আফগান সমস্যা ও পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারতের বৈদেশিক নীতি : শুভাশীষ চক্রবর্তী

আফগানিস্তান এশিয়ার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ হলেও এই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান কার্যত তার রাজনৈতিক গতিপথকে একাধিক স্রোতেপ্লাবিত করেছে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গেলে আলোচনার প্রথমাংশেই এই দেশের ভৌগোলিক অবস্থানটিকে স্পষ্ট করা বিশেষ জরুরী। আফগানিস্তান তার দক্ষিণে ও পূর্বে ১,৫১০ মাইল ডুরান্ড লাইন বরাবর পাকিস্তান দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছে। উত্তরে, মধ্যএশিয়ার ৭৬২ মাইল সীমানা জুড়ে অবস্থান করছে এই দেশ। এই দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে যথাক্রমে তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান-এর মত দেশগুলি। আফগানিস্তানের পশ্চিমে প্রায় ৬৩৫ মাইল সীমানা জুড়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রি ইরানের অবস্থান, আর উত্তরপূর্বে আছে চিনের ওয়াখান করিডরের শেষ প্রান্তে অবস্থানকারী জিংজিয়াং প্রদেশ। সর্বোপরি, এই দেশের মাধ্যমেই দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্য প্রাচ্যের মধ্যে যোগাযোগের পথ মসৃণ হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও আফগানিস্তানের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই অঞ্চলের মাধ্যমেই চিনের সাথে মধ্য প্রাচ্যের সিল্ক রুটের যোগাযোগ সুনিশ্চিত হয়েছে। তাছাড়া বহুযুগ থেকেই ভারত-ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সচল রাখতেও আফগানিস্তানকে অন্যতম প্রয়োজনীয় মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে এই দেশ পৃথিবীর একাধিক অঞ্চলের মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বটি যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একাধিকঘাত-প্রতিঘাত ও টানাপোড়েনের সাথে জড়িয়ে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। এই প্রেক্ষাপটে, সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হ্যালফোর্ড জন ম্যাকিনডার-র ধারণাটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও উল্লেখযোগ্য :
Who rules East Europe commands the Heartland:
Who rules the Heartland commands the World- Island [Eurasia]:
Who rules the World-Island commands the world. [১]
অর্থাৎ, সহজভাবে বলতে গেলে যে-কোনো শক্তিধর সাম্রাজ্যের জন্যই এই ইউরেশিয়া জয় অত্যন্ত লাভজনক যা তাদের বিশ্বজয়ের দরজা উন্মুক্ত করবে। বলাবাহুল্য, এই অঞ্চলের আধিপত্য কায়েমের জন্য আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সর্বোপরি, বিপুল হাইড্রো কার্বন ও তেল সমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া এবং কাস্পিয়ান সাগরের নৈকট্য আফগানিস্তানের অবস্থানকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সুতরাং, বিশেষ স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বর ভিত্তিতেই আফগানিস্তান রাষ্ট্রটি যে ঐতিহাসিকভাবে ‘সাম্রাজ্যের সমাধিক্ষেত্র’-এ (graveyard of Empire’) পরিণত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়।

ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের প্রাক্কথন :

ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায় ভারত-আফগানিস্তনের সম্পর্ক বহুদিনের, যার সূচনাসিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই। অ্যালেকজান্ডার-এর পর সেলেউসিদ সাম্রাজ্য আজকের আফগানিস্তানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে। কিন্তু ৩০৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে জোট চুক্তির (Alliance Treaty) ফলস্বরূপ ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যকে এই অঞ্চলের বেশ কিছু অংশ তারা ছেড়ে দেয়। হিন্দুকুশের দক্ষিণের অঞ্চল মৌর্যদের দখলে আসে এবং তাদের সময়ই এখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তন ঘটে। তবে মুঘলের সময় থেকেই এখানে ইসলামের প্রভাব জোরদার হয়। তাছাড়া দশম শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত আফগানিস্তান হয়ে একাধিক বহিঃ শক্তিকে (যেমন দুরানি, শুরি, খিলজি, ঘুরি, মুঘল) উত্তর ভারত দখল করতে দেখা যায়। আবার পরবর্তীকালে, খান আবদুল গফফরখান-র মত পাস্তুন নেতাদের নামও ভারতের জাতীয় সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। তবে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছরের জন্য মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের (Treaty of Friendship) মাধ্যমে ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।[২] এই সম্পর্কের সর্বপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি ছিল১৯৭৩ সালে প্রজাতন্ত্রী আফগানিস্তানকে ভারতবর্ষের স্বীকৃতি প্রদান। আবার ঠাণ্ডা যুদ্ধের রাজনীতির বদলে যাওয়া সমীকরণে সোভিয়েত রাশিয়া যখন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে তখন ভারত সোভিয়েত সমর্থিত প্রজাতন্ত্রী আফগানিস্তানকেই সমর্থন জানায় ও রাজীব গান্ধি সরকার তখন নাজিবুল্লার সরকারকে বন্ধু রাষ্ট্রের তকমা দেয়। তবে ২০০১ সালেতালিবান উচ্ছেদ ও ন্যাটোর (NATO) ছত্রছায়ায় বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কে এক নতুনদিগন্ত উন্মোচিত হয়। হামিদ কারজাই-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অন্তর্বর্তী সরকারের সূচনালগ্নেই ভারতের বাজপেয়ী সরকারের পক্ষথেকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালে ভারত-আফগান সম্পর্কের একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ ছিল তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াতে প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড চুক্তির (Preferential Trade Agreement) বাস্তবায়ন। পরবর্তীকালে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, পরিবহন থেকে বাণিজ্য বা কৃষি থেকে শিল্প বা সুরক্ষা সবেতেই ভারত আফগানিস্তানে বিভিন্ন পথে বিনিয়োগ করেছে। মনমোহন বা মোদি জমানাতে ও বন্ধুত্বপূর্ণ আফগান নীতিরই ইঙ্গিত মেলে।

আফগান সমস্যা ও ভারতের বিদেশনীতিতেসম্ভাব্য প্রভাব :

তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ যেকোনও সময়ে যে-কোন মুহূর্তে বদলাতে পারে। আফগানিস্তানের জন্যও সেটাই বরাদ্দ ছিল। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়ক বাহিনী (International Security Assistance Force) আসলে যেটা বুঝতে পারেনি সেটা হল শুধুমাত্র সামরিকপদ্ধতিতে সরকারবিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। স্বভাবতই দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাসী হামলায় আফগানিস্তান বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। ২০১৮ সালের জেনেভা সম্মেলনে আফগানিস্তানে শান্তি ও পুনর্গঠনকে সামনে রেখে আফগান রাষ্ট্রপতি আশরাফঘানি একটি ‘রোডম্যাপ’-কে (Road Map) সামনে রাখে। শান্তি প্রসঙ্গে আন্তঃ-আফগান ডায়লগের বা মতবিনিময়ের দরজাটিকেও খোলা রাখা হয়। অবশেষে ২০২০ সালে কাতারের দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবানদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঠিক হয় মার্কিন ও ন্যাটো সেনা আফগানিস্তান থেকে খুব শীঘ্রই প্রত্যাহার করা হবে, যার পরিবর্ত শর্ত স্বরূপ তালিবানরা আল কায়দা বা অন্যান্য উগ্রপন্থীর হাতে যাতে আফগানিস্তানের মাটির অপপ্রয়োগ না ঘটে তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি এটাও স্থির করা হয় যে ২০২০-র নরওয়ের ওসলোতে তালিবানরা আন্তঃ-আফগান ডায়লগে অংশ নেবে। এই ডায়লগে আফগান সরকার ও তালিবানদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ও সহাবস্থানের ভিত্তিকে জোরদার করতে ১০০০ আফগানী সুরক্ষা বাহিনী ও কারারুদ্ধ ৫০০০ তালিবানির বিনিময়ের (exchange) কথাও বলা হয়।[৩] তবে এই প্রেক্ষিতে দুনিয়ার কাছে সবথেকে আশঙ্কার বিষয়টি ছিল এই যে যদি শান্তি চুক্তিটি যথার্থভাবে কার্যকর না হয় তাহলে হয়ত পুনরায় তালিবানরা আফগান বাহিনীকে সরিয়ে কাবুল দখল করতে পারে। আর এই আশঙ্কাকেই সত্যিকরে ২০ বছর পর তালিবানরা কাবুল পুনর্দখল করেছে এবং ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তানের (Islamic Emirate of Afghanistan) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে তালিবানরাজের প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত হয়েছে। এর সাথে এটাও সমগ্র বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয় যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে ঘানিওতার প্রতিদ্বন্দ্বী মুখ্যকার্যনির্বাহক আব্দুল্লাহআব্দুল্লার মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও পারস্পারিক ক্ষমতাভাগের সন্ধিটি কার্যত বিফলে যেতে চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান থেকে ক্ষমতা বিস্তারকারী তালিবানি গোষ্ঠী ঠিক যেভাবে ১৯৯৫ সালে ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হেরাতকে দখল করেছিলো এবং তার ঠিক পরের বছরেই মুজাহিদ্দিন গোষ্ঠীর অন্যতম প্রাণপুরুষ, তৎকালীনরাষ্ট্রপতি বুরহানুদ্দিন রাব্বানির শাসনকে সমূলে উৎপাটন করে, আফগান রাজধানী কাবুলের ক্ষমতা দখল সম্পন্ন করেছিলো, ঠিক এই একই দৃষ্টান্ত একবিংশ শতকেও পরিলক্ষিত হল।
আফগানিস্তানে ঘটে যাওয়া এই পরিবর্তিত বাতাবরণে বেশ কিছু বিষয় ভারতের সামনে উন্মুক্ত হয়েছে এবং বলাবাহুল্য, এই বিষয়গুলোই ভবিষ্যতে ভারতের বৈদেশিক নীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে একান্তভাবে কার্যকারী হবে।

প্রথমত, আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের হাত ধরে যে নতুন আফগানিস্তানের পূর্বাভাস পাওয়া গেছে সেখানে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় থাকা ভারতের জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য একান্তভাবে কাম্য, কারন ভারত আর কোনভাবেই এটা চাইবেনা যে তালিবান অধীনে নতুনভাবে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিক এবং ভারতের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে, বিশেষত কাশ্মীর অঞ্চলের সুরক্ষাকে বিঘ্নিত করুক। ইতিমধ্যেই ইণ্ডিয়া টুডে-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ম্যান মাইকেল ওয়ালটজ তালিবান ক্ষমতায়নের ফলে আল কায়দা ৩.০-র সূচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। পাশাপাশি, তালিবান ও লস্করি তৈবার পারস্পারিক সংযোগ যে ভারতের মাটিতে নতুন করে সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে, এই কথাও তিনি স্বীকার করেন। বিবিসিকে দেওয়া ব্রিটেনের আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এম.আই ফাইভের মহাপরিচালক ম্যাককালামের বক্তব্যে এই আশঙ্কার কথাই উঠে এসেছে: “Terrorist threat tend not to change overnight in the sense of directed plotting or training camps or infrastructure – the sorts of things that al-Quada enjoyed in Afghanistan at the time of 9/11”.[৪] প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের (Islamic Republic of Afghanistan) যৌথ ঘোষণাতেও (Joint Declaration) আফগানিস্তানের জমি যাতে দক্ষিণপন্থী উগ্রসন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে ব্যবহৃত না হয় সেই বিষয় গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল : “guarantees to prevent the use of Afghan soil by any international terrorist groups or individuals against the security of the United States and its allies.”[৫] তাছাড়া একথা অজানা নয় যে আফগানি গেরিলা সন্ত্রাসী সংগঠন হাক্কানি গ্রুপ-(Haqqani) এর সাথেও আইএসআই (ISI)-এর একটি গভীর সংযোগ রয়েছে, যা ভারতের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। ১৯৯৯ সালে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনস প্লেন ফ্লাইট ৮১৪-র হাইজ্যাক অথবা ২০০৮ সালে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে বোমা আক্রমণের পিছনেও এই আইএসআই-এর নামই জড়িয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, পূর্বাতন নির্বাচিত আফগান সরকার-এর পরিবর্তন এবং তালিবান প্রত্যাবর্তনের পেছনে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতের বিষয়টিকেও কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। নতুন সরকার গঠনের প্রাকমুহূর্তে তালিবান সরকার-এর পক্ষ থেকে পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি আই.এস.আই-র প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনেরাল ফাইজ হামেদ-কে আমন্ত্রণ কার্যত এই অভিযোগকেই আরও জোরদার করে তুলেছে। সুতরাং, পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার সম্পদ যদি জেহাদি গোষ্ঠীর হাতে এসে পোঁছায় তা হলে সেটি যে ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হবে এই আশংকা অমূলক নয়। সর্বোপরি, পাকিস্তান ও তালিবানের এই সম্পর্ক নিয়ে যে নিউ দিল্লিও যথেষ্টভাবে চিন্তিত একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। সম্প্রতি মস্কোর সাথে হওয়া উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে, যেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও রাশিয়ান ফেডারেশনের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব নিকলাই পাত্রুশেভ-কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ভাগ নিতে দেখা যায়, সেখানে ভারতের পক্ষে হিন্দু বা শিখ সম্প্রদায়ের মত আফগানিস্তানবাসী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিরপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তালিবান প্রশ্নে পাকিস্তানের আইএসআই-র ভূমিকা প্রসঙ্গে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হয়।

দ্বিতীয়ত, আশরাফ ঘানি সরকারের বিপর্যয় ও তালিবানদের কাবুল দখল বিশ্ব রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে কিছু রাজনৈতিক সমীকরণের পরিবর্তন আনতে চলছে। এই প্রেক্ষিতে যে প্রসঙ্গটি না বললেই নয় তাহল এই যে, তদানিন্তন ন্যাশানাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (NUG) নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের সাথে ভারতের মোদি সরকারের সুসম্পর্ক স্থাপন হওয়া, যা দুই দেশের পারস্পরিক সৌহার্দ্যকে এক অন্যমাত্রা দেয়। আফগানিস্তানের প্রধান কার্যনির্বাহক আবদুল্লা আবদুল্লা যখন ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভারতে আসেন, তখন তাঁর বিবৃতিতে তিনি স্পষ্টত জানান: “India ought to look at Afghanistan as a permanent friend”[৬]. যদিও এই সময় ঘানি সরকারের ‘পাকিস্তান-চিনপ্রজেক্ট’ নিউ দিল্লীকে চিন্তিত করে, কিন্ত আফগানিস্তানের প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রাকেশ সুদ আশ্বাস দেন যে আফগানিস্তানে ভারতের উন্নয়নমূলক অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ভারতের যে একটা সুঠাম ভাবমূর্তি আফগানি সমাজে গড়ে উঠেছে তা কখনই সহজে বিনষ্ট হওয়া সম্ভব নয়। ২০১৫ সালেই নরেন্দ্র মোদির আফগানিস্তান যাত্রা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তারপর কেটে গেছে এক দীর্ঘ পথ। আফগান পার্লামেন্ট বিল্ডিং-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন থেকে শুরু করে সুরক্ষা স্বার্থে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আফগান বায়ুসেনাকে ৪টি এমআই ২৫ হেলিকপ্টার ও ৩টি হ্যাল (HAL) লাইট ইউটিলিটি হেলিকপ্টার (LUH) প্রদান, আফগানিস্তানের কান্দাহারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণে সহায়তাদান, প্রায় ১৬,০০০-এর বেশি আফগান ছাত্রছাত্রীদের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার জন্য ভিসাপ্রদান অথবা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (Strategic Partnership Agreement) সম্পন্নায়ন ইত্যাদি একাধিক কার্যকারী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ভারত সরকার আফগানি সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি, বাণিজ্য ক্ষেত্রেও দুই দেশের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি ছিল পশ্চিম আফগানিস্তানে হেরাত প্রদেশে হরি নদীর উপর আফগান-ভারত মৈত্রী ড্যাম (Afghan-India Friendship Dam) প্রোজেক্ট বাস্তবায়িতকরন এবং ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে সিস্তান ও বালুচিস্তানে অবস্থিত চাবাহার সমুদ্রপথের উন্মুক্তকরণ। এই বাঁধ নির্মাণের উপর, যা পূর্বে সালমা নামে পরিচিত ছিল, ভারত সরকার ইতিমধ্যে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, পাকিস্তান যখন ভারত থেকে আফগানিস্তানের যাবতীয় মাল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তখন পাকিস্তান কে পাশ কাটিয়ে ১,৩০,০০০ টন এর গম আফগানিস্তানে প্রেরিত হয় শুধুমাত্র চাবাহার পোর্টের সুবিধার জন্য। সুতরাং ভবিষ্যতে আফগানিস্তান ও ভারত এই দুই দেশই যে তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক আদান প্রদানকে মসৃণ করার জন্য এই বিকল্প পথকেই শক্তিশালী করতে পারে তারও আভাস মেলে। তাছাড়া, ২০১৭ সালে ইরানের চাবাহারে, ভারত, আফগানিস্তান ও ইরানের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও গমনের করিডরের (Establishment of International Transport and Transit Corridor) রূপরেখা নির্ণীত হয় যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এই দেশগুলিকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করবে। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে (কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিবিধ ক্ষেত্রে) ইতিমধ্যে ভারত সরকার ৩ বিলিয়ন ডলারের উপর বিনিয়োগ করেছে যা ভারতকে এই দেশের অন্যতম বৃহৎ আঞ্চলিক আর্থিক অনুদানকারী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাই বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত সরকার আফগান নীতি নির্ধারণে একান্তভাবে সতর্ক। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচী, আর্থিক অনুদান বা ‘সফট পাওয়ার’-প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও সাংস্কৃতিক স্তরে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ভারত সরকার আফগানিস্তানি জনসমাজে যে আস্থা অর্জন করেছে তা যাতে কোন হঠকারী সিদ্ধান্তে বিপর্যস্ত না হয় সেই দিকে ভারতের কূটনৈতিক জগৎ সদা সতর্ক। তাই ভারত এই মুহূর্তে কিছুটা হলেও ধীরে-বুঝে চলো নীতির পক্ষপাতী। আর এই কারনেই তালিবান ক্ষমতায় আসা প্রসঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর বিগত বক্তব্যে আপাতত কিছুটা সুর নরমের ইঙ্গিত মিলেছে। আর এই পরিবর্তিত কাবুলের জন্য ভারতের বিদেশনীতিতে যে একটা কৌশলগত পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে তার সব থেকে বড় উদাহরণ হল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলার সভাপতিত্বে ৩-২ বিভাজনে প্রস্তাব পাশ। চিন ও রাশিয়ার সম্মতি না থাকলেও, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স সহ ১৩ টি দেশ এই প্রস্তাবে সমর্থন করেছে। তবে এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয় বিষয়টি হল এই যে, যেখানে ১৫ ই আগস্ট কাবুল পতনের দিনই নিরাপত্তা পরিষদের তরফ থেকে তালিবান গোষ্ঠীকে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের জন্য আহ্বান করা হয়েছিল তার ঠিক কিছুদিন ব্যাবধানের মধ্যেই আফগানিস্তান প্রশ্নে সন্ত্রাসের সমার্থক ‘তালিবান’ শব্দটিকে কূটনৈতিক শব্দ চয়নে প্রত্যাহার করা হয়। ২৫৯৩-র এই প্রস্তাবে বলা হয় : “Afghan territory not be used to threaten or attack on any country or to shelter or train terrorists, or to plan or to finance terrorist acts”[৭]. তাছাড়া, আফগানিস্তানের মাটি যাতে ভারত বিরোধী সন্ত্রাসে ব্যবহৃত না হয় তা সুনিশ্চিতকরণের জন্যই দোহাতে তালিবানদের সাথে প্রথমাবার সরকারিভাবে মিটিং করে ভারত সরকার। তালিবান সরকারের সম্ভাব্য বিদেশ মন্ত্রী শের মহম্মদ আব্বাস স্তানিকজাইয়ের সাথে ভারতের রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তলের-এর এই বৈঠকে আফগানিস্তানে আটকে থাকা ভারতীয় নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরপত্তার বিষয়টিকে জোর দেওয়া হয়।সুতরাং, এই নতুন আফগানিস্তানের জন্য ভারতের কূটনৈতিক নীতির যে কিছুটা বদল ঘটতে চলছে তা অনুমান করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, যে বিষয়টি এই প্রসঙ্গে স্বীকার করে নিতে হয় তা হল এই যে পরিবর্তিত আবহে তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে যদি পাকিস্তান বা চিনের প্রভাব সুদৃঢ় ও সুবিস্তৃত হয়, তা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতবর্ষের বিকাশের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হবে। এই আলোচনা সূত্রধরে বলা যায় পাক-তালিবান-এর সম্পর্কের বীজ প্রোথিত হয়েছিল বহুদিন আগেই এবং ৯০-র দশকের শুরু থেকেই পাকিস্তানের তালিবান মদতপুষ্ট আফগান নীতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পাশাপাশি, শারিয়া আইন তালিবানদের পাকিস্তানের আরও কাছে এনেছে। এমনকি ৯/১১-র মর্মান্তিক ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘War on Terrorism’-র নীতিকে মুশারফের পাকিস্তান সরকার সমর্থন জানালেও, তালিবান প্রশ্নে তাদের প্রশ্রয় অব্যাহত থাকে। এই প্রেক্ষিতে, ২০০৭ সালে প্রকাশিত আহমেদ খানের একটি প্রতিবেদন ‘Understanding Pakistan’s Pro-Taliban Afghan Policy’-এ তালিবান প্রশ্নে পাকিস্তানের সমর্থনের প্রসঙ্গে বক্তব্যটি ছিল এইরূপ :
Pakistan’s Afghan policy of supporting the Taliban rule remained unaffected. Pakistan continued to view Taliban rule as the best possible means of achieving its goal in Afghanistan. Despite differences in approaches to domestic, and even some international issues, this policy continued to receive support from a large variety of opinion, not just fundamentalist political parties. These included JI, JUI, PML (from all its factions after the October 1999 coup) from the right of Pakistan politics. Naseerullah Babar of PPP continued to express strong support for the Taliban, even as his party, PPP changed its stance from 1996 onwards. With a few exceptions, most of the intelligentsia, not necessarily religious, was and is still vocal in its support to the Taliban.[৮]

আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে তালিবান অধীন আফগানিস্তানে পাকিস্তান নিঃসন্দেহে তাদের দীর্ঘ আকাঙ্খিত ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’ লাভ করতে চলেছে। পাশাপাশি আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানকে বৃহত্তর মুসলিম সমাজের স্বপ্নকে আরও বেশি সুদৃঢ় করবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই ‘স্ট্র্যাটেজিকডেপথ’ এর ধারণাটি পাকিস্তানের কাছে ৮০-র দশকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এবং তা ছিল মূলত ১৯৭১-র যুদ্ধে ভারতের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার ফল এবং ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের সাথে আবারও কোন যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে যাতে আফগান জমিকে তাদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে কাজে লাগানো যায় এবং সেই অনুযায়ী তারা যাতে উত্তরপশ্চিম সিমান্ত থেকেও আঘাত হানতে পারে সেই বিকল্পটিকে মাথায় রেখেই আফগান ভূমিতে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের বিষয়টি পাকিস্তানের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্ট্রই নিউক্লিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্রের তকমা পাওয়ায় এই ‘স্ট্র্যাটেজিকডেপথ’ এর প্রাসঙ্গিকতা কিছুটা হ্রাস পেলেও তা পুনরায় গুরুত্ব পায় ২০১০ সালে পাক জেনারেল আসফাক‌‌ পারভেজ কয়ানির একটি বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে যেখানে আফগান ভুমিকে তাদের ‘স্ট্র্যাটেজিকডেপথ’-র প্রক্সি ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করার বাসনাই উন্মোচিত হয়।[৯] আনন্দ আরনি ও অভিমুন্ন তন্দনের ভাষায় : “The Pakistani military doctrine behind the concept of strategic depth suggests transforming Afghanistan into a client or subservient state that is beholden to the Pakistani security establishment. Unchallenged pursuit of this policy could potentially widen the area of military conflict and drag Afghanistan into the Indo-Pak equation”.[১০] এর পাশাপাশি পাস্তুন জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রনের জন্যও পাক সরকারের আফগানিস্তান কেন্দ্রিক আধিপত্য প্রয়োজন।

অন্যদিকে আবার বিশেষজ্ঞরা এটাও মনে করছেন যে ২০১৬ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার আফগান ভুমিতে সাময়িকভাবে যে একটা শক্তি শূন্যতা (power vacuum) তৈরি করেছে তার ফায়দা তুলতে পারে আগ্রাসী চিন। এই অঞ্চলে তাদের কায়েমি স্বার্থকে দুইভাবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, চিনের কাছে এই তথ্য আছে যে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট বা ইটিআইএম (ETIM) আল-কায়দার কাছেই আশ্রিত ও প্রতিপালিত। তাছাড়া, চিন সরকার এটাও মনে করে যে আফগানিস্তানের অস্থিরতা ও সন্ত্রাশ কার্যত জিংজিয়াং প্রদেশের বিছিন্নতাবাদকে উদ্দীপ্ত করবে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তালিবানদের কাবুল দখলের পর, চিন-তালিবান কূটনৈতিক আঁতাতকে শক্তিশালী করতে চিন সরকার আজ যথেষ্ট তৎপর। অর্থনৈতিক দিক থেকেও আফগানিস্তান চিনের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারন মধ্য এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে, বিশেষত নিউ সিল্ক রোড বেল্টের মাধ্যমে ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের সাথে চিনের যোগাযোগ স্থাপনে আফগানিস্তানকে তারা একটা সেতু হিসেবে কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর।ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের খনি বিভাগে চিন বিনিয়োগ শুরু করেছে। যেমন, ২০০৭ সালে চিনের মেটালার্জিকাল কর্পোরেশন (Metallurgical Corporation of China) ৩০ বছরের পাট্টা নিয়ে আফগানিস্তানের মেস আয়াঙ্কের তামার খনিতে ৩ বিলিয়ন ডলার-র বিনিয়োগ সম্পন্ন করেছে। মিডিল ইস্ট ইন্সটিটিউট-র গবেষক মিশেল ত্যাচামের ভাষায় : “if the Taliban can provide China stable operating conditions, then the copper operations alone potentially could produce tens of billions of dollars of revenue, spurring the development of lithium and cobalt mining operations in the country.”[১১] তাছাড়া আফগান জমিতে চিনের এই বিপুল বিনিয়োগ ও পরিকাঠামো উন্নয়নের পিছনে পাকিস্তানের স্বার্থও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ত্যাচামের বক্তব্যে সেটাও উঠে আসে: “Pakistan has a vested interest as the materials could potentially be transported along the commercial transit route from Pakistan to China.”[১২] সুতরাং, আফগান মাটিতে পাকিস্তান-চিন-এর যৌথ স্বার্থ ও এই স্থানে তাদের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ ভবিষ্যতে ভারতকে যে বিচলিত করবে তা বলাবাহুল্য।

উপসংহার:

আলোচনার শেষাংশে এসে যে বিষয়টিকে স্বীকার করে নিতে হয় তা হল এই যে তালিবান নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তিত আফগান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছু পরিবর্তনের অনুঘটক রুপে কাজ করবে এবং এই আবহের সাথে খাপ খাইয়েই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই ভারতবর্ষও তার বৈদেশিক নীতি নিরূপণে কিছুটা পরিবর্তন আনতে চলেছে। অর্থাৎ তালিবান সরকারের ভবিষ্যতের কার্যপন্থা ও গতিবিধিকে মাথায় রেখেই ভারত যে কার্যত ‘বাস্তববাদী’ নীতি নির্ধারণকেই গুরুত্ব দেবে তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। তবে আফগান নীতি প্রসঙ্গে আমেরিকার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং তার ফলস্বরূপ অন্য শক্তিগুলির সাথে মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণের অপারগতায় ভারতকে যে তার কৌশলগত বিচক্ষণতার অভাবের মাশুল দিতে হচ্ছে তা অনুমান করা যেতে পারে। যদিও ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মতে “taking risks is inherent to the realization of ambitions.”[১৩] তবে এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে ‘মনেরো তত্ত্ব’ (Monroe Doctrine)-কে অনুধাবন করে ভারতবর্ষ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শক্তি হতে চেয়েছিল তা যেআফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর অনেকাংশেই ধাক্কা খাবে তা বলাই যায়। আফগানিস্তানে নিজ প্রভাব জারি রাখতে আমেরিকার পাশাপাশি রাশিয়া বা ইরানের মত দেশগুলির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য কোন বিশেষ কার্যকারী পদক্ষেপ ভারত সরকার নেয়নি। স্ট্র্যাটেজিক জোটের ভিত্তিতে আমেরিকার সাথে ভারতের সখ্যতা যত বেশি গভীর হয়েছে, রাশিয়া ঠিক ততটাই পাকিস্তানমুখী হয়ে পড়ছে। মস্কো ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক শুখোই (sukhoi) ৩৫ ফাইটার ও এম আই (mi) ৩৫ অ্যাটাক হেলিকপ্টার দিতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে চাবাহার পোর্ট ও দীর্ঘ ২১৮ কিলোমিটার জারাঞ্জ দেরালাম (Zaranj-Delaram) রাস্তা নির্মাণে ইরানের সহায়ক ভূমিকা রয়েছে। তাই ইরানের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের কাছে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে আনা ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা সমর্থিত স্যাংশন (sanction) প্রস্তাবে ভারতের সায় দেওয়াকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। সর্বোপরি, ভারতের ইরান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া বা আই পি আই-র প্রজেক্ট থেকে সরে আসা পাকিস্তানকে ইরান-পাকিস্তান পাইপলাইন প্রোজেক্টের জন্য ঝাঁপাতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। তাদের এই প্রোজেক্টই চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এইরূপ পরিস্থিতিতিতে ভারতের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি হবে পরিস্থিতি সাপেক্ষে বহুপাক্ষিক স্তরে অন্যান্য শক্তিগুলির সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন এবং অবস্থা বুঝে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ। যেমন ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে স্থায়িত্ব, মানবাধিকার রক্ষা এবং সন্ত্রাস দমনে ব্রিক্স (BRICS)-র প্লাটফর্মকে কাজে লাগাতে মোদি সরকার বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। তাছাড়া তালিবান সরকারের প্রতি কিছুটা সুর নরম করেই ভারত সরকার তালিবানদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্টেক হোল্ডার-এর সাথে আলোচনার পথ খোলা রেখেই যাতে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের মাটি সন্ত্রাসবাদী কাজে ব্যাবহৃত না হয় তা সুনিশ্চিতকরণে ভারতের কূটনৈতিক মহলের তৎপরতা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। তবে তালিবান সরকার অধিনস্ত আফগানিস্তান রাজনৈতিকভাবে ঠিক কি পদক্ষেপ নিতে চলেছে তা কিছুটা বুঝে নিতেই ভারত সরকার আপাতত তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণকে কিছুটা বিলম্বিত করতে চায়। তবে যেটা বোঝা গেলো ভবিষ্যতে ভারতের উত্থান যাতে বিশ্ব রাজনীতির প্রাঙ্গণে স্তব্ধ না হয় এবং আফগান সমস্যার মত অন্য সমস্যাগুলিকে আন্তর্জাতিক স্তরে যাতে দক্ষতার সাথে সামলানো যায়, তার জন্য ভারতের কাছে এই মুহূর্তে সবথেকে বেশি প্রয়োজন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে আরও বেশি সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান স্থাপন এবং আঞ্চলিক বহুপাক্ষিক স্তরে কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রেখে ক্ষমতার ভারসাম্যকে সুস্থিত করা, এমনই ধারণা দ্বিধাহীনভাবে পোষণ করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা। এই পটভূমিতে ভারতের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ন্যাশানালিস্ট কংগ্রেস পার্টি প্রেসিডেন্ট শরদ পাওয়ারের বক্তব্যটি তুলে ধরা বিশেষ প্রয়োজন : “will have to take precautions in the long run…There was a time when, except for Pakistan and China, our relations with all other neighbours were good. It is time to review our foreign policy concerning other countries. The situation is not good. But it is a sensitive issue”.[১৪]

তথ্যসূত্রঃ
১. Mackinder, H. J. (1942), Democratic Ideals and Reality: A Study in the Politics of Reconstruction, London: Constable Publishers, p. 106
২. ‘Treaty of Friendship: Treaty of Friendship between the Government of India and the Royal Government of Afghanistan’ (January 4, 1950), Ministry of External Affairs, Governmnet of India, Retrieved from https://mea.gov.in/bilateral-documents.htm?dtl/6584/Treaty+of+Friendship
৩. Verma, R. (2020), ‘The US-Taliban peace deal and India’s strategic options’, Australian Journal of International Affairs, (75)1: 1, Retrieved from https://doi.org/10.1080/10357718.2020.1769551
৪. Thompson, F. (September 10, 2021) ‘MI5 boss issues terror warning over Afghanistan’, Evening Standard, Retrieved from https://www.standard.co.uk/news/uk/mi5-afghanistan-islamic-state-government-taliban-b954660.html
৫. ‘Joint Declaration between the Islamic Republic of Afghanistan and United Sates of America for Bringing Peace to Afghanistan’, State Ministry of Peace, Afghanistan, Retrieved from https://smp.gov.af/en/joint-declaration-between-islamic-republic-afghanistan-and-united-states-america-bringing-peace
৬. Kaura, V. (2017), ‘India-Afghanistan Relations in the Modi-Ghani Era’.Indian Journal of Asian Affairs (30)1/2: 33, Retrieved from http://www.jstor.org/stable/26465815
৭. Laskar, R. H. (August 31, 2021), “‘Afghan territory not to be used to threaten or attack any country’: UNSC”, Hindustan Times, Retrieved from https://www.hindustantimes.com/world-news/afghan-territory-not-to-be-used-to-threaten-or-attack-any-country-unsc-101630429738311.html
৮. Khan, I. A. (2007), ‘Understanding Pakistan’s Pro-Taliban Afghan Policy’. Pakistan’s Foreign Policy Analysis, 60(2): 155, Retrieved from http://www.jstor.org/stable/41500068
৯. Arni, A. &Tondon, A. (June 2, 2014), “The Genesis of Pakistan’s “Strategic Depth” in Afghnaistan.” The Observer, Retrieved from https://www.fairobserver.com/region/central_south_asia/the-genesis-of-pakistans-strategic-depth-in-afghanistan-88910/
১০. তদেব।
১১. ‘Taliban to reap $ 1 trillion worth of Afghanistan’s mineral wealth’ (August 19, 2021), Frontline, Retrieved from https://frontline.thehindu.com/dispatches/taliban-to-reap-1-trillion-worth-of-afghanistans-mineral-wealth/article35992556.ece
১২. তদেব।
১৩. ‘External Affairs Minister’s Speech at the 4th Ramnath Goenka Lecture, 2019’ (November 14, 2019), Ministry of External Affairs, Government of India. Retrieved from https://mea.gov.in/SpeechesStatements.htm?dtl/32038/External_Affairs_Ministers_speech_at_the_4th_Ramnath_Goenka_Lecture_2019
১৪. ‘Need to review foreign policy regarding neighbouring nations: Pawar on Afghanistan crisis’ (August 16, 2021), The Week. Retrieved from https://www.theweek.in/news/india/2021/08/16/need-to-review-foreign-policy-regarding-neighbouring-nations-pawar-on-afghanistan-crisis.html

[লেখক – যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অধিনস্ত ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস এ ‘Senior Research State Fellow’ রূপে গবেষণারত। পি.এইচ.ডি গবেষক তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক সেমিনারে অংশগ্রহন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন বই এবং একাডেমিক জার্নাল-এ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ পাঠ ও প্রকাশ করেছেন। বিশেষত, ক্রীড়া সংস্কৃতি ও রাজনীতি প্রসঙ্গে তার গভীর বিশ্লেষণাত্মক রচনা এবং মূল্যবান তথ্যাবলী একাডেমিক জগতকে একান্তভাবে সমৃদ্ধ করেছে।]

Facebook Comments

Leave a Reply