকে আসায়, সূর্যমন্দিরের প্রসঙ্গ আসায়, মিরাশি এবং আমাদের কাছে কালপ্রিয়নাথের ব্যাখ্যাটা বদলে যায়। কানে ইত্যাদি পণ্ডিতেরা মিরাশির তত্ত্বকে বাতিল করেছেন কালপ্রিয় সূর্যের নাম নয়, এই ব্যাখ্যা দিয়ে। কিন্তু মিরাশি দেখিয়েছেন কালপ্রিয় স্থান নাম। তার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলে সূর্যকে এখানে কালপ্রিয়নাথ বলা হচ্ছে। এ যুক্তি খানিক সঙ্গত বলেই আমাদেরও অনুমান।
ভবভূতিরই অন্য আরেকটি নাটক ‘মালতীমাধব’-এর শুরুতে সূর্যবন্দনা ইত্যাদিও মিরাশি টেনে এনেছেন এ আলোচনায়। সঙ্গে আছে রাষ্ট্রকূট রাজা চতুর্থ গোবিন্দ-এর তাম্রফলক, যেখানে কনৌজ দখলের পথে তাঁর পিতা তৃতীয় ইন্দ্র, কালপ্রিয়নাথের বিরাট প্রাঙ্গণে সসৈন্যে অবস্থান করেছিলেন লিপিবদ্ধ। অর্থাৎ কালপ্রিয় স্থাননামের পক্ষে এটি আরেকটি প্রমাণও। তার পরেও বিতর্ক থাকে, থাকতেই পারে। ইতিহাসের পক্ষে বিতর্ক স্বাস্থ্যকর, যতক্ষণ না দৃঢ়তম প্রমাণ জোটে।
যাই হোক, প্রথম অঙ্কেই রূপকের উদ্দেশ্য পরিচ্ছন্ন ভাবে প্রকাশ করেছেন নাটককার। রাম-লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্র নিয়ে এসেছেন অযোধ্যা থেকে। তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। তিনি একাধারে রাক্ষস-ধ্বংস এবং রাম-সীতার বিবাহ আয়োজন করবেন। সঙ্গে রামকে দেবেন অলৌকিক অস্ত্র-সমূহ। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি রাজা জনককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর যজ্ঞে। রাজা জনক, যিনি সারীধ্বজ নামেও পরিচিত নিজে যজ্ঞানুষ্ঠানে ব্যপৃত আছেন তাঁর বিদেহ রাজ্যে। তিনি ব্রহ্মজ্ঞ। স্বয়ং যাজ্ঞ্যবল্ক তাঁকে ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়েছেন। সেই জনক নিজে আসতে অক্ষম হয়ে তাঁর অনুজ সাংকশ্য দেশাধিপতি কুশধ্বজকে সীতা এবং উর্মিলা এই দুই কন্যা সমেত প্রেরণ করেছেন বিশ্বামিত্রের তপোবনে। সেখানে রাম-সীতা এবং লক্ষ্মণ-উর্মিলার প্রথম দর্শন ও শ্রবণে প্রণয়ও জন্মাচ্ছে। সেই প্রণয় এবং বিশ্বামিত্রের আকাঙ্খার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বের স্বরূপ হয়ে আসছেন রাক্ষসরাজ রাবণের বৃদ্ধ দূত সর্বমায়।
রাক্ষসরাজ রাবণ অযোনিজা কন্যা সীতাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। জনকের পরিবার এবং তাঁদের পুলস্ত্য ও পুলহের কূলের মধ্যে এভাবে আত্মীয়তার সম্ভাবনাও জানিয়েছেন সর্বমায়। ততক্ষণে ওদিকে কুশধ্বজ কুমারদ্বয়ের, বিশেষ করে রামের গুণপনায় মুগ্ধ হতে শুরু করেছেন। অন্যদিকে রাম-সীতা ও লক্ষ্মণ-উর্মিলার পারস্পরিক অনুরাগ জন্মে গিয়েছে। আরেকটি বড় ঘটনা ঘটেছে সর্বমায় আসার আগেই। তা হল গৌতমপত্নী অহল্যার শাপমোচন। এঁর গর্ভেই জন্মেছেন শতানন্দ, যিনি রাজা জনকের পুরোহিত। আর জন্মেছেন আঙ্গিরস। ইনিও প্রসিদ্ধ ঋষি। এঁরা সকলেই অঙ্গিরা কূলের ঋষি, যাঁরা অগ্নিসেবক। অহল্যার অপরাধ কি ছিল? দেবরাজ ইন্দ্র এঁর প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন। নাটককার বলছেন এঁকে ইন্দ্র অবৈধভাবে উপভোগ করায়, অহল্যাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন ঋষি গৌতম। ঘটনার কোনো বিবরণ দেননি এখানে ভবভূতি।
অহল্যা বিষয়ক বিশদ আলোচনায় আমরা এখানে প্রবৃত্ত হব না। শুধু অহল্যার ঘটনায় ইন্দ্রের অভিশপ্ত হওয়ার কোনো চিহ্ন যে ভবভূতি রাখেননি তা লক্ষ্য রাখব। সঙ্গে লক্ষ্য রাখব পুরাণ-রামায়ণাদির বহু পাঠে অহল্যাও সীতার মত অযোনিসম্ভূতা। ব্রহ্মা অহল্যাকে নির্মাণ করেছেন অনেক পাঠে। তাই গর্ভ লাগেনি তাঁর। এ ছাড়াও অহল্যা শব্দের মধ্যে হল শব্দটির উপস্থিতিও আমরা লক্ষ্য রাখব। হল শব্দের প্রচলিত অর্থ লাঙল। ‘অ’ শব্দটি তার আগে যুক্ত হওয়ায় একটি ‘না’-বাচক অর্থ তৈরী হয়। অকর্ষিত জাতীয় একটি মানেও অনেক বিশেষজ্ঞ অহল্যা নামের অর্থের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন, এই কথাটিও মনে রাখব।
এই অযোনিজ কন্যার বিষয়টি খুব গুরুত্বের। কারণ এই অঙ্কেই বিশ্বামিত্রের আশ্রমে আসার পরে পরেই মহারাজ জনকের প্রসঙ্গ উঠতেই রাম-লক্ষ্মণ জানতে চেয়েছিলেন এমন এক অদ্ভূত কন্যার অস্তিত্বের কথা। যে অঙ্কে তাঁরা অযোনিজা সীতার কথা জানতে চাইছেন সেই একই অঙ্কে সীতার উপস্থিতিতেই নেপথ্যে অহল্যার শাপমোচন ঘটাচ্ছেন ভবভূতি। অযোনিজ অহল্যার শাপমুক্তির নাটকীয়তার অর্থ এখানে কি? সীতাও অযোনিজা। জরায়ুজ এবং অণ্ডজ হল যোনিজ জন্ম। স্বেদজ এবং উদ্ভিজ্জ দেহ হল অযোনিজ। এমন ধারণা পুরাণাদিতে পাওয়া যায়। অহল্যা, অকর্ষিত অর্থে এবং সীতা, লাঙলের ফাল দিয়ে কর্ষণ করলে যে রেখা পড়ে – এই দুই চরিত্রের জন্মই অযোনিজ। এ প্রকল্পের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যেতে পারে কৃষি বিদ্যার, যা উদ্ভিদ নির্ভরও। এ কারণে এঁরা অযোনিজ, প্রতীকি চরিত্র হিসেবে – এমনটা হতে পারে। আবার যোনিজ জন্মে, পুনর্জন্মের সংস্কারে পাপ-পূণ্য ইত্যাদি ফলাফল নারীর গর্ভে প্রবেশ করে এমনটাও ধারণা দেওয়া আছে। অতএব সে জন্ম, মহানায়িকাদের জন্য উচিত নয়, এমন ভাবনাও কাজ করে থাকতে পারে।
এই প্রসঙ্গেই একটি কৌতুহলজনক বিষয় নিয়ে এখানে কথা বলতেই হয়। সতী সম্পর্কে একটি সুপরিচিত সংস্কৃত শ্লোক হল –
অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্।।
এই পাঁচজনকে সতী হিসেবে স্মরণ করার চল আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে এখানে ‘কন্যা’ শব্দটি ‘সতী’ বোঝায় না। কন্যা বলতে বিবাহিতা বা অবিবাহিতা কন্যাই বোঝায়। কুমারীত্বও বোঝায় না। তাহলে সতীত্বের আরোপ কেন? কেনই বা এই তালিকায় সীতা নেই? রামায়ণ থেকে অহল্যা, তারা, মন্দোদরী আছেন। মহাভারত থেকে কুন্তী এবং দ্রৌপদী। প্রত্যেক নারীরই একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক। মন্দোদরি সম্পর্কে সচরাচর কম আলোচনা হয় বলে তাঁর কথা লিখি সামান্য। রামায়ণের নানা পাঠে একাধিক কাহিনী আছে তাঁর সম্পর্কে। মেঘনাদের জন্মের মূলে শিবের বীর্যের কাহিনী আছে। আবার এমন কাহিনী আছে যেখানে রাবণ, পার্বতীকে হরণ করছিল বলে তাঁর জায়গায় মন্দোদরীকে সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও মন্দোদরী ব্যাঙ-এর চেহারা নিয়েছেন মুনিদের বিষ থেকে বাঁচাতে। পরে অভিশাপে মন্দোদরী হয়েছেন। সেখানে আবার মন্দোদরী বালির সঙ্গে বিবাহপূর্ব যৌন-সম্পর্কে জড়িত হচ্ছেন। রাবণ পরে তাঁকে বিবাহ করছেন জোর করে। এখানেই বহু পুরুষের কথা পেয়ে যাচ্ছি আমরা। রাবণের মৃত্যুর পরে বিভীষণের সঙ্গে তাঁর বিবাহ-কাহিনী ছাড়াও। এমতাবস্থায় মন্দোদরী স্মরণীয়া, সীতা কেন সেই সুযোগ পেলেন না?
এর উত্তর সম্ভবত এই পঞ্চ কন্যার পুরুষতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ এবং প্রয়োজনে সে তন্ত্রে পুরুষের রূপ পরিগ্রহণ করার মধ্যে আছে। অহল্যা অভিশাপ মেনেছেন। তারা, যে পুরুষ শাসক তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং সংসারকে ধরে রেখেছেন। সুপরামর্শ দিয়েছেন, মন্দোদরীর মতই। কুন্তী এবং দ্রৌপদী আবার পুরুষতন্ত্রের সম্পদ অধিকারের যে লড়াই তা লড়েছেন পুরুষের মতই অথবা পুরুষকে অনুকরণ করেই। সীতার জীবন কিন্তু তা সম্পূর্ণত নয়। রাবণের দখল থেকে রামের কাছে ফিরেও তাঁকে লড়তে হয়েছে। রামের সব আদেশের যথাযথ অনুগমন করেননি। বস্তুত অগ্নিতে আত্মসমর্পণ একটি প্রজ্জ্বলিত প্রতিবাদ স্বরূপ সেযুগে। সুতরাং সীতার ঠাঁই এ তালিকায় হয়নি।
আমরা ফিরে আসি নাটকের প্রসঙ্গে আবার। অনুমান করা চলে অযোনিজা বলে পরিচিতা সীতার, রাবণের হাতে অপহরণ যেহেতু ঘটবে সেখানে দর্শককে নৈতিক অবস্থানের জন্য নাটককার এই ঘটনার মাধ্যমে খানিক প্রস্তুত করে রাখছেন। নাটকীয় কলা-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছেন, যদিও সীতা দীর্ঘকাল রাবণের শাসনে অশোকবনে বসবাস করবেন তবুও তাঁর অপরাধ হবে না। কারণ রাম এমন যিনি অযোনিজা এবং অবৈধ যৌন সংসর্গে জড়িতা অহল্যাকেও মুক্ত করতে পারেন। অতএব তাঁর পত্নীর ক্ষেত্রেও তাঁর এই মহিমা অক্ষুণ্ণই থাকবে।
মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে আগে মহিমা নির্মাণও তো করতে হবে। সেই নির্মাণের কাজটিই ভবভূতি এখানে রামকে অহল্যা মুক্ত করানোর মধ্যে দিয়ে সেরে রাখলেন। রাম যখন এই কাজ নেপথ্যে ঘটাচ্ছেন তখন মঞ্চে উপস্থিত সীতা। প্রচলিত রামায়ণে অহল্যা মুক্তি, সীতার সঙ্গে রামের সাক্ষাৎ এ সব কোনো কিছুই বিশ্বামিত্র আশ্রমে ঘটে না। অথচ ভবভূতি তাঁর নাটককে ঘনীভূত করতে সে সব একত্রে ঘটিয়ে দিচ্ছেন। জেনেশুনেই কালানৌচিত্য দোষ ঘটাচ্ছেন। যাই হোক, রাক্ষস দূত তখনো উপস্থিত হননি। রামের এই মহানতা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এখানে রাজা কুশধ্বজের প্রশ্নে। অহল্যা মুক্তিতে যখন নেপথ্যে রামের জয়-জয়কার চলছে তখন কুশধ্বজ বিশ্বামিত্রের কাছে জানতে চাইছেন এই বিষয়। বিশ্বামিত্র অহল্যা সংসর্গের জন্য ইন্দ্রকে বিদ্রূপ করে অহল্যার উপপতিরূপে চিহ্নিতকরণ সমেত অহল্যার শাপের কথা জানাচ্ছেন। এবং জানাচ্ছেন রামচন্দ্রের তেজে তিনি মুক্ত হলেন। এইখানে সীতার প্রতিক্রিয়াটিও আমরা লক্ষ্য রাখব। সীতা বিষ্ময় এবং অনুরাগের সঙ্গে বলছেন, শরীরের গঠনের অনুরূপই রামের প্রভাব।
বাক্যটি অসাধারণ ব্যঞ্জনা বহন করে অন্যদিক থেকে দেখলে। নরনারীর সম্পর্কের মধ্যে শরীরের অবস্থানকে ভবভূতি এখানে অবজ্ঞা তো করছেনই না, উপরন্তু তাকে সরাসরিই সামনে রাখছেন। সীতা, রামের শারীরিক সৌন্দর্য্যে যেমন মুগ্ধ, তেমনই তাঁর বল-বীর্য থেকে এই অলৌকিক প্রভাব সকলে মুগ্ধ। অর্থাৎ অনুরাগ শরীর থেকে চরিত্রের দিকে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সেখানে শরীরকে অদৃশ্য করে দিচ্ছেন না নাটককার। শরীরের গঠনের অনুরূপ কথাটির মধ্যে দিয়ে একটি তুলনা আনছেন। রামায়ণের প্রচলিত পাঠে সীতাকে মুক্ত হবার সময় থেকে বারেবারে যে সতীত্বের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেই প্রশ্নগুলি তো সবই শরীর কেন্দ্রিক। এবং রাবণের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ হওয়া না হওয়ার মধ্যে দিয়ে চরিত্র নিয়ে প্রশ্নের দিকে বেড়ে চলেছে। ভবভূতি এ সকল পাঠ জানেন। তিনি তাই যেমন ভাবে রামের বল-বীর্য প্রতিষ্ঠা করছেন এই অঙ্কে, তেমনই সতীত্বের মহিমা প্রতিষ্ঠা করাতেও তাঁর প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে রাখছেন। ঠিক সেইখানেই আবার সীতাকে দিয়ে শরীর এবং প্রভাবের তুলনা আনিয়ে রাখছেন – যাতে আমরা ভুলে না যাই মানুষ দেহধারী। সমাজ অনুমোদিত চরিত্র ধারণ করতে হলেও দেহ তার লাগবেই। কেন করছেন এমন কাজ ভবভূতি এ প্রসঙ্গে আমরা আবার পরে আসব।
ঠিক এইখানে দুয়েকটি সংলাপের পরেই প্রবেশ করবেন রাক্ষস সর্বমায়, রাবণের দূত হয়ে। সেই দু-একটি সংলাপের মধ্যে যেহেতু কুশধ্বজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা আছে তাই সে অংশটির কথা আগে জেনে নিই আমরা। রামের এই প্রভাব দেখার পরে কুশধ্বজ বলছেন রাজা জনক যদি হরধনুভঙ্গের মত অসম্ভব প্রতিজ্ঞা না করে বসতেন তাহলে রামের হাতে সীতা সম্প্রদানই যথাযথ হত। হ্যাঁ, তখনও বিবাহ বিষয়টি পুরুষের হাতে নারী সম্প্রদানই ছিল। দুজন মানুষের মধ্যে সমমানের বিনিময় ছিল না।
সর্বমায় এলেন। রাক্ষস দূতের বিশ্বামিত্রের আশ্রমে আসাটাতে রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই আশ্চর্যও হলেন। সর্বমায় এসে জানালেন রাবণ সীতাকে যাতে অপহরণ না করেন তার জন্য মন্ত্রী মাল্যবান তাঁকে বুঝিয়েছেন। রাবণ সীতার পাণিপ্রার্থী। সর্বমায় প্রথমে মিথিলা গিয়েছিলেন। সেখানে দেখেছেন জনক যজ্ঞে ব্যাপৃত। জনক তাঁকে বলেছেন বিশ্বামিত্র এবং কুশধ্বজের কাছে আসতে। রাবণ বলেছেন যদি কোথাও কোনো রত্ন থেকে থাকে তাহলে তা ইন্দ্রকে ছেড়ে তাঁর অধিকারে আসে। কারণ তিনি ইন্দ্রবিজেতা। কন্যা তো আবার পরের ঘরে যাবার জন্যই। সুতরাং রাবণকে সীতা সম্প্রদান করলে রাবণ এবং পুলস্ত্য-পুলহের কুলজ শ্রেষ্ঠ রাক্ষসেরা জনকের আত্মীয় হবেন। রাবণের এই বার্তার নেপথ্যে সম্ভবত একটি ক্ষমতাজনিত রাজনীতিও কাজ করছে। সে রাজনৈতিক ক্ষমতার চেহারা আমরা ক্রমশ দেখব। আপাতত দেখি সর্বমায়ের এই বার্তার তাৎক্ষণিক ফলাফল।
সীতা লজ্জিত এবং বিড়ম্বিত রাক্ষস তাঁকে কামনা করছে বলে। লক্ষ্মণ আর রামের আলোচনাটিও এখানে মনোগ্রাহী। লক্ষ্মণ, রাবণের এই আগ্রহে খানিক আশ্চর্য এবং বিরক্তও বটে। একে তো রাক্ষস, তায় আবার তাঁদেরই পূর্বপুরুষ ইক্ষ্বাকু রাজা অনরণ্যের হত্যাকারী। বেদাচার ধ্বংসকারীও বটে। এখানে রামের চরিত্র ভবভূতি নির্মাণ করছেন অনন্য দক্ষতায়। ধীরোদাত্ত নায়কের চরিত্রগুণের সঙ্গে যুক্ত করছেন দার্শনিক উপাদান। রাম বলছেন, যে কোনো কন্যাকে সাধারণভাবে যে কেউ প্রার্থনা করতেই পারেন। অর্থাৎ রাম লোকাচার সচেতন। আবার রাবণ ত্রিভূবনজয়ী এবং ব্রহ্মার প্রপৌত্র। অতিবীর্যবান, অনন্ত তপস্যার আধার এবং অসাধারণ। অর্থাৎ রাবণের চরিত্র নির্মাণে তাঁর বংশমর্যাদা, কূলগরিমা, শিক্ষা-দীক্ষা, বল-বীর্যও লক্ষ্য করছেন রাম। লক্ষ্মণকে মৃদু ভর্ৎসনা করছেন রাবণ সম্পর্কে সাধারণের মত কথা বলার জন্য। আবার এ কথা বলতেও ভুলছেন না, শত্রু হলে রাবণ অবশ্যবধ্য।
লক্ষ্মণ কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট না। তাঁর অভিযোগ বীরের আচরণ থেকে রাবণ চ্যূত। এখন বীরের আচরণ ঠিক কী তা লক্ষ্মণের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে যা হবে, তা তো রাবণের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে হবে না। সে যদি বাদই দিই, রাবণের আচরণ-চ্যূতির উদাহরণও এখানে প্রত্যক্ষ ভাবে লক্ষ্মণ দিচ্ছেন না। অনুমান করা যেতে পারে আগের সংলাপে যে বেদবিহিত আচরণ ধ্বংস করা, ইক্ষ্বাকু বংশের রাজাকে হত্যা করা ইত্যাদি নিয়ে যে সব অভিযোগ তিনি করছিলেন সেই সবই সম্ভবত বীরের আচরণ-চ্যূতি। রামও বীরের আচরণ-চ্যূতি বলতে ঠিক কী বোঝায় তা নিয়ে কোনো কথা বললেন না ভবভূতির নাটকে। বরং তিনি বললেন, পন্ডিত হয়েও রাবণ যে ধর্মপথ থেকে বিচ্যূত তার কারণ হল সব গুণ এক আধারে থাকে না। অর্থাৎ রামের উত্তরটি এখানে দার্শনিক। একদিকে সত্যই। একজন সর্বগুণের অধিকারী হবেন এমন হতে পারে না। অতএব এ লোকসত্যও বটে। অন্যদিক হল ধর্মপথ সম্পর্কে একটি একরৈখিক ধারণা যা নাটককার নিজেও এড়াতে সক্ষম হলেন না। তিনি নাটকটি লিখছেন যখন, তখন শুরুতেই পক্ষ অবলম্বন করে ফেলেছেন। নইলে কতগুলি প্রশ্ন এখানে দেশ-কাল-ধর্ম ইত্যাদি পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত হতেই পারতো।
রাম-লক্ষ্মণের এই আলোচনার কিছুক্ষণ আগেই কিন্তু আমরা অহল্যা-ইন্দ্রের কথা জেনেছি। ইন্দ্রকে অহল্যার উপপতি বলে তাচ্ছিল্য করার বাইরে কোনো ধর্মবিচার আমরা পাইনি। ইন্দ্র দেবরাজ। ইন্দ্র ব্রহ্মজ্ঞ বলেও পরিচিত। সেই ইন্দ্র যখন তাঁদেরই প্রচলিত যৌনতা সংক্রান্ত বিধি-নিষেধকে অতিক্রম করলেন তখন তিনি কোন ধর্ম পালন করলেন? রাবণ, আমরা জানি, সীতাকে অপহরণ করেছেন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। অমার্জনীয় অপরাধ। এদিকে ভবভূতির নাটকে অহল্যা-ইন্দ্রের উপাখ্যানে আমরা জানতে পারছি না অহল্যার ইচ্ছেতে এই কাণ্ড হয়েছিল কী না! ইন্দ্র যে জেনেই এ কাণ্ড করেছেন তা কিন্তু পরিস্কার। তাহলে রাবণ, যিনি অপহরণ করেছেন, কিন্তু সীতার উপর বলপ্রয়োগ করেছেন বলে কোথাও জানা নেই, তিনি একাই ধর্মপথ বিচ্যূত হলেন কেমন করে? তাঁরই শাস্তি শুধু মৃত্যু কেন? ইন্দ্রের শাস্তি, তাঁদেরই প্রচলিত নিয়মানুসারে মৃত্যু কেন নয়?
যে কালে এই নাটকটি লেখা হয়েছিল, তার অনেক পরের কালে আমরা এই আলোচনা করছি। সুতরাং আমাদের কালের যা বিচার-বুদ্ধি তার থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর এখানে থাকবে না এ বলাই বাহুল্য। কিন্তু যে কালে করছি আমরা এই আলোচনা, সেই কালে দেবতারা মানবের শাসক, অতএব যা খুশী করলেও তাঁদের বিরাট অপরাধ হয় না, এই ভাবনাটাও তার জোর হারিয়েছে। অন্তত একটি বিরাট অংশ এ কালে আছেন, যাঁদের কাছে দেব মানেই মানবের শাসক এ ভাবনা নেই। সেইখান থেকে দেখলে এ ভাবনা সঙ্গত যে নাটককার শুরুতেই মেনে নিয়েছেন কতগুলি কথা – বেদই একমাত্র আচরণ ধর্মের নির্দেশক, দেবই একমাত্র শাসক, রাম অবতারকল্প এবং রাবণ সীতাহরণের আগেই দোষী দেব-বেদ দুটিকেই দ্বন্দ্বে আহ্বান করার জন্য। অতএব চরিত্র চিত্রণে যুক্তির চাইতে এই সব মতের প্রচারধর্মীতাই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। আর ঠিক সে জন্যই রামকে দিয়ে নাটককার যতই সংবেদনশীল মানুষের মত কথা বলান, দার্শনিকের মত কথা বলান না কেন, চরিত্রটিও আদপেই পক্ষপাত দুষ্ট হয়েই আছে। সঙ্গে এ কথাও বলা উচিত, যে কোনো নাটকের নেপথ্যে নাটককারের একটি ভাবনা থাকে, যা এক প্রকার পক্ষপাতী ভাবনা। সুতরাং চরিত্রগুলিও সে ভাবনায় জারিত হয়। এখানে নাটককারের দক্ষতার উপর নির্ভর করে সে পক্ষপাত তিনি কতটা প্রচ্ছন্ন রাখতে সক্ষম। ভবভূতি এখানে প্রচ্ছন্ন রাখার ধারও ধারেননি।
তার ফল হল রামের এই সংলাপের মধ্যেই তাঁকে দ্রুত বিষয়ান্তরে সরে যেতে হয়েছে পরবর্তী ঘটনার আভাস দিতে। সে আভাসে যেমন পরশুরামের এই নাটকে প্রবেশ সহজ হয়, তেমনই রামের চরিত্রের বীরোচিত উপাদান ক্ষুণ্ণ হয়। রাম রাবণের বিচ্যূতি নিয়ে কথা বলতে বলতেই চলে যাচ্ছেন পরশুরামের প্রসঙ্গে, যেখানে তিনি জানাচ্ছেন কার্তিকেয় বিজয়ী পরশুরাম ছাড়া রাবণের মত বীর আর কেউ নেই। নিজেকে তুলনা থেকে বাদ দেওয়া যদি বিনয় বলেও ধরি তাহলেও প্রতি-প্রশ্ন হবে প্রয়োজন কী ছিল! কিছু আগেই বলেছেন শত্রু হলে রাবণ অবশ্যবধ্য। তারপরেই বলছেন পরশুরাম ছাড়া সমকক্ষ কেউ নেই রাবণের। দোলাচল একটা যেন ধরা পড়ছে এতে। এই দোলাচলের কারণ হয়তো কোথাও গিয়ে নাটককারের রামের মহিমা দ্রুত প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা, যাতে তিনি যতটা সময় প্রয়োজন তা নিতে পারছেন না। তাই আবার পরশুরামের প্রসঙ্গ উঠে যেতেই তাটকা রাক্ষসীর প্রবেশকাল এসে যায়।
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Serial